সে গানের পরশ লেগে হৃদয় হল সোনা
এক বড় ঝড়কে পোষ মানিয়ে
হাতপাখা নাম দিয়ে ঘরে এনেছি
দুরন্ত বন্যাকে কোণঠাসা করে
একটি গেলাসে তাকে পান করেছি
সূর্যের পিঠে আমি হাত বুলিয়ে
কিছু তার তেজ এনে আলো জ্বেলে ফেলেছি
তারা ভরা বিশ্বকে অক্ষর করে
ছোট এক বই লিখে ফেলেছি।
সলিল চৌধুরীর লেখা এই কবিতার নাম ‘বিজ্ঞানীর উক্তি।’ আমার কাছে তিনিই বিজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক না হলে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা এমন সফল এবং সাবলীল হয়ে অটুট থাকে কী করে! এবারের পুজোয় অধিকাংশ মণ্ডপে তাঁর গান, তাঁর সুরের পরিক্রমায় পথ চলা আনন্দের হয়ে ওঠে। তাল দিই, গেয়ে উঠি – যেন সুরের যজ্ঞে সামিল হওয়ার ডাক তিনি আমাকেও দিয়ে গেছেন। তিনি চিকিৎসকও, তাঁর সুর আমায় নিরাময় করে নিয়ত। যখন ভেঙে পড়ি, মন বিষণ্ণ হয় আমি সলিলসঙ্গীত শুনে সেরে ওঠার মন্ত্র পাই। তিনি আলো। ঝিকিমিকি আলো নয়। সূর্যের মতো মস্ত। এক বিরাট ঝড় তিনি কিংবা তারায় ভরা এক মহাবিশ্ব যার বিচ্ছুরণ আমাদের জীবনের অন্ধকারে পরম আশাবাদ। আমি প্রতিদিনই আবিষ্কার করি তাঁর সুরারোপিত গানে, তাঁর লেখায় এক সমগ্রতা। হয় তিনি লড়াই করে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন আর নয়তো প্রকৃতি ও প্রেমে দুরন্ত সহজাত স্মার্টনেস রেখে আমাদের বেঁচে থাকার মন্ত্র, পরম আনন্দের হদিশ দিচ্ছেন। যে গান সংগ্রামের নয়, ভালোবাসা কিংবা বিরহের আবহে তৈরি তার মধ্যেও থাকছে সমাজমনস্কতা, সময়ের সঙ্গে লগ্নতা।
সেই শৈশব থেকে প্রায় প্রতিদিন বাড়িতে ‘রানার,’ ‘গাঁয়ের বধূ, ‘অবাক পৃথিবী,’ ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’ শুনেছি, একদিনের জন্যও একঘেয়ে লাগেনি। মনে হয়নি, আজ আবার? “শোনো আহ্বান” যখন অন্ধকার দিনে শুনি, পথ্যের কাজ করে ওই সুর, কথা। গা এলিয়ে যা হচ্ছে হোক ভাবনা নিয়ে তখন আলস্যে বসে থাকতে পারি না। তামসিকতা মুছে যায় মনের ব্ল্যাকবোর্ডে। আমি দেখতে পাই এক না শেষ হওয়া মিছিল আসছে, না শেষ হওয়া স্বপ্ন ফুটে উঠছে গোলাপের মতো, প্রান্তর কাঁপিয়ে স্লোগান উঠছে, না শেষ হওয়া গন্তব্য খুঁজে পাওয়ার আশা মরছে না। ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, ফুল ফুটছে… অবসাদ দূর হয়ে যাচ্ছে আমার, আমার মতো অনেকের। তাঁর সুরে, কথায় কোন ঔষধ আছে আমি জানি না- “একদিন রাত্রে” ছবিতে ‘জাগো মোহন প্রীতম জাগো’ গানটি অবশ্যই ভক্তিগীতি কিন্তু যখন মিছিলের গানের মতো- এক মহৎ আহ্বান, ভক্তিগীতিতে এমন জাগরণের ডাক সমবেত কন্ঠে উঠে আসে ভৈরবী রাগে…তেজদীপ্ততা প্রাণিত করে।
জাগ রে জাগ রে জাগ জাগো নবমন্ত্রে
প্রভাত সূর্যের গম্ভীর মন্দ্রে
জাগ রে জাগ রে জাগ রে….
জাগ রে জাগ রে জাগ রে
গানের এই জায়গাটা কোরাসে হয়, অংশটি যেন লক্ষ কন্ঠে সেই আশাবাদ, চৈতন্যের ডাক।
আমি উত্তর খুঁজে চলি। ঝর্নার গানে গানটি কীভাবে নিজেই ঝর্না হয়ে ওঠে? ‘সুহানা সফর’ গানে ওই প্রতিধ্বনি আমায় পাহাড়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রতিবার! এক মিছিলের গানের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি কিভাবে প্রকৃতির গান হয়ে যায় সেইসব কথা ‘সুহানা সফর’ গানটিকে নিয়ে সকলের জানা। প্রবল হাওয়ায় যখন চুল উড়ে যায় মেঘের মতো, দেখতে পাই চাঁদের মুখের পাশে কীভাবে কালো মেঘ জড়ো হচ্ছে! ঘোর আমার অঘোর হয়ে জড়িয়ে ধরে। রবীন্দ্রনাথের পর এইভাবে তিনি আমায় ডুবিয়ে রাখেন তাঁর ভাবনায়, সুরে, লেখায়, জীবন দর্শনে। সন্ধ্যা মুখার্জি যতবার “উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা” বলেন ততবার আমি দেখি শুভ্র ঝাঁক – যাদের ডানায় পোষ মানার গন্ধ নেই, দৃপ্ত রোদ্দুর আছে, তারা উড়ে যাচ্ছে নিখিল বিশ্বের সন্ধানে। তাঁর গান এক সম্পূর্ণতা। যে সম্পূর্ণতার বিকিরণ নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে কেটে যায় জীবন। সুচিত্রা মিত্রের লেখায় আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই, “গানের বাণী যেন নির্ভুল নিশানায় অস্ত্রের মতো ছুটে যেত- এখানেই সলিল-গানের প্রাণ শক্তি।”
... সবুজ ঘাসের প্রজাপতি
আমায় খানিক চিনত
আমায় ডেকে বলল,
তুমি আছ- এটা ওদের দেখাই, কোনো প্রমাণ নয়
তোমার সুর যে শব্দ
ওদের শোনাই; কোনো প্রমাণ নয়
আমি বললাম, ভালো! (নিরুপায়)
“তোমার সুর যে শব্দ ওদের শোনাই…” যাদুকরের মতোই তিনি সুরকে শব্দ, শব্দকে সুর করে দিতে পারতেন। সুর সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন,
কোনো কথাকে প্রকাশ করবার সময় কোনো সুরের আমি যখন আশ্রয় নিই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার দ্বারা ওই কথাটি ওইভাবে বলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে বলা সম্ভব নয়। … ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’ এই কবিতাটিতে সুর দেওয়ার সময় লক্ষ করে দেখেছি প্রথমাংশে ভৈরবীর সুরের প্রভাব এসেছে। কিন্তু মাঝখানে যেখানে ‘অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার’ সেখানে ভৈরবী ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়ে ‘মেজর কর্ড’ অর্থাৎ শুদ্ধ পর্দা এসে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন আঘাতে আঘাতে নতুন নতুন বিস্ময়ের যে ধাক্কা, তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে ওটা আমি সচেতনভাবেই করেছি। এতে আমার কিছু কিছু সুরজ্ঞ বন্ধু প্রচণ্ড আপত্তি তুলেছেন, বলেছেন এটা ব্যাকরণে অশুদ্ধ।
কথাটি মিথ্যা নয়। কিন্তু আমার মতে আজকের সমাজজীবনের রূঢ়তাকে, বাস্তবতাকে সঙ্গীতে প্রকাশ করতে গেলে প্রাচীন ব্যাকরণে অনেক পরিশুদ্ধি-পৃষ্ঠা যোগ করা দরকার।
সময়কে পাশ কাটিয়ে না যাওয়ার চেতনা তাঁর ভেতরে এতখানি স্বাভাবিক ছিল যে তাঁর সৃষ্টিতে এই প্রভাব অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর মননের গভীরতা। তিনি অন্য আর একটি লেখায় এই কথাই লিখে গেছেন, “স্রষ্টার শিল্পকর্মের মধ্যে শুধুমাত্র তার ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ ঘটে তা নয়, সমকালীন যুগের প্রতিফলন এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবও তার মধ্যে সুপরিস্ফূট।”
আমার মতে কবিতার সুরারোপ তাঁর মতো করে… এমন সার্থক অনন্য সৃষ্টি আর কেউ করতে পারেননি এই দেশে। একটা আধটা নয়, যে কবিতায় তিনি সুরারোপ করেছেন প্রত্যেকটি মাইলফলক হয়েছে। একটি কবিতাকে তিনি এত গভীরভাবে অনুভব করতে পারতেন যে সেই কবিতা যখন গান হয়ে যায় শ্রোতারা যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়। সেই মুগ্ধতা এবং বিস্ময় হাজার বছরেও কাটবে না। রানারের সঙ্গে আমরাও ছুটে চলি এই প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তে, যতবার শুনি। দিগন্ত থেকে দিগন্ত আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। আমাদের শিরায়, রক্তে রানারের পদধ্বনি। অথচ আমি কিন্তু রানার দেখিনি। পালকির চলমান দৃশ্যও নিজের চোখে দেখিনি।
কিন্তু এসব আমার যেন দেখা, হুম হু না রে হুম হু না সুরধ্বনি গুঞ্জরিত হয় পালকি প্রসঙ্গটুকু এলেই। ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সন্ধ্যা মুখার্জির কন্ঠস্বরের এমন স্মার্ট ব্যবহার তিনিই করে গেছেন। রানারের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন যেহেতু কবিতা থেকে গান হয়েছে তাই আর আস্থায়ীতে ফেরার উপায় নেই। রানারের যাত্রা অনন্ত, একবার ছুটে সে বেরিয়ে গেলে আর সে ফিরছে না আরম্ভের খুঁটিতে তাই এই কবিতা থেকে গান হলে সেই বহমানতাই ধরে রাখতে হবে, ফেরার সুযোগ নেই। কবিতার প্রতি অনুরাগ এবং কবিতা লেখার মনন ও বোধ পুরোমাত্রায় ছিল বলেই হয়তো তাঁর এই উপলব্ধি সহজেই হয়েছিল। মহান সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ বলেছিলেন, “He was composer of the composers!” সলিল চৌধুরীর প্রয়াণের পর তাঁর উপলব্ধি আমাদের সকলেরই সঙ্গে মিলে যায়- ‘One of the seven notes of music has been lost!’
বামপন্থী আন্দোলনের গানই হোক কিংবা বাণিজ্যিক কাঠামোয় তৈরি গান – তিনি কখনো তাঁর উচ্চতা থেকে সরে আসেননি। আপস করেননি নিম্নমানের রুচির সঙ্গে। সত্তরের দশকে বম্বে থেকে সরে এসেছেন কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির মর্যাদা ও গুরুত্ব এখানে আর মানানসই হবে না। অপশব্দ, গানের নামে অপসংস্কৃতির সঙ্গে তিনি মানিয়ে গুছিয়ে চলবেন না। নৌশাদ তাঁকে ঠিক বুঝেছিলেন, “Salilbabu was a member of communist party and he struck to its principles!”
বাণিজ্যিক ছবিতে সুর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বম্বেতে গড়ে তুলেছিলেন বৃন্দগানের দল। কত কত ভালো ভালো গান শ্রোতারা পেয়েছেন সেই সময়ে সলিল চৌধুরীর সুরে ‘বম্বে ইউথ কয়্যার’ থেকে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে রাখতেন নিজেকে সবসময়, যেখানেই থেকেছেন সেখান থেকেই ভারতীয় সঙ্গীতের বহমানতা তাঁর হাত ধরে নিশ্চিন্তে চলেছে। মান্না দে, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর, রুমা গুহঠাকুরতা, দ্বিজেন মুখার্জি, অসীম কুমার প্রমুখরা ছিলেন এই কয়্যারের সদস্য। প্রেম ধাওয়ান, শৈলেন্দ্র ছিলেন গীতিকার আর সলিল চৌধুরী ছিলেন সুরের দায়িত্বে। তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন প্রথমে সুরকার অনিল বিশ্বাস এবং পরবর্তীকালে নৌশাদ। এই দলের অনেক গান পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে ছবিতে।
তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ড এক একটি অধ্যায় – তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা সহজ কাজ নয়। যোগ্যতাও নেই। শুধু অনুভবগুলো জড়ো করে লেখা। তাও সবটা সম্ভব নয়। তিনি সংকীর্ণতাকে ঠাঁই দেননি। তাঁর গানে যেমন কোরাসের প্রতিধ্বনি, বোধে যেমন কৃষক, শ্রমিক, খেটে পাওয়া মানুষের পদধ্বনি, তিনি কোনো অন্যায় নিষেধাজ্ঞা মানেননি। কিছু সংকীর্ণমনা কমিউনিস্ট যেমন তাঁর দিকে আঙুল তুলেছিলেন তেমনই রবীন্দ্রভক্তরা সুচিত্রা মিত্রের ‘সেই মেয়ে’ গানটিকে ভেবেছিল ‘কৃষ্ণকলি’ গানের প্যারোডি। দুর্ভিক্ষ পীড়িত ময়নাপাড়ার মেয়েকে তারা কৃষ্ণকলির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললেন সে কি সলিল চৌধুরীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখ বলে? কণিকা বন্দোপাধ্যায়কে দিয়ে দুটি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। ‘আমার কিছু মনের আশা’ আর ‘প্রান্তরের গান আমার’ কিন্তু দুটি গান বিশ্বভারতী কতৃপক্ষের কড়া মনোভাবের জন্য মুক্তি পেল না। শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যেতে হবে এমন হুমকি পেয়েছিলেন কণিকা। পরে উৎপলা সেন রেকর্ড করলেন গানগুলি। এরই সঙ্গে যে বামপন্থীরা মনে করতেন কিংবা করেন কোনো বামপন্থী শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে মানেই তাঁর স্খলন ঘটছে, এ ধারণা ভুল। কিংবা তাঁর গানকে, গানের কাঠামো বা শব্দকে বেঁধে রাখতে হবে শুধুই রাজনৈতিক ঘেরাটোপে তাহলে সেই সংকীর্ণতাকেই আবাহন করা হয়। বিশেষ করে সলিল চৌধুরীর মতো প্রতিভাকে তো আটকে রাখার চেষ্টা করা হাস্যকর। তিনি যখন ভাঙা হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে মাঠে, রাজনৈতিক সভায়, কারখানার গেটে, মহানগরের পথে, অজ প্রান্তরে গেয়ে গেছেন নিরন্তর তখন তিনি মহান। আর মহান মানেই তাকে যশে, খ্যাতিতে, জনপ্রিয়তায় খানিক খাটো থাকতে হবে এই ফর্মুলায় তাঁর মতো প্রতিভাকে বেঁধে রাখা সম্ভবই নয়। আজও যুব সমাজের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ‘বেলা চাও,’ ‘গুয়ান্তানামেরা,’ ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ প্রভৃতি গান যা মিছিলের গান হিসেবেই পরিচিত, তেমনই জনপ্রিয় ‘ও আলোর পথযাত্রী আর শোনো আহ্বান,’ ‘হেই সামালো ধান হো’ অথবা ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে!’ প্যালেস্তাইনের পথে যে ফ্লোটিনা চলেছে সেখানে সলিলসঙ্গীত গাইবার দু একজন শিল্পী যদি থাকতেন! এখনকার এক জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীকে সলিল চৌধুরীর গান নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর উত্তর ছিল এরকম, “গান তো আছেই, তাঁর মতো মেরুদণ্ড যদি আমাদের থাকত!”
তথ্যসূত্র-
১। সলিল চৌধুরী : রচনা সংগ্রহ প্রথম খণ্ড (সংকলন ও সম্পাদনা- সবিতা চৌধুরী, অন্তরা চৌধুরী, রণবীর নিয়োগী)
২। কবিতা সংগ্রহ- সলিল চৌধুরী (সম্পাদনা- প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী)
1 Comment