প্রীতম বসুর - “পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’’
ডাঃ সুকুমার সেনের (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস) মতে “১২০০ হইতে ১৪৫০ অব্দের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যের কোন নিদর্শন তো নাই-ই, বাঙ্গালা ভাষারও কোন হদিস পাওয়া যায় না।” কেন? এর কারণ কি ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় আর তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শনগুলি মঠ-বিহারের সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা, মুসলিম শাসকদের বাংলা সাহিত্য ও রচনার পৃষ্ঠপোষকতা না করা, কাগজ না থাকায় সংরক্ষণের অভাব, না অন্য কিছু যা এখনও রহস্যাবৃত?
প্রবাসী যে কয়েকজন বাঙালি সাহিত্যপ্রেমী মাতৃভাষাকে ভালবেসে বাংলা সাহিত্যের সেবা ও সমৃদ্ধিসাধন করে চলেছেন সেই ঘরানার অন্যতম হলেন আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক রাজ্যের অ্যালবানি-নিবাসী সাহিত্যিক প্রীতম বসু। ‘অবসর’-এর আগের সংখ্যায় পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি তাঁর প্রথম প্রকাশিত (২০১৩) উপন্যাস ‘ছিরিছাঁদ’ সম্পর্কে। ১
এবারের আলোচ্য গ্রন্থটির প্রকাশ ২০১৫তে। তবে দেরিতে এলেও নিজস্ব রচনাশৈলীর মাধ্যমে বাংলাপ্রেমী পাঠকমহলে রীতিমত সাড়া জাগিয়ে তুলেছেন প্রীতম বসু, তাঁর রচিত ও প্রকাশিত সাতটি গ্রন্থের প্রতিটি পাঠকমহলে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এযাবৎ প্রকাশিত অধিকাংশ গ্রন্থগুলিতে তাঁর সাহিত্যের যে ধারা প্রকাশ পেয়েছে তা হল ভারতীয় পরিবেশে ও পটভূমিতে ইতিহাস-স্থাপত্য-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-লোকসংগীতের এক রহস্যময় জগতের দ্বার আধুনিক যুগের চরিত্র ও পরিবেশের মিশ্রণে পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করা- যার স্বাদ আমরা কিছুটা পেয়েছি এককালে বঙ্কিম-রমেশ দত্ত-শরদিন্দুর রচনায়- যদিও সেগুলি মূলতঃ ইতিহাস-ভিত্তিক কল্পকাহিনি। পিরিয়ড কাহিনির মধ্যে রহস্যময়তার পরিবেশ এনে ইদানীংকালে ইংরেজিসাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ বা ‘লস্ট সিম্বল’-এর মত উপন্যাসগুলি। তবে প্রীতমবাবুর উপন্যাস কিছুটা সমধর্মী হলেও কোনমতেই তাদের সমধারা বা অনুসরণ নয়, বরং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বাংলাসহ এই দেশের সাহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।
আধুনিক সময়ে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে কাহিনির সূত্রপাত, তারপর সময় পিছিয়ে গেছে ‘ওপাড়া’, অর্থাৎ ইতিহাসের হাত ধরে মধ্যযুগে। কাহিনির মূল হোতা কালাচাঁদ, যার মুখ্য জীবিকা চৌর্যবৃত্তি। সে একটি পুঁথি এনে পাঁচমুড়োর ক্ষয়িষ্ণু বংশের বৃদ্ধ জমিদার সদানন্দ ভট্টাচার্যকে দেখায়, তার দাবি- এটি দ্বিজ চণ্ডীদাসের ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের রচনা। সদানন্দ পড়তে শুরু করলেন-
”বিধুর পাছেঁত নেত্র পক্ষশূন্য।
নবহুঁ নবহুঁ গীত রসে পুণ্য।।”
সংকেতে রচনার সময় বোঝান হচ্ছে- বিধু, মানে চাঁদ- একে চন্দ্রর এক, তিনে নেত্রর তিন, পক্ষ- দুই, আর শূন্য, অর্থাৎ ১৩২০। এটা শকাব্দ, সঙ্গে ৭৮ জুড়লে হয় খ্রিস্টাব্দ। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, খটকাটা তার পরেই। কালাচাঁদের আনা পুঁথি পড়ছেন সদানন্দ, প্রাচীন বাংলা লিপি আর সাহিত্যে তাঁর জ্ঞান অপরিসীম।
“বাশুলি আদেশ শুনি গৌরচন্দ্রিকা ভণি
পদাবলী রচে চণ্ডীদাসে।
নাহিআঁ যমুনা নীরে রাধিকা উইল তীরে
যমুনা উছলিল উচ্ছ্বাসে।”
এবার রাগে ক্ষেপে উঠলেন সদানন্দ। এ তো ডাহা জোচ্চুরি! গৌরচাঁদ, অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের জন্ম চণ্ডীদাসের ৭৮ বছর পরে। তাঁর নামেই প্রচলিত হয় বৈষ্ণব সাহিত্য শুরু করার আগে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ শব্দটি। তাহলে চণ্ডীদাস কেমন করে গৌরচন্দ্রিকা দিয়ে কাব্য-উপাখ্যান শুরু করেন? রামের জন্মের আগেই রামায়ণ! তবে কাহিনি এখানেই থেমে যায় না, বরং নতুন করে শুরু হয়।
বাংলার ভাগীরথী তীরের অখ্যাত গ্রাম পাঁচমুড়োর একটি হারিয়ে যাওয়া পঞ্চানন শিবের মন্দির আর তাকে নিয়ে রচিত লুপ্ত মঙ্গলকাব্য পঞ্চাননমঙ্গল নিয়ে এই গল্প। কেন আর কিভাবে পঞ্চমুখ শিবের মূর্তিসহ একটা আস্ত মন্দির হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, তার রহস্য, পুনরুদ্ধার, আর সবকিছুকে ছাপিয়ে এক আন্তর্জাতিক অপরাধ-চক্রের দুরভিসন্ধি, সব মিলেমিশে আছে এই রুদ্ধশ্বাস উপন্যাসে। গল্পের অবশ্য প্রয়োজনে বার বার উঠে এসেছে এই বাংলার ইতিহাস, প্রাচীন ভারতের সুমহান ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ। এই সূত্রে লেখক একটি আস্ত মঙ্গলকাব্য লিখে ফেলেছেন চতুর্দশ শতাব্দীর অধুনালুপ্ত বাংলাভাষায়। এই ভাষা চর্যাপদের সন্ধাভাষার থেকে পৃথক, জয়দেবের সংস্কৃত নয়, বৌদ্ধশাস্ত্রের পালি নয়, বিদ্যাপতির অবহট্ট-মৈথিলী-ব্রজবুলির সঙ্গেও তেমন মিল নেই আর লিপিও অনেক আলাদা। বখতিয়ার খিলজির নালন্দা-বিক্রমশীলা-ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় আর মহাবিহার ধ্বংস, প্রচুর প্রাচীন পুঁথি-পাণ্ডুলিপি সমেত গ্রন্থাগারগুলি পুড়িয়ে ফেলা (যদিও ইতিহাসকার মিনহাজউদ্দিন হয়ত ইচ্ছে করেই ১৭ জন অশ্বারোহীর দ্বারা গৌড়বিজয় সম্বন্ধে লিখেছেন অথচ এড়িয়ে গেছেন খিলজি-কর্তৃক নালন্দা-ধ্বংসের প্রসঙ্গটি) আর বহু মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি বিদেশী শাসক আর চোরাকারবারিদের হাতে বিদেশে পাচার হওয়া সত্ত্বেও চণ্ডীদাসের বাংলাভাষার পদাবলীর প্রায় সমস্ত নিদর্শনগুলি রয়ে যায়। যেমন-
”সখি কে বা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
কিংবা-
“কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈয়ো তুমি।”
কিন্তু এসব তো আধুনিক বাংলা! তার একটা সঙ্গত ব্যাখ্যা দিলেন সদানন্দ যে পরবর্তী কীর্তনিয়াদের মুখে মুখে চণ্ডীদাসের চতুর্দশ শতকের প্রাচীন বাংলার রূপান্তর ঘটে এযুগের কথ্য ভাষায় ফিরেছে। চণ্ডীদাসের মূল ভাষা দেখা যাবে তাঁর রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, অশ্লীলতার কারণে যা নাকি মহাপ্রভুর পছন্দ হয়নি বলে তেমন জনপ্রিয়তাও লাভ করেনি, তাই এর মূলরূপটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সে কেমন ভাষা?
“আহ্মে তোর বড়ায়ি তোহ্মে মোর নাতি।
চিন্তিবোঁ তোহ্মার হিত পরাণশকতি।।”
না, পাঁচমুড়োর মন্দিরগাত্রের শিলালিপিগুলোর আংশিক উদ্ধার হলেও মূল পঞ্চাননমঙ্গলের কোনও হদিস পাওয়া গেল না। অগত্যা খুনে-পাগলা আরবি ভিলেনের হাত থেকে বাঁচতে আস্ত একটা মঙ্গলকাব্য সেকালের বাংলায় লিখে ফেললেন ইতিহাসের পাড়ায় টাইম-মেশিনে ঘোরাফেরা করার ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হরু ঠাকুর। সঙ্গে রইল শিলালিপি থেকে উদ্ধার করা কিছু মন্ত্র যা কি শুধু মন্ত্র না ছদ্মবেশে অন্য কিছু? হরুর গণিতজ্ঞ ভাগ্নে বদন তার রহস্যের উদ্ঘাটন করল, যা জেনে চমকে উঠতে পারে আজকের বিশ্ব। বইটির সম্ভাব্য পাঠকের কাছে সব রহস্যের উন্মোচন করে দিতে পারিনা, তবু একটা নিদর্শনে তাঁদের প্রাচীন ভারতের গণিত ও বিজ্ঞান-চর্চা সম্বন্ধে সম্যক আগ্রহ জাগবে এই আশা।
“নাহি তবেহোঁ আছহ আহ্মে সহ্মে জানি।
দেব তুহ্মি নিরাকার আন্তরে মানি।।
অব্যয় অক্ষয় দেব সদা শিব মুক্ত।
মায়ামোহ সংসারত হৈবে নাহি যুক্ত।।
জড়ের হনন করী দিলেঁ নিজ থান।
দান পরিহরি বামে দশগুণ দান।।”
আপাতদৃষ্টিতে ঈশ্বর ও শিবের সম্বন্ধে দার্শনিক বর্ণনা বা স্তব মনে হলেও এটা কি শূন্যের স্বরূপ আর দশমিক পদ্ধতি সম্বন্ধে আর্যভট্টের ৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা “স্থানাৎ স্থানম্ দশগুণম স্যাৎ” অর্থাৎ একঘর বামে সরিয়ে সেখানে শূন্য বসালে সংখ্যার মান দশগুণ বেড়ে যায়, তাই সূচিত করছে না?
পাঠক ভ্রমিত হবেন না, প্রাচীন ভারতে সাংখ্য-বৈশেষিক-পিঙ্গল আর ব্রহ্মগুপ্ত-আর্যভট্ট-ভাস্কর থেকে শুরু করে এই বাংলার গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর পর্যন্ত অশেষ গুণীজনসমাহার-সমন্বিত গণিত-জ্যোতিষ-বিজ্ঞানের গৌরবময় ইতিহাসকে মাথায় রেখেই বলছি, এই পুস্তকে লিখিত প্রাচীন বাংলার গণিতের ধাঁধাঁগুলি থেকে শুরু করে ১৪০০ সালের বাংলাভাষায় আস্ত একখানা পঞ্চাননমঙ্গল-কাব্য লিখে ফেলেছেন এই কথাশিল্পী। বইটির প্রতি অধ্যায়ে চমকের পর চমক থাকলেও প্রীতমবাবু একে ঘিরে আত্মপ্রচার নয়, আন্তরিকভাবে চাইছেন তাঁর রচনার মাধ্যমে বিশ্বের আপামর বাঙালি ও বঙ্গভাষাপ্রেমী মানুষ জানুন এই বাংলার গৌরবময় ইতিহাস, আগ্রহ বাড়ুক বাংলাভাষা-সংস্কৃতি ও তার ঐতিহ্য সম্পর্কে।
পরিশেষে জানাই, গ্রন্থটি লেখার সুবাদে যে মঙ্গলকাব্য রচনা করতে হয়েছে লেখককে, তার খানিকটা নিদর্শন না দিলে অন্যায় হবে, তবে এ নিয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা নিরর্থক। আপনাদের মনে থাকতে পারে, ১৮৭৭ সালে ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর প্রথম কয়েকটি পদ প্রকাশিত হবার পর অনেকের ধারণা হয়েছিল যে এগুলি ১৩-১৪ শতকের কোন মৈথিল কবির অপ্রকাশিত রচনা! গল্প হলেও পরশুরাম তাঁর চরিত্র কেদার চাটুজ্যের মুখ দিয়ে দক্ষিণরায়ের পাঁচালি বা রায়মঙ্গল রচনা করে বলিয়েছেন, এই নিয়ে বিস্তর কৌতুকও করেছেন তিনি। এবার পঞ্চাননমঙ্গলের সূচনার অংশটুকু দিয়ে আলোচনায় ইতি টানি, বাকিটুকু গ্রন্থপঠনের জন্যে তোলা থাক। আর একটা কথা জানানো আবশ্যক। লেখকের নিজস্ব কাব্য আর আখ্যানভাগ বাদ দিলে বাকি তথ্যাদি সম্পূর্ণ ইতিহাস-নির্ভর, পাঠককে সেটুকু বুঝে নিতে হবে। তবে গ্রন্থে ব্যবহৃত সেযুগের ভাষা দুর্বোধ্য হতে পারে ভেবে পরিশিষ্টে গ্রন্থকার ব্যবহৃত অপ্রচলিত শব্দাবলীর একটা তালিকা জুড়ে দিয়েছেন, খুব সঙ্গত কারণেই।
“জপয়ে কবিরাজ পঞ্চানন নাম।
বেগবতী নইকুলে পঞ্চমুণ্ড গ্রাম।।
পরজা সহ্মে অন্নপাণি ছছন্দে পাআঁ।
পঞ্চাননে পুজে কামোদ ধানশী গাআঁ।।
বামে বহে বেগবতী ডাহিনে পাথর।
মাঝত পঞ্চমুণ্ড গ্রাম পাছে পান্তর।।
সরোঅর দহ এক পাণি বার মাষ।
পঞ্চানন দেব দুআর তারি পুব পাস।।
গহন আন্ধারী বন পাথরের পার।
বনত আন্ধারে বাঘ হাথী দুরুবার।।
পঞ্চানন দেব মোর আইলাহা সপনে।
পঞ্চানন তত্ত্ব তেএঁ কবিরাজ ভনে।।” ………
(কামোদ ধানশী = উত্তর ভারতীয় সংগীতের একটি রাগিনী, কামোদ-ধনশ্রী)
উপন্যাস- ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’
লেখক ও প্রকাশক- প্রীতম বসু
৯সি শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন
কলকাতা ৭০০ ০৫৪
প্রচ্ছদ- দেবাশিস রায়

প্রীতম বসুর এযাবৎ প্রকাশিত রচনা-
ছিরিছাঁদ
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল
চৌথুপীর চর্যাপদ
অন্ত্যমিলের অঙ্গনে
প্রাণনাথ হৈয়ো তুমি
কপিলাবস্তুর কলস
বিদ্বান ও বিদুষী