আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি - ইনকা সভ্যতা
রেড ইন্ডিয়ান বলে আমরা যাদের জানি তাদের নেটিভ আমেরিকান বলাই ভালো। ইউরোপীয়দের দখলদারির পূর্বে নেটিভ আমেরিকানদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা জুড়ে বাস করত। তাদের বেশিভাগ জাতিগোষ্ঠী এখন প্রায় বিলুপ্ত এবং ইতিহাসের আড়ালে চলে গেলেও দুটি শক্তিশালী ও মেধাবী জাতি তাদের শৌর্য বীর্যের কথা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তারা হল প্রাচীন ইনকা ও মায়া সভ্যতার রূপকার।
দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় ১৫ শতকে (১৪৩৮ সালে) যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা ইনকা সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। ইনকা শব্দের অর্থ ‘সূর্য দেবতার সন্তান।’ আর কোস্কোর অধিপতিকে (ইনকা সম্রাট) সূর্য দেবতার সন্তান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তাই স্পেনীয়রা সাম্রাজ্যটির নাম দেয় ইনকা সাম্রাজ্য।
ইনকা সাম্রাজ্যের প্রথম দিকের ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়। স্পেনীয়দের লেখায় কিছু ধারণা পাওয়া যায়, কোস্কো অঞ্চলে যাত্রা শুরু হলেও ক্রমে বর্তমান আইয়াকুচো, পেরু ইত্যাদি অঞ্চলের অনেকটা অংশ নিয়ে ইনকাদের বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অনেকের ধারণা, ইনকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানকো কাপাক। ইনকাদের রাজ্য বিস্তারে সবচেয়ে সফল রাজা ছিলেন পাচাকুতি। তিনি সাম্রাজ্যকে আগের চেয়ে দশ গুণ বড় করে তোলেন। কেচুয়া, ইনকা ভাষায় কথা বলা লোকেদের তিনি সরকারী চাকরি দেন। আর যারা কেচুয়া ভাষায় কথা বলতে পারত না তাদের বলা হত সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হবে, রাস্তা, ফাঁড়ি, মন্দির তৈরী করতে হবে। রাস্তাগুলো চিত্তাকর্ষক ছিল, সৈন্য ও ইনকা কর্মকর্তারা এমন রাস্তা বানিয়েছিলেন যে দুটি মহাসড়ক ছিল। একটা আন্দিজ বরাবর, আরেকটি উপকূল বরাবর। বর্তমানে দক্ষিন আমেরিকায় যত রাস্তার বিকাশ ঘটেছে, সবই ইনকাদের বানানো রাস্তার হাত ধরেই সম্ভব হয়েছে। কারণ রাজধানী কোস্কো থেকে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যকে চালনা করতে উন্নত সড়ক ব্যবস্থা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার তারা চাকার ব্যবহার জানত না। এই বিস্ময়কর উন্নত সড়ককে বলা হয় ‘ইনকা ট্রেইল।’ কৃত্কৌশলের দিক থেকে যা ছিল সময়ের দিক থেকে অনেক বেশি উন্নত।
মনোরম উপত্যকা ও দুর্গম গিরির ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে ইনকা ট্রেইল। আজও ধ্বংসাবশেষ দেখে চেনা যায়। কোনও কোনও পথ ১৬০০০ ফুট উপরে। প্রধান রাস্তায় সামরিক ও অসামরিক সকলেই চলত আর চলত লামা ক্যারাভান। সাধারণ লোকের সে পথে চলতে গেলে ইনকা সম্রাটের অনুমতি লাগত। পথের মাঝে ছিল সেতু, সেতুতে টোল ব্যবস্থা ছিল।
ইনকা সাম্রাজ্য পরিচালনা করত রাজকীয় পরামর্শসভা। পুরোহিত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির সমন্বয়েই গড়ে উঠত রাজকীয় পরামর্শসভা। এরা সম্পর্কে সকলেই আত্মীয়। সম্রাট বিয়ে করতেন নিজের বোনকে, সাধারণত রাজার বড় ছেলেই সম্রাট হত। ইনকা যোদ্ধারা অন্য নগর আক্রমণ করলেও তাদের প্রধানকে হত্যা করত না, যদি সে ইনকা শাসন মেনে চলত, কর দিত, শস্য ভান্ডার মজুদ রাখত আর বিদ্রোহ না করত। ইনকাদের কর ব্যবস্থা ছিল কঠোর, মেয়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণে কাপড় বুনতে হত। পুরুষরা কাজ করত সৈন্যবিভাগে অথবা খনিতে। সাধারণ জনগনকে সরকারের কাজ করে কর শোধ করতে হত।
চাষবাস করা হত উপত্যকা বা পাহাড়ের ঢালে। ইনকাদের খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিল খুব উন্নত, রাজার আদেশে জনগণকে শস্যের একাংশ রাখতে হত সংরক্ষণের জন্য। সাম্রাজ্য জুড়ে ছিল স্টোর হাউজ, সেখানে ৩ থেকে ৭ বছরের খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখা হত। এমনকি মাংস শুকিয়ে নুন দিয়ে রাখা হত।
ইনকাদের প্রধান খাদ্য ছিল আলু ও ভুট্টা। মানবসভ্যতায় আলু ইনকাদের অবদান। ওরা ওল ও খেত আর খেত সমুদ্রের তাজা নীল শ্যাওলা। লংকা চাষ করত, গিনিপিগ ও লামার মাংস খেত। এছাড়াও খেত সামুদ্রিক মাছ। সাম্রাজ্যের পশ্চিমে ছিল প্রশান্ত মহাসাগর আর বিখ্যাত টিটিকাকা হ্রদ। তাই মাছের অভাব হত না। এই মাছ মাংসের সঙ্গে খেত চিচা নামে পানীয়, যা তৈরী করত ভুট্টা পিষে। এই পানীয় এখনও পেরুতে খুব জনপ্রিয়।
বেশিরভাগ ইনকা মানুষেরা ছিল কৃষক বা পশুপালক। ওরা আলপাকা বা লামার পালত। আলপাকা ও লামার উল থেকে তাদের নিজস্ব পোশাক ও কম্বল তৈরী করত। সকলেই স্যান্ডেল পরত। ইনকারা যৌথ পরিবারে থাকত, ওদের বাড়িগুলো তৈরী করত পাথর বা অ্যাডোবি, অর্থাৎ পোড়া মাটি দিয়ে। বাড়ির ছাদ তৈরী করত শুকনো ঘাস দিয়ে।
ইনকারা মৃত্যুর পরে তাদের দেহ মমি করে রাখত, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে যেমন বিয়ে বা ফসল কাটার মরশুমে মমিগুলো বাইরে বের করে আনত। ইনকা সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের জয়যাত্রার বিশেষ উপকরণ বলে তারা মনে করত উপাসনা। সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য যেসব প্রথা সবথেকে ফলপ্রসূ বলে মনে করা হত তা হল, বলি প্রথা। আর সেটা যদি শিশুবলি হত তাহলে সব থেকে ভালো।
বর্তমানেও কিছু কিছু সমাজ এর থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া লাগলেও পুরনো কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি এখনো বজায় আছে। আজ থেকে ৮০০–৯০০ বছর আগে ইনকা সাম্রাজ্য তা থেকে মুক্ত ছিল না। শিশু সবসময়েই নিষ্পাপ, তাই কোনো খারাপ মনোবৃত্তি তাদেরকে স্পর্শ করে না। তাই তার কদর দেবতাদের কাছে সব থেকে বেশি। এই বিশ্বাস থেকে ইনকা সমাজে ‘কাপাকোচা’ অর্থাত শিশুবলি প্রচলন ছিল। আর এইজন্য অ্যান্ডিজের বিভিন্ন পবিত্র চূড়াগুলি নির্বাচন করা হত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল স্বর্গ থেকে সেইসব চূড়াগুলির দূরত্ব কম। দেশের কোনো বিজয় বা আগামী বছর যাতে ভালো ফসল হয় তার জন্য এই অনুষ্ঠান করা হত। আর এমনই একটি কাপাকোচার সাক্ষী ছিল একটি কিশোরী ও তার দুই শিশুসঙ্গী।
১৯৯৯ সালে যখন এই তিনটি দেহ উদ্ধার হয়, গবেষণায় দেখা যায় কুমারী কিশোরীটির বয়স ছিল আনুমানিক ১২–১৪ বছরের মধ্যে এবং শিশুদুটির বয়স ছিল ৬–১০ বছরের মধ্যে । পরে ডি এন এ পরীক্ষায় জানা যায় মেয়ে দুটি দুই বোন ছিল। দেহ্পরীক্ষা করে জানা যায় দুই বছর ধরে এদের আলাদা রাখা হয় কোনো পুরোহিত বা রাজ প্রতিনিধির তত্ত্বাবধানে, নিজেদের চরম সমর্পণের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি করতে। তারপর তাদের ভালো কাপড়, সোনার গহনা পরিয়ে হাজির করা হয়েছিল পর্বতের পাদদেশে। সেখানে বিশেষ পুজো অর্চনা সেরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পর্বত চূড়ায়, রাস্তার কষ্ট লাঘব করার জন্য তাদের চিবোতে দেওয়া হয়েছিল কোকোপাতা আর ভুট্টার তৈরী বিশেষ মদ চিচা। এরপরে পর্বতের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল গুহার ভিতরে।
৫০০ বছর পরে নৃতত্ববিদ য়োহান রাইনহার্ড (Johan Reinhard) যখন সেই গুহার দরজা খুলেছিলেন তিনি অবাক হয়ে দেখেছিলেন উজ্জ্বল পোশাক পরিহিত একটি কিশোরী দেওয়ালে হেলান দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে। উচ্চতা ও শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে তার দেহ পুরোপুরি অবিকৃত অবস্থায় আছে। দেহগুলো ছিল প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত মমি। যার ফলে তাদের মস্তিষ্ক ও এতটুকু নষ্ট হয়নি। পাকস্থলীতে শেষ হওয়া খাদ্য তখনও বিদ্যমান আর ঠোঁটের নীচে থেকে গিয়েছে চিবোনো কোকো পাতার অবশিষ্ট। এখনও আর্জেন্টিনার Museum of high Altitude archeology-এ carrier-র তৈরী বিশেষ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে তাদের দেহ সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের দেহ থেকে সেই সময়ের নানা বিষয় জানার চেষ্টা করা হয়।
ইনকারা ছিল খুবই ধর্মপ্রাণ, যার জন্য তারা শিশু বলি দিতে দ্বিধা করত না। তারা ভাবত যে কোনো মূহুর্তেই অমঙ্গল হতে পারে। এইজন্য ইনকা সমাজে পুরোহিতদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইনকা সমাজে নারী পুরোহিতও ছিল। মেয়েরা ঋতুমতী হলে নারী পুরোহিতরা চুল আঁচড়ানো উত্সব করতো। মেয়েটি তখন নতুন নাম নিত। এই সময় সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে পাঠানো হত কোস্কোতে, মেয়েটি সম্রাটের স্ত্রী হবে।
ইনকারা খুব উন্নত হলেও তাদের কোনো লিখিত ভাষা ছিল না। পরিবর্তে তারা রেকর্ড রাখার জন্য কুইপু নামক গিঁটযুক্ত দড়ি ব্যবহার করত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে গিঁটের স্টাইল এবং স্ট্রিংয়ের রঙের মত জিনিসগুলোতে তথ্য রয়েছে। গবেষকরা কম্পিউটারের মাধ্যমে এই কোডগুলোকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
ইনকাদের মাচু পিচু নগরীর অবস্থান পেরুর কুজকো (প্রাচীন ইনকা রাজধানী) শহর থেকে ৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালার দু’টি সুউচ্চ শৃঙ্গের মধ্যবর্তী সরু উপত্যকায়। মাচু পিচুর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৫০০ ফুট উচ্চতায়, মেঘের দেশে। অধিকাংশ সময় মাচু পিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে উপর দিয়ে চলাচল করা বৈমানিকদেরও চোখে পড়েনা। স্থানটি আবিষ্কারের পর মাচু পিচু সম্পর্কে এমন সব তথ্য জানা যাচ্ছে যে সুইজারল্যান্ডের নিউ সেভেন ওয়ার্ল্ড ফাউনডেশন ২০০৭ সালে মাচু পিচুকে আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে ঘোষণা করেছে।
মাচু পিচু নগরীটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একেবারে অক্ষত অবস্থায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের কাছে ইনকা সভ্যতা বলতে মাচু পিচুর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। সেকারণে প্রতি বছর দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র এবং সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও দর্শনীয় স্থান দেখতে লক্ষ লক্ষ পর্যটক ছুটে যায় মাচু পিচু দেখতে। মাচু পিচুর একপাশের চূড়া থেকে একেবারে খাড়া ভাবে ৬০০ মিটার নীচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। গিরিখাত ও পাহাড় পর্বতের দ্বারা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এই শহরের অবস্থান সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উরুবাম্বা নদীর উপর দড়ির তৈরী সেতু ইনকা সৈন্যদের গোপন প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। মাচু পিচুর পশ্চিমদিকে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরী আরেকটি সেতু ছিল। এই সেতুর মধ্যে ২০ ফুট জায়গা ফাঁকা ছিল, প্রয়োজনমতো গাছের তক্তা দিয়ে সেতুর দুই অংশকে সংযুক্ত করা যেত। সেতুটির নীচে ১৯০০ ফুট গভীর গিরিখাত, তাই গাছের তক্তা সরিয়ে নিলে কোনো শত্রুর পক্ষে তা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য হত। এই শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই মজবুত।
ইনকারা সামরিকভাবে শক্তিশালী ছিল। দক্ষ সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা করে তারা বিশাল সাম্রাজ্য তৈরী করে। ইনকা প্রশাসনে সামরিক বাহিনী একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বও পালন করত। ইনকারা অনেক দুর্গ গড়ে তোলে, মূল দুর্গকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু উপদুর্গ গড়ে তোলা হয়। কেচুয়া ভাষায় যাকে বলা হত পুকারা। প্রত্যেক পুকারায় সাত–আটজন করে সৈনিক থাকত। ইনকাদের তৈরী দুর্গ পাথর নির্মিত এবং জোড়া দেবার জন্য কোনরকম সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ বা চুন সুড়কির মিশ্রণ এখানে ব্যবহার করা হয়নি। অ্যাশলার নামক এই নির্মাণ কৌশলে ইনকারা খুবই দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খন্ড এমন নিঁখুতভাবে কাটা হত যেন কোনরকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথরগুলো শক্তভাবে খাঁজে খাঁজে একটার পর আরেকটা বসে যায়। ইনকারা পাথরের এই নির্মাণ পদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল। তাদের নির্মিত পাথরের দেওয়ালগুলোর জোড় এতটাই নিপুণ যে একটা পাতলা ছুরিও তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনা। শুধুমাত্র খাঁজে খাঁজে পাথর বসিয়ে তৈরী হলেও এগুলো ছিল ভূমিকম্প প্রতিরোধী। ইনকাদের তৈরী দেয়ালগুলোতে বিস্তারিতভাবে প্রচুর সূক্ষ নকশা দেখা যায় যেগুলো ভূমিকম্পের সময় দেয়াল ধ্বসে পড়া রোধ করে। দেয়াল ও জানলাগুলো অসম চতুর্ভুজ আকৃতির এবং নীচ থেকে ওপরে ক্রমে ভেতর দিকে হেলানো। কোণাগুলো সাধারণতঃ গোলাকৃতি, ভেতরের দিকের কোণাগুলো মাঝে মাঝে কক্ষের ভেতরে অল্প হেলানো। এবং অনেক জায়গায় ইংরাজি ‘L’ আকৃতির পাথরখন্ড ব্যবহার করে বাইরের কোণাগুলো জোড়া দেওয়া হয়েছে। মাচু পিচুর দেয়ালগুলো ওপর থেকে নীচে একদম সোজা নয়। বরং এক সারি থেকে অন্য সারি কিছুটা হেলানো এবং এভাবেই দেয়ালগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। এর ফলে মাচু পিচু শহরটি অনেকগুলো ভূমিকম্প সহ্য করে এখনো ভালোভাবে টিকে আছে।
এ তো গেল বাড়ি ঘর তৈরির কথা। ইনকারা মাচু পিচু নগরীতে মন্দির, পার্ক তৈরী করেছিল। এখানে একশোটার মত সিঁড়ি আছে যার কোন কোনটা সবগুলো ধাপসহ একটামাত্র গ্রানাইট কেটে বানানো। ১৬টি ঝরনা বানিয়েছিল, যেগুলো পাথর ছিদ্র করে বানানো। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে মাচু পিচুর নগরপ্রান্তে তিনটি ভাগ ছিল। সেগুলো হল, পবিত্র এলাকা, বসতি এলাকা এবং উচ্চপদস্থ ও পাদ্রীদের এলাকা। পবিত্র এলাকায় আছে মাচু পিচুর ইন্তিউয়াতানা পাথর, সূর্য মন্দির এবং তিন জানলা ঘর। এসব উৎসর্গ করা হয়েছিল ইন্তি অর্থাৎ সূর্যদেবতাকে। স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনো অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘষে তাহলে আধ্যাত্মিক জগত দেখতে পাবে। স্পেনীয়রা ২০ শতকের আগে এই পাথর খুঁজে পায়নি, ফলে এটা ধ্বংস হবার হাত থেকে বেঁচে যায়। এই পাথরগুলো এমনভাবে স্থাপন করা যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিক নির্দেশ করে। একে ‘সূর্যের আঁকড়াও বিন্দু’ বলা হয়। ২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর বছরে এই দু’বার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে উপরে থাকে, ফলে এর কোনও ছায়া তৈরী হয় না। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একট ‘মহাকাশ ঘড়ি।’ এটি ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি মদের বিজ্ঞাপন কোম্পানি তাদের ভিডিও নির্মাণের সময় ৯৯০ পাউন্ড ওজনের একটি ক্রেন এই পাথরের উপর পড়লে কলমের আকারের একটা টুকরো ভেঙ্গে যায়। এরপরে বহু মানুষ মনে করে আত্মারা ইন্তিউয়াতানা ছেড়ে চলে গিয়েছে।
সবদিক দিয়ে উন্নত একটা সাম্রাজ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিজিত মানুষের ছোট দল প্রায়ই ইনকাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। ১৫২৬ সালের দিকে একজন ইনকা রাজার দুই পুত্র পরবর্তীতে কে শাসন করবে এই নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই সময়ই ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের আনা গুটি বসন্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ৬৫ শতাংশ মানুষ মারা যায়।
এদিকে স্পানিশরা খোঁজ পেয়েছিল কলম্বাসের কাছ থেকে যে সোনা দিয়ে সাজানো লোকেদের তিনি দেখেছেন। এই খবর পবার পরে ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বে ১৮০ স্পানিশের একটা দল সোনায় সাজানো মন্দিরের খোঁজে কোস্কো শহরে গিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে ইনকারা আন্দিজ পর্বতমালা থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্য খনন করে গয়না ও সোনার সুন্দর শিল্প তৈরী করেছিল। ইনকা শিল্পীরা সূর্য দেবতা ইন্তির মুখোশ তৈরী করেছিল সোনা দিয়ে। ১৫৩৩ সালে পিজারো ছলনার আশ্রয় নিয়ে ইনকা সম্রাটকে ঠকিয়ে সোনা ও রুপার পাত্র, গহনা গলিয়ে স্পানিশ আক্রমণকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এরপরে পিজারো ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়।
—-
তথ্যসূত্র–
১) https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/soheldigitals/29931804
২) আ. ব. প. পত্রিকা (২২ মে ২০২১)-Inca Civilization: গিঁট বাধা রঙিন সুতোর হরফে রহস্য সমাধান
https://www.anandabazar.com/world/college-student-decoded-the-inca-knots-dgtl-photogallery/cid/1277757?slide=1
৩) https://www.magiclamp.net.in/2016/01/blog-post_76.html?m=0
1 Comment