ধরণীর ধূলি হোক চন্দন!

ধরণীর ধূলি হোক চন্দন!

যারা ঘোলাটে আলোয় একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসে নিজেদের চাষ করা আলুগুলো খায়, নোংরা আঙুল ডুবিয়ে স্যাঁতসেঁতে ঘরে.........ওই অন্ধকার আমি আঁকবো, ওই দারিদ্র আমি আঁকবো, আঁকবোই! (ভ্যান গগের জীবনালম্বনে ‘স্বপ্নসন্ধানী’ প্রযোজিত ‘তারায় তারায়’ নাটকের একটি সংলাপ)

ইংরেজিতে বলে ‘ইনভার্টেড পিরামিড!’ ইতিহাস ঝাঁকুনি দেয় মাটির হিম হিম অন্ধকার অতলে। আর পিরামিডের চূড়া নেমে আসে মৃন্ময়ী ধরাতলে, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ। মানুষ এভাবেই পৃথিবীর আশ্চর্য অমরায় বিকশিত হয়। তবে কেন আমরা বিস্মৃত হই সেই উল্টোপথ। অথচ এখনও তো কেউ কেউ অন্যরকম হয়। সত্যিকারের শিল্পীরা হাঁটেন স্রোতের বেহিসেবি বিপ্রতীপে। ভাটার গা ছাড়া ভাসান নয়, সাহসী সাঁতার ‘উজান গাং বাইয়া!’
এরকম একটা কথা বলেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাঁর আত্মজীবনীতে, বইটার নামও তাই! গানের প্রকরণ, গীতির বিবৃতি বা বিন্যাস, স্বরলিপির সুরধুনী বা স্লোগান, শিল্পের রাজনীতি বা রাজনীতির শিল্প, সঙ্গীতের উচ্চারণ বা সরগম, এরকম নানা বিষয় নিয়ে তর্ক ছিল সলিল চৌধুরী আর হেমাঙ্গর। তবু যেন মূলস্রোতের বিরুদ্ধে সারিগানের শিল্পসুষমা নিয়ে ওই কথাটা বলার সময় হেমাঙ্গ মনে মনে ভাবতেন সলিলের কথাই। কেন? সবাই তো প্রথমে রুদ্ধঘরের জীর্ণ কপাটের খিল ভাঙে। পায়ের শিকল কাটে, উঠোনে নেমে হাঁটে। অনভ্যস্ত চলনে গ্রাম পেরোয়, শহর ছাড়ায়, রাজধানী ছোঁয়। তারপর তো দেশ দেশান্তর! হাতের মুঠোয় তবেই না এঁটে যায় তামাম দুনিয়ার মানচিত্র। কিন্তু সলিল একটু অন্য ধরনের। উনি শুরু করলেন বাইরে থেকে।
যে সুদূর নীহারিকা ধরে হাঁটা দিলেন সলিল, তার ঠিকানা ক’জনা জানে! জানে না বলেই তো ‘বড্ড হাঁ করা ছেলে’ অপুর মতো নবীন ডাগর দুই চোখে বিশ্বগ্রাসী খিদে নিয়ে তিনি কান পাতলেন ধরণীর ধূলি ‘পরে। শুনতে পেলেন বিশ্বসুরের অন্তরা আলাপ সঞ্চারী সমাপন। আর তখনই তাঁর মনে পড়ল দেশের মাটির কথা। এত বড় এই পৃথিবীটাকে তাঁর তখন খুব চেনা চেনা লাগছে। সলিল মনে ভাবছেন, কোথায় যেন মিল। সব কেমন একরকম দেখতে। সবার কণ্ঠস্বর যেন অবিকল এক। সব মানুষের অবয়ব যেন হুবহু অবিকল। সলিল তখন বাড়ি ফিরলেন। টোকা মারলেন বন্ধ দুয়ারে। একটা বেআক্কেলে দামাল হাওয়া খোয়ারি ঘুচিয়ে জড়তার দরজা হাট করে খুলে দিল। কে এসেছে দেখো, কোন আগন্তুক!

‘পুরনো আখরগুলি’ নামে একটা বই আছে সুচিত্রা মিত্রের লেখা, যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এ কথা বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই – রবীন্দ্রোত্তর যুগে শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী!’ প্রসঙ্গান্তরে ওই গ্রন্থে সুচিত্রা লিখেছেন, “আমরা প্রথমে প্রাণভরে দেশের গান শুনেছি আগে। তারপরে চোখ কান তৈরি হওয়ার পরে আমরা গানের ভিনদেশে হাত পেতেছি!” সলিল নিয়েছিলেন অজানা অচেনা এক বিরুদ্ধপথ, যেটা এক ধরনের বিদ্রোহ। তিনি চুটিয়ে পাশ্চাত্যের গান শুনলেন কৈশোর থেকে। আর দেশের কথা তাঁর মনে পড়ল কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতার কলেজে পড়তে এসে। তখনই তাঁর মনে হলো, আরে! এই জগতের সব গানেরই তো ভাষা এক, কথা এক, বিকাশ এক। সলিল যখন এই পূর্ব-রাগ পরখ করলেন, তখন তিনি আদ্যোপান্ত দেখে ফেলেছেন গোধূলি গগনের মেঘ। কাজেই সলিলের গান বাঁধাটাই ছিল আসল বিপ্লব। কথার রেভলিউশন, সুরের দীপশিখা তো অনেক পরের কথা। সলিল পুব পশ্চিম মিলিয়ে দিলেন। প্রেম প্রতিবাদ মিশিয়ে দিলেন। যেমন রবি ঠাকুর মিলিয়েছিলেন প্রেম আর পূজা, মিশিয়েছিলেন স্বদেশ আর ঋতু! সাধে কি আর পণ্ডিতরা বলেন যে, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গানের অভিমুখ বদলে দিয়েছিলেন সলিল!
আমরা বরং একটু পর্দা সরাই। মঞ্চের পিছনে সাজঘরের নীল আলোয় দুই চোখ ভরে দেখি সলিলকে। কিছু তথ্য নেওয়া যাক সমীরকুমার গুপ্তের ‘সলিল চৌধুরীজ ফার্স্ট লাইফ অ্যান্ড মাস সংস’ বই থেকে। সলিল জন্মেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার গাজিপুর গাঁয়ে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতি তখনও টালমাটাল। সমান্তরালে ডমকে চমকে পৃথিবীর চোখে তাক লাগিয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন। অপর গোলার্ধে শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হাঁটতে শুরু করেছে নয়া জমানার দিকে। দুধের শিশু সলিলের অতশত জানা বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। হদ্দ গ্রামের নিরাপদ নিরালায় বড় হতে হতে সলিল তখন গাছেদের পাতার নূপুর শুনছেন, নদীর ছলাৎ ছলাতে কান পাতছেন। শুনছেন পাখিদের শিস, পৃথিবীর আদিমতম সুর। কান পাতছেন রাতের ঝিঁঝিঁপোকার কনসার্টে। সুর কি আর এমনি এমনি এসেছিল সলিলের জীবনে!

যদিও সলিলের গাজিপুরের জীবন টেকেনি বেশিদিন। তাঁর বাবা ডাঃ জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী চাকরি নিলেন অসমের কাজিরাঙায়। ব্রহ্মপুত্রের বয়ে যাওয়ার সুর শোনা যায় যে হাতিকুলি চা বাগান থেকে। নিজের চেনা পাড়া, জানা রাস্তার বাইরে সেই শুরু হলো সলিলের ঘরছাড়া বাইরের জীবন। ১৯৩১ সাল, সলিলের বয়স তখন সবে ছয়। সেই চা বাগানও অবশ্য গাজিপুরের মতোই। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। নিবিড় বনস্পতির ছায়ায় সে এক কৃপণ আলোর অন্তঃপুর। মানুষের কোলাহল নেই। শুধু যত রাজ্যের পাখিদের ক্যাকোফোনি। ‘সলিল বুঝি সা রে গা মা পা ধা নি শিখেছিলেন পাখিদের ওই পাঠশালাতেই। মানুষের মাস্টারিতে তো আর সলিলকে তৈরি করা যায় না। তারজন্য চাই প্রকৃতির ক্লাসরুম!’এমনটাই লিখেছেন ভিস্তার আরদেসির বালসারা, তাঁর আত্মজীবনী ‘জেগে থাকি সপ্তসুরে’ বইয়ে। নিশ্চিতভাবেই নির্ভুল ছিল বালসারার জরিপ। তবে সেখানেই শেষ নয়। ওই সময়ই সলিলের জীবনে এসেছিল কাঁটাতার পেরনো সুরের অনন্য ‘ইনফিউশন!’

জ্ঞানেন ডাক্তারের ছিল নাটকের নেশা। তাতে শহুরে তত্ত্ববুলির প্রসাধন ছিল না। তিনি বলতেন, “শোনো বাপু, নাটকই করো বা গানই করো বা সিনেমাই করো, মানুষের কথা বলতেই হবে। মানুষ যেভাবে কথা বলে, সেভাবেই বলতে হবে!” এই কথাটা কেন কীভাবে কখন এক বালকের মনে ধরেছিল কে জানে! সদ্য কৈশোরেই তিনি মানুষের সুর পেয়ে গেলেন, আর তাতে ভর করে মনে মনে মানুষের মতো করেই সহজ সরল কথা কইলেন। ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’-এর জর্জ বিশ্বাস যথার্থেই বলতেন যে, “ওরা দল বাইন্ধা রবিবাবুর গানেরে রুদ্ধ করছিল। সলিলেরে পারে নাই!” কারণ সলিল যেমন খুশি কথা লিখেছিল। মন যা চায়, তেমন করে সে সবে সুর লাগিয়েছিল। ওই সব কথা আর সুর তো আগে ছিলই। কিন্তু কেউ টেরই পায়নি। সলিল সে সবই শোনালো সব্বাইকে। পর্দার গান কিংবা পথসভার গান কিংবা প্রেমের গানে তাই সেই সলিলই এক ও অভিন্ন।
শুনলে খানিক অবাক লাগতেই পারে, কিন্তু সত্যটা হলো, জ্ঞানেন ডাক্তারবাবু নাটক করাতেন চা বাগানের কুলি কামিনদের দিয়ে। শ্রমিকদের বেড়ার ক্লাবঘরে হ্যারিকেনের আলোয় হতো নাটকের মহড়া। সলিলের হাজিরা ছিল সেখানে বাঁধা। তিনি মন দিয়ে দেখতেন, মানুষ কিভাবে চলেফেরে। কান পেতে শুনতেন, মানুষ কীভাবে কথা বলে। আর আশ্চর্য, ওই গদ্যমার্কা নাটুকে সংলাপের সাথে পা নাচাতেন সলিল। হাতে হাতে তালি বাজাতেন নিঃশব্দে। কখনও সখনও মাথা দোলাতেন। আচ্ছা, ওই সব হাল্কারকম সোজাসাপটা পার্টের কথার মধ্যে কিশোর সলিল কীভাবে সুর খুঁজে পেতেন? মুখ্যুসুখ্যু বুভুক্ষু মানুষের অশীলিত উচ্চারণে কী এমন তাল পেতেন সলিল? কোন ছন্দ, কোন লয়! মানুষের কথাবার্তাও কি তবে আদ্যিকালের কোনো বাজনার মতো? বাদ্যযন্ত্র শুনেই কি মানুষ প্রথম কথা বলতে শিখেছিল? তাহলে তো গান তৈরি করা কঠিন কিছু নয়! শুধু সরল সোজা কথা কও, আর তাতে সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত সুর লাগাও। এমনটি যেমন ভাবা, তখনই তৈরি হয়ে গেলেন আদিঅন্তহীন অবিনশ্বর সলিল!
আরেকজন অবশ্য ছিলেন। নীরবে, কাউকে কিচ্ছুটি না বলে। চা বাগানের বাবুলোক বটে, কিন্তু তিনি নিয়মিত আসতেন বস্তির লোকেদের নাটকের রিহারস্যালে। তিনি তো ছাই ভাষাটাও বুঝতেন না। তবে তিনি কী পেতেন হাড় হাভাতেদের ন্যাড়ান্যাংটা বলনে? বাজনা? হবেও বা। হয়ত সেজন্যই তিনি নজর করতে পেরেছিলেন যে, একটি কিশোর ছেলে নাটক শুনতে শুনতে পায়ে পায়ে ঝুমুর বাজাচ্ছে! হাতে হাতে তুড়ি! এ ছেলের মধ্যে একটা আপনমনের সুর আছে, আছে একটা বাজনার বীন! সেই বাবুটি হলেন জ্ঞানেন ডাক্তারের ‘বস’, চা বাগানের চিফ মেডিকেল অফিসার ডাঃ ডেভিড ম্যালনি। জাতে আইরিশ। তিনি নিজেকে কখনও ডাক্তার বলতেন না। বলতেন, আমি ‘রেনেসাঁর কর্মচারী!’ তাঁর গৃহকোণে ডাক্তারির যন্ত্রপাতির চেয়েও বেশি সযত্নে শোভা পেতো গ্রামোফোন। আর পশ্চিমের যাবতীয় গানবাজনার লংপ্লেয়িং রেকর্ড! এক সন্ধ্যায় শ্রমিক বস্তির সেই আলোছায়া মহড়াকক্ষ থেকে বেরনোর সময় সলিলকে কাছে ডেকে ম্যালনি বললেন, “একটা ছুটির দিনের সকালে বাবার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলে এসো। দেখি, তুমি কত গান শুনতে পারো!”

অবশেষে সেই দু’টি পাতা একটি কুড়ির বাগিচায়, এক আটটা ন’টার সূর্যের সকালে সলিলের সামনে খুলে গেল গানের ভুবনের হাজারদুয়ার। গান তাঁকে টেনে নিয়ে গেলো আপনঘরের বারান্দা থেকে বিশ্বঘরের আঙিনায়। ম্যালনির বাড়িতে বসে সলিল একে একে শুনতে লাগলেন মোৎজার্ট, বিঠোফেন, চপিন, তাচিকোভস্কি, বব অ্যাচার, বব উইলস, বনি ব্লু, এডই আর্নল্ড, জিন আট্রি, হ্যাঙ্ক উইলিয়ামস, জনি বন্ড, আর্নেস্ট ট্যাবকাউবয় কোপাস, রয় রজার্স! এরপর গানে গানে পথ চলা শুরু হয়ে গেল সলিলের। ওই সব গানবাজনা শুনে তাঁর কেবলই মনে হতে থাকল, সব কেমন যেন আগেই শোনা! কোথায় যেন মিল! কী গান, কাহার গান, কী সুর, কী ভাব তার! চা বাগানের সরীসৃপের মতো রাস্তায় ধূলি ধূসরিত পথে হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে সুর ভাজতেন সলিল। আর চুপিসারে কোথায় যেন মিশে যেত সারি, জারি, বিহু, বাউল, ভাটিয়ালি ঝুমুর কিংবা ধানকাটার গান অথবা ছাদপেটানোর বাজনা। এবং অবশ্যই ঢুকে যেতেন সাত রাজার ধন মানিক রবীন্দ্রনাথ!

বিদেশি গান বাজনার সমঝদারির সঙ্গে সঙ্গে ‘গুরু’ ম্যালনির কাছ থেকে সলিল শিক্ষা নিলেন পিয়ানো এবং ভায়োলিন। সেই সুরচারণার আবেশেই পরে সলিল ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলেন হারমোনিয়াম, বাঁশি এবং এসরাজে। ওই যে, ‘ইনভার্টেড পিরামিড’, বাইরে আগে, পরে ঘরে। চা বাগানের সেই নবীনকিশোর সলিলের মনের কথা বর্ণনা করতে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সেই অবিনাশি গদ্য ঋণ করা যেতে পারে। ‘আমি বদলে যাচ্ছিলাম অথবা গিয়েছিলাম। শহরের সমস্ত কথা পায়ের তলায় মাড়িয়ে ততদিনে আমার চলার গতি কমেছে। লাগামছাড়া ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়েছি, চলে গেছে পেছনে। আমি পায়ে হাঁটছি। নিজের পায়ে হাঁটার মধ্যে আবিষ্কার করছি আনন্দ!’এরকম বাইরে হাঁটাচলার দিনগুলিতে, সলিল তখন হাইস্কুলের প্রায় শেষদিকে, একদিন ঘনঘোর বৃষ্টি নামল। এমনতর বরষায় শব্দ হয় না কোনো। কেমন যেন নীরব ধারাপাত, অশ্রুর মতো। আর এমন দিনেই শুধু সলিল কেন, আপামার বাঙালির মাথার ওপর থেকে একটা ছাতা সরে গেলো। বাইশে শ্রাবণ। জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে চলে গেলেন রবি ঠাকুর। সলিল অবশ্য সেই গানের ওপারে সকাতরে সমাপন করলেন না। বরং সেই ‘কী আছে পথের শেষে’তে সলিল বাবার লাইব্রেরি থেকে একটা বই টেনে নিলেন, ছিন্নপত্র।
‘ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালবাসি। ওর এই গাছপালা নদীমাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন-কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম?’ নিজঘরের এই যোগী কবির বিশ্বদীক্ষায় সলিলের স্বরলিপিতে কোরাসের মতো মিলতে শুরু করল পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ, কোলাজের মতো মিশতে শুরু করল প্রেম প্রতিবাদ লোককথা আর পল্লীপ্রাণ। গানেরও মন্তাজ হয় বৈকি! যেমন হয়েছে রবীন্দ্রনাথে। বাঁধ ভেঙে যাবতীয় বদ্বীপ ভাসিয়ে একাকার হয়ে গেছে প্রেম পূজা প্রকৃতি স্বদেশ এবং বিচিত্র। রবি ঠাকুরে মোহাতুর বাঙালি মোহনার দিকে আরও একটা অনাবিল রাস্তা খুঁজে পেলো। নতুন একটা সরণি। অভিনব এক সড়ক। যত দূরেই হোক মোহনা, সলিল বললেন, “এখানে থেমো না!”

সলিল নিজেও থামলেন না। কলেজে পড়তে শহরে এলেন তিনি। শহর কোথায়! মহানগর। কত মানুষ, কত কলরব, কত গাড়িঘোড়া। রাস্তার এপারে কত জমক, কত জেল্লা, কত সম্ভোগ। আর ওপারেই কুঁড়েঘর, কঙ্কালসার শিশু, কত মর্মান্তিক মরণ। শহরের সুবিধা এটাই, একালের ভাষায় ‘কম্বো অফার!’ প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মানুষে, প্রতিটি তল্লাটে, প্রতিটি কথায় শত সহস্র আরব্য রজনীর গল্প, ঠাকুমার ঝুলির ছবি, হোমারের জাগ্রত পদ্য। টিনের বায়স্কোপের বাক্সের জানালায় চোখ লাগিয়ে, দেখো দেখো খেলা দেখো রে! সবাই তো তাই-ই করে। কিন্তু সলিলের টিকিট কাটা অনেক দূরে। তিনি অন্য গাড়িতে চেপে বসলেন। বসবেনই তো। উঁচু করা মাথার ভিতরে দেশ দেশান্তরের গানবাজনা থাকলে, সারা শরীরে রবীন্দ্রনাথ থাকলে, বুকের ভিতরে বস্তির বারো ঘর এক উঠোনে বাবার নাটক থাকলে, কেউ চেনা রাস্তায় যেতে পারে না। অচিনপথের পরিব্রাজক তখন নিজেই রাস্তা বানায়, নিজেই পথে নামে আর সবাইকে ডেকে নেয়। সবাই শুনতে পায়, পৃথিবী আমারে চায়। রেখো না বেঁধে আমায়।

সলিলের সেই সময়টা ভাবা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভ্রান্ত বসুন্ধরা। ভারত জুড়ে স্বদেশি আন্দোলন, মন্বন্তর, খরায় শুকিয়ে যাওয়া কৃষিজমি, বন্যায় ভেসে যাওয়া কল কারখানা। তেভাগা বিদ্রোহে নেমে পড়েছেন কৃষকভাইরা। দুর্ভিক্ষ উজিয়ে শুরু হলো দুর্দমনীয় শ্রমিক বিপ্লব। তেলেঙ্গনা, বুকে আছে হিম্মত, পেটে নেই দানা। এমনি অশান্ত নৈরাজ্যের সময়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন সুভাষ বোস। এরইমধ্যে ঝুটা স্বাধীনতা এলো। বিনিময়ে দেশভাগ হয়ে গেলো। তিন টুকরো দেশ নতুন একটা জনগোষ্ঠীর জন্ম দিলো, উদ্বাস্তু। কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা ছেয়ে গেলো নিরন্ন গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষে। সলিল মিশে গেলেন মানুষের মধ্যে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে তখন নবজাগরণের পালা। সবচেয়ে সক্রিয় তাদের সাংস্কৃতিক শাখা, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ (আই পি টি এ)। সলিল যেন চাঁদ হাতে পেলেন। ‘চাঁদের শতক আজ নহে তো, এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’। গান, নাটক, গদ্য, পদ্য প্রবন্ধ নিয়ে সলিল শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সলিল বুঝে গেলেন, সুরে আর কথায় গানের অভিমুখ বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। গানে চিরকালীন চাঁদ ফুল তারা থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে ভালবাসা আর প্রত্যাখ্যান, দরদ আর দ্রোহ!
এই যে যুগপৎ কঠিন ও কোমল, সলিল এটা পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। জ্ঞানেন ডাক্তার যেমন ছিলেন দরদি, তেমনই নিঠুর। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আলোর পথযাত্রী’ নিবন্ধে আছে, চা বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজার একবার জ্ঞানেনবাবুকে ‘কাম হিয়ার ডার্টি নিগার’ বলে ডেকেছিলেন। জবাবে এক ঘুষি মেরে ওই লালমুখো গোরা সাহেবের তিনটা দাঁত ফেলে দিয়েছিলেন ‘জনপ্রিয়’ ডাক্তারবাবু। আর তারপর এক কাপড়ে সপরিবারে চা বাগানের কোয়ার্টার্স ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সব ফেলে রেখে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন শুধু সেই ‘চোঙা দেওয়া কুকুর মার্কা কলের গান আর কিছু পশ্চিমি বাজনার রেকর্ড!’ ওই ‘গানপাগলা’ ডাক্তার ছিলেন স্যুটেড বুটেড পাক্কা সাহেবসুবো। কিন্তু গান্ধিজি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলে উনি নিজের সব পশ্চিমি জামা প্যান্ট কোট নিজের হাতে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলিল বলতেন, ‘এই আমিটা বাবা নামে একটা গাছের ফল!’

বাবার এমন রাগ আর অনুরাগের একনিষ্ঠ অনুগত সলিল জীবনে কোনোদিন কোনো কিছুকে একমাত্রায় দেখেননি, দেখেছেন দুই দিক থেকে। ‘একজন সলিল’ নিবন্ধে কঙ্কণ ভট্টাচার্য লিখছেন, শিল্প সাহিত্য সমাজ রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই সলিলের দেখাটা ছিল উভয়মুখি, এপার ও ওপার থেকে। সেই সূত্র ধরেই তিনি নিজের গানজীবনে সার্বিক ও সামগ্রিক ভাবে মেলাতে পেরেছিলেন আমজনতা আর কমরেডকে, রোমান্স আর রেভলিউশনকে, গ্রাম এবং শহরকে। তা নিয়ে ঘরে বাইরে, পার্টির ভিতরে এবং বন্ধুপ্রকাশ্যে বিস্তর লড়াই করতে হয়েছে সলিলকে। তিনি একদিন গণসঙ্গীত বানিয়েছেন, তো পরেরদিন বানিয়েছেন সিনেমার গান। একবার তিনি আধুনিক গান বেঁধেছেন, আর পরেরবার রচনা করেছেন পুরাণের গীতি। কারণ নিজের বাবাকে ছাড়াও সলিল সঙ্গে পেয়েছিলেন আরেকজনকে। রবীন্দ্রনাথ!

আমাদের দেশের বর্তমান কালের জীবন কেবল গ্রাম্য নয়। তার ওপরেও আর একটা বৃহৎ লোকস্তর জমিয়া উঠিতেছে যার সঙ্গে বিশ্ব পৃথিবীর যোগ ঘটিল। এখন আমরা দুই যুগের সন্ধিস্থলে। আমাদের জীবনের গতি যেদিকে জীবনের নীতি সম্পূর্ণ সেদিকের মত হয় নাই। দুটিতে ঠোকাঠুকি চলিতেছে। যেটা সচল তারই জিৎ হইবে!

সলিল এই বাধাহীন সচলতাকে বেছে নিয়েছিলেন। পার্টির রেজিমেন্টেশন বা প্রডাকশন হাউসের রেস্ট্রিকশনের শিকল পরেননি সলিল, অথচ দুই ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সফল হয়েছেন। সলিল গানে গানে বলে গেছেন, মানুষকে জড়ো করতে হবে। তাই মানুষ যা চায় সেটাই করতে হবে। তা সে সিনেমায়ই হোক কিংবা সমাজেই হোক। কল্পনায়ই হোক অথবা বাস্তবে! রাজনীতিতে হোক বা রোমান্সে।
ওই যে রবীন্দ্রনাথ যুগসন্ধির কথা বললেন, সেটাই আসল সলিল। তিনি নিজেই একটা সেতু। তিনি ছিলেন বলেই মানুষের মৃত্যুহীন পারাপার শুরু হল। পথ হারানোর উপায়ই থাকল না। সলিল রইলেন ‘যত মত তত পথ’র পথফলক হয়ে, যা পথও দেখায়, আবার সেই পথে আলোও ফেলে। সলিলের জীবন ও কাজে বাঁধা পড়লো ইতিহাস, দেশভূমি আর মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম। এতদিনের মরচে ধরা একটা শৃঙ্খল ছিঁড়ে সলিল নতুন একটা শৃঙ্খলা নির্মাণ করলেন। সুয়োরানির গলায় তা যেমন মণিহার, দুয়োরানির কণ্ঠে তা-ই যেন বজ্রমালা। সলিলের সমীকরণ যদি এমনটা হয়, ইতিহাসের সালতামামি হল, সর্বকালের শাসকরাই সর্বদা শিকল পরাতেই পছন্দ করে। আর শাসন করে তাদের, যারা শিকল খোলার কথা বলে। কাজেই সলিলের ক্ষেত্রেও অনুশাসনই জুটল। কমিউনিস্ট পার্টিবাজি আর শিল্পের দোহাই দিয়ে বিপ্লবীগিরির দায়ে সলিলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে দিলো ব্রিটিশ পুলিস। এই হুলিয়া থেকে বাঁচতে অজ্ঞাতবাস ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না সলিলের সামনে। আর সেটাই যেন শাপে বর হল, সেই অরাজক সময়ের সমীপে!
এটাই চাইছিলেন সলিল চৌধুরী। সসাগরা ধরিত্রীর সঙ্গীতসরণি পায়ে হেঁটে পেরিয়ে বাহিরপানের সলিল এবার ফিরলেন নিজ নিকেতনে। জননী জন্মভূমি। গাজিপুর গ্রাম। অনেকদিনের পর, যেন পথের পাঁচালির অপুর নিশ্চিন্দপুরে ফেরা। শহরের সেই ধীমান সাংস্কৃতিক কর্মী অবলীলায় মিশে গেলেন খোলা আকাশের ঘরে, মাটির সুখপালঙ্কে। সলিল বলতেন, ‘এটা আমার আত্মগোপন নয়, বরং আত্মমিলন!’নিকোনো উঠোনে আল্পনার মতো কোনো এক গাঁয়ের বধূর লক্ষ্মীপায়ের ছাপ। দাওয়া পেরিয়ে হাকিম শেখের ধানগোলা। একটু দূরেই রামা কৈবর্তের কামারশালা। ক্ষেতজমি ভরে উঠেছে রবিশস্যে। যেন কোন সুরে বাঁধা প্রকৃতির খেয়ালখুশির গান। ‘আলো ফুটছে, কারা টুটছে!’একজন মুক্ত স্বাধীন সলিল পিয়ালি নদীতীরে গিয়ে বসলেন। মাথা ঠেকালেন মাটির ‘পরে। সলিলের কপালে জয়তিলকের মতো লেগে রইল বাদামি রংয়ের মৃত্তিকা।

‘ধরণীর ধূলি হোক চন্দন’!

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির স্নাতকোত্তর, যদিও স্নাতকস্তরে তিনি বিজ্ঞানে সাম্মানিক। কলকাতায় সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন। ছাত্র রাজনীতি করেছেন, সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেছেন গ্ৰুপ থিয়েটার আর লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে। নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন বেতার ও দূরদর্শনে। এখন কর্মসূত্রে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী। নিয়ম করে লেখেন কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রে। এ পর্যন্ত আটটি বই প্রকাশিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *