গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: প্রসঙ্গ সাবঅলটার্ন

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: প্রসঙ্গ সাবঅলটার্ন

সারা বিশ্বের চিন্তার জগতের সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি-দর্শনচর্চার বিস্তারিত প্রেক্ষাপটে, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অতুলনীয় অবদানের কোনও খতিয়ান বা সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ এই লেখকের আয়ত্তের বাইরে। স্পিভাকের চিন্তাধারা বিকাশের পথ এবং তাঁর স্বকীয় ভাষার মাধ্যমে সেই চিন্তার প্রকাশ: দুই-ই অসম্ভব জটিল। স্পিভাক-চর্চা দীর্ঘ অধ্যবসায় এবং ধৈর্যের ব্যাপার, এর কোনও ‘মেড-ইসি’ নেই। তাই, এই অতি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে, স্পিভাকের সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ একটি প্রবন্ধ, “Can the Subaltern Speak?”, নিয়ে আলোচনা করব।

মূল প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে; প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮-তে। পরবর্তীকালে গায়ত্রী প্রবন্ধটি নিয়ে নানা জায়গায় আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে, ২০১৮ সালে, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এই প্রবন্ধটি সম্বন্ধে বাংলায় আলোচনা করলেন। সেই বাংলা বক্তৃতাটির প্রসঙ্গও আমাদের আলোচনায় আসবে। তবে একটা কথা প্রথমেই পরিষ্কার করে বলে নিতে চাই: সাবঅলটার্ন বিষয়ক ইংরেজি প্রবন্ধ ও বাংলা বক্তৃতায় ব্যবহৃত স্পিভাকের ইংরেজি ও বাংলা ভাষা (বিশেষত বাংলার ক্ষেত্রে, তার আপাত-মৌখিক-সারল্যের ফাঁদকে শিরোধার্য করে) শ্রোতা/পাঠককে সবসময় এক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে এনে ফেলে, যেখানে বক্তব্যের সহজ ও নিশ্চিত কোনও অর্থ-নিষ্কাশন কঠিন হয়ে পড়ে। তাই, স্পিভাকের প্রবন্ধ বা বক্তৃতার কোনও ‘মান্য’ ভাষ্য-রচনা আমার বুদ্ধির সীমার বাইরে। বরং তাঁর বক্তব্য, আমার বিদ্যাবুদ্ধির সীমাবদ্ধতাহেতু, হাজার না-বোঝার মধ্যেও নিজের মতো যতটুকু বুঝেছি, তা-ই পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

প্রবাসজীবন ও গবেষণাঃ

স্পিভাকের দীর্ঘ প্রবাসজীবনে বাংলা ‘একাদেমিয়া’-র সঙ্গে তাঁর যোগ একটি তুলনামূলক সাম্প্রতিক ঘটনা। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী গায়ত্রী বাংলা তথা ভারত ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন আজ থেকে চৌষট্টি বছর আগে: ১৯৬১ সালে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন, গবেষণা ও অধ্যাপনা করে বিশ্বের চিন্তাজগতে আলোড়ন ফেলেছেন গায়ত্রী। বর্তমানে তিনি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মানবিক-বিদ্যার ‘University Professor’। দর্শনচর্চার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্পিভাকের প্রাথমিক উল্লেখযোগ্য অবদান হল জাঁক দেরিদার দ্য লা গ্রামাতোলজি বইটির ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ এবং তার দীর্ঘ ভূমিকা-রচনা। তাঁর এই অনুবাদের ফলে দেরিদার ‘অবিনির্মাণ’ তত্ত্ব এবং ‘পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম’-এর চর্চা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন মাত্রা পেল। সারা বিশ্বের সাহিত্য, দর্শন, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, রাজনৈতিক দর্শন-সহ মানবিক-বিদ্যার সকল ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রয়োগে গায়ত্রীর ভূমিকাকে শিরোধার্য করেন সকল চিন্তাবিদ। গায়ত্রীর নিজের ভাষায়: “ওই যে পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট কথাটা, ওটা তো আমিই আবিষ্কার করি।”(অপর ১০৭)। সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস এবং দর্শনচর্চায় ইউরোপ-কেন্দ্রিকতা (eurocentrism)-র গভীর সমালোচনা (critique)-ই গায়ত্রীর চিন্তাবিকাশের মূল সূত্র। এই সূত্র ধরেই তাঁর প্রশ্নমূলক অনুসন্ধানের সামনে এসেছে জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা, নারীবাদ: তার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা, সাবঅলটার্ন স্টাডিস: তার প্রয়োগ ও সেই প্রয়োগের সীমা, মার্কসবাদ এবং ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর দেশগুলির প্রাতিস্বিক পরিবেশে মার্কসবাদের তাৎপর্য, তার ব্যবহারের নানান সম্ভাবনা, ধরন ও চ্যালেঞ্জ।

স্পিভাক ও সাবঅলটার্ন স্টাডিসঃ

এবার আসি গায়ত্রী এবং সাবঅলটার্ন স্টাডিসে তাঁর অংশ-নেওয়া বা ‘intervention’-এর প্রসঙ্গে। ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাঙালি ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে যে-সাবঅলটার্ন স্টাডিস গ্রুপ সারা বিশ্বের ইতিহাসতত্ত্বের চর্চাকে নতুন দিকে চালিত করল, গায়ত্রী সেই গ্রুপের অংশ হয়েও তার সমালোচক। ইতিহাসচর্চার এই বিশেষ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে তাঁর ঐতিহাসিক প্রশ্নটি আসলে বিরামহীন আত্মানুসন্ধান এবং প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রতিনিয়ত যাচাই করে চলার এক ‘ক্রিটিকাল’ প্রক্রিয়ার চিরকালীন প্রেরণা: “Can the Subaltern Speak?”।

এ-কথা সকলেই জানেন যে, ‘subaltern’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন আনতোনিও গ্রামশি। যে-অর্থে গ্রামশি এই বিশেষ শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন, তার ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “small social groups on the fringes of history” (ইতিহাসের প্রান্তে অবস্থানকারী ছোট সামাজিক গোষ্ঠী)। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সাবঅলটার্ন স্টাডিসের প্রথম সংকলনে রণজিৎ গুহ সাবঅলটার্ন শব্দটিকে দক্ষিণ এশিয় সমাজ ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করলেন। তাঁর মতে: ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাস লেখা হয়েছে মূলত এলিট গোষ্ঠী (কলোনিয়ান এলিট এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী এলিট)-র দৃষ্টিকোণ থেকে। ইতিহাসের এই নির্দিষ্ট বয়ানে people অথবা subaltern (এই শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন রণজিৎ গুহ)-এর নিজস্ব ভূমিকাটি সবসময় উপেক্ষিত থেকে গেছে। সাবঅলটার্ন-চেতনা যে কেবলমাত্র এলিটের নিয়ন্ত্রণে চলে না, তার আছে একধরনের স্ব-নিয়ন্ত্রিত চলন ও বিকাশ, সেটাই সাবঅলটার্ন স্টাডিস গোষ্ঠীর ইতিহাসচর্চাকারীর মূল অনুসন্ধানের বিষয়। এককথায়, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বয়ানে যে-সব মানুষের কণ্ঠ নথিভুক্ত হয়নি, তাঁরাই সাবঅলটার্ন। রণজিৎ গুহের ধারণায় সাবঅলটার্নের অর্থনৈতিক অবস্থান বা শ্রেণি (class)-র বিচারের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী আখ্যানে তার স্থান পাওয়ার প্রশ্নটি: ইতিহাসের ‘মান্য’ ভাষ্যে এই সাবঅলটার্ন আসলে ‘স্বরবঞ্চিত’।

কোনও বিশেষ সামাজিক কাঠামোয় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থানই শুধু তার subalternity-কে নির্ধারণ করে না, ভারতের মতো জটিল ও বহুস্তরায়িত সমাজে মানুষের শ্রেণিগত অবস্থার পাশাপাশি জাত-পাত ও অন্যান্য উপাদানের জটিল মিশ্রণেই নির্দিষ্ট হয় তার সামাজিক ক্ষমতার মাপকাঠি। ক্লাসিকাল মার্কসবাদের proletariat/bourgeois-র শ্রেণিগত বৈপরীত্যের মডেল যেখানে অনেকাংশেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান-নির্ভর, সেখানে subaltern/elite-এর বৈপরীত্যের মডেলটি অনেক জটিল, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং পরিস্থিতি-নির্ভর (situational)।

গ্রামশি-কথিত, রণজিৎ গুহ-ব্যবহৃত, এই ঐতিহাসিক ‘subaltern’ শব্দের আওতায় মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: “কিন্তু আমরা যা জানি গ্রামশির কথা, subalternos, সেটাতে পুরুষমানুষ ছাড়া কারোর কথা নেই। আমি না-জেনে না-বুঝে সেখানে মহিলাকে ঢোকালাম” (অপর ২০৮)। এই প্রসঙ্গে গায়ত্রী আঠারো-উনিশ শতকের ভারতে মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত দগ্ধ-হওয়া ‘সতী’-দের কথা তুললেন। তাঁর মতে, ভারতে একসময়ে প্রচলিত এই সতীপ্রথা নিয়ে ইতিহাসের দলিলে আমরা দু-ধরনের বক্তব্য খুঁজে পাই। এক: ইউরোপীয় পুরুষের (নারীরও বটে) বয়ান, যেখানে বলা হচ্ছে ইউরোপীয় পুরুষেরা ভারতে এসে ভারতীয় নারীদের এখানকার পুরুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা করলেন (“White men saving brwon women from brown men”)। দুই: তথাকথিত ভারতীয় শাস্ত্রীয় মতামত (“Indian nativist statement”) যেখানে দাবি করা হয় যে নারীরা স্বেচ্ছায় সতীত্ব গ্রহণ করেন (“The women wanted to die”)। এই দুই মতামতের চাপে সতী হয়ে-যাওয়া মহিলাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর কি ইতিহাসের পাতায় কোনওদিন খুঁজে পাওয়া সম্ভব? সতী হয়ে স্বামীর চিতায় দগ্ধ হয়ে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁদের একান্ত স্বকীয় কণ্ঠকে শুনতে পাওয়ার কোনও উপায় আর আছে কি?

প্রসঙ্গ – “Can the Subaltern Speak?” 

নিজের পারিবারিক ইতিহাস থেকে আর-একটি ঘটনার কথা জানালেন গায়ত্রী। ১৯২৬ সালে তাঁর মায়ের মাসি, মধ্যবিত্ত পরিবারের সতেরো বছর বয়সী এক তরুণী, ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী আত্মহত্যা করেন।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে চরমপন্থী সংগঠন-প্রদত্ত একটি গুরুতর ‘দায়িত্ব’ পালন করতে অপারগ হয়ে আত্মহত্যা করলেন তিনি: “…তাঁকে কাউকে গুলি করতে বলা হয়েছিল, assassination, এবং তিনি সেটা পারেননি। মারতে পারেননি। নিয়ম ছিল, মারতে যদি না-পারো, তাহলে নিজেকেই মরতে হবে।” (অপর ২০৫)। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে এই তরুণীর আত্মহত্যার পিছনে কোনও অবৈধ সম্পর্কের সন্ধান না-করে, তার জন্য তরুণীটি অপেক্ষা করলেন তাঁর রজঃস্বলা হওয়ার দিনগুলির জন্য। ওই অবস্থায় আত্মহত্যা করলে অন্তত কেউ অবৈধভাবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার অভিযোগ আনতে পারবে না। এভাবেই ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী তাঁর দেহের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে সামাজিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ীর এই “দেহকথা” (অপর ২২৪) কি শুনতে পেয়েছিল তৎকালীন সমাজ? গায়ত্রী জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার এই ঘটনার প্রায় ছয় দশক পরে তিনি যখন এই বিষয়টি নিয়ে লিখবেন ভাবছেন, তখনও তাঁর পরিবার থেকে বলা হচ্ছে যে ভুবনেশ্বরী আত্মহত্যা করেছিলেন “একটা অবৈধ প্রেমের জন্য” (অপর ২০৬)। এই দৃষ্টান্তগুলি দেখিয়ে স্পিভাকের প্রশ্ন: সাবঅলটার্নের কথা কি আমরা সত্যিই শুনতে পাই? সাবঅলটার্নের ‘বলা’ টেক্সট-এর পাঠ কি নিখুঁত? না কি সাবঅলটার্ন স্টাডিসের নামে ঐতিহাসিকরা নিজেদের বক্তব্যকেই সাবঅলটার্নের মুখে বসাচ্ছেন শুধু (“Yet the ventriloquism of the speaking subaltern is the left intellectual’s stock-in-trade.”)? গায়ত্রীর সিদ্ধান্ত: “The subaltern as female cannot be heard or read.”

এই বিশেষ সিদ্ধান্তটিতে গায়ত্রী পৌঁছেছিলেন ফুকো (Michel Foucault) এবং দ্যলুজ (Giles Deleuze)-এর তত্ত্বের সমালোচনার মাধ্যমে। এঁরা দুজনেই প্রখ্যাত ফরাসি তাত্ত্বিক, যাঁরা বিশ্বাস করতেন: কোনও ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীন চেতনা/সত্তা থাকতে পারে না, অর্থাৎ, মানুষ নিজের চেতনার উপর সার্বিক ও সার্বভৌমিক নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব রাখতে পারে না। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট ধারণা অনুযায়ী, মানুষের চেতনা আসলে একটি বয়ান/ভাষ্যগত নির্মাণ (discursive construction)। বিভিন্ন ডিসকোর্সের পারস্পরিক সম্পর্ক, টানাপোড়েন, দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মানুষের চেতনা গড়ে ওঠে: বিশুদ্ধ ও সার্বভৌমিক ব্যক্তিচেতনা বলে কিছু হয় না। গায়ত্রী বলছেন, ফুকো বা দ্যলুজের মতো তাত্ত্বিকেরা একদিকে ব্যক্তিচেতনার এক পিচ্ছিল, অনিশ্চিত ও দ্বন্দ্বময় ধারণার কথা তুলে ধরছেন; অন্যদিকে সমাজে দলিত বা নিপীড়িত মানুষের কথা বলতে গিয়ে তাঁরাই আবার এই নিপীড়িত শ্রেণির একধরনের স্বনিয়ন্ত্রিত ও সর্বজনীন সত্তার নির্মাণ করছেন। যে-সত্তা বা subject একান্তই ডিসকোর্সভিত্তিক নির্মাণ (ফুকো বা দ্যলুজের মতে), সেই সত্তারই একধরনের সারভিত্তিক বা মৌলিক (essentialist) চেহারা এঁরা খুঁজতে চাইছেন; অর্থাৎ এঁদের প্রয়াসে “subjective essentalism”-এর পুনর্নির্মাণ ঘটছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি তাত্ত্বিক গোলমাল। এ ছাড়াও দ্বিতীয় একটি তাত্ত্বিক সমস্যার কথা বললেন গায়ত্রী। সমাজে নিপীড়িত শ্রেণির কথা বলতে গিয়ে এই তাত্ত্বিকেরা ধরেই নিয়েছেন যে তাঁরা নিজেরা হলেন স্বচ্ছ এক মাধ্যম (transparent medium), যাঁদের মধ্য দিয়ে নিপীড়িত শ্রেণির বক্তব্য/চেতনা নির্ভুলভাবে নির্মিত হতে পারে। গায়ত্রীর মতে, এই দুটি ধারণাই (এক: নিপীড়িতের এক স্বাধীন ও বিশুদ্ধ চেতনা আছে, দুই: ইন্টেলেকচুয়াল বা তাত্ত্বিকেরা নিজেদের স্বচ্ছ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নিপীড়িত মানুষের চেতনাকে তাঁদের রচনায় তুলে ধরতে পারেন) স্ববিরোধিতায় দীর্ণ। দ্বিমুখী এই তাত্ত্বিক সমস্যাটিকেই গায়ত্রী সাবঅলটার্ন স্টাডিসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। এই হল মোটামুটি গায়ত্রীর ইংরেজি প্রবন্ধটির বিষয়। এবার আসি সাবঅলটার্ন-বিষয়ক তাঁর বাংলা বক্তৃতাটির প্রসঙ্গে।

Subaltern প্রসঙ্গে বাংলা বক্তৃতা

২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়ত্রী নতুন করে পড়ালেন “Can the Subaltern Speak?” প্রবন্ধটি। পুরো প্রবন্ধটিকে তিনি চারটি পর্বে ভাগ করলেন। প্রথম পর্ব: ফুকো ও দ্যলুজের তাত্ত্বিক প্রয়োগের সমালোচনা। এই পর্বে গায়ত্রী দেখালেন যে: মানুষের চেতনার কাঠামো নিয়ে যে-তত্ত্বগুলি এঁরা আমাদের দিয়েছেন, নিপীড়িত মানুষের হয়ে কথা বলার সময় তাঁরা নিজেরাই “সেই তত্ত্বগুলিকে প্রয়োগ করছেন না। অর্থাৎ ওগুলি যেন বইয়ের পাতায় লেখা রয়েছে, কিন্তু নিজেদের চিন্তার মধ্যে আসেনি” (অপর ২০৯)। দ্বিতীয় পর্ব: কার্ল মার্কস কীভাবে ‘representation’-এর ধারণাকে একাধিক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন (‘darstellung’ বা প্রতিকৃতি যা শিল্পে বা দর্শনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং ‘vertretung’ বা প্রতিনিধিত্ব যা সংসদীয় গণতন্ত্রে হয়ে থাকে), তার আলোচনা। এই আলোচনা প্রসঙ্গে গায়ত্রী বামপন্থী চিন্তকেরা কীভাবে নিপীড়িতকে নিজেদের লেখার মাধ্যমে পুনর্‌-উপস্থাপন করতে চাইছেন, সেই পুনর্‌-উপস্থাপনার তাত্ত্বিক গোলমাল নিয়ে কথা বললেন। এই সমালোচনার ফলে অনেকেই ভুল বুঝলেন ব্যাপারটা: তবে কি গায়ত্রী বলতে চাইছেন যে, সাবঅলটার্ন নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না, সাবঅলটার্ন নিজেরাই নিজেদের ‘represent’ করবে? তাঁদের হয়ে অন্য কেউ কথা বললে, সে-উচ্চারণ কি অবৈধ? তা নয়। গায়ত্রী জানালেন, তিনি এই পুনর্‌-উপস্থাপন-প্রক্রিয়ার মূলগত তাত্ত্বিক সমস্যাটিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ‘representation’-এর মূল্যকে তিনি অস্বীকার করেন না। “আমি যেটা বলেছিলাম সেটা হচ্ছে, সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিকভাবে কী করে লোকে represent করতে পারে” (অপর ২১২)। তৃতীয় পর্ব: সতীদাহ-প্রসঙ্গ। এ-বিষয়ে গায়ত্রীর মতামত: সতীদাহ যে আইন করে এ-দেশে বন্ধ করা হল, সেটা “খুবই ভালো কথা”, কিন্তু তাতে মেয়েদের “মানসিক পরিবর্তন কিছু হল কি না, [সেটা] দেখা হল না। সুতরাং আজও গ্রামে-গঞ্জে সতীদাহর বিরুদ্ধে, একেবারে গণ্ডগ্রামে, মেয়েরা সবসময় যে সতীদাহর বিরুদ্ধে কথা বলেন, তা নয়।” (অপর ২১৩)। চতুর্থ পর্ব: ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী। “…ওই মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে একা একটি মেয়ে একটা কিছু resistance করল, কিন্তু সেটা তার ঘরেরই মহিলা, দুই প্রজন্ম, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত”, সে ধরতে পারল না (অপর ২১৪)।

এই বক্তৃতাটিতে গায়ত্রী জানালেন, তাঁর মূল ইংরেজি প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর যাঁরা ভেবেছিলেন যে সাবঅলটার্নের কথা বলার অক্ষমতা বা অপারগতার কথাই বলেছেন গায়ত্রী, তাঁরা ভুলভাবে প্রবন্ধটি পাঠ করেছেন। প্রবন্ধটিতে নথিবদ্ধ ইতিহাসে সাবঅলটার্নের জায়গা না-পাওয়া নিয়ে লেখকের রাগ প্রকাশ পেয়েছে (“rhetoric of rage”), কিন্তু সাবঅলটার্ন যে ‘কথা’ বলতে পারে না, সে-কথা গায়ত্রী বলেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল: তথাকথিত সাবঅলটার্ন যে নিজের বক্তব্য প্রকাশে অক্ষম, তা নয়; তাঁরা ‘কথা’ বলেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। কিন্তু তাঁদের কথা বা “speech act”-কে “পরিপূর্ণ করবার করবার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই, infrastructure আমাদের নেই” (অপর ২০৭)। অর্থাৎ সাবঅলটার্নের কথা যে আমরা বুঝতে পারি না, এ আমাদের বয়ানগত/ভাষ্যগত পরিকাঠামোর অসম্পূর্ণতা। কথা বলার অক্ষমতা নয়, অন্যের কথা শোনার সীমাবদ্ধতাকেই গায়ত্রী তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধে।

অন্যের কথা শুনতে আমরা যদি অপারগ হই এবং সেই অক্ষমতা যদি এতই গভীর ও মূলগত হয় যে তার থেকে কোনও সহজ পরিত্রাণের ফর্মুলা আমাদের হাতের কাছে নেই, তা হলে আমরা কী করব? আমাদের কি তবে কোনও করণীয় নেই? আপাত-সমাধানহীন এক সমস্যার কথা তুলে গায়ত্রী কি তবে এক তাত্ত্বিক নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার পক্ষে যুক্তি দিলেন? তা নয়। হাজারো ত্রুটিপূর্ণ বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় আমাদের কী করা উচিত, সে-বিষয়ে স্পিভাকের বক্তব্য পরিষ্কার:
… সেই জন্য subaltern জিনিসটাকে নষ্ট করে, সেটাকে কোনোমতে নাগরিকতার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের কর্তব্য, subaltern নিয়ে primitivism করে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে যে তাঁদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া, এমন একটা পরিকাঠামোর মধ্যে তাঁদেরকে ফেলা, যাতে করে আমরা বুঝতে পারি, তাঁদের speech act, এইটাকে আমরা complete করতে পারি ঠিকমতো শুনে। (অপর ২০৮) অর্থাৎ সাবঅলটার্ন নিয়ে কোনও রোমান্টিসিজম নয়, সাবঅলটার্ন চেতনা—যা কিনা প্রচলিত সামাজিক ভাষ্যে পুনর্নির্মাণ করা ‘অসম্ভব’—নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল মাতামাতি নয়, আমাদের বাস্তবিক কাজ হল: ওই চেতনাকে “primitivism”-এর আওতা থেকে বার করে এনে “citizenship”-এ অন্তর্ভুক্ত করা। সাবঅলটার্ন হিসেবে যাঁকে আমরা সেলিব্রেট করছি, তাঁকে নিয়ে আসতে হবে বোধযোগ্য ও শ্রবণযোগ্য কাঠামোর মধ্যে, যাতে তিনি স্টেট মেশিনারিতে অর্থপূর্ণভাবে অংশ নিতে পারেন।

গায়ত্রী শুধু তত্ত্বের কথা বলেই থেমে থাকেননি। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক স্তরে স্কুল চালিয়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজের তথাকথিত ‘পিছিয়ে-পড়া’ মানুষদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের নিয়ে আসতে চাইছেন শিক্ষার প্রচলিত কাঠামোর ভিতরে। এক কথায় বলা যায়: বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের ওই স্কুলগুলিই হল তাঁর পরীক্ষাগার, সেখান থেকে বাস্তবের মাটিতে কাজ করে, বাচ্চাদের মন-বদলানোর ও “মাথা খাটানোর” শিক্ষায় (অপর ২১১) নিজেকে নিয়োজিত করে, কাজ করতে গিয়ে ভুল করে, সেই ভুল থেকে শিখে, নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজেকে এবং অন্যকে প্রশ্নের সামনে রেখে, গায়ত্রী নিজের তাত্ত্বিক অবস্থানকে প্রতিনিয়ত পরিমার্জন করছেন, এবং সাবঅলটার্ন মানুষের মধ্যে তাঁর প্রাত্যহিক ও বাস্তবিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিশ্বের চিন্তাজগৎকে প্রশ্ন করে চলেছেন। সারাজীবন ধরে তিনি ইউরোপ-কেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষার সমালোচনা করেছেন, নিজেও সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর যাবতীয় তাত্ত্বিক বোঝাপড়াকে গায়ত্রী সবসময় যাচাই করেছেন ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্ব থেকে আমেরিকায় প্রবাসজীবন অতিবাহিত-করা এক অশ্বেতাঙ্গ নারীর অবস্থান থেকে; খুঁজতে চেয়েছেন সেই কণ্ঠস্বরকে যা মান্য ভাষ্য (normative discourse)-এর স্বীকৃতি থেকে চিরবঞ্চিত। সাবঅলটার্ন বা স্বরবঞ্চিতকে তিনি অনুসন্ধান করেছেন ইতিহাসের নানান স্তরে। পুরস্কার, সমালোচনা, বোঝা, না-বোঝা, ভুল বোঝা, স্বীকৃতি, অস্বীকার, প্রশংসা, প্রত্যাখ্যান: সব মিলিয়ে এক জটিল, অন্তর্দ্বন্দ্বে জারিত ও বিরোধসংকুল প্রক্রিয়ায় গায়ত্রী চক্রবর্তী আন্তর্জাতিক চিন্তা ও দর্শনের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন ও থাকবেন।

উদ্ধৃতিসূত্র:

১। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অপর: লেখা ও কথার সংকলন, অনুষ্টুপ, ২০২২।

২। Gayatri Chakravorty Spivak, “Can the Subaltern Speak?”, The Post-Colonial Studies Reader (Second Edition). Bill Ashcroft, Gareth Griffiths and Helen Tiffin, eds. Routledge, 2006. [লেখিকাকর্তৃক সংক্ষেপিত]।

চিত্রঋণ – লেখক

জন্ম ১৯৮৬। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ, এম ফিল, পি এইচ ডি। গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত অধ্যাপক চিন্ময় গুহর তত্ত্বাবধানে। পেশায় একটি সরকার-পোষিত কলেজের অধ্যাপক। এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি জার্নাল, অনুষ্টপ ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ: যুগান্তরের চিঠি: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য (ধানসিড়ি, ২০১৫), ইতিহাসের মোহনামুহূর্ত ও সত্যজিৎ রায় (আপনপাঠ, ২০২৪)। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু মৌলিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের লেখক ও একটি গ্রন্থের সহ-সম্পাদক। সম্পাদিত গ্রন্থ: বিগত যাপন: একটি পারিবারিক আখ্যান (ধানসিড়ি, ২০২১)। অধ্যাপক ছন্দক সেনগুপ্তের সহযোগী হিসেবে সম্পাদনা করেছেন অনুষ্টুপ-প্রকাশিত অনুষ্টুপের সত্যজিৎ (২০২৩) গ্রন্থের। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বাংলা প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন (অপর: লেখা ও কথার সংকলন, অনুষ্টুপ, ২০২২)-এর প্রস্তুতি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *