স্মৃতির ফুটবল

স্মৃতির ফুটবল

তখনও টেলিভিশনে রং বেরং আসেনি। বাংলায় রঙের হুল্লোড় নিয়ে হাজির হল শক্তি সামন্তের অমানুষ। ইস্টম্যানকলার। উত্তমকুমার মাথার টুপিতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। হাততালিতে মুখর প্রেক্ষাগৃহ। গুরু গুরু আওয়াজ উঠছে।
তখন গুরুর যুগ। সাহিত্যে সুনীল, শীর্ষেন্দুদা। অদৃশ্য মেরুকরণ। যেমন সৌমিত্র আর উত্তম।
তখন সাহিত্যেরও যুগ। আর সব খেলার সেরা বাঙালির প্রাণের ফুটবল।
আমার সাহিত্যের গুরু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সিনেমা কখনও উত্তম, কখনওবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ফুটবলে একজনই গুরু। পনের নম্বর জার্সি। বল ধরলে সরীসৃপ গতি। আউটসাইড ড্রিবলে ছিটকে যাচ্ছে। একের পর এক ডিফেন্ডার। কে তিনি!
সুরজিৎ সেনগুপ্ত। মোহনবাগান দিয়ে শুরু করেছিলেন। আর আমরা কাষ্ঠ বাঙাল। তখনও তিনিও তেমন মেলে ধরতে পারেননি। বদনাম ছোট টিমের বিপক্ষে দারুণ খেলেন কিন্তু বড় টিমের বিরুদ্ধে বোতলবন্দি হয়ে যান।
সেই সুরজিতের নবোদয় ঘটল ইস্টবেঙ্গলে এসে। রোদ্দুর পড়লে লাল হলুদ জার্সি আর সেই স্কিল অকাল বসন্ত ডেকে আনে। মাঠে আমাদের বৃথা অনুকরণ সেই আউটসাইড ড্রিবলিং।
এছাড়াও কর্ণার থেকে বেনানা কিকে গোল। শুধু চোখ জুড়ে থাকা স্বপ্নের ফুটবল।

তবুও পনের নম্বরকে চাই। মার ভুলে বেদনা ভুলে দেখছি ফুটবল।
গ্যালারি থেকে নেমে অনায়াসে টপকে নিলাম কাঁটাতারের বেড়া। আর কত মারবে পুলিশ কিন্তু সেই সর্পিল গতি, সেই ম্যাজিক তো দেখা চাই।
ছুটছেন তিনি। পায়ে বল যেন লাট্টুর মতন ঘুরছে। এরকম অবিশ্বাস্য স্পিনিং। কেটে গেল তিনজন ডিফেন্ডার। রাজস্থান ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল তিন এক করল কিন্তু সুরজিত সেনগুপ্ত মাতিয়ে দিলেন মাঠ।
আমরা কোন্নগর নবগ্রামের। আর ওঁর বেড়ে ওঠা চুঁচুড়ায়। অনেক মিথ ওঁকে ঘিরে। ভাল ছাত্রও। ব্যাংকে চাকরি। তাও ছেড়ে আনন্দবাজার পত্রিকায়।
একবার বড় ম্যাচে বল পেলেই ছেড়ে দিচ্ছেন। পাসগুলি সঠিক ঠিকানায় চলে যাচ্ছে কিন্তু সেই জাদু লুকিয়ে রেখেছেন।
অজয় বসু রিলেতে বলছেন, অমন যে সুরজিত সেনগুপ্ত, তিনিও পায়ে বল রাখছেন না।
সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে বাংলা দলে সুরজিত নেই। উত্তাল জনতা, সুরজিতকে চাই। ইঁটের টুকরো গ্যালারি থেকে উড়ে এলো। মাথা ফেটে গেল আকবরের। সুরজিত নামলেন, ম্যাচ জিতল বাংলা।
আসাম থেকে রূপকথা হয়ে উড়ে এল সুরজিতের ফুটবল।
পিয়ং ইয়ং ভার্সেস ইস্টবেঙ্গল। গ্যালারিতে বাঙালির জায়গা নেই। বাংলা কাগজ দেখলেই পেটানো হচ্ছে।
প্রথমে এক গোল খেল ইস্টবেঙ্গল। তারপর শুরু হল সুরজিতের ম্যাজিক। ফলাফল তিন – এক।
সেই নায়কের সঙ্গে একবার দেখা হল। তখন তিনি ফুটবল ছেড়েছেন।

হুগলি Branch স্কুলের স্টেজে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এসেছেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। আমরাও ওঁকে কয়েকদিন আগে এনেছি। আমার বউ নিরামিষ চিলি পনির নিয়ে গেছিলেন, দেওয়া হল। খুব সামান্য কথা হয়েছিল মার্জিত সুভদ্র আমার কৈশোরের স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে।
শুনেছি তবলা বাজাতেন। ইস্টবেঙ্গল তাঁকে সন্মাননা দিয়েছেন বিস্তর। জাতীয় স্তরে সেই ভাবে আলোচিত হলেন না।
স্বপ্নের তো মৃত্যু হয় না। মৃত্যু হয় না ফুটবলের।
মৃত্য হয় একটা কালের। কালাতীত কিছু নয়। তবুও মিল্টনের ইডেনে বা আমাদের স্বর্গে যদি World 11 হয় আমার বিচারে ভারতের সুরজিত সেনগুপ্ত থাকবেনই।
এমন বল প্লে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ফুটবলের সেই শিল্প।
কিন্তু কেন! আমরা অপেক্ষায় রইলাম। কোন অনাগত তরুণ আসবেন, মাঠ মাতাবেন।
আমার বাবা চাইতেন, আমি ফুটবলার হবো। হলাম ম্যাজিস্ট্রেট।
লাজুক রোদ্দুরে অমলকান্তি আজও স্বপ্ন দেখে সুরজিত সেনগুপ্ত আবার মাঠ মাতাচ্ছেন। আর পুলিশের লাঠি খাওয়া সেই ছেলেটা রক্ত রুমালে মুছে নিয়ে দেখছে সেই স্বপ্নের স্কিল। জীবনের জাদু বাস্তবতা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *