“….শান্ত, সমাহিত, বোবা কান্নার মত কিছু বেদনা” -সলিল চৌধুরীর গানে এক একাকী, বিষণ্ণ কবিসত্তার প্রকাশ
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গীত শাখাকে যাঁরা একদা ফুলে ফলে পল্লবিত করে তুলেছিলেন নবজীবনের গানে, তাঁদের মধ্যে তরুণতম সদস্য ছিলেন সলিল চৌধুরী। তরুণতম হলেও, একথা অনস্বীকার্য যে জীবন চেতনার উত্তাপে, ভাষার বলিষ্ঠতা ও নবত্ত্বে এবং সর্বোপরি সুরের স্বাতন্ত্র্যে সলিল তার গণসঙ্গীতের মাধ্যমে যে ভাবে লক্ষ লক্ষ বাঙালির হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, অন্য কোনো সঙ্গীত স্রষ্টাই বোধহয় তেমনটা হননি। স্বদেশের প্রতি মমতায়, অন্যায়ের প্রতি ঘৃণায় আর গণসংগ্রামের চেতনায় একদা আপামর বাঙালি উদ্বোধিত হয়েছিল তাঁর গানে।
এর প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ আমরা দেখি শিল্পী জীবনের উত্থান পর্ব থেকেই সলিলের ‘গণনাট্য সঙ্ঘের সক্রিয় কর্মী’ এবং ‘সার্থক গণসংগীত স্রষ্টা’ হিসেবে এক সুনিশ্চিত চিহ্নিতকরণ। বিশেষতঃ বামপন্থী রাজনৈতিক মতবাদীদের কাছে সলিল চিরকালই ‘গণসংগীতের সলিল চৌধুরী’ হয়েই রয়ে গেলেন। ভিন্ন ধরণের গানে সলিলের সাফল্য বা দক্ষতা এঁরা দেখেও দেখেন না। এর সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শ্রোতাদের- যাদের কাছে সলিল মানে বাংলার অজস্র জনপ্রিয় পুজোর গান, যার সিংহ ভাগই রোমান্টিক বা প্রেমের গান, কিংবা হিন্দি ছায়াছবির গান। বলাই বাহুল্য, স্বল্প সংখ্যক কিছু পরিচিত গণসঙ্গীত ছাড়া সলিলের ব্যাপক সংখ্যক গণসঙ্গীতের সঙ্গে এই শ্রোতা সাধারণের কোনো পরিচয় নেই।
অর্থাৎ, অল্প কথায় বলতে গেলে, উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক – এই দুই সলিল যেন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছেন। এইখানে দাঁড়িয়েই বোধহয় খুব স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই দুই শ্রেণীর মানুষের পল্লবগ্রাহিতা সলিলের কবি প্রতিভার যে দিকটি আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়, তা হল সলিলের গীতিকবিতায় গণসংগ্রামী সলিল কিংবা প্রেমিক সলিলের পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষ সলিলের উপস্থিতি।
কোনো কবি বা গীতিকবিকে কোনো বিশেষ পরিচয়ের গণ্ডীতে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা তার কবি প্রতিভার অবমূল্যায়নের নামান্তর। ‘ইনি সংগ্রামের কবি’ কিংবা ‘উনি সর্বহারার কবি’ কিংবা ‘তিনি রোমান্টিক কবি’ – এই ধরনের তকমা-আঁটা মন্তব্য যে কোনো কবির সামগ্রিক বহু-ব্যাপ্ত কবি প্রতিভাকে অবমূল্যায়িত করে। পৃথিবীর কোনো কবিতাই সার্থক কবিতা রূপে পরিগণিত হয় না যতক্ষণ তা ব্যক্তিমানুষের কথা না বলে। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের অন্যতম শক্তিশালী গীতিকবি সলিলের গীতিকবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। একদিকে রাজনৈতিক চেতনার যাবতীয় গান এবং অন্যদিকে রোমান্টিক গীতিকবিতা – এর পাশাপাশি সলিলের বহু গানেই আমরা খুঁজে পাই এক একাকী জীবন পথিককে – যিনি একাকী কিন্তু নিঃসঙ্গ নন। একাকীত্বের মুহূর্তে নিজেরই ভাষায়, “চেতনার মৌতাতে ঝুম হয়ে” থেকে সলিল জীবনকে উপভোগ করতে জানেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে – নিজের প্রিয় শিষ্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সলিল একদা বলেছিলেন, “Everybody is alone in this world – specially the creative artists. They do not allow others to take entry within their periphery” (গানের গল্প, গল্পের গান)। বস্তুতঃ এ হল পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষেরই মনের কথা। একাকীত্বই প্রকৃত শিল্পের জননী। যে সৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুরণিত হয়না একাকীত্বের অনুভব, তার প্রকাশ যত বলিষ্ঠই হোক না কেন, যথার্থ শিল্প সৃষ্টি হিসেবে তার ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী।
মানব চেতনায় একাকীত্বের অনুভব অনেকাংশেই বেদনাবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সলিলের গীতিকবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু একাকীত্বের মুহূর্তের যে বেদনা বোধ সলিলের সৃষ্টির প্রেরণা তা শুধু ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা বোধে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বব্যাপী দরিদ্র, শোষিত নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার হাহাকার নির্ঘুম যামিনীর একাকীত্বেও তাঁর চেতনাকে আচ্ছন্ন করে:

কেন ঘুম আসে না?
সারারাত জেগে বসে শুনি পৃথিবীর কোলাহল
কত অসহায় শিশু নারীদের আর্তনাদ যেন
ভেঙে ভেঙে খান খান করে বাসনা।।
এ যে কার অপরাধ – এত অশ্রু শোণিত ঝরে
কেন হাসি আর গানে ভরে না ধরা?
সুখ শান্তির মায়া দিয়ে যত ঘর কেন হয় না ভরা?
কেন মিছে হবে মানুষের সাধনা?
বিশ্ব -মানবতার যে বেদনা বোধের অনুরণন সলিলের চেতনায় ঝংকার তোলে তা কিন্তু কেবলমাত্র স্থূল পার্থিব দুঃখ কষ্ট, ক্ষুধা-নিরন্নতার গণ্ডীতেই আবদ্ধ থাকে না। সলিলের মনস্বিতা তার কল্পনায় অনুরণিত করে বিশ্বব্যাপী শত শত সৃজনশীল মানুষের সাধনার অসফলতার, সার্থকতার মোহনায় উপনীত হতে না পারার অব্যক্ত বেদনার গভীরতাও।
ঢেউ লেগেছে মনে বেদনার, কেন তা তো জানিনা
হয়তো কারো সুর সাধনায় ছিঁড়ে গেছে বুঝি বীণা।।
জীবনেরই পান্থশালায় দু দিনেই হাসি খেলায়
শুকালো কত যে মালা, পড়ে আছে অবহেলায়,
হয়তো কোনো নদীর ধারা মরু মাঝে হল লীনা।।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে ফুল না ফুটিতে / ঝরেছে ধরণীতে/ যে নদী মরুপথে হারালো ধারা / জানি হে জানি তা ও হয়নি হারা“।
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চেতনা তাঁকে দিয়েছিল আশাবাদ – নিরাশার ঘন অন্ধকারেও আলোর উপস্থিতির হদিশ। কিন্তু সলিলের বাস্তববাদ তাঁকে সেই সান্ত্বনা দেয় না। ব্যর্থতা সলিলের চোখে তাই ব্যর্থতাই। বিশ্বমানবতার ব্যর্থতায় তাঁর মনে তাই লাগে বেদনার ঢেউ, শিশিরবিন্দুতে তিনি দেখতে পান বঞ্চনার বেদনায় ধরণীর কান্না – “কেউ বোঝে না নিশির শিশিরে ধরা কাঁদে বঞ্চনায় / ঢেউ লেগেছে মনে বেদনার”
একাকীত্বের অবসর মানুষের অতীত জীবন পর্যালোচনার অবসর, জীবনের ব্যাপ্তিতে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলানোর অবসর। সমতুল্য পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র-মানসিকতা কিন্তু সেই হিসাব মিলাতে রাজি নয়, বরং হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে সুখ-দুঃখের অতীত কোনো অনুভবের সুরে বেজে ওঠা বাঁশরীর সুরে মগ্নতাতেই তার প্রশান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু সলিলের বাস্তববাদী অনুভব নিছক দার্শনিকতার গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকে না। আবার সাধারণ মানুষের মতো স্থূল, বস্তুবাদী চাওয়া পাওয়ার হিসেবেও সে ব্যাপৃত নয়। বরং নিজেরই যত অক্ষমতা, নিজেকে সম্পূর্ণ ছড়িয়ে দিতে পাড়ার অপারগতাই উঠে আসে সলিলের জীবন পর্যালোচনায়। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, “চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা”। এই অবহেলার বৌদ্ধিক অহংকারের বিপরীতে সলিলের লেখনীতে ব্যক্ত হয় স্বার্থপরতার গণ্ডীতে নিজেকে আবদ্ধ রেখে কৃপণ সুলভ সঞ্চয় প্রবণতা এবং আত্মদানের অক্ষমতার অনুশোচনা
কুহেলি রাত একা একা
কাটেনা আর দাও দেখা
ভীরু চাঁদনী আজ মেঘে ঢাকা, সুপ্ত বলাকা।
………………..
………………..
হয়তো পারিনি বন্ধন ছিঁড়ে নিজের সব দিতে
কৃপণের মত সঞ্চয় করে নিজের গণ্ডীতে।
আপন শিকলে বন্দীর মত, নিজের ফন্দীতে।
কুহেলি রাত সব নিঝুম
একা একা আসেনা ঘুম
ভাবছি, ভাবনা সব এলোমেলো – কারা এলো গেল,
কত ভালোবাসা, আশা নিরাশা দ্বন্দ্বে দিন গেল।
এখনো সময় হয়নি কি? আর কত বাকি?
বন্ধ দুয়ারে বারবার করাঘাত শোনো না কি?
সে যে গো সাধের স্বপ্ন, ফিরে ফিরে যাবে কি?
আপন অক্ষমতা স্বীকার করে নেবার পরেও কোনো এক অনাগত সাধের স্বপ্নের জন্য এই প্রতীক্ষাই গীতিকবিতাটিকে উত্তরিত করে যথার্থ কবিতার স্তরে।
একাকীত্বের অবসর কখনো কখনো স্মৃতি রোমন্থনের অবকাশ। ঝিম ধরানো কোনো মধ্য দুপুরে ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের দিনগুলির নির্জন সংলাপে কবির অলস অবসরের মুহূর্তগুলি বাঙময় হয়ে ওঠে:
ঝিম ঝিম ঝিম দুপুরে
মনের চুপুর চুপুরে
পাবো কি পাবো না এই ভাবনা-
আমি কি করি কি করি, আমার তৈরী ঘাটের তরী
আমি দ্বন্দ্ব দ্বিধায় দুলে মরি যাব কি যাব না – এই ভাবনা।।
রাঙামাটির পরিপাটির শীতল পাটির গাঁ
নদী বইত, পাখি গাইত, মাঝি বাইত না,
সেই মেঘলা মেঘের ছায়, একদিন শুধালো আমায়, “কি দেব তোমায়?”
হায় পোড়া মন! মনস্থির করতে পারলাম না – এই ভাবনা।।
পুরানো মন, পুরানো ক্ষণ, হারানো সব দিন
ছিল তাথৈ ছন্দে কতই গন্ধে ভরা যে রঙিন!
সেই শ্যামলা শ্যামল গাঁয়, একদিন শুধালো, “কিছু দেবে কি আমায়?”
হায় পোড়া মন! মনস্থির করতে পারলাম না – এই ভাবনা।।
সত্যিই তো! “কত রঙিন সে আমার কামনার সাধনার দিন” যদি আচমকা কোনো অবসরে সামনে এসে দাঁড়ায় আর আমার কাছে কিছু চায় কিংবা আমাকেই কিছু দিতে চায়, কীই বা দিতে পারি তাকে? চাইতেই বা পারি কী! একমাত্র “তুমি আবার ফিরে এস” এইটুকু ছাড়া? কবিও তাই মনস্থির করতে পারেন না। আর তাঁর এই মনের দ্বিধাই গীতিকবিতাটিকে সার্থকতায় উত্তরিত করে।
আত্মসমালোচনা কিংবা জীবন পর্যালোচনার অবকাশের পাশাপাশি একাকীত্বের মুহূর্ত কখনো শুধুই ব্যক্তিগত বিষণ্ণতার (Melancholy) বাহক – যদিও সেই বিষণ্ণতা বহুমুখী এবং বহু ব্যাপ্ত। কখনো সেই বিষণ্ণতা জীবন নদীর বাঁকে ফেলে আসা প্রিয়জনদের বিচ্ছেদ বেদনা:
বড় বিষাদ ভরা রজনী, সজনী
যে গেছে মিলে সুদূর ছায়া মিছিলে
স্মরণ নদীর বাঁকে দাড়ায়ে থাকে
কেন যে, কি জানি!
পিছে পড়ে রয়ে গেল স্বপ্ন রঙিন,
সাথী যারা সাথে ছিল কে কোথা থেমে যে গেল,
পথেরই ধুলা হল সেই সব দিন।
তবু এ জীবন ঘিরে
কেন আসে ফিরে ফিরে
ভাসায় নয়ন-নীরে – কী জানি!
চেয়ে চেয়ে আজ বড় শ্রান্ত আমি
বুঝি নাতো কি যে মানে,
চলেছি কিসেরই টানে
কবে যাব কোন খানে থামি।
কেন এই আসা যাওয়া, কেন এই গান গাওয়া
কেন যে হারানো পাওয়া- কী জানি!
প্রিয়জনদের বিচ্ছেদ বেদনার সঙ্গে এই গীতিকবিতায় মিশ্রিত হয়েছে জীবনের অর্থহীনতার অনুভূতি- আর সব মিলে কবিতাটিকে করে তুলেছে তীব্র হতাশার সুরে সঞ্চারিত।
জীবনের এই অর্থহীনতার অনুভূতি মধ্য বয়সের বোধহয় এক স্বাভাবিক অনুভূতি যা একাকীত্বের মুহূর্তে কম বেশি সকল সংবেদনশীল মানুষকেই গ্রাস করে। সলিলের গানেও বারবার অনুরণিত হয়েছে এই অর্থহীনতার অনুভবের সুর। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে “কিছুই তো হল না/ সেই সব, সেই হাহাকার রব/ ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম/ এখনও তো ভালোবাসি/ তবুও কী নাই”। একই সঙ্গে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা পাওয়া মানব জীবনে খুব দুর্লভ না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে জীবনের সার্থকতার এক অন্যতম চরম নিদর্শন। কিন্তু সংবেদনশীল তথা মননশীল ব্যক্তির উপলব্ধিতে জীবনের সার্থকতার সংজ্ঞা এত সহজ নয়।প্রিয়জনের ভালোবাসা, পার্থিব যত চাওয়া পাওয়া অতিক্রম করে তার শ্রবণে ধ্বনিত হয় কোন সুদূরের, কোন অদেখা বন্ধুর আহ্বান। রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি সলিলের গানে পাই এই অনুভবেরই প্রতিফলন:
যা রে যা, যা ফিরে যা,
জীবন তরণীতে হবে দূরে পাড়ি দিতে
ভাঙা হলে টলোমলো, ছেঁড়া পালে হায়, হায়।।
লাগে না আর ভালো হাসি গান আর আলো
সুরে সুরে কে মোর ডাকে আয়, আয়।।
স্বপন পাখি মোর যা, ফিরে যা
বাঁধিয়া হৃদয়ে তোরে রাখিব না।
বহিয়া যায় বেলা, আজি শেষ করো খেলা
রঙের রসের মেলা মুছে যায়, যায়।।
জীবন পথের এই ক্লান্তির অনুভব আর সেই সঙ্গে পূর্বে উল্লেখিত জীবনের অর্থহীনতার অনুভব বারবার ফিরে আসে সলিলের গানে। স্বাভাবিক ভাবেই, এইসব গানের অধিকাংশই পঞ্চাশোর্ধ বয়সের রচনা। অর্থাৎ সত্তর দশকের শেষার্ধ কিংবা আশির দশকের রচনা। বহু গানের মধ্যে বহুস্তরীয় মিশ্র অনুভবের প্রকাশে ভাস্বর এই গানটির সম্পূর্ণ উদ্ধৃতির প্রলোভন বর্তমান লেখক দমন করতে ব্যর্থ:
যাও, তবে যাও
আর কখনো শুনবে না জানি মোর মানা
শ্রান্ত পাখি আর কোনোদিন
মেলবে না জানি তার ডানা।
সেই যে ফাগুন, এই তো সেদিন
ফুল ফোটানোর সেই খেলা,
কেই বা জানে হায় ফুরাবে
উৎসবেরই সেই বেলা।
এমনি চলে যুগ যুগান্তে
কারো তবু নেই জানা
শ্রান্ত পাখি আর কোনোদিন……
অস্তরাগের এই রাগিণী
আর তো আমি সাধব না,
অশ্রু নদীর তীরে বসে
আর কোনোদিন কাঁদব না।
ওই পথেরই পথিক আমি
এই তো শুধু সান্ত্বনা
একাকীত্বের বিষণ্ণতা মানেই তা সর্বদা জীবনের অর্থহীনতার বোধের সমার্থক – কোনো জীবনমুখী, বাস্তববাদী কবির রচনাই নিয়ত এই অনুভবের ধারক হতে পারে না। সলিলের গানেও তাই এই অনুভব চিরস্থায়ী নয়।আমাদের মনের গভীরে কৈশোর ও প্রথম যৌবনে একান্তে লালিত হয় বহুতর আশা ও স্বপ্ন। যা পরবর্তী জীবনে সংসার, কর্মক্ষেত্র ও আদর্শের প্রতি ত্রিবিধ দায়বদ্ধতার ঝড়ে দ্রুতই সলিল-সমাধি লাভ করে। সলিলেরই গানে পাই, “জীবন বৃন্তের থেকে ঝরে/ কতনা স্বপ্ন গেছে মরে/ তবু এ পথচলা কবে যে শেষ হবে জানিনা”। একাকীত্বের অবসরে মানুষ যখন ফেলে আসা জীবন পথের পর্যালোচনা করে, তখন এই ডুবন্ত স্বপ্নের তরী আগামী জীবনে প্রাণপণে বেয়ে যাবার বেদনা বোধও তার মনে থাকে সদা জাগরূক। সলিলের বহু আত্মমগ্ন গীতিকবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং একই সঙ্গে দুস্তর পারাবারে আশার ক্ষুদ্র তরণী বেয়ে যাবার এক রঙিন স্বপ্ন।
কে যাবি আয় ওরে আমার সাধের নায়
ও সে রাঙা আশার পাল তুলে ঝিকিমিকি যায়
আয়, আয় রে আয়, আয়, আয় রে আয়।।
আকাশ তারই অনুরাগের মেঘে মেঘে রাঙে,
বাতাস তারই আভাসে গায় তরঙ্গেরই গানে
তারই তরে হৃদয় মেলে, নয়ন প্রদীপ জ্বেলে
বধূরা পথ চায়।।
ময়ূরপঙ্খী নহে আমার শুধু ছোট তরী
তাহার ছেঁড়া পালের দড়ি
ভাঙা হালে টলোমলো ঢেউয়ে উঠি পড়ি,
আমি তবু কি হাল ছাড়ি?
জানি অথৈ সাগর অবহেলে দেব পাড়ি।।
বয়সের পরিণতি মানুষকে ক্রমশঃ প্রদান করে এক নিঃস্পৃহতা, এক নির্মোহ উদাসীনতা। সবার মাঝে একাকী কবি ভোগ বাসনার মধ্যে অবস্থান করেও নিজের মধ্যে অনুভব করেন কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে এক সন্ন্যাসী প্রতিম, বৈরাগী সত্ত্বাকে, প্রিয়জনকে উদ্দেশ্য করে যিনি বলতে পারেন:
স্বজন বন্ধু ভুল বুঝোনা, জীবনের বন্ধ দ্বার খুলে
যেতে হবে দূর দিগন্তে একাকী,
স্মরণের প্রাঙ্গণে আর ডেকো না।
অনুরাগ সূর্যের অস্ত রাগের রঙে
গেরুয়া বসন হল বাসনা আমার
আর যত ছিল সাধ তত সাধ্য ছিলনা
বাঁধন বিহীন হল তাই সাধনা।
কামনার তীর্থে তারে খুঁজো না।
সমস্ত জাগতিক চাওয়া-পাওয়া, পার্থিব কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে এই আধ্যাত্মিক অনুভূতি সলিলের পরিণত মননের একান্ত নিজস্ব অনুভব।
মৌলিক অনুভূতিটুকু একই – যৌবনের উচ্ছল আনন্দ, প্রিয় মানুষের সঙ্গসুখ সব কিছু অতিক্রম করে সুদূর এক মহাপ্রস্থানের পথে কবির চেতনার অনন্ত যাত্রা। কিন্তু এর সঙ্গে মিশে রয়েছে আরো বহু জটিল অনুভূতির স্তর, আরো বহু অব্যক্ত মান অভিমানের বেদনা এই উজ্জ্বল গীতিকবিতাটিতে:
যেতে দাও নদী হয়ে বন জোছনায়, দূর অজানায়
পড়ে থাক তরু শাখে বাঁধা ঝুলনা, কথা বোলো না।
শুধু চুপ, নিশ্চুপ, শান্ত, সমাহিত বোবা কান্নার মত কিছু বেদনা
ফুল হয়ে ঝরে যাক, তারে তুলে নিয়ে আর মালা গেঁথো না।।
তোমাকে চেয়েছি কত কামনা ছিল গো যত
আজ বলাকার মত দূর আকাশে গেল সে ভেসে,
আর তারে ডেকো না।
শুধু চুপ, নিশ্চুপ…
সজল কাজল দিনে মরমের কানে কানে
যে গান ছিলে শুনে আজ তা মনে নাই-
হল অজানা, তারে ভুলো সজনা।
শুধু চুপ, নিশ্চুপ…
সলিলের পরিণত মননের এই সঙ্গীবিহীন যাত্রায় জাগতিক কামনার বাহ্যিক উজ্জ্বলতার পরপারে আপন মগ্ন চৈতন্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই অপরূপ উপলব্ধি শ্রোতা ও পাঠকের কাছে সলিলের একান্ত কবি সত্ত্বার শ্রেষ্ঠ উপহার।
বর্তমান আলোচনার ইতি টানব বৌদ্ধিক বিষণ্ণতার হীরক দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল, সলিলের কবি-কৃতীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই গীতিকবিতাটির উল্লেখ করে:
কিছুদিন পরে আর কিছু চাইব না আর
কামনার বাতি নেভা ঘরে,
চেতনার মৌতাতে ঝুম হয়ে যাব,
পৃথিবীর আলো কম হয়ে যাবে –
তখন এসো, তখন এসো।।
কিছু কেন রেখে যাব?
পৃথিবীর ভার এমনি অনেক,
ক্ষয় সে তো একদিনে নয়
প্রতিদিনে তিলে তিলে হয়।।
শরীরের বোঝা নেমে একদিন যাব থেমে
থামা নয়, চলার নেশায়।
সব পাওয়া শেষ হয়ে, সব চাওয়া শেষ হয়ে
মণিহীন চোখে চাওয়া থেকে যাবে –
তখন এসো, তখন এসো।।
আমি যবে ভুলে যাব তোমার আসার কথা – তখন এসো,
প্রত্যাশা শূন্য কলস ধুলায় গড়াগড়ি যাবে অবহেলায়।।
কথাদের লতার থেকে মানেদের ফুলেরা সব
টুপটুপ ঝরে পড়ে যাবে,
মানে হীন কথা যখন ওঙ্কার ধ্বনির মতন
সুরধ্বনী সঙ্গীত হয়ে যাবে –
তখন এসো, তখন এসো।।
এই গভীর জীবনবোধ, আত্মমগ্ন কবি হৃদয়ের এই জটিল উপলব্ধির ধারক সৃষ্টিকে শুধুমাত্র গীতিকবিতার অভিধায় সীমায়িত করতে যে কোনো পাঠকেরই দ্বিধা বোধ জাগা স্বাভাবিক। গীতিকবিতার মোড়কে এ এক পরিপূর্ণ কবিতা যা অনায়াসে সলিল কে অন্যান্য আধুনিক কবিদের সাথে এক পংক্তিতে আসীন করতে সক্ষম। কোনো আলোচনাতেই বোধহয় এর দার্শনিক গভীরতাকে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। কেবল নতজানু অন্তরে এই উপলব্ধির আত্মীকরণ, এবং সেই পরম একাকী, চির অভিমানী কবি সত্ত্বার সঙ্গে একাত্মতা বোধের প্রয়াস – সংবেদনশীল ও রসগ্রাহী পাঠকের কাছে এই কবিতার মর্মস্থলে উপনীত হবার এই বোধহয় একমাত্র চাবিকাঠি।
বর্তমান নিবন্ধে আলোচিত গীতিকবিতাগুলি গান হিসেবে সলিলের অন্যান্য জনপ্রিয় গানের তুলনায় নিঃসন্দেহে স্বল্পশ্রুত, কিন্তু কাব্যব্যঞ্জনায় সলিলের অনন্য কবিপ্রতিভার পরিচয় বহন করে। তাছাড়া বিষয়বস্তুর অসাধারণত্বে এই গীতিকবিতাগুলি সলিলের ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার এমন একটি দিগন্তকে উন্মোচিত করে, যে দিকটি নিয়ে এযাবৎ আলোচনা বিরলতম বলেই আমাদের ধারণা। বর্তমান আলোচনাটি তাই সলিল অনুরাগীদের যদি সামগ্রিক ভাবে সলিলের কবি-প্রতিভার প্রতি ও বিশেষ ভাবে সলিল-চেতনার এই তুলনামূলক অনালোচিত দিকটির প্রতি কিছুটা হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়, তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল বলে জানব।
তথ্যসূত্র:
১। শ্রী গৌতম চৌধুরী সৃষ্ট ওয়েবসাইট : http://www.salilda.com ( রচনায় ব্যবহৃত যাবতীয় গানের কথার জন্য)
২। গানের গল্প, গল্পের গান – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকাল প্রকাশন
৩। সেই বাঁশিওয়ালা – একটি সলিল সংকলন – গণনাট্য প্রকাশনী (বিভিন্ন প্রবন্ধ)