কোথায় পাবো তারে

লম্বোদরঃ ওরে ও অভিরাম, নামা আমায় নামিয়ে দে। ঐ দ্যাখ, সবাই আমার দিকে কীরকম কটমট করে তাকাচ্ছে। নাঃ, আর তোর পিঠে না, এবার হেঁটে যাব।
নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য লম্বোদরকে কত পথ চলতে হল – অবশ্য সে সবটাই করলো অভিরামের পিঠে চড়ে। আর সে যাত্রা কী সাংঘাতিক! অননুমেয় এই যাত্রা মনোজ মিত্র দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেন তাঁর ‘রাজদর্শন’ নাটকে। প্রভূত অস্তিত্ববাদী অর্থবহ সেই ‘আত্মানং বিদ্ধি’ যাত্রার অভিঘাত মঞ্চে আছড়ে পড়ে লম্বোদর ভট্টের ‘এবার হেঁটে যাব’ শব্দত্রয়ে, নাটক শেষ হয়।
অযোধ্যা রাজ্যের কোন এক গণ্ডগ্রামে অবস্থান এই কঙ্কালসার বৃদ্ধ লম্বোদর ভট্টের; গৌরবর্ণ, খড়্গনাসা, পেটের পরিধিটি তার বেশ বড়। তার ছাতায় এক টুকরো কাপড় নেই, আছে শুধু লোহার শিকগুলো। এই যার অবস্থা তার ক্রোধ কিন্তু অপরিসীম। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আছে যারপরনাই লোভ।
নাটকের শুরুর দিকে দেখা যাচ্ছে এই লোভকে চরিতার্থ করার জন্য লম্বোদর এক কাঁদি মর্তমান কলা, যেটি যোগাড় করে সে ঘরের আড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল তাই দিয়ে চাল, গুড়, ঘি সহযোগে মালপো হলে খাবে বলে, সেটি বৌ-বাচ্চার পেটে চলে যাওয়ায় তাদের উত্তম-মধ্যম শাপ-শাপান্ত করছে।
লম্বোদরঃ পেটে গেছে! নিজে গিলেছে, পুঁই পোনাদের দিয়ে গিলিয়েছে … মাগি বছর বছর বিয়োচ্ছে আর আমার কপাল থেকে একটি একটি করে সুখাদ্য উঠে যাচ্ছে র্যা … (সহসা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে) নির্বংশ কর … হে ভগবান, নির্বংশ কর!
অভিরাম গাঁয়ের কামার, লোহাপেটা বলিষ্ঠ যুবক; লম্বোদর তার “ধম্মোবাপ”, তার স্ত্রী “ধম্মোমা”।
অভিরামঃ এহেহে, নিজের বংশ নিজে নাশ করে গো! এই জন্যে বলেছে ল্যাজে পা পড়লে ষাঁড়ে আর বামুনে কোন ভেদাভেদ থাকে না।
এর পরেও ভগবানের উদ্দেশে লম্বোদর যখন বলে চলে, “নির্বংশ করো … নির্বংশ করো … করো… বৌ, বাচ্চা, ধাড়িপোনা সব তুলে নাও … নাও … নাও …”, তখন অভিরাম ঘুরে দাঁড়িয়ে ধমকে বলে,
অভিরামঃ চুপ! দুকুরবেলা শাপমুণ্যি কচ্চে! খেয়েছে কলা, বেশ করেচে। না খেয়ে খাবেটা কী! ভাত দেবার ক্ষ্যামতা নেই … শাপ দেবার গোঁসাই। বলি পুঁইপোনাগুলো কি মা আমার বাপের ঘর থেকে আঁচলে বেঁধে এনেছিল তোমার ঘরে?
রাগে অন্ধ অবস্থা থেকে লম্বোদরের গলার স্বর, হাবভাব সব চকিতে বদলাতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শোনা যায়,
লম্বোদরঃ (অভিরামের হাত ধরে)ঃ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ –
অভিরামঃ ও যতই গায়ে হাত বোলাও আর হেঁ হেঁ কর, আজ আর কানাকড়িটি পাচ্ছ না ঠাকুর! এই ঘনঘন হাত পাতার অভ্যেসটা ছাড়ো দিকি! কেন? নিত্যি আমি তোমারে পেন্নামি দিতে যাবো কেন? কী পেয়েছো কি তুমি?
আমরা দেখেছি নাটকের প্রারম্ভে শনিদেবতার অভিশাপে অযোধ্যারাজ নন্দ প্রচণ্ড অসুস্থ। সেই কালব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়,
ঘোষকঃ ঘোষণা, ঘোষণা, ঘোষণা! অযোধ্যাপতি নন্দ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আগামী শুক্লাপঞ্চমীতে রাজ্যেশ্বর তাঁর রোগমুক্তিকল্পে দরিদ্র নারায়ণের সেবা করবেন। অমিত বৈভব নৃপতি নন্দ মুক্তহস্তে দেশের সদাচারী ব্রাহ্মণদের স্বর্ণ ও রৌপ্য দান করবেন।
এই ঘোষণাটি শোনার পর থেকেই লম্বোদরের মাথায় ঘুরতে থাকে কীভাবে সে অযোধ্যা যাবে। অপরিসীম লোভের বশবর্তী হয়ে সে অভিরামকে এক অবাস্তব পরিকল্পনায় শামিল করতে উদ্যোগী হয়। নিজের শক্তি না থাকলেও যুক্তির জালে তাকে পর্যুদস্ত করে।
লম্বোদরঃ আরে নিজের খ্যমতা থাকলে তোর পায়ে তেল মাখাতুম নাকি? নেহাৎ অনেক দূর পথ … ঘুর পথ … প্রায় এক পক্ষকালের পথ … বনজঙ্গল, নদী, পাহাড় … দুর্গম পথ … তুই না গেলে আমি কার পিঠে চেপে পার হব র্যা?
অভিরামঃ কী হল? আমার পিঠে পথ পার হবে?
লম্বোদরঃ তোর এই কোলটিতে মাথাটি দিয়ে … তুই রান্নাটি করে, অন্নটি আমার মুখে ধরবি। দে বাবা, তোর কামারশালাটা আজই বেচে দে।
অভিরামঃ কেন? কামারশালা বেচতে হবে কেন?
লম্বোদরঃ (রেগে) বোঝাও … এ মুখ্যুকে আর কীকরে বোঝাবে বোঝাও! ওরে শালা … প্রায় এক পক্ষকালের পথ। কামারশালা না বেচলে বাপবেটার পথখরচা উঠবে কোত্থেকে র্যা?
অভিরামকে কামারশালা বেচতে বলার সময় সে দৃশ্যে ঢুকে পড়ে রাজস্ব আদায়কারী মুরলীধর। পদগৌরবে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে যা তাকে অসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার করতে প্ররোচিত করে।
মুরলীঃ রাজার রাজত্বে বাস করবি, কর দিবি না উঁ!
অভিরামঃ এই তো ফাল্গুন মাসে দিলুম …
মুরলীঃ সে তো গেল বাৎসরিক কর। এই বিশেষ করটা কে দেবে শুনি উঁ উঁ উঁ … !
লম্বোদরঃ রাজা কি বিশেষ কর বসিয়েছে নাকি র্যা মুরলীধর …
মুরলীঃ তোমাদেরই জন্যে! ভুরি ভুরি দান নেবে, আয় না হলে দানটা কী দিয়ে হবে ঠাকুর … কী দিয়ে হবে উঁ উঁ!
লম্বোদরঃ (আনন্দে ছাতাটা মাকুর মত ফরফরিয়ে) বটেই তো … বটেই তো …!
মুরলীঃ এসব কাজে তো রাজকোষে হাত দেওয়া যায় না। বাইরে বাইরে থেকে তুলে বাইরে বাইরে ছড়িয়ে দিতে হয়, কী বুঝলে উঁ!
লম্বোদরঃ (চকচকে চোখে) বুঝেছি … বুঝেছি! (অভিরামকে) তুই কর দিবি, সেই কর রাজার কর ঘুরে এসে আমার করে করকর করবে। তুই থেকে রাজা … রাজা থেকে আমি … ত্রিভুজ!
লোভী চরিত্রের অভাব নেই এই নাটকে। বৈষয়িক লোভ, ক্ষমতার লোভ, মায় নিজের পেট ঠেসে রাজভোগ খাওয়ার অদম্য স্পৃহা, এই বহুবিধ লোভে জর্জরিত মানুষ কীভাবে এক দাবার ছকে নিজের অজান্তে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে তার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে পরে জেরবার হয়। এ শুধু লম্বোদর ভট্টের চরিত্রের উপজীব্য নয়। রাণী যশোমতী, কুমার চন্দ্রকেতু থেকে শুরু করে নন্দ রাজার দুই দেহরক্ষী ব্যাঘ্রমল্ল ও ভীমভল্লের মাধ্যমেও আমরা বিভিন্ন সামাজিক স্তরে লোভের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করি। যা এই প্রাচীন কাহিনির যুগ থেকে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থায় কীভাবে অপ্রতিহত রয়েছে এই নাটকের প্রতিটি মুহূর্ত তা মনে পড়িয়ে দেয়।
লম্বোদরের আত্মোপলব্ধির পথ সরল ছিল না। তার পটভূমি নাট্যকার সৃষ্টি করেন একটির পর একটি উৎকৃষ্ট নাট্যমুহূর্ত দিয়ে। যে রাজার রোগমুক্তিকল্পে রাজার ধনদান ঘোষণা করা হয়েছে, সেই নন্দ রাজারই মৃত্যু হয়। অথচ সেখানেই আসছে লম্বোদর ধনরাশি পাবার আশায়, অভিরামের কাঁধে চড়ে, একপক্ষকাল ধরে। এই সময় হঠাৎ রাজার মৃত্যুতে লম্বোদরের বিরাট আশাভঙ্গ, অভিরামের কামারশালা ভেঙে যে পাথেয় নিয়ে এই যাত্রা তাও নিঃশেষিত।
নন্দরাজাকে আসলে খুন হতে হয় – সিংহাসনলিপ্সু ভাই চন্দ্রকেতুর ষড়যন্ত্রে। খুন করানো হয় কুব্জাকে দিয়ে। নন্দরাজার শবাধারের চারপাশে উন্মাদিনী কুব্জার বয়ান শুনি দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে।
কুব্জাঃ আসছে না … কেউ আসছে না। রানিরা ব্যস্ত … তোমার রত্নভাণ্ডারের চাবি খুঁজতে –। তোমার কেউ নেই রাজা। তুমি ভাবতে সব আছে! কিছু ছিল না। রাজা না, প্রজা না, ভাই না, রানি না —-! ধাই … না, সেও না … সেও তোমার না … সেই তোমাকে মারল রাজা! … আমি না মারলেও তোমাকে মারার লোকের অভাব ছিল না… তবু আমি তোমাকে মারতে চাইনি বাবা … চাইনি (থেমে) চন্দ্রকেতু যে আমার পেটের সন্তানদের মারবে বলে ভয় দেখাল!

এই সময় শনিদেবতার বরে লম্বোদরের প্রাণ এসে নন্দরাজার মৃতদেহে ঢোকে, মৃত নন্দরাজা উঠে বসে। অভিরাম ওদিকে রক্ষা করে লম্বোদরের মৃতদেহ। পরিকল্পনামত পুনর্জীবিত নন্দরাজের কাছ থেকে ধনরাশি পাওয়ামাত্রই লম্বোদর তার প্রাণ নিয়ে ঢুকবে নিজের মরদেহে, ফিরে যাবে স্বস্থানে।
নন্দের মৃত্যু হতেই অন্যদিক থেকে ছুটে আসে বিদ্রোহী বৃষল। এবার মহামাত্যের উপদেশে চন্দ্রকেতু চায় পুনর্জীবিত নন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে। অতএব অভিরামের হাত থেকে মৃতদেহ কব্জা করে তাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে হবে। অভিরামের পিছনে ছুটল সেনা তাকে ধরতে।
অভিরামের প্রতিজ্ঞা সে তার ধম্মোবাপকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ধম্মোমার কাছে। পিছনে সৈন্য, চারপাশে জ্বলে ওঠা বিদ্রোহের আগুনেও সে দৃঢ় বিশ্বাসে অটল থাকে, তাকে নিভিয়ে দেওয়া যায় না। এই সংঘর্ষের মধ্যে তার চরিত্রের দৃঢ়তা অন্য সব চরিত্রকে ম্লান করে দেয়। লম্বোদরের উত্তরণের পথ নাটকের শেষে আমাদের চোখে স্পষ্ট করে দেয়। নাটকের শেষে তার আত্মোপলব্ধির মুহূর্ত তাই বড় মধুর ও আশাব্যঞ্জক।
আবেগ-উচ্চকিত এই নাটক ‘রাজদর্শনে’ মনোজ মিত্র তাঁর স্বভাবসুলভ দক্ষতায় গভীর বক্তব্যের সঙ্গে সমান্তরাল রেখে চলেছেন তাঁর হাস্যরসে নিমজ্জিত উচ্চমানের সংলাপ যা দর্শককে সম্মোহিত করে রাখে। নাটকের থেকে দর্শকের যা কিছু প্রাপ্য অপর্যাপ্ত পরিমাণে তা বিতরণ করা তিনি নাট্যকারের দায়িত্ব বলে মনে করেন, অবশ্যই নান্দনিকতা সম্পূর্ণ বজায় রেখে।
৪৫ বছর হল আমরা ফোরাম থ্রির পক্ষ থেকে ব্যাঙ্গালোরে মনোজ মিত্রের নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছি। আর করেছি ওঁর ‘সাজানো বাগান’, ‘রাজদর্শন’ নাটকের অনুবাদ, প্রথমে ভারতীয় ইংরেজিতে, পরে হিন্দিতে।
চেষ্টা ছিল যাতে অনুবাদে ওঁর রসসিক্ত ভাষার মাধুর্য না হারিয়ে যায়। আর নাট্যশালায় উপস্থিত দর্শক যদি দেশের বিভিন্ন প্রান্তেরও হয়, ভারতীয় ইংরেজিতে অনুবাদের ভাষা সহজেই তাদের এমন আপন করে নেবে যে প্রত্যেক দর্শকের মনে হবে যে তার মাতৃভাষায় নাটকটি পরিবেশিত হচ্ছে। আমাদের দর্শকমণ্ডলীর বক্তব্য যে আমরা দুটি পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছি।
‘রাজদর্শন’ হিন্দিতে অনুবাদ হওয়ার পর মনোজবাবুকে ফোনে রিহার্সাল শোনাতাম।
শুধুমাত্র দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক নাট্যকার দের মধ্যেই নন, প্রথম সারির ভারতীয় নাটক এবং চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যেও উনি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। ওঁর প্রশংসা একাধারে আমাদের পরম সৌভাগ্য ও অনুপ্রেরণা।
মনোজ মিত্রের সমসাময়িক আর একজন প্রখ্যাত নাট্যকার আত্মবিশ্লেষণ নিয়ে তাঁর একটি নাটকে একটু অন্যভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। তিনি গিরীশ কারনাড। দু’জনেরই জন্ম ১৯৩৮ সালে এবং কর্মপরিধিও একেবারে অভিন্ন।
মানুষের এই নিজের স্বরূপ বোঝার প্রয়াসকে অন্যভাবে সাজিয়ে ‘কোথায় পাব তারে’ বলে যে এই নিরন্তর খোঁজার চেষ্টা, তার বিশ্লেষণ গিরীশ কারনাড অন্যপ্রণালীতে করেছেন তাঁর হয়বদন নাটকে। পটভূমি এখানে ‘রাজদর্শনে’র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যদিও কাহিনি এখানেও প্রাচীন। এক সুন্দরী নারীর কাছে পুরুষের কোন পরিচয় বেশি কাম্য, সেই বোধ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষের পরিচয় কী হওয়া উচিত, তার ধীশক্তি না তার পেশীর জোর? চিরন্তন এই বিতর্ককে আশ্রয় করে ‘হয়বদন’ নাটকে দেখি মানবী ও মানবের চেতনার মন্থন।
নাটকের পাত্র দু’জন। একদিকে সুকুমার ব্রাহ্মণ যুবক দেবদত্ত যার বুদ্ধিমত্তাই তার পরিচায়ক , অন্যদিকে তার প্রিয় বন্ধু কামারের ঘরের ছেলে কপিল, যে শরীরী উৎকর্ষের প্রতীক।
গবেষণার পদ্ধতি হিসেবে নাট্যকার এর ধড়ে ওর মাথা বসিয়ে দেখিয়েছেন, এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে সুন্দরী বণিককন্যা পদ্মিনীর জীবন কীভাবে পরিপূর্ণ মানব কাকে বলে তার মাপ নিতে নিতে আলোড়িত।
আজ এই দুই নাট্যকারই আমাদের মাঝে নেই। আছে শুধু দর্শকমনের ওপর এঁদের প্রভাব। তাই এই অন্বেষণ অগণিত পাঠকের মননে ও জীবনচর্যায় চলতেই থাকবে।
চিত্রঋণ –
রাজদর্শন নাটকের ছবি – লেখক
মনোজ মিত্রের ছবি – ্আন্তর্জাল