প্রিয় নারীচরিত্র

আমার প্রিয় বঙ্কিমসৃষ্ট চরিত্র - "দেবীচৌধুরানী"র "প্রফুল্ল"

[সম্পাদকীয় টীকা – ‘অবসর’ পত্রিকার ফেসবুক গ্রুপে পত্রিকার তরফে পাঠকদের কাছ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের চরিত্র নিয়ে পাঠ – প্রতিক্রিয়া আহ্বান করা হয়েছিল। প্রাপ্ত লেখাগুলির মধ্যে থেকে নির্বাচিত লেখাটি প্রকাশিত হল।] 

.বাংলাভাষায় প্রথম প্রকৃত উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাই তিনি সাহিত্য সম্রাট। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী“র রচনাকাল ১৮৬৫ সাল। পরবর্তী বাইশ বছরে তিনি আরো এগারোটি উপন্যাস রচনা করেন। তিনি যখন বাংলায় উপন্যাস লিখতে আরম্ভ করেন, বাংলাভাষা তখনো তার শৈশবে, সংস্কৃতভাষার ক্রোড়ে। তার অনেক বছর পরে, রবিঠাকুরের শক্তিশালী লেখনী বাংলা ভাষাকে একটা অন্যমাত্রা দান করবে। এই বারোটি উপন্যাসের সবকটাই নারীচরিত্র প্রধান। তাদের মধ্য থেকে আমার প্রিয় একটি নারীচরিত্র নিয়ে সীমিত শব্দসংখ্যার মধ্যে কিছু লেখার চেষ্টা করছি।

বাল্যকাল থেকেই গল্প, উপন্যাস, কবিতা পড়ার অভ্যাস ছিল। স্কুলে পড়াকালীন বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন এবং কিয়দংশে রবীন্দ্রনাথ পড়া শেষ করে সবে তারাশংকর, মানিক, বিভূতিভূষণের স্বাদ পেতে শুরু করেছি, সেই সময় আমার নজর পড়ে বঙ্কিমের নতুন (আমার কাছে) উপন্যাস “দেবীচৌধুরানীর“ প্রতি। উপন্যাসটি পড়েই আমার মনে হয়েছিল এটি বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ১৮৮৪ সালে এই উপন্যাসটি তিনি যখন রচনা করেন তখন তাঁর লেখনী দক্ষতার উচ্চতম শিখরে। শরৎচন্দ্র (জন্ম – ১৮৭৬, লেখকজীবন শুরু – ১৯০৭) তাঁর মর্মস্পর্শী লেখনীর মাধ্যমে তখনো বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের অন্দরমহলে প্রবেশ করেননি। 

পরে দেবীচৌধুরানী উপন্যাসটি আমি বারবার পড়েছি। বঙ্কিম নিজেই বলেছেন যে এই উপন্যাস রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল অনুশীলনতত্ত্বের বিশ্লেষণ ও মাহাত্ম্য প্রচার। এই উপন্যসের প্রধান চরিত্র দেবী চৌধুরানী। সে পূর্বে ছিল ‘প্রফুল্ল’ নামের এক স্বামী পরিত্যক্তা দরিদ্র রমণী। বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন প্রফুল্ল কিভাবে দেবী চৌধুরানীতে রূপান্তরিত হল। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি দু’টি চরিত্রকে পৃথকভাবে দেখি। উপন্যাসটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডেই প্রফুল্ল চরিত্রের বিশিষ্টতা তুলে ধরার জন্য লেখকের সযত্ন প্রয়াস চোখে পড়ে। একজন গ্রাম্য, দরিদ্র, সাধারণ গৃহবধূকে দেবীচৌধুরানীর মত চরিত্রে রূপান্তরিত করা সহজসাধ্য কাজ নয়। তার জন্য লেখককে অসাধারণ পরিশ্রম করতে হয়েছে।
প্রফুল্লর মধ্যে যে একটা ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান বোধ ছিল, সেটা প্রকাশ্যে আনার জন্য উপন্যাসের প্রারম্ভেই বঙ্কিম উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রফুল্লর, নিজের মাকে, যুক্তি দিয়ে আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করে, অন্যের বাড়িতে ভিক্ষা করতে নিবৃত্ত করা একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। প্রফুল্ল জমিদারের পুত্রবধূ, তাই হেলাফেলার পাত্রী যে নয় সেই সম্বন্ধে সে পূর্ণ সজাগ। তাই মাকে অসাধারণ যুক্তিসিদ্ধভাবে বলে,
“যাহাদের উপর আমার ভরণ-পোষণের ভার, তাহাদের কাছে অন্নের ভিক্ষা করিতে আমার অপমান নাই। আপনার ধন আপনি চাহিয়া খাইব তাহাতে আমার লজ্জা কি?” এই কথা বলে সে তার মা’কে তাকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যেতে রাজি করায়।
শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে প্রফুল্লের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়। একদিকে দরদী শাশুড়ি ঠাকরুন ও সতীন সাগরের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং অন্যদিকে শ্বশুরমশাই হরবল্লভের রূঢ় ব্যবহার। এখানেই প্রফুল্লর জীবনের সমাপ্তি ঘটতে পারত। কিন্তু বঙ্কিম তা চান নি। সেজন্য ভবানী পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়ে অনুশীলনবৃত্তি শুরু করার অনেক আগে থেকেই বঙ্কিম প্রফুল্লর রূপান্তরিত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাই দেখা যায় এক গ্রাম্য অশিক্ষিতা রমণীর মুখে তার শাশুড়ির প্রতি উক্তি- “মা, একঘরে হবার ভয়ে কে কবে সন্তান ত্যাগ করেছে? আমি কি তোমার সন্তান নই?” এই শুনে শাশুড়ি পর্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন।
প্রফুল্ল জানত স্বামীগৃহে তার স্থান হবে না। কিন্তু অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও স্বামী সন্দর্শনে আসার জন্য সে দৃঢ় সংকল্প ছিল। সাগরের সহায়তায় সেটা সম্ভবও হয়েছিল। এখানেই প্রফুল্লর জীবনে সার্থকতার সূচনা। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না না হলে স্বামীকে কেউ বলতে পারে “তিনি (শ্বশুরমশাই হরবল্লভ) আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, আমি তাঁর কাছে ভিক্ষা লইব না। তোমার নিজের যদি কিছু থাকে তবে তোমার কাছে ভিক্ষা লইব।”
যাই হোক, এসব কথা নিয়ে বিশদ আলোচনার সময় এই ক্ষুদ্র পরিসরে নেই। এর পর বঙ্কিম তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রফুল্লর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভবানী পাঠকের সহায়তায় তাঁর অনুশীলন তত্ত্বকে সাফল্যমণ্ডিত করে প্রফুল্লকে দেবীচৌধুরানীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমার বক্তব্য অন্য। প্রফুল্লর মূল উদ্দেশ্য অর্থশালিনী বা ক্ষমতাশালিনী হওয়া নয়, তার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সসম্মানে স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন করে স্বামী সন্তান সহ সুখে সংসার যাপন। বঙ্কিম কিন্তু তা করেন নি। যে প্রফুল্লর মত একটা চরিত্র তিনি অঙ্কন করলেন, সেই প্রফুল্ল স্বামীগৃহে ঠিকই প্রত্যাবর্তন করল, কিন্তু সসম্মানে নয় প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে, প্রফুল্ল হয়ে নয়, অন্য রমণীর ছদ্মবেশে।
দেবীচৌধুরানীর চরিত্রে কিছু অসামঞ্জস্য থাকলেও, প্রফুল্ল চরিত্রটি আদর্শ। দেবী চৌধুরানী মিথ্যাভাষণ করল তার গুরু ভবানী পাঠকের কাছে, শেষ বারের মত বিদায় নেবার সময়। সে বিভিন্ন সময় বলল, “আমাকে অব্যাহতি দিন—আমার এ রাণীগিরিতে আর চিত্ত নাই। —- আমি কাশী গিয়া বাস করিব, মানস করিয়াছি।— আমি এই রানীগিরি হইতে অবসর লইতে চাই। আমার এ আর ভাল লাগে না।”
প্রফুল্লকে পুত্রবধূ রূপে গ্রহণ করা শ্বশুর হরবল্লভের পক্ষে সম্ভব ছিল না সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য। যে গৃহপরিত্যক্তা বধূ মৃতা বলে প্রচারিত, তাকে সমাজ কিছুতেই মেনে নেবে না।
এটুকু পর্যন্ত তাও মেনে নেওয়া গেল, কিন্ত ধনশালিনী ও প্রচণ্ড ক্ষমতাশালিনী দেবী চৌধুরানীকে লেখক কোন মর্যাদা দিলেন না। সে শ্বশুরবাড়িতে এসে সামান্য দাসীর মত দিন কাটাতে লাগল। যদিও প্রফুল্ল তার স্বাভাবিক বিনয় ও স্ত্রীবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে সাগরকে বলেছিল, “এই ধর্মই স্ত্রীলোকের ধর্ম; রাজত্ব স্ত্রীজাতির ধর্ম নয়।”
সবচেয়ে বড় কথা, এত কিছুর পরেও পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে প্রফুল্লর জীবন কি সার্থক হয়েছিল। আমার মতে, তার উত্তর এক কথায় ‘না’। বঙ্কিম প্রফুল্লর প্রতি যে অন্যায় করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিন খণ্ডের উপন্যাসটির মোট বিয়াল্লিশটি পরিচ্ছেদের মধ্যে স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর প্রফুল্লর কথা উল্লিখিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি পংক্তিতে। প্রফুল্লকে অবতার বানিয়ে স্বর্গে পাঠিয়ে লেখক আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও পাঠকের মন জয় করতে পারেন নি। আমার প্রিয়তম এই চরিত্রকে লেখক আরও একটু সম্মান দিয়ে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করলে পাঠক অনেক বেশি তুষ্টিলাভ করতে পারত।

জন্ম ও বিদ্যালয় শিক্ষা অসম রাজ্যের শিলচর শহরে । পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং শেষে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক। এ ছাড়া আর ও ডিপ্লোমা প্রাপ্ত। পঁয়তাল্লিশ বছর ভারতের বিভিন্ন শহরে উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত থেকে অবসর গ্রহণ করে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতনবাসী হয়ে সম্পূর্ণভাবে সাহিত্য কর্মে লিপ্ত। এ পর্যন্ত ষোলটি পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। মোট 250 টির অধিক গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • কল্যানী মিত্র ঘোষ , July 17, 2021 @ 1:36 am

    অসাধারণ বিশ্লেষণ, খুব ভালো লাগলো।

  • Anindita Basu , July 31, 2021 @ 9:18 pm

    খুব ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *