শচীন দেব বর্মণ এবং বাংলার কিংবদন্তি কবি-সুরকারেরা
বঙ্গীয় রেনেসাঁর বা নবজাগরণের শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে – রাজা রামমোহন রায়ের মতো সংস্কারকদের হাত ধরে – যাঁরা তাঁদের যুগান্তকারী কাজের মাধ্যমে বাঙালি এবং জাতীয় মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। এই আন্দোলন উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিকে গিয়ে শিখরে পৌঁছায়। এবং এই নবজাগরণ থেকেই জন্ম নেয়ে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে অসংখ্য মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁরা শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীতের মাধ্যমে জনমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিখ্যাত। তবে ওনার সঙ্গে ছিলেন অন্যরাও, যাঁদের কাজ লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি-সুরকার ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং, এঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, কাজী নজরুল ইসলাম।
এইসব মহান শিল্পীদের সৃষ্টি বাঙালিদের মধ্যে এতটাই লোকপ্রিয় যে হিন্দি ছবিতে প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি বাঙালি সুরকাররা মাঝেমধ্যেই সেই সুরগুলি ব্যবহার করে চলছেন বৃহত্তর শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করার জন্য…এবং সেই সুরাশ্রয়ী হিন্দিগান গুলি এখনো দেশব্যাপী শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছে। সত্যিই – music knows no boundaries.
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের অগ্রগণ্য সুরকার পঙ্কজকুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল এই রূপান্তরের পথপ্রদর্শক। পঙ্কজ মল্লিক ছিলেন পুরোপুরি রবীন্দ্রসংগীতে নিমজ্জিতপ্রাণ একজন মানুষ। বহু বাংলা ছবিতে উনি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করতেন, রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই; আবার হিন্দি ভাষায় রবীন্দ্রসংগীতের কিছু নন-ফিল্মি সংস্করণও নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করেছিলেন (যেমন – প্রাণ চায়ে চক্ষু না চায়ে / প্রাণ চাহে নয়ন না চাহে, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ / ধরতি কে উস পার) । অন্যদিকে রাইচাঁদ বড়াল ১৯৪৫ সালে হামরাহী সিনেমায় ‘জনগণমন’ গানটি প্রথম সর্বভারতীয় দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করেন – পরাধীন ভারতে, অর্থাৎ গানটি যখন জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠেনি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীতের সম্পূর্ণ আবহটাই ছিল রবীন্দ্র-পরিবেষ্টিত। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়ে যে ওনার অসংখ্য জনপ্রিয় সুরের মূল মোটিফ ছিল রবীন্দ্রসংগীত; এছাড়া উনি বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত সরাসরি হিন্দিতে রূপান্তরও করেছিলেন (যেমন “দো দো পাঙ্খা লাগাকে” (রাহগির) / “তোমার খোলা হাওয়া”)।
অনিল বিশ্বাস ও সলিল চৌধুরী থেকে শুরু করে বাপ্পি লাহিড়ী ও শান্তনু মৈত্র—প্রায় প্রত্যেক বাঙালি সুরকারই রবীন্দ্রসংগীত নামক অতলান্ত মহাসাগর থেকে কিছু-না-কিছু মণিমুক্তো কুড়িয়ে তুলেছেন।
আর এঁদের মধ্যে স্বকীয়তা, বৈচিত্র্য এবং শ্রোতার হৃদয়ে স্থায়ী প্রভাবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য নামটি হলো শচীন দেব বর্মণ।
শচীনদেব বর্মণের রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল, যদিও তিনি নিজের কণ্ঠে কখনো রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেননি ( শোনা যায়, এর পেছনে কিছু পারিবারিক, বা রাজনৈতিকও বলা যায়, কারণ ছিল)। তাঁর কিছু সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় – তাঁর বলিউড-পূর্ব যুগের বাংলা গান থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত। কখনো সেগুলি ছিল সরাসরি মূল রবীন্দ্রসংগীতের সুরের ভিত্তিতে তৈরি করা গান, কখনো সামান্য কিছু phrase বা শুধু নির্যাসটুকু ব্যাবহার করে নতুন সৃষ্টি, আবার কখনো বা এমনভাবে সুর গঠন করেছেন যেখানে কেবল একটা রাবীন্দ্রিক মেজাজ ফুটে উঠেছে কিন্তু সুরটা পুরোপুরিই ওঁর নিজের।
১৯৪৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দো ভাই’ ছবিতে গীতা রায় (দত্ত)-এর গাওয়া গান “মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া” এই ষোড়শী কিশোরীকে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি এনে দেয়। এই গানটি শচীনদেব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের “রোদনভরা এ বসন্ত”র স্থায়ী (বা “মুখড়া”) কে অবলম্বন করে সৃষ্টি করেছিলেন। সম্ভবত বলিউডে এটিই ছিল রবীন্দ্রসংগীত থেকে তাঁর প্রথম রবীন্দ্র-অনুপ্রেরণামূলক সৃষ্টি। এর আগে করা, ১৯৪৪ সালে কলকাতায় করা তাঁর শেষ বাংলা ছবিগুলোর একটি, ‘ছদ্মবেশী’ ছবির একটি গানে (“বন্দর ছাড়ো যাত্রীরা সবে” ) রবীন্দ্রসংগীত “বারতা পেয়েছি মনে মনে”-র সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
এ ধরনের রবীন্দ্র-ছোঁয়া শচীনদেবের সৃষ্টিতে প্রায়শই ফুটে উঠতো, কখনো বা অপ্রত্যাশিতভাবেই – almost like an inside joke.
১৯৫০ সালে ‘আফসার’ ছবিতে শচীনদেব “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে” গানটিকে সরাসরি অনুবাদ করে সৃষ্টি করেন বিখ্যাত “নয়ন দিওয়ানে” , যা সুরাইয়ার কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়, গীতিকার ছিলেন পণ্ডিত নরেন্দ্র শর্মা। হিন্দি ছবির গানে সঞ্চারীর ব্যবহার সাধারণত বিরল – শচীনদেব সহ সব বাঙালি সুরকারেরাই হিন্দি সুর করার সময় সঞ্চারীটা বর্জন করতেন – কিন্তু কর্তা এখানে সঞ্চারীটি বজায় রেখেছিলেন।
[অনেকের অজানা একটি তথ্য – এর চার বছর আগে, ১৯৪৬ সালে, এস. এন. ত্রিপাঠী ‘উত্তরা অভিমন্যু’ ছবিতে “লাজ ভরে ইস নৈনন মে” গানটি তৈরি করেন, যেটি অভিনেতা-গায়ক অশোক কুমার গেয়েছিলেন। এই গানটির সুর রবীন্দ্রনাথের “সেদিন দুজনে” গানের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়, যদিও অন্তরার সুর কিছুটা ভিন্ন ছিল। যেহেতু এস. এন. ত্রিপাঠী বাঙালি ছিলেন না, তাই প্রশ্ন থেকে যায়—অশোক কুমার বা ইউনিটের অন্য কেউ কি তাঁকে এই সুরের সন্ধান দিয়েছিলেন, নাকি তিনি অন্য কোথাও রবীন্দ্রনাথের মূল গানটি শুনে সেটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? এর উত্তর সম্ভবত আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।]
প্রায় এক দশক পরে, বিশ্ববরেণ্য পরিচালক বিমল রায়ের কালজয়ী ছবি ‘সুজাতা’ (১৯৫৯)-র শিরোনাম সংগীতে শচীনদেব আশা ভোঁশলেকে দিয়ে “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার” (বা “ওরে ঝড় নেমে আয়ে” – দুটো সুরের স্থায়ীর চলনই প্রায় সমান) গানের মুখড়ার সুরের ভিত্তিতে আধারিত প্রায় তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের একটা humming তৈরি করেছিলেন। ন্যূনতম বাদ্যযন্ত্র সহযোগে আশার মায়াবী কণ্ঠ সিনেমার শুরুতেই একটা আন্তরিক আর ঘরোয়া পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল।
শচীনদেবের আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গান যেগুলোতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়:
• জায়ে তো জায়ে কাঁহা (‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ১৯৫৪) / হে ক্ষণিকের অতিথি
• জলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে (‘সুজাতা’, ১৯৫৯) / একদা তুমি প্রিয়ে
[এটিকে বলিউডের প্রথম “টেলিফোন গান” বলে ধরা হয় (যেখানে নায়ক টেলিফোনের মাধ্যমে নায়িকাকে প্রেম নিবেদন করছেন)। এর পর থেকে এই কনসেপ্টটা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটি মনোরম সাক্ষাৎকারে মজরু সুলতানপুরী বর্ণনা করেন যে বিখ্যাত এই গানটির দৃশ্যায়নের আইডিয়াটা নাকি কর্তাই দিয়েছিলেন। গানটির জন্য উপযুক্ত কোনো সিকোয়েন্স খুঁজে না পাওয়ায় গানটি বাদ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বিমল রায় প্রথমে কর্তার কথায়ে গুরুত্ব দেননি, কিন্তু কর্তা ওনাকে বলেন, “এই গানটা থাকবেই, নাহলে আমি এই ছবিতে আর সুরই করবো না”…অগত্যা]
• তেরে মেরে মিলন কি (‘অভিমান’, ১৯৭৩) / যদি তারে নাই চিনি গো
‘অভিমান’ ছবির এই গানে যদিও রবীন্দ্রসংগীতের সাথে মিলটি সীমাবদ্ধ শুধু মুখড়ায়, সেটাকে catalyst করে কর্তা সৃষ্টি করেছিলেন একটি অবিস্মরণীয় ও মর্মস্পর্শী অন্তরা, যার মিষ্টত্ব, আমি বলব, মূল গানের অন্তরার থেকেও বেশি বইতো কম নয় ।
একবার কর্তা রসিকতার ছলে বন্ধুদের বলেছিলেন যে তিনি সম্প্রতি একটি হিট গানে জাতীয় সংগীতের একটি অংশ খুব সুনিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন – উনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন কেউ সেটা ধরতে পারে কিনা…এতই দক্ষতার সঙ্গে উনি কাজটা করেছিলেন যে বহুবার শোনার পরেও কেউ বুঝেতেই পারেনি যে তিনি বলছেন “জানে ওহ ক্যায়সে” (‘পিয়াসা’, ১৯৫৭) গানটির কথা । গানের মুখড়ার দ্বিতীয় ছত্র, “হমনে তো জব কলিয়া মাঙ্গি কাঁটো কা হার মিলা” -র কাঠামোটা উনি বানিয়েছিলেন “পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ” অংশের অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিবর্তন করে!
শচীনদেব হয়তো রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা বা মনের আন্তরিক সংযোগ থেকেই এইভাবে তাঁর গানে পরিচিত রবীন্দ্রসুরের এই ছোট ছোট টুকরোগুলো বিভিন্নভাবে– হয়তবা কিছুটা অবচেতন মনেই – অন্তরায়িত করে নিতেন। এই পরোক্ষ প্রয়োগের আরো কিছু উদাহরণ:
• পটদীপ রাগে আধারিত “মেঘা ছায়ে আধি রাত” (‘শর্মিলী’, ১৯৭১)-এর “সবকে আঙ্গন দিয়া জ্বলে রে” অংশটি রবীন্দ্রনাথের “লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণা খানি” থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত ।
• “অ্যায়সে তো না দেখো” (‘তিন দেবিয়া’, ১৯৬৫) এর সুরের বিন্যাস রবীন্দ্রনাথের “আমি তোমায় যত”র স্থায়ী বা মুখড়ার সঙ্গে বেশ মিলে যায়।
• “দুখী মন মেরে” (‘ফান্টুশ’, ১৯৫৬)-র এক জায়গায়ে একটা গিটার bridge শোনা যায়ে যেটা “পুরানো সেই দিনের কথা”র “সে কি ভোলা যায়” অংশটির মতো শোনায়।
[হ্যাঁ, এটা অবশ্য সকলেরই জানা যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই গানটি প্রায় সরাসরিভাবেই নিয়েছিলেন স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস-এর বিখ্যাত গান “Auld Lang Syne” থেকে।
• “জানে জিগর হায় হায়” (‘নও দো গেয়ারা’, ১৯৫৭)-র মুখড়ার চলনের সাথে “একটুকু ছোঁয়া লাগে”-র কিছুটা সাদৃশ্য আছে।
• “ইয়েহি তো হ্যায় ও” (‘সোলভা সাল’, ১৯৫৮) -র প্রথম লাইনটির সাথে “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়” গানের সুরের মিল আছে।
অনেকে বলেন যে “সচ হুয়ে সপ্নে তেরে” (‘কালা বাজার’, ১৯৬০)-র মুখড়ার সুর রবীন্দ্রনাথের “এপারে মুখর হল কেকা ওই” থেকে নেওয়া। তবে আমার মতে, এটি কাফি রাগের-এর একটা textbook চলন – এবং সেই কারণেই এই দুই গানের সুরের মধ্যে আপাত মিল রয়েছে, সম্ভবত এটা কাকতালীয়।
এবার আমরা সেই সময়ের বাংলার অন্যান্য কবি-সুরকারদের প্রসঙ্গে আসি।
বেহাগ রাগের একটি নির্দিষ্ট চলন আছে – সা-গা-গা-মা-পা-পা-নি-নি – যেটা এই বাংলার কবি-সুরকারদের বিশেষ প্রিয়। রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেন তাঁদের বিখ্যাত কিছু গানের মুখড়ায় এই সুরের ব্যবহার করেছেন। যেমন রজনীকান্তের স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, বঙ্গদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” এবং অতুলপ্রসাদ সেনের হৃদয়স্পর্শকারী “একা মোর গানের তরী” দুটি গানের প্রথম ছত্র এই চলনের উপর আধারিত । রবীন্দ্রনাথও এই চলনটিকে নিজের মতো করে “মনোহরণ চপল চরণ” (“তোরা যে যা বলিস ভাই”)-এ রূপান্তরিত করেছিলেন। কর্তা এই পরিচিত phrase টাকে নিয়ে গান বাঁধলেন – “লহরোঁ কে রেলে সঙ্গ ” (‘বাবলা’, ১৯৫৩, শিশু শিল্পী হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের গাওয়া) এবং পরে “ইয়ে তনহাই হায় রে হায়” (‘তেরে ঘর কে সামনে’, ১৯৬৩) । এছাড়া লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “আঁখ খুলতে হি তুম” (‘মুনিমজি’, ১৯৫৫) গানেও এই phrase টির স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
ডি. এল. রায় ছিলেন একজন অসাধারণ নাট্যকার, কবি ও সুরকার; তিনি আপাত সাধারণ, দৈনন্দিন বিষয়কে (প্রেম, বিরহ) কেন্দ্র করে মধুর গান রচনা করতেন… কিন্তু অনেক সময়েই তার আড়ালে লুকিয়ে থাকত জাতীয়তাবাদী বার্তা বা সঙ্কেত । কখনো বা সেগুলো ওনার ঐতিহাসিক নাটকের বিবেকের চরিত্রদের মুখ দিয়ে বলানো হতো – ব্রিটিশ প্রশাসনের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর জন্যই এই ধরনের decoy-এর প্রয়োগ।
- তাঁর একটি অতীব সুন্দর
ঘুমপাড়ানি গান, “আয় রে আমার সুধার কণা” -এর উপর ভিত্তি করে কর্তা বানালেন “ননহে কালি সোনে চলি” (সুজাতা)। এবারও উনি শুধুমাত্র মুখড়ার হুকলাইনটি ব্যবহার করে একটি মাস্টারপিস তৈরি করেছিলেন, যা গীতা দত্তের অনন্য, আবেগময় কণ্ঠ বেয়ে সারা দেশের অন্তত এক (বা তারও বেশি) প্রজন্মের পিতামাতাদের জন্য default lullaby হয়ে গেছিল।
শচীনদেবের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। শচীনদেবের কুমিল্লার পৈত্রিক বাড়িতে নজরুল – এবং সেই সময়ের বাংলার গণ-লোক সংগীতের অন্যান্য দিকপালেরা, যেমন লালন ফকির (দার্শনিক-কবি-সুরকার যিনি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো মনীষীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন), জসীমউদ্দীন (পল্লীকবি-সুরকার যিনি শচীনদেবের জন্য “নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে” এবং “রঙ্গিলা রঙ্গিলা” এর মতো কিম্বদন্তী গান সৃষ্টি করেছিলেন) এবং সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (শচীনদেবের প্রথম দিকের কিছু গানের সুরকার, যেমন “আলো ছায়া দোলা” এবং “প্রেমেরও সমাধি তীরে” – যে গানগুলি ছাড়া শচীনদেবকে ভাবাই যায় না) – প্রায়ই একত্রিত হতেন। এবং সেই সমাবেশে সঙ্গীতচর্চা, সঙ্গীত নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, আলোচনা, ইত্যাদি অবাধে প্রবাহিত হত। অতি অল্পবয়েসে শচীনদেব এইসব মহীরুহদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন, এবং এই সাঙ্গীতিক osmosis-কে যে পুরোপুরি অন্তরায়িত করে নিতে পেরেছিলেন সেটা ওনার পরবর্তীকালের output দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় – উনি গ্রামবাংলা ছেড়ে থাকতে পারেন, কিন্তু বাংলা ওঁকে কোনদিনই ছাড়েনি।
আহির-ভৈরব রাগে রচিত নজরুলের বিখ্যাত গান “অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি”-এর কর্তার অবিস্মরণীয় পুনর্নির্মাণ “পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে” (‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’, ১৯৬৩) তো আমরা সকলেই জানি। শোনা যায়, এই নজরুল-সৃষ্ট গানটির গঠন প্রক্রিয়ার সাথে কর্তা নিজেও যুক্ত ছিলেন (বা এটি হয়তো তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরি হয়েছিল), আদপে দুটি গানই আহির-ভৈরবের একটি প্রচলিত বন্দিশের আধারে তৈরি, তাই হয়ত এটাকে ঠিক “নজরুল অনুপ্রাণিত” বলা উচিত নয়।
জসীমউদ্দীন এবং হিমাংশু দত্তের মতো নজরুলও বিশেষ করে শচীনদেবের জন্য কিছু গান লিখেছিলেন এবং সুর করেছিলেন – পরে সেগুলো শচীনদেব নিজে, এবং তাছাড়া সলিল চৌধুরী এবং রাহুলদেব, হিন্দিতে রূপান্তরিত করেছিলেন ।
“পদ্মার ঢেউ রে” গানটি কর্তার জন্য লেখা নজরুলের এক অনন্য সৃষ্টি – কর্তা পরে এই সুরটিকে নিজের মতো করে হিন্দিতে রূপান্তর করেছিলেন ‘আফসার’ (১৯৫০) সিনেমার “পরদেসি রে” গানে। মূল গানে আর্তি ও বিষণ্ণতাকে ওনার গায়কীতে উনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা তুলনাহীন – ওনার মতো করে গাওয়া তো আর কারো পক্ষে সম্ভব না… কিন্তু সুরাইয়ার অপরূপ কণ্ঠশৈলী ও শ্রুতিমাধুর্যের জন্য “পরদেসি রে” গানটাও হৃদয়ে সমানভাবে দোলা দিয়ে যায়।
কর্তার নজরুল-সৃষ্টির হিন্দি রূপান্তর তুলনামূলকভাবে কম। উল্লেখযোগ্য বলতে লতার গাওয়া “ম্যায় আলবেলি রুমঝুম রুমঝুম” (‘বুজদিল’, ১৯৫১)-র মুখড়া, যাতে “মেঘলা নিশি ভোরে”-র কিছুটা ছায়া পাওয়া যায় – তবে এখানে মিলটা কিছুটা প্রছন্ন।
[সলিল চৌধুরী পরে এই গানটির মুখড়ার মোটামুটি সরাসরি রূপান্তর করেছিলেন গুলজারের প্রথম নির্দেশিত ছবি “মেরে আপনে” (১৯৭১)-এর জন্য; যদিও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া সেই গানটি (“রোজ অকেলি আয়ে” ) ছবিতে শেষ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।]
এইভাবে, সর্বভারতীয় শ্রোতাদের অজান্তেই শচীনদেব বর্মণ তাদের বাংলার কবি-সুরকারদের সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে, কয়েকটি জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের বাইরে, এই মহান স্রষ্টাদের জাদুর ভাণ্ডারের এই মণিমাণিক্যগুলি (কণামাত্র হলেও) বঙ্গদেশের বাইরে চিরকাল অজ্ঞাতই থেকে যেত।
টীকা – গানের অংশের ওপর ক্লিক করলেই উদ্দীষ্ট গানটি শোনা যেতে পারে।
চিত্রঋণ – অন্তর্জাল
1 Comment