বিচিত্রা সুচিত্রা
আকাশ যখন চক্ষু বোজে অন্ধকারের শোকে,
তখন যেমন সবাই খোঁজে সুচিত্রা মিত্রকে –
তেমন আবার কাটলে আঁধার সূর্য উঠলে ফের,
আমরা সবাই খোঁজ করি কার ? সুচিত্রা মিত্রের।
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
তিনি কোমরে আঁচল বেঁধে শান্তিনিকেতনের মাঠে ফুটবল খেলেছেন, আবার সেখানেই মঞ্চে নৃত্যনাট্যে নাচ অভিনয়ও করেছেন। তাঁর দৃপ্ত, আপাত কঠিন ব্যক্তিত্ব যেমন ছাত্রছাত্রীদের কাছে সমীহ আদায় করে নিত, তেমনি ভালোবাসাও, কারণ সুদূর দেশে তাদের সমূহ-অনুষ্ঠান সম্ভব করার জন্য তিনি নিজের গয়নাগাটিও বন্ধক রাখতে পারতেন। কোনও বিষয় তাঁর কাছে ভ্রান্ত বা অন্যায় মনে হলে প্রতিবাদে সরব হতেন, কিন্তু কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনিই প্রয়াসী হতেন। বলতেন রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপি একটা কাঠামো মাত্র, প্রয়োজনে বিচ্যুতিও ঘটিয়েছেন। আবার তিনিই বলেছেন, কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিকৃতি করবার চেষ্টা করলে দরকার হলে পথে নেমে যুদ্ধ করতেও রাজি। তাঁর রোষ যেমন প্রখর, তাঁর কৌতুক ও পরিহাসপ্রিয়তা তেমনই সুবিদিত। তিনি কবিতা লিখেছেন, পুতুল গড়েছেন, আবার কখনো টেবিলের ওপর চড়ে গেয়েছেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,’ কখনো লরির ওপর দাঁড়িয়ে ‘সার্থক জনম আমার।’
তিনি সুচিত্রা মিত্র। এক আপাতবিরোধী ব্যক্তিত্ব, বলা যায় এক ‘enigma।’ যেমন সপ্রতিভ, তেমনই নমনীয়। এবং তাঁর গান, রবীন্দ্রনাথের গান, সেও তেমনই। ব্যতিক্রমী, উদাত্ত, নিজস্ব।
সৌরভ গাঙ্গুলী রবিতীর্থে সুচিত্রা মিত্রের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাধনা করলেও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বিশেষত সুচিত্রার ওপর গবেষণামূলক কাজ করেছেন। এস আর এফ টি আই কমিউনিটি রেডিওর সাক্ষাৎকারমালায় তিনি বলেন, ‘সুচিত্রা মিত্রের ব্যক্তিত্বকে এক কথায় বলা যায় ভীষণ ‘মুডি।” ওঁর মুড হতো পাহাড়ের আবহাওয়ার মত, এই বৃষ্টি এই রোদ। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্তা শিল্পী শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায় আকাশবাণীর এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তাঁর ওপরটা যত কঠিন ছিল, ভেতরটা ছিল ততটাই নরম, অসম্ভব মায়া আর স্নেহতে ভরা।’
হয়তো এক রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস তাঁর চেতনায় গভীর মানবদরদী ভাবনা সিঞ্চন করেছিল। শ্রীনন্দা তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। ১৯৭৯ সাল। সেদিন কলকাতা প্রবল বর্ষণে বিপর্যস্ত। রাস্তাঘাট জলমগ্ন। কিন্তু তারই মধ্যে তরুণী শ্রীনন্দারা মজা করে জল ভেঙে দল বেঁধে চলেছেন সুচিত্রার বাড়ী তাঁর গানের ক্লাসে, আলোচনা করতে করতে দিদি সেদিন কোন গান শেখাবেন। নিশ্চয় কোনও বর্ষার গান। তাঁর তৎকালীন বাড়ি সুইনহো স্ট্রীটের এলাকা জলে ভাসছে। কোনক্রমে তা অতিক্রম করে সুচিত্রার বাড়িতে পৌঁছে ওপরে উঠে দেখলেন অনেক মানুষে ঘর ভর্তি। তারা সব সে অঞ্চলের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তাদের বাসায় জল ঢুকে গেছে। তাদের জন্য বিশাল হাঁড়িতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। সেদিন সেখানেই তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। আবার তারই মধ্যে অন্য ঘরে গানের ক্লাসও হল। কারণ সেই দুর্যোগ ঠেলে যারা পৌঁছেছে শেখার বাসনায়, তাদের বিফলে ফেরৎ পাঠানোও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।


তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বার এই নমনীয় দিকটির পরিচয় বেশ কয়েকজনের অভিজ্ঞতার বিবরণীতে পাওয়া যায়। পরিণত বয়সে তার বহিঃপ্রকাশ বেশি করে নজরে আসে। সুগায়ক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে সুচিত্রার প্রথম সাক্ষাতের কথা শোনাতে গিয়ে বলেছেন, ১৯৯৭ সালের এক শীতের সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন সুচিত্রার বাড়ি। তখন অভিষেক স্কুলে পড়েন। গানও শোনেন, করেন, এবং তখনই সুচিত্রার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। পরিচয় পর্বে তিনি যখন জানলেন অভিষেক গান করেন, স্বাভাবিকভাবেই বললেন শোনাতে। সেই শীতের সন্ধ্যায় দুরুদুরু বক্ষে দুঃসাহসিকতায় ভর করে অভিষেক গেয়েছিলেন সুচিত্রারই গাওয়া একটি বর্ষার গান – ‘অশ্রুভরা বেদনা।’ ভয়ে চোখ বন্ধ করে গাইলেন, যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাননি। গান শেষ করে চোখ খুলে দেখলেন, সুচিত্রারও চোখ বোজা। আর চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।
সুচিত্রা মিত্রের যে সাক্ষাতকার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছিলেন, তা অনেকেই দেখে থাকবেন। সেখানে তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজেশ্বরী দত্তের কথা একে একে আলোচনা করে রঞ্জন হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘এঁরা তো এখন কেউই নেই। কেমন লাগে আপনার?’ এ প্রশ্নের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর চেহারায় দৃশ্যতই যে বেদনাতুর অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিল তা নজর এড়িয়ে যাবার নয়। ক্ষণেক চুপ করে থেকে তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘এবার কেঁদে ফেলব আমি।’
যখন সুচিত্রা ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিভাগীয় প্রধান, সুমিত্রা সেন দীর্ঘকাল রবীন্দ্রভারতীতে শিক্ষকতা করেছেন। ‘স্মৃতিসুধা’য় সুমিত্রা লিখেছেন, ‘সুচিত্রাদিকে বাইরে ভীষণ কঠোর মনে হত। কিন্তু মনেপ্রাণে নরম। …ওঁর মানবিকতা বোধের আরো পরিচয় পেলাম যখন আমার স্বামী অসুস্থ হলেন এবং চলে গেলেন, সেই পর্বে। প্রতিদিন নিয়ম করে খোঁজ নিতেন বড় দিদির মত, জানতে চাইতেন খেয়েছি কি না। উপদেশ দিতেন। সেই সময় সুচিত্রাদি যেভাবে পাশে ছিলেন, তা আমি ভুলতে পারি না। ভুল করলে বকে শুধরেও দিতেন।‘
নিজের এই মায়াময় দিকটিকে সযত্নে জনসমক্ষে ঢেকে রাখতেন তিনি। সেখানে তিনি অত্যন্ত স্মার্ট, মেজাজি, আবার কৌতুকপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। লেখক সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্য একাধিকবার শুনিয়েছেন এই দিকটি উন্মোচন করে কিভাবে তিনি সুচিত্রার রোষের শিকার হয়েছিলেন। তখন ট্যাবলয়েড আকারে যে সানডে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত, তার জন্য সুচিত্রার একটি সাক্ষাতকার তিনি নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাতে সুচিত্রাকে একটি প্রশ্ন তিনি করেছিলেন, ‘আপনি তো বলেন রবীন্দ্রনাথের গান আপনাকে জীবনের সবরকম পরিস্থিতিতে সর্বদা সঙ্গ দিয়েছে। এমন কি কখনও হয়নি যখন রবীন্দ্রনাথও আপনার পাশে থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন?’ সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘এমন একবারই হয়েছিল।’ ঘটনাটি ছিল শান্তিদেব ও সাগরময় ঘোষের ভাই শুভময় ঘোষের তরুণ বয়সে অকালমৃত্যু। তিনি সুচিত্রার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘সেদিন আমি সারাদিন খালি কেঁদেছি। ঐ একটা দিন রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে ছিলেন না, আমার অবলম্বন হতে পারেননি।’ এ কথা বলতে বলতেও তাঁর চোখের জল তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এই বিবরণ শঙ্করলালের লেখায় প্রকাশিত হয়। সুচিত্রা বলেছিলেন, লেখা প্রকাশ হলে তিনি তাঁর মতামত ফোন করে জানাবেন। কিন্তু চার-পাঁচদিন পরও তাঁর ফোন আসেনি। তখন শঙ্করলালই তাঁকে ফোন করেন, একাধিকবার। প্রতিবারই সুচিত্রার পরিচারক ফোন ধরে বলে, তিনি ব্যস্ত, কথা বলতে পারবেন না।
সুচিত্রার সঙ্গে শঙ্করলালের প্রথম পরিচয় হয়েছিল আকাশবাণীতে বিমান ঘোষের মাধ্যমে। একটি অনুষ্ঠানে বিমানবাবুর সঙ্গে দেখা হলে শঙ্করলাল তাঁকে এই বৃত্তান্ত জানান। বিমানবাবু হেসে বলেন, ‘আমি জানি। সুচিত্রা খুব রাগ করেছে। বলছিল, আমাকে অমন মিনমিনে ন্যাকাবোকা করে দেখানোর কি দরকার ছিল?’ ১
ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি সুচিত্রা মিত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কখনো আত্মপ্রত্যয় ও আত্মমর্যাদার বিচ্যুতি হয়নি। একবার কোন একটি অনুষ্ঠানে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তাঁকে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সুচিত্রা, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তোমার কি শরীর খারাপ?’ সুচিত্রা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দ্বিজেন, এমন শরীর খারাপ আমার রোজই থাকে। কারণ আমি রান্না করে, বাসন মেজে, ঘর গুছিয়ে তবে গান গাইতে আসি। তোমাদের মত ফুলবাবুর জীবন আমার নয়।‘ শোনা যায়, তাঁর রান্নাঘরের দেওয়ালে স্বরলিপি সাঁটিয়ে রাখতেন, আর রান্নার ফাঁকে ফাঁকে স্বরলিপি দেখে গান তুলতেন। তাঁর পুত্র কুণাল বলেছিলেন তাঁর শৈশবের অভিমান অনুভূতির কথা। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সাদার্ণ অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটের জানলা ধরে অপেক্ষা করতেন, আর রেডিওয় ভেসে আসতো মায়ের গান। শুনে মনে হতো ছুটে গিয়ে রেডিওটা ভেঙে ফেলেন। ‘মা রেডিওয় গান করার সময় পায়, অথচ আমার কাছে একটু থাকার সময় হয় না ? মা তো মা। সবার যেমন। কিন্তু আমার মা যে সুচিত্রা মিত্র, সেটা সেদিন বুঝিনি। আর পরে সারা জীবন শুধু সেটাই বুঝেছি।‘ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট, ২০১৮) ২
শান্তিনিকেতনে ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের মনে হয়েছিল, সুচিত্রার মুখটি বেশ মজার। তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা সুচিত্রাকে সামনে বসিয়ে তাঁর একটি মুখাবয়ব মূর্তি তৈরী করে উপহার দেন। সেটি সুচিত্রার বাড়ীতে রাখা থাকত। বেশ কয়েক বছর পরে একদিন শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের সামনে সুচিত্রা এসে হাজির। ক্লিষ্ট মুখ, অশ্রুসিক্ত চোখ। বললেন, ‘বাড়ীতে ঝগড়া অশান্তি চলছিল। রাগের মাথায় আপনার দেওয়া মূর্তিটা আমি টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেছি।‘ রামকিঙ্কর সব শুনে বলেছিলেন, ‘এর সাজা তোমায় পেতেই হবে। আজ আমাকে অনেক গান শুনিয়ে যেতে হবে।‘ পরিণত বয়সে তাঁর আত্মজীবনীর অনুলেখক সাংবাদিক অলকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘খুব রাগ হয়। সত্যিই তুচ্ছ কথা, আজ মনে হয়। …আমার মূর্তি থাকল কী গেল, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু কিঙ্করদার তৈরী একটা শিল্পকর্ম নষ্ট করেছি। এটা অপরাধ। এই অপরাধ থেকে সারা জীবন আমি নিষ্কৃতি পাব না।‘
স্বামী ধ্রুব মিত্রর বাড়ী থেকে একবস্ত্রে বেরিয়ে এসেছিলেন। অথচ, পরবর্তীতে ধ্রুবকে তাঁর বন্ধু বলে স্বীকার করেছিলেন। ধ্রুবর আগেও একটি বিবাহ হয়েছিল, সেই স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ হন। সুচিত্রার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ধ্রুব আবারও বিয়ে করেন। সেই পত্নীর নামও গীতা। এঁদের সকলের সঙ্গেই সুচিত্রার হৃদ্য সম্পর্ক বজায় ছিল, নিয়মিত আসাযাওয়া ছিল। ধ্রুব মিত্রের মৃত্যুর পর প্রবাসে কুনালকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আজ আমার বন্ধু চলে গেল। জগতে আমার আর কেউ বন্ধু রইলো না।’ পুত্রবধূ পামেলা মধুকে একবার বলেছিলেন, ‘ধ্রুবর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত কিছু ছিল না। তবে খুব ভাল বন্ধু হওয়া আর সংসার করা এক নয়। সংসার করা কাকে বলে, সেটা ও বুঝত না।‘ কুণাল অবশ্য তাঁর নিজের বিশ্লেষণে মনে করেন, ‘মা এবং বাবার মধ্যে কোথাও হয়তো ভিতরে ভিতরে একটা ব্যক্তিত্বের সংঘাত হত।‘
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, সুচিত্রা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়কেও মাতৃস্নেহে পালিত করেন, এবং অনেকেরই ধারণা ছিল সুদেষ্ণা তাঁরই সন্তান। তিনিও সুচিত্রাকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন, আর সুচিত্রা তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘চিকু’ বলে। সুদেষ্ণা তাঁর ‘মা’র কাছে সঙ্গীতশিক্ষা লাভ করেন, এবং শিল্পী হিসেবে নিজস্ব প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। পরে তিনিও প্রবাসিনী হ’ন। কিন্তু ২০১৪ সালে দেশে ফিরে, সুচিত্রা প্রতিষ্ঠিত রবিতীর্থের তৎকাললীন ক্রমাবনতির প্রেক্ষিতে, তিনি ‘রবিতীর্থ-প্রাক্তনী’ নামের একটি সংস্থা স্থাপনায় প্রধান উদ্যোক্তার ভুমিকা পালন করেন। একটি ইংরেজী সংবাদ মাধ্যম এই ঘটনার প্রতিবেদনে আগাগোড়া সুদেষ্ণাকে ‘Suchitra Mitra’s daughter’ বলে পরিচিতি দিয়েছিল। ২০১৫তে সুদেষ্ণা, ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী সোহিনী মুখোপাধ্যায়, যুগ্ম প্রয়াসে তাঁদের পিসিদের স্মরণে কলকাতায় ‘পিসিমণিদের গান’ শীর্ষক একটি অনবদ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।
সেই পঞ্চাশ ষাট দশকের সমাজে একাকিনী এক মহিলার পক্ষে জীবন সংগ্রামে নিরন্তর সংঘর্ষ করে নিজস্ব প্রতিভার জোরে স্বমহিমায় নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করা সাধারণ ব্যাপার ছিল না, তা অনস্বীকার্য। সেই জীবনযুদ্ধই বোধহয় তাঁর ব্যক্তিত্বে এক কাঠিন্যের বহিরাবরণ সৃষ্টি করে থাকবে যা তিনি বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ ছিল অভেদ্য, এবং যা তিনি অন্যায় বা বেঠিক মনে করতেন, তার বিরুদ্ধাচরণে কোন রাখঢাক রাখতেন না।
কুণাল তাঁর মায়ের এই দিকটির আলোচনায় একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন। একবার এক রেকর্ডিং সংস্থায় রেকর্ড করতে গিয়েছিলেন। সেখানে এক আধিকারিকের কোন উক্তি তাঁর কাছে অত্যন্ত অশালীন এবং অসম্মানজনক বলে মনে হয়। তাঁকে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, সুচিত্রা মিত্র বাজারের আলু পটল নয়। আর কখনও এখানে পা দেব না।‘ এই বলে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ী ফিরে যান। পরে সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের তাঁর হাতেপায়ে ধরে নিজেদের ভুল স্বীকার করে ফিরিয়ে আনতে কালঘাম ছুটেছিল।
অলক রায়চৌধুরী লিখেছেন, “১৯৬৯ সালে প্রয়াত হলেন রবীন্দ্রভারতীর সঙ্গীত বিভাগের ডিন রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজ সামলানোর দায়িত্ব পড়ল সুচিত্রা মিত্রের উপরে। সেই পদে আর একজন যোগ দিলেন যে দিন, সুচিত্রা তার পরে আর জোড়াসাঁকোমুখো হননি। তখন ছাত্র, পরে সুচিত্রার ছায়াসঙ্গী কাশীনাথ রায়ের হাতে উপাচার্য ‘রিডার’ পদে আবেদনের একটি ফর্ম দিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্রের জন্য। কাশীবাবু ভয়ে ভয়ে সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে গেলে শিল্পী বাধ্য মেয়ের মতো স্বাক্ষর করলেন বটে, কিন্তু নিজেই কেটে দিলেন দুজন ‘রেফারি’র নামের শূন্যস্থান। ওঁর আবার রেফারি কে! সে পদের ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। তিন মিনিটের ইন্টারভিউতে কেবল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাড়িতে কে কেমন আছেন।“ {আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) ৩
অন্য আর এক দিকে তাঁর রসিকতা আর মজা করে কথা বলার স্বভাব। নিজের ছোটবেলার দুরন্তপনার, ডানপিটে স্বভাবের অনেক কাহিনি তিনি নিজেই অনেক জায়গায় শুনিয়েছেন। সৌরভ গাঙ্গুলী বলছেন, ‘তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমাকে কি ভদ্রমহিলা বলা যায়? কলার বোন, হাত ভেঙেছি, মাঠে ঘাটে ফুটবল খেলেছি, এ সব কি ভদ্র মেয়েরা করে?’’ প্রমিতা মল্লিক এক সাক্ষাতকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঝড়ের দিনে শান্তিনিকেতনে আম্রকুঞ্জে মাটিতে ঝরে পরা আম কুড়িয়েছ?’ দুষ্টু হেসে সুচিত্রা বললেন, ‘মাটি থেকে কি রে? আমি তো গাছে চড়তাম আম পাড়তে!’ আচ্ছা বল, এ সব কোন ভদ্র মেয়ে করে?’ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যাকে বলছেন, ‘আমাদের বাড়ীতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে প্রায়ই আসতেন পঙ্কজ মল্লিক আর বাণী কুমার। মা আমার হাত দিয়ে জল পাঠাতেন তাঁদের জন্যে। পঙ্কজবাবু আবার ঠান্ডা জল খেতেন না, তাই তাঁর গ্লাসে সাদা জল, আর বাণী কুমারের জন্য ফ্রিজের জল। মা বলতেন, ভুলেও যেন পঙ্কজবাবুকে ঠান্ডা জলের গ্লাস দিবি না। আমার কৌতূহল হল, দুটোর মধ্যে কী এমন তফাৎ? সেইটা পরখ করতে, নিয়ে যেতে যেতে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলাম। পেছনে মা যে দেখছেন, তা কে জানতো। ঘাড় ধরে বললেন, এঁটো করে দিলি তো ? এঁটো ব্যাপারটা কী, তা কি তখন বুঝি?’ আরও বলেছেন, ‘কেউ দেখতাম সিগারেট খায়, আবার কেউ বিড়ি ফোঁকে। কোনটা কেমন জানতে গিয়ে একবার একটা আধফোঁকা বিড়িতে টান মেরে দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল।‘
শান্তিনিকেতনে এস্রাজ বাজানো শেখা নিয়ে তাঁর সংগ্রামের কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। ‘এস্রাজের শিক্ষক ছিলেন অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষ্ণুপুর ঘরানায় এস্রাজ সোজা দাঁড় করিয়ে বাজাতে হয়। এস্রাজ ধরে রাখতে গিয়ে ছড় এদিক ওদিক হয়ে খালি বেসুরো ক্যাঁ কোঁ চ্যাঁ চোঁ আওয়াজ বেরোয়। অশেষদাকে বললাম, ‘অশেষদা, যা পারলাম বাজালাম। চল্লিশটা নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেবেন। অশেষদা বললেন, সে কি? তুমি তো সমেই আনতে পারলে না। বাইরে গিয়ে আমার বদনাম করবে। তার থেকে আরো এক বছর প্র্যাকটিস করে এসো। আমারও রোখ চেপে গেল। ভর দুপুরে এস্রাজ বাজিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। সবাই বলতো, সুচিত্রা, তুই বরং গান গা। এস্রাজটা বাজাস না। পরের বার আবার অশেষদার সামনে বসলাম। মোটামুটি বাজিয়ে ঠিক সমের মাথায় ছড় স্লিপ করে সেই আবার চ্যাঁ। শেষমেশ অশেষদার পায়ের কাছে এস্রাজ নামিয়ে রেখে বললাম, এর থেকে বেশি আর হবে না, অশেষদা।‘
রবিতীর্থে গান শেখানোর সময় ছাত্রছাত্রীদের ভুল সংশোধন করতেন কেমন মজা করে, তার কাহিনি বলেছেন সৌরভবাবু। স্পষ্ট জড়তাহীন উচ্চারণে তাঁর বিশেষ নজর থাকত। একদিন বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ শেখাতে গিয়ে গান থামিয়ে বললেন, ‘তোরা সব ভেড়া বাঁদর, ভেড়া বাঁদর করছিস কেন ? পরিষ্কার করে বল, ভরা বাদর।‘ আর এক দিন, ক্লাসে ঢুকেই বললেন, ‘আজ সবার জিভ পরিষ্কার আছে তো ?’ আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘কারণ আজ শেখাব ‘নমো যন্ত্র’, তাতে আছে –
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,
তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট দন্ত॥ –
ইত্যাদি আরও দাঁতভাঙা সব শব্দ।’


তাঁর আর এক ছাত্র অরিজিৎ মৈত্র (banglalive.com, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪) লিখেছেন তাঁর মজাদার গল্প করার কথা। ‘তিনি মজা করে বলতেন, বিবিদি অর্থাৎ ইন্দিরা দেবীর কাছে গান শিখতে গিয়ে দেখতাম বিবিদি আর প্রমথবাবু নিজেদের ভেতর ফরাসি ভাষায় ঝগড়া করছেন।‘ ৪
কুনাল-বাবু জানিয়েছেন, ‘একবার গ্রামোফোনের বিমানমামা (ঘোষ) কে মা বলেছিলেন, তুমি আমার পিছন পিছন যতই ঘোরো, আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করব না। শুনে খুব হাসেন বিমান ঘোষ।‘

বহুমুখী প্রতিভার সুচিত্রা তিনটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘দহন’ মুক্তি পায় ১৯৯৮ সালে। এই ছবিতে ঋতুপর্ণ কোনও কারণে সুচিত্রার ডায়ালগগুলি অন্য কারোর কণ্ঠে ডাব করান।
তিনি আহত হয়েছিলেন, কিন্তু আবার কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘কেন যে আমার গলাটাই কেটে দিল!’
সুচিত্রা মিত্র কোনও রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সদস্যতা গ্রহণ না করলেও বামপন্থী, বা সমাজতান্ত্রিক মতধারায় প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে মূলত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণচেতনা উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রচারকে মাধ্যম করতে যে আই পি টি এ গঠিত হয়, তার হোতারা বামাদর্শীই ছিলেন। সুচিত্রার দুই দিদির মাধ্যমে তিনি নিজে এই আই পি টি এর কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশীদার হয়ে পড়েন। গণনাট্যের বহু অনুষ্ঠানে শহর-গ্রামে মাঠে ময়দানে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মনে পড়ে, গণনাট্য সংঘের কোন নতুন গান লেখা হলেই কেমন উদ্দীপনাময় মহড়া চলতো জর্জের ঘরেই। …বটুকদা, হেমন্ত, ভূপতি নন্দী, সুরপতি নন্দী, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, আমি ও আরও অনেকে জড়ো হতাম জর্জের ঘরটায় – নতুন গানের মহড়ার সঙ্গে নানাবিধ আলাপ আলোচনা – সে দিনগুলিই ছিল অন্যরকম।‘
১৯৪৬এর ভাতৃঘাতী দাঙ্গার বিরুদ্ধে মিছিলে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে গেয়েছেন ‘সার্থক জনম আমার।’ ১৯৬৪র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে শান্তিমিছিলের প্রথম সারিতে চলতে চলতে গেয়েছেন ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন।’ ১৯৪৮এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণপূর্ব এশীয় যুব সম্মেলনের শেষ দিনে অতিথিদের লক্ষ্য করে দুষ্কৃতীরা গুলি চালায়। তাঁরা বেঁচে গেলেও দুজন আয়োজক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এর প্রতিবাদসভায় দক্ষিণ কলকাতার মাঠে প্রাণসংশয় জেনেও টেবিলে চড়ে আবার গেয়েছেন ‘সার্থক জনম আমার।’ ১৯৫১তে বার্লিনে এক যুব সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে দমননীতির প্রতিবাদে গান করে এসেছেন। ১৯৭১এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উজ্জীবিত রাখতে, শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে, বারংবার গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান, তার মধ্যে অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা।’ ৯০এর দশকে নিকারাগুয়ার বিপ্লবী তরুণ-তরুণীদের জন্য অর্থসংগ্রহের মানসে অশক্ত শরীরে মাত্র দু’টি গান গাইবার জায়গায় পরের পর গেয়ে গেছিলেন বোধহয় গোটা দশেক। খরা বা বন্যাত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহে দুই বাংলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছেন বারংবার। কলকাতার শেরিফ থাকাকালীন সময়ে সদর স্ট্রীটে রবীন্দ্র-স্মৃতি বিজড়িত বাড়িকে হোটেলে পর্যবসিত করার প্রতিবাদ করলে টেলিফোনে তাঁকে হত্যার হুমকিও শুনতে হয়েছিল।
১৯৪৭এর শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গে বিনা বিচারে বন্দী রাখার আইন লাগু হল। কলকাতা তথা বাংলা এই আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। দিল্লী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লৌহমানব সর্দার প্যাটেল এলেন আইনের সমর্থনে বক্তব্য রাখতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে। সেদিনই বেতারে সুচিত্রার গান গাইবার কথা। নির্ভীক সুচিত্রার অব্যর্থ উপস্থাপনা ছিল ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে।’ মতান্তরে কোনও সভায় তিনি এ গান গেয়েছিলেন। অন্যমতে, একদিন রাষ্ট্রীয় বেতারে তাঁর গান প্রচার হচ্ছিল, এবং জওহরলাল নেহরু সেদিন কলকাতা সফরে গিয়েছিলেন। সুচিত্রা নাকি সেদিন গেয়ে বসলেন ‘বাল্মিকী প্রতিভা’র দস্যুর গান, ‘কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে।‘ যে কারণেই হোক, ফলস্বরূপ বেতারে তাঁর গান সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। কলিম শরাফী লিখেছেন, ‘সুচিত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পার্লামেন্টেও উষ্ণ আলোচনা চলেছিল। বস্তুত তাঁর উপর কোনই আইনভঙ্গের অভিযোগ টিঁকতো না। ফলতঃ সে নিষেধ বেশি দিন কায়েম রাখা যায়নি।
ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনে বরাবরই সুচিত্রা মিত্র ব্যতিক্রমী। প্রথমত, তাঁর কণ্ঠস্বরই ছিল তৎকালীন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের থেকে ভিন্নতর ধরণের। তারপর, দৃপ্ত উদাত্ত কণ্ঠে জটিলতা বর্জন করে গাইবার যে গায়নপদ্ধতি তিনি অবলম্বন করলেন, সেই সময়ের বিচারে তাকে অভিনবই বলতে হয়, যদিও সৌরভ গাঙ্গুলীর মতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, অমিতা সেন বা শান্তিদেব ঘোষরা খোলা গলায় এই ধারাতেই গাইতেন। গণনাট্য সঙ্ঘের সভানুষ্ঠানে অন্যরা যখন গাইতেন গণসঙ্গীত, বিপ্লব বিদ্রোহের গান, সুচিত্রা মিত্র এবং দেবব্রত বিশ্বাস তার মধ্যে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। সুচিত্রা আন্তরিকভাবে মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথের গান কেবল এক সীমিত অভিজাত গোষ্ঠীর বৈঠকখানায় মনোরঞ্জনের বস্তু না, তা সর্বজনের, সর্বসাধারণের অনুভবের সম্পদ। ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় অতিক্রম করে নারীসত্ত্বার যে দৃঢ় অপ্রতিরোধ্য অথচ মার্জিত ও শালীন রূপের তিনি পরিচয় দিয়েছেন, সমসাময়িক তো বটেই, আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজেও তার উদাহরণ সহজলভ্য নয়।
সম্পর্কে খুড়তুতো বোন নবনীতা দেব সেন লিখেছিলেন, তাঁর গজুদি যখন ইন্দিরা গান্ধীর মত ছোট করে চুল কেটে ফেললেন, তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। মাথায় ফুল গুঁজবেন কি করে? শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ডিসেম্বর,২০২৩) যথার্থই লিখেছেন, ‘চুল ছেঁটে ফেলে, হাতকাটা ব্লাউজ় পরে, কপালে টিপ না দিয়ে, দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে, সাজসজ্জায় একটা সম্পূর্ণ অনাড়ম্বর ‘ওয়ার্কিং উয়োম্যান লুক’ এনেও যে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যায়, জীবিকা ও খ্যাতি দুটোই অর্জন করা যায়, মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নেওয়া যায়, সেটা বোধ হয় আমরা সুচিত্রা মিত্র-র কাছেই প্রথম জেনেছি। তাঁর সেই নিজস্ব স্টাইলে তিনি অনায়াসে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঘরে-বাইরে, নানা পরিসরে।‘ ৫
পুত্র কুণালকে বলতেন, ‘সিগারেট, মদ যা খাবি, বাড়ীতে আমার সামনে। বাইরের লোক এসে বলবে, সুচিত্রা মিত্রের ছেলে মদ, সিগারেট খাচ্ছে – সেটা আমি সইব না। আমি যেন বলতে পারি যে, আমি সব জানি।‘
গান নির্বাচনের ব্যাপারেও প্রথা ভেঙেছেন অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সঙ্গে। দীর্ঘ দিনের সহযাত্রী বান্ধবী তৃপ্তি মিত্রের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণসভায় গান গাইবার কথা। সকলে ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের কোন গান তিনি গাইবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে তিনি গাইলেন প্রেম পর্যায়ের দুটি গান –‘ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে’ এবং ‘বনে যদি ফুটল কুসুম’। এ চয়ন অপ্রাসঙ্গিক, কে বলবে?
আবার বামপন্থী আদর্শে প্রভাবিত এই সুচিত্রাই ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী সফরে যাবার আগে ‘ওঠো ওঠো জয়রথে তব জয়যাত্রায় যাও গো’ গেয়ে শুধু অনেককে বিস্মিতই করেননি, অনেকের কটূক্তিও অর্জন করেছিলেন। তিনি অবশ্য নিজের বিচার-বিশ্বাসে অটল প্রত্যয়ী ছিলেন।
সমসাময়িক শিল্পীদের সকলের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুর সম্পর্ক থাকলেও একজনের সঙ্গে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের পরিসর আজীবন অমলিন থেকে গেছে। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বয়সে বছর চারেকের বড় হেমন্ত সুচিত্রার দিদিদের পরিচিত ছিলেন। সুচিত্রার যখন ১৫ বছর বয়স, সম্ভবত ১৯৪০ সালে, সুচিত্রা ও তাঁর দিদিরা মিলে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন। সুচিত্রা নিজে নাচ ও গান দুটোই করতেন, কিন্তু অন্য চরিত্রগুলিতে সবার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। বিশেষত অর্জুনের চরিত্রে একটি পুরুষকণ্ঠ নিতান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন হেমন্তকে অর্জুনের গানগুলি গাইবার জন্য দিদিরা মহড়ায় আহ্বান করেন। পরে তাঁরা ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিট্যুশনে স্টেজ বেঁধে চিত্রাঙ্গদা অনুষ্ঠিত করেন। তার আগে রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর দলবল নিয়ে কলকাতায় তাঁর নৃত্যনাট্য গীতিনাট্য ইত্যাদি পরিবেশন করে যেতেন। কলকাতার কেউ বিশেষ তা করেননি। সুচিত্রা-হেমন্তদের এই অপেশাদার মঞ্চায়ন সে দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল।
সেই থেকে পরিচয় শুরু। পরে তা প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। দুজনেই পারস্পরিক ব্যক্তি- ও শিল্পীসত্ত্বার গুণগ্রাহী ছিলেন। দুজনের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কি নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বকীয় হলেও কোথাও অনেক মিলও ছিল। স্পষ্ট উচ্চারণ, বাণীর গভীরতা সুরে-স্বরে ব্যক্ত করা, মূল সুর অনুসরণ করেও গানে নিজস্বতার স্ফুটন, অযথা জটিলতা বর্জন করে পরিবেশনা – দুজনের গানেই আমরা এই মিল পেয়েছি।
দুজনকে এক সঙ্গে অনেক গীতিনাট্যে, অনুষ্ঠানে পাওয়া গেছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতই রবীন্দ্রসঙ্গীতেও হেমন্তবাবুর কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তিনি একাধিক বার অকপটে স্বীকার করেছেন সুচিত্রা তাঁকে অনেক গান শিখিয়েছেন। ১৯৮০ সালে রবিতীর্থের একটি অনুষ্ঠানে হেমন্ত বলেছিলেন, ‘আমি যখন বম্বেতে ভীষণ ব্যস্ত, তখন বাল্মীকি প্রতিভা রেকর্ড হবে বলে আমাকে জানানো হল। আমি বললাম বাল্মীকি প্রতিভার গান তো আমি কিছুই জানি না! সুচিত্রা আমাকে বলল, তুমি ভাবছ কেন ? আমার একটা দিন সময় ছিল। ধরে ধরে একটা করে গান ও আমাকে শিখিয়েছে, তারপর আমি রেকর্ড করেছি। সুচিত্রা শেখায় খুব ভাল।‘ সুচিত্রা নিজেও বলেছেন, ‘ও বম্বে থেকে আসত, আর আমাকে বলত, এই দু’তিনটে গান আমাকে শিখিয়ে দাও না। তা হলে রেকর্ড করি।‘ (প্রসঙ্গত, হেমন্ত কখনো গান ‘তোলা’ বলতেন না। তাঁর কাছে বিষয়টা ছিল গান ‘শেখা।’)


কারোর রেকর্ড করা গান যখন খুব জনপ্রিয় হত, তখন অন্য জন, পারস্পরিক পেশাদারী মর্যাদাবশত, তা সাধারণত রেকর্ড করতেন না, বা দুজনেরই অংশ নেওয়া কোন অনুষ্ঠানে সেই গান গাইতেন না।
১৯৪৯এ ‘সন্দীপন পাঠশালা’ নামে একটি ছবিতে হেমন্ত সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাতে তিনি দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন। একটি, ‘জাগো আলস শয়ন বিলগ্ন’ তিনি নিজে গান। অন্যটি, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,’ গাওয়ালেন সুচিত্রাকে দিয়ে। এই গানের সঙ্গে সুচিত্রা তখন সমার্থক হয়ে উঠেছেন।
১৯৮৯এ মৃত্যুর কিছুদিন মাত্র আগে পর্যন্ত হেমন্ত নিজে এ গান রেকর্ড করেননি। কোন এক অনুষ্ঠানে সুচিত্রাকে দর্শক-শ্রোতারা অনুরোধ করেন ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়’ গাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, ‘এর পর হেমন্ত আসবে। এটা ওর গান। ওকেই অনুরোধ করবেন।‘ কিন্তু ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়’ আসলে সুচিত্রাই হেমন্তকে শিখিয়েছিলেন; অন্য আর একটি অনুষ্ঠানে হেমন্ত সে কথা অকপটে জানিয়েছিলেন। সুচিত্রা মিত্রের যুগান্তকারী গান ‘কৃষ্ণকলি’ হেমন্ত রেডিওতে বা অনুষ্ঠানে গাইলেও কদাপি রেকর্ড করেননি। গোর্কি সদনে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর গাওয়া ‘কৃষ্ণকলি’র লাইভ রেকর্ডিং অনেক পরে, সম্ভবত ১৯৮৭-৮৮ সালে একটি এলবামে সংযোজিত হয়ে প্রকাশ পায়। সেটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে সুচিত্রা উপস্থিত ছিলেন। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এই গানটি যখন বাজানো হচ্ছিল, সুচিত্রা চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।’
৩৩ জনের দল নিয়ে সুচিত্রার আমেরিকা ও কানাডায় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ও গানের অনুষ্ঠান পরিবেশনে যাওয়ার পরিকল্পনা বানচাল হতে বসেছিল যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্যয়ভার বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যান। সেই সময় হেমন্ত তাঁর বম্বের বাড়ি বন্ধক রেখে অর্থ সাধনের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সুচিত্রা তাতে রাজি হননি। তিনি হেমন্তকে বলেছিলেন, ‘ও টাকা আমি নিতে পারব না। কিন্তু তোমার এই সাহায্যের প্রস্তাবও আমি জীবনে ভুলব না।‘ তিনি নিজের গয়না বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করে সেই যাত্রা বাস্তবায়িত করেন। এই ঘটনা সুবিদিত। বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর অবশ্য তাঁকে অবাক করে সরকারী চেক তাঁর হাতে এসে পৌঁছয়। শোনা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গোচরে হেমন্তই এই ব্যাপারটি আনেন। ইন্দিরা নিজেও অবশ্য সুচিত্রার গানের অনুরাগী ছিলেন। তিনি কোনও সময়ে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া ‘একলা চলো রে’ আমাকে সর্বদা একলা চলার অনুপ্রেরণা দেয়।’
সুচিত্রার লেখা কবিতার সংকলনে বন্ধুর উদ্দেশ্যেও একটি কবিতা ছিল – ‘হেমন্তকে’।
আমেরিকা প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায় সুচিত্রার ছাত্রী ছিলেন। তাঁর একটি ব্লগে (জন্মশতবর্ষে সুচিত্রা মিত্র, banglalive.com, অক্টোবর ২৮, ২০২৪) তিনি যে একটি ঘটনার কথা লিখেছেন তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেছেন নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠান করতে। তখন সুচিত্রা-পুত্র কুণালের সঙ্গে ভাবী বধূ পামেলার বন্ধুত্বপর্ব চলছে। কুণালের মা যে একজন স্বনামধন্যা শিল্পী, তা প্যাম তখন জানতেন না। কুণাল সে বিষয়ে তাকে কখনো বলেননি। প্যাম ছিলেন হেমন্ত কুমারের ফ্যান। তাই কুণাল তাকে নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে। মাইকে বার কয়েক ঘোষণা হল, হেমন্ত কুমার কুণাল মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে চান। বিরতির সময়ে বিস্মিত প্যামকে নিয়ে কুণাল গ্রিনরুমে ঢুকতেই হেমন্ত ‘কী রে বাবু, কেমন আছিস’ বলে কুণালকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘তোর মা তোর জন্যে একটা প্যাকেট দিয়েছে’ বলে সেটি ধরিয়ে দিলেন। পরে কুণাল বলতেন, ‘প্যাম সেদিন থেকে আমার মর্ম বুঝল। হেমন্ত কুমারের জন্য আমার স্টেটাস বেড়ে গেল। তিনি যে আমার মা’র দেওয়া জিনিষও বয়ে নিয়ে এসেছেন! তবেই বোঝ ব্যাপারটা।‘ ৬
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই প্রবাদপ্রতিম চতুষ্টয়ের অন্য এক স্তম্ভ দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে গণনাট্যের সময় থেকেই সুচিত্রার বন্ধুত্ব। বয়সে প্রায় ১৪ বছরের বড় হলেও সুচিত্রা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে তাঁকে জর্জ বলে সম্বোধন করতেন, আর জর্জ সুচিত্রাকে বলতেন দিদিমণি। আই পি টি এর জন্য একসঙ্গে তাঁরা মহড়া করেছেন, বহু জায়গায় গান গেয়েছেন। দেবব্রতর গান ও গায়কিকে সুচিত্রা এক সময় পর্যন্ত বিশেষ কদর করতেন, দেবব্রতও সুচিত্রার গানের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর বাড়ীতে বইয়ের তাকে একজনেরই ফ্রেমবদ্ধ ছবি স্থান পেয়েছিল, সেটি দিদিমণির। কিন্তু একটা সময় এই সম্পর্কে চিড় ধরে, যখন দেবব্রত রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেন, বেড়াজাল ভাঙতে উদ্যোগী হন। অন্তত কিছু মহলের এমনই ধারণা ছিল। সুচিত্রা গুরুদেবের গানের মূলীভূত রূপকে কোনভাবে পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী ছিলেন, জনসমক্ষে তা ব্যক্তও করেন। দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড যখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের দ্বারা অনুমোদন পেতে বারংবার ব্যর্থ হ’ল, সুচিত্রা তখন সেই বোর্ডে। অভিমানী দেবব্রত রেকর্ড করা বন্ধ করলেন। কানাঘুষো চলল, এই অননুমোদনের পিছনে অন্যদের সঙ্গে সুচিত্রাও যুক্ত। সুচিত্রা এ নিয়ে প্রত্যক্ষ কোন বিবৃতি তখন জনমাধ্যমে দেননি। পরে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন যে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড জর্জের কোনও রেকর্ড কখনও বাতিল বা খারিজ করেনি। কথাটা এক দিক দিয়ে সত্য। দু-চার জায়গায় কিছু পরিবর্তন করতে বলা হয়েছিল, সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়নি। শোনা যায়, হেমন্তও দেবব্রতকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কনিষ্ঠ শিল্পীরা তাঁর গানের এমনধারা মূল্যায়ন করবে, দেবব্রতের কাছে তা অপমানজনক মনে হয়েছিল।
১৯৭৫-৭৬ সালে সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্য দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন এবং সেই সুত্রে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত ছিল। সানডে ম্যাগাজিনে সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে পূর্বোল্লিখিত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবার পর একদিন দেবব্রতের বাড়ি গেলে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘শোনালাম দিদিমণিরে লয়ে কী একটা লিখেছেন আপনার কাগজে ? …এও শোনালাম আমারে গালটাল দেন নাই। নাকি দিয়াছেন, আপনি দয়া কইরা ল্যাখেন নাই?’ (জীবন থেকে জীবনে, তৃতীয় পর্যায় – পর্ব ১৩, banglalive.com, মার্চ ১৩, ২০২৪) ১
১৯৮০র ২১শে মার্চ রবীন্দ্র সদনে দেবব্রত বিশ্বাসের বহুচর্চিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় হেমন্তবাবু ও বাণী ঠাকুরের কিংশুক গোষ্ঠীর উদ্যোগে। হেমন্তর আহ্বানে সুচিত্রা অসুস্থতা সত্ত্বেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা তাঁকে কিছু বলবার অনুরোধ করলে হেমন্ত বলে ওঠেন, ‘আমি সুচিত্রাকে এই শর্তে নিয়ে এসেছি যে ওকে কিছু বলতে হবে না। ও অসুস্থ। আপনারা দয়া করে ওকে কিছু বলার অনুরোধ করবেন না।‘ ৭
অল্প কথার মানুষ হেমন্তবাবু অতি সহজভাবে সেই যে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা শেখায় খুব ভাল’, তা নিছক মজার ছলে বলেননি। সতীর্থ দ্বিজেন চৌধুরীর সঙ্গে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান রবিতীর্থ সুচিত্রা তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, তার অগণিত ছাত্রছাত্রী তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণে বারবার তাঁর অসাধারণ শিক্ষণশৈলীর বর্ণনা করেছেন। শিল্পী সুচিত্রার পাশে এই শিক্ষয়িত্রী সুচিত্রা কম উল্লেখ্য নন। সৌমিত্র কর বলছেন, ‘তাঁর ক্লাসে ঢোকাটাও একটা দেখার মত বিষয় ছিল। দরজা খুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে ঢুকে টেবিলের ওপর দুম করে ব্যাগ, জলের বোতল ইত্যাদি যাবতীয় জিনিষ রেখে দিয়েই চক নিয়ে বোর্ডে সে দিনের গানের স্বরলিপি লিখতে শুরু করতেন। অবলীলায় পুরো গানের স্বরলিপি একবারে অমনভাবে লিখে দিতে আমি কাউকে দেখিনি। একটা স্পর্শস্বরও বাদ পড়ত না। লেখা শেষ হলে আবার আমাদের বলতেন, ‘কোথাও ভুল হল কিনা একটু দেখে নিও।‘ আরো বলছেন, ‘স্বরলিপি আমরা কখনোই পুরোপুরি ঠিক করতে পারতাম না। স্বরলিপি করার পরীক্ষা উনি নিজে নিতেন। কোন গানের দু-চার লাইন নিজে কয়েকবার গেয়ে দিতেন। তার স্বরলিপি বানিয়ে আধঘন্টার মধ্যে জমা দিতে হতো। আমরা ভাবতাম, যে কটা গান শেখানো হয়েছে সে কটার স্বরলিপি মোটামুটি জানা হয়ে গেছে, করে দিতে পারব। উনি এসে এমন গান ধরলেন, যা আমরা কখনো শুনিইনি, তাও আবার গানের মাঝখান থেকে চার লাইন।‘ বর্ষীয়ান শিল্পী বিভা সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘সুচিত্রা মিত্রকে তো একটা আলাদা জায়গায় বসিয়ে রেখেছিলাম, তাঁর কাছে গিয়ে এককভাবে গান শেখার সুযোগ কখনো হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রভারতীতে আসতেন স্পেশাল ক্লাস নিতে। ওনার শেখানোটা আমার খুব ভাল লাগতো। খুব কঠিন জায়গাও গানের ভাব বজায় রেখেও খুব সহজ করে শেখাতেন’।
সৌরভ গাঙ্গুলী বলছেন, ‘গান ভুল করলে তিনি যে খুব বকাবকি করতেন, তা নয়। তাঁর ভ্রুকুটি বা মুখভঙ্গিই বুঝিয়ে দিত কোথাও ভুল হচ্ছে। কিন্তু কখনো নিষ্ঠা বা অধ্যবসায়ের অভাব দেখলে অখুশি হতেন, বলতেন অবশ্য পরিহাসছলে। যেমন কেউ যদি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে দেখতে পেতেন, তাকে বলতেন, ‘একটা বালিশ এনে দেব?’ খাতা খুলে কথা দেখে দেখে গাওয়াও তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না।
রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য-গীতিনাট্যের পরিচালনা ও রবিতীর্থের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে পরিবেশনা সুচিত্রার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির এক উল্লেখযোগ্য দিক। সৌমিত্র কর বলছেন, ‘যখন রিহার্সাল চলত, সঙ্গীতে অংশগ্রহণকারীরা ঘরের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গাইতেন। মাঝে নাচের শিল্পীরা অনুশীলন করতেন। একদিকে সুচিত্রাদি ও নৃত্যপ্রণেতা থাকতেন। গানের কোন শিল্পীর যদি দশ মিনিট গান নাও থাকত, জায়গা ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না।’
নৃত্যশিল্পী শান্তি বসু উদয়শঙ্করের নৃত্যগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন এবং দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় তাঁদের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তিনি রবিতীর্থের অনুষ্ঠানগুলিতেও নাচ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘এক একটি প্রোডাকশনের পেছনে সুচিত্রাদি যে কী অপরিসীম পরিশ্রম করতেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। দিনের পর দিন, সারাদিন ধরে রিহার্সাল হত। এক একটি গান ধরে বারবার নাচের সঙ্গে মহড়া চলত। যতক্ষণ না তাঁর নিখুঁত মনে হত, তিনি ছাড়তেন না। শুধু গানই নয়, নাচের দিকেও তাঁর সমান নজর থাকত। কোনও নাচের অংশ অনুপযোগী মনে হলে কম্পোজার রামগোপাল ভট্টাচার্যকে বলতেন, ‘রাম, এটা ঠিক লাগছে না। চেঞ্জ করে দাও।‘’ রামবাবুর মাধ্যমেই সুচিত্রার সঙ্গে ১৯৬৩ সালে তাঁর প্রথম পরিচয়। তার পর বহু বছর ধরে তাঁর অনেক নৃত্যনাট্যের উপস্থাপনায় শান্তিবাবু অংশগ্রহণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ১৯৬৮ সালে উদয়শঙ্করের দলের বিদেশ যাওয়ার কথা, তার রিহার্সাল চলছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। সে সময়ে খবর পেলেন, সুচিত্রাদি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। দেখা হলে বললেন, ‘এবার ‘শ্যামা’ করব। তোমাকে বজ্রসেন করতে হবে।‘ এর আগে সুচিত্রাদি ‘শাপমোচনে’ তাঁকে অরুণেশ্বরের ভূমিকায় নাচ করিয়েছেন, কোন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে সেই প্রথম তাঁর নায়কের ভূমিকায় অবতরণ। তবে অরুণেশ্বরের দেহশ্রী ছিল বিকৃত। কিন্তু বজ্রসেন? শান্তিবাবু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে সুচিত্রাকে বললেন, ‘দিদি, আমাকে দেখতে তো তেমন ভাল নয়, বজ্রসেন কি আমাকে মানাবে?’ সুচিত্রাদি চোখে চোখ রেখে উত্তরে বলেছিলেন, ‘শো-টা আমার। আমিই ঠিক করব কে কোন রোল করবে। আমার মাকালফল চাই না, নাচ চাই।‘
প্রখ্যাত তালবাদ্য বিশারদ, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রমা মন্ডলের স্বামী, বিপ্লব মন্ডলও নৃত্যনাট্যের পরিচালনায় সুচিত্রা মিত্রের অতুলনীয় দক্ষতা ও উদ্যমের কথা বলেছেন। সুচিত্রার সঙ্গে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের প্রযোজনায় অংশ নেবার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রসাহিত্য বা তাঁর নাটক সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ সম্যক ধারণা ছিল না। বিপ্লববাবু বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের নাটকের গান তো শুধু দাদরা কাহারবা নয়। সুচিত্রাদি পাশে বসিয়ে বোঝাতেন, কোন গানের সিচুয়েশন কী, তার ভাব কেমন, মানেটা কী। সেই মত লয় কেমন হওয়া উচিত, ইত্যাদি খুঁটিনাটি।’
তরুণ-তরুণীদের যাদেরই গান পছন্দ হত, প্রশংসা করতেন, উৎসাহ, আশীর্বাদ দিতেন। শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘বালিকা বয়সে প্রথম যেদিন তাঁর বাবা নিয়ে গেলেন সুচিত্রার কাছে, তিনি বললেন, ‘কী গান জানিস, একটা গেয়ে শোনা।‘ ‘কী গান গেয়েছিলাম, এখন মনে নেই। কিন্তু এটা স্পষ্ট মনে আছে, গান শুনে তিনি বাবাকে বলেছিলেন, সুভাষ, এ কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা?’ সমরেশ বসুর স্ত্রী গৌরী বসুর গান শুনে তাঁদের নৈহাটির বাড়ীতে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনি রেডিওতে চলুন। এমন তৈরী, রেওয়াজি গলা আপনি এখানে বসে নষ্ট করবেন?’ এই প্রস্তাব তাঁকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু সাংসারিক কারণে গৌরী স্বামী-পুত্র-কন্যাদের ছেড়ে তখন শিল্পী জীবনে প্রবেশ করতে চাননি। একবার এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় আজকের প্রখ্যাতা শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত প্রতিযোগী এবং সুচিত্রা বিচারক। স্বাগতার গাওয়া ভজন শুনে অভিভূত সুচিত্রা তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার কাছে এসো। আমি তোমার কাছে ভজন শিখবো, তোমায় আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবো।‘
অথচ পুত্র কুণালকে তিনি কোন মঞ্চে কখনো গাইতে দেননি। দ্বিজেন চৌধুরীর কাছে শিখিয়েছেন, নিজেও সময় পেলে শেখাতেন। কুণাল বলেছেন, ‘গানের গলা আমার খারাপ ছিল না। তবু মা জনসমক্ষে একবারও গাইতে দেননি।‘ সুচিত্রা তাঁকে বলেছিলেন, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা দেবব্রত বিশ্বাসের মতো শিল্পী হতে পারবে মনে করলে চেষ্টা করে দেখ, নইলে পড়ালেখায় মন দাও।‘
সুচিত্রা মিত্র কলকাতায় বেথুন স্কুলে পড়াকালীন অমিতা সেন ও অনাদি দস্তিদারের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা লাভ করেন। তার আগেই অনেক ছোটবেলা থেকে তাঁর বাবার সুহৃদ পঙ্কজ মল্লিকের গান শুনে সঙ্গীতের ব্যাপারে ধারণা ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। পরে শান্তিনিকেতনে তিনি ইন্দিরা দেবী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষের মত দিকপালদের থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের ও ভি ভি ওয়াঝেলওয়াড়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম পান। তবে তিনি নিজে শান্তিদেব ঘোষকেই তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিগদর্শক গুরু হিসেবে সর্বাধিক মান্যতা দিয়েছেন। উদাত্ত কণ্ঠে, সুস্পষ্ট উচ্চারণে, সুর, স্বর এবং ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে যে পদ্ধতিতে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, দীনেন্দ্রনাথ ও শান্তিদেব গাইতেন, সুচিত্রাকে সেই ধারারই অন্যতমা, সম্ভবত শ্রেষ্ঠা সুযোগ্যা উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য করা হয়। সুচিত্রার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শান্তিদেব বলেছিলেন, ‘গুরুদেব ও দিনুবাবু যে ভাবে গাইতেন ও শেখাতেন, আমিও সে ভাবেই শেখাবার চেষ্টা করি। তার থেকে তোমার মত দু-একজন যারা পেরেছে, শিখে নিয়েছে।‘ এই শিক্ষার পেছনে যে কত আন্তরিকতা ছিল, তা বুঝতে গেলে জানতে হবে যে ১৯৪৩ সালে, যখন তিনি বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী, তখনই এচএমভির কর্ণধার হেম সোম তাঁকে রেকর্ড করার আহ্বান জানান, কিন্তু সুচিত্রা তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এখনও শিখছি। এখন রেকর্ড করলে শেখার থেকে বিভ্রান্তি হবে।‘ ১৯৪৫ সালে ডিপ্লোমা অর্জন করার পরই তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রনাথের গান এবং তাঁর নিজের গায়নরীতি সম্পর্কে সুচিত্রা অনেক জায়গায় তাঁর চিন্তাধারা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিমার যেমন কাঠামো থাকে, তেমনি গানের কাঠামো তার স্বরলিপি। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সম্যকভাবে আত্মস্থ এবং উপস্থাপিত করার জন্য তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল তার বাণীকে কেবল বোঝা নয়, উপলব্ধি করা।’ শান্তিদার কাছে এই শিক্ষাই তিনি পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন তিনি গুরুদেবের গান গাইতেন, কথাগুলো যেন একের পর এক আপনিই এসে যেত; তাঁর মনে হত, রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁরই মনের কথা চুরি করে লিখে দিয়েছেন। তখন সে গান আর রবীন্দ্রনাথের থাকতো না, তাঁর নিজের হয়ে উঠতো। প্রকৃতি পর্যায়ের গানে যে সব বর্ণনা আছে, তা তিনি মানসচক্ষে দেখতে পেতেন, এমনটা তিনি পারতেন।’ একটি সাক্ষাৎকারে প্রমিতা মল্লিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পূজা বা প্রেম পর্যায়ের গানগুলি তো বেশ abstract, সেখানে এই দৃশ্যায়ন কি ভাবে সম্ভব?’ সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘তার জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে, তাঁর জীবন ও জীবনদর্শনকে জানতে ও বুঝতে হবে। তবেই সম্ভব।’
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে পড়া দরকার। নিজের মতো করে বোঝা দরকার। তার পরই তো গানটা হয়ে উঠবে নিজের গান। যেমন মোহরের গান, জর্জের গান।
সুচিত্রা বলেছিলেন, “আমি নিজে যখন গাই, তখন শান্তিনিকেতনে যেভাবে শিখেছি, সেভাবে গাই। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের যখন শেখাই, স্বরবিতান অনুযায়ীই শেখাই।“ এর অর্থ, শান্তিনিকেতনে যা শিখেছিলেন, তার সঙ্গে অনেক গানেই স্বরবিতানে মুদ্রিত স্বরলিপির প্রভেদ আছে। এতে অবশ্য আশ্চর্যের বিশেষ কারণ নেই। তাঁদের সঙ্গীত শিক্ষার সময়ে স্বরবিতানের আবির্ভাব হয়নি। এবং অনেক গানের স্বরলিপিও তখন পাওয়া যেত না। সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করতেন তাঁদের গুরুদের প্রদত্ত শিক্ষা। পরে বিভিন্ন ব্যক্তির করা স্বরলিপি সংকলিত হয়েছে, অনেক স্বরলিপি নতুন করে নির্মাণ করতে হয়েছে, এবং একই গানের রূপান্তরও মূল মুদ্রিত স্বরলিপির সঙ্গে সংযোজন করা হয়েছে।
সৌরভ গাঙ্গুলীর মতে সুচিত্রা মিত্রই রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি সঙ্গীত শিক্ষা না পাওয়া শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র, যাঁর গাওয়া রেকর্ডের ভিত্তিতে মূল স্বরলিপির ভিন্ন রূপও বিশ্বভারতীকে স্বরবিতানে সংযোজন করতে হয়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৪৮ সালে। গানটি তখনই জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সুচিত্রার গাওয়া এ গান সেখানে আরও অধিক ব্যাপ্তি ও প্রচার লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর যখন সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এই গানের প্রথম দুই স্তবক নির্ধারিত হল, তখন বাংলাদেশ সরকার বিশ্বভারতীর কাছে গানটির সঠিক স্বরলিপি চেয়ে পাঠান। গানটির মূল স্বরলিপিকার হলেন ইন্দিরা দেবী। সেটিই তাঁদের কাছে পাঠানো হয়। তার সঙ্গে সুচিত্রার গাওয়া রেকর্ডের প্রভেদ পাওয়া গেলে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বভারতীকে এই দুই স্তবকের একটি রূপান্তর প্রকাশের অনুরোধ করেন, কারণ সুচিত্রার গাওয়া গীতিরূপটিকেই তাঁরা জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছিলেন। অবশেষে শান্তিদেব ঘোষ এই স্বরলিপি রচনা করেন ও তা স্বরবিতান-৪৬এ সংযোজিত হয়।
যদিও তিনি বলেছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের তিনি স্বরবিতান অনুযায়ী শেখাতেন, কিন্তু সৌরভবাবু বলছেন, তা সর্বাংশে ঠিক নয়। রবিতীর্থে সংরক্ষিত স্বরবিতানের খণ্ডগুলিতে বহু জায়গায় সুচিত্রার নিজের হাতে পেন্সিল দিয়ে করা পরিমার্জন আছে। পরিণত বয়সে যখন আর বোর্ডে দাঁড়িয়ে স্বরলিপি লিখতে পারতেন না, তখন ঐগুলিরই প্রতিলিপি শিক্ষার্থীদের দিতেন। তবে মূল সুরকে অতিক্রম করে সে সব পরিবর্তন নয়। ব্যবহারিক কারণে, বা গানের বাণীর প্রতি যথার্থ সুবিচারের বিবেচনায়, কিছু অদলবদল তিনি করতেন। সৌরভবাবু উদাহরণ দিয়েছেন রবিতীর্থে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মহড়া চলার সময় একটি ঘটনার। রবিতীর্থের ‘শ্যামা’ সুচিত্রাদি করাতেন নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ এবং মূল আধার কবিতা ‘পরিশোধ’এর থেকে আংশিক নিয়ে একটি মিশ্রিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী। বজ্রসেন যখন কোটালকে বলছে ‘আমি বণিক,’ স্বরলিপিতে সেখানে তাল রক্ষার নিয়মে চার মাত্রা জুড়ে ‘ব-ণ-ই-ই-ই-ই-ক’ শব্দের বিস্তার দেখানো আছে। কিন্তু সুচিত্রাদির এটা পছন্দ ছিল না। তিনি বলতেন, ‘নাটকের গান আসলে সংলাপ, তবে সুরে। আমরা কাউকে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় টান দিয়ে বলি না, আমি ‘অমউউউউক’। তাই ‘বণিক’এর ‘ই’কে হ্রস্ব করে গাওয়াই যুক্তিযুক্ত।’ কিন্তু যিনি বজ্রসেন গাইছিলেন, তিনি স্বরলিপির দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে অনেক চেষ্টার পরেও তার থেকে বেরোতে পারছিলেন না। চার-পাঁচ বারের পরেও যখন হল না, সুচিত্রাদি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “যাও বাপু, তোমাকে দিয়ে নাটকের গান হবে না। তুমি ঘরে গিয়ে ‘রূপে তোমায় ভোলাব না’ গাও।“
সৌরভবাবু ভাবলেন, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ও তো ‘অরূপরতন’ নাটকের গান। তবে সুচিত্রাদি এ গানের কথা কেন তুললেন ? আসলে, এই গানটি ঢালা গান। মুক্ত তালের এ গানে অনেক বিস্তার করে গাইবার পরিসর আছে। কিন্তু নৃত্যনাট্যে ‘আমি বণিক’এর মত সংলাপ-প্রধান গানে অত ঢেলে গাইবার প্রয়োজন নেই। এই কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন।
গানের দাবি অনুযায়ী, স্বরলিপিতে যেখানে অবসান চিহ্ন আছে, অনেক গানে তার থেকে অন্য জায়গায় তিনি গান শেষ করতেন। যেমন ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’তে অবসান চিহ্ন থাকলেও তিনি গান সব সময় শেষ করতেন ‘তবু অনন্ত জাগে’তে গিয়ে। কারণ, তিনি বলতেন, ‘গানটির মূল বার্তা ওই স্থানেই।’ অনেক ভাঙা গান মূল গানের সুর অনুযায়ী স্বরলিপিতে অবসান করা হয়েছে। ঝিঁঝিট রাগের ‘তোমারি মধুর রূপে’র অবসান চিহ্ন আছে ‘তোমারি’তে। কিন্তু সুচিত্রাদি শেষ করতেন ‘রূপে’তে গিয়ে। তাঁর মত ছিল ‘তোমারি’তে শেষ করা অত্যন্ত আকস্মিক হয়ে যায়। এমন আরো উদাহরণ আছে।
সঙ্গীত জীবনে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিও তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নতুনভাবে অনুধাবন ও সেইমত কিঞ্চিত ভিন্ন রূপে পরিবেশনে অনুপ্রাণিত করেছে। তার মধ্যে সুরের অদলবদলও হয়েছে, তা স্বরবিতান-প্রভাবিত কি না সেই নিয়ে চর্চা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই গানটি তিনি অসংখ্যবার গেয়েছেন, এবং তাঁর অন্তত তিনটি রেকর্ডিং পাওয়া যায়। প্রথম সেই ১৯৪৯ সালের ‘সন্দীপন পাঠশালা’র রেকর্ড, আর সর্বশেষে ১৯৮৯তে আমজাদ আলী খানের সঙ্গে দ্বৈত অনুষ্ঠানের রেকর্ড। এগুলি শুনলেই পরিবেশনার পরিবর্তন নজরে আসবে। বিশেষত, ‘না আসে’র ‘আসে’ শব্দটিকে সন্দীপন পাঠশালায় তিনি যে ভাবে সুরের তারতম্য করে গেয়েছিলেন, পরে তা তিনি বর্জন করে গেয়েছেন।
আমজাদ আলী খান সুচিত্রা মিত্রের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। আরো বহু বছর আগে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবিসম্বাদিত পিতৃপুরুষ উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবকেও সুচিত্রা তাঁর গানে সম্মোহিত করেছিলেন। ১৯৫০ সালের ঘটনা। সে বার অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে গান গেয়ে সুচিত্রা স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, উইংসের ধারে বসে সে গান শুনে উস্তাদজী সুচিত্রাকে অভিনন্দন জানান। তখন খাঁ সাহেব পার্ক সার্কাসে একটি বাড়িতে উঠেছিলেন। সুচিত্রা খাঁ সাহেবের রেওয়াজ করার পদ্ধতি দেখার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করেন। আমন্ত্রিত হয়ে সুচিত্রা ও দ্বিজেন চৌধুরী একদিন ভোরবেলা পার্ক সার্কাসের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ পর রেওয়াজ ঘরে খাঁ সাহেব এলেন। সুরমণ্ডলে সুর মেলাতে মেলাতে সুচিত্রাকে বললেন, ‘বেটি, আপ সুর লাগাইয়ে।‘ সুচিত্রা ধরলেন আশাবরী খাম্বাজে সেই ‘অশ্রুভরা বেদনা।’ গানের শেষে বড়ে গুলাম আলি খাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। খুশি হয়ে সেদিন খাঁ সাহেব দুই বন্ধুকে টানা পাঁচ ঘন্টা আহির ভৈঁরোতে খেয়াল শুনিয়েছিলেন।
দেশে বিদেশে অসংখ্য শ্রোতা ও বোদ্ধার প্রশংসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করলেও সুচিত্রা মিত্রকেও জীবনের বিভিন্ন সময়ে সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। শোনা যায় কোন এক প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর গলায় নাকি তারার গান্ধারের ওপরে সুর ওঠে না। তখন তিনি গলা তোলার বদলে ঘাড় তুলে দেন। তাঁর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকেও রেহাই পাননি। “যারা তাঁকে কেন্দ্র করে কোনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি, তারা তাঁর সম্বন্ধে বিশেষণ যুক্ত করেছে, ‘বাগান বিলাসিনী বোগেনভিলিয়া।’“ ৮
কিন্তু যিনি সঙ্গীতজীবনের একেবারে প্রারম্ভেই এক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞের অনাবিল প্রশস্তি অর্জন করে ধন্য হয়েছিলেন, চলার পথে এমন কতিপয় কটূক্তি তাঁকে কি বিচলিত করতে পারে? সেই চল্লিশের দশকের মধ্যভাগেই ডেকার্স লেনে একটি অনুষ্ঠানে সুচিত্রার গান শুনে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “সে বেশ গলা ছেড়ে পুরো দমে গান গায়। এর মধ্যে কোন গোঁজামিল নেই। তার সাবলীলতা, সে একটা দেখার এবং শোনার জিনিষ বটে। তার ছন্দজ্ঞানও অসামান্য। …সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দীনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন। …শুনলাম মেয়েটি কমিউনিস্ট। কমিউনিজমে দেশে সাহিত্যের উন্নতি ঘটেছে কিনা জানি না, তবে ঐ মেয়েটির গলার কোন ক্ষতি হয়নি।“
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছিলেন, ‘সুচিত্রার গাওয়া এমন কিছু গান আছে, যা কেবল তার গলাতেই শুনতে ইচ্ছে করে।’ সুচিত্রা মিত্রের নামের ও কণ্ঠের সঙ্গে সহজেই চিহ্নিত করা যায়, এমন বহু গান রয়েছে। ‘ও আমার দেশের মাটি,’ ‘সার্থক জনম আমার,’ ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,’ ‘অশ্রুভরা বেদনা,’ ‘তবু মনে রেখো,’ ‘হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে,’ ‘আমার রাত পোহালো,’ ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে,’ ‘পেয়েছি ছুটি,’ ‘এই আকাশে আমার মুক্তি,’ ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু,’ ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে,’ ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে,’ ‘তবু মনে রেখো,’ অথবা সেই অবিস্মরণীয়, অননুকরণীয় ‘আমি চিত্রাঙ্গদা,’ এমন কত গান যে আছে, যার উল্লেখ হলেই আপনিই যেন সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠ আর গায়কিই মনের মধ্যে অনুরণন তোলে।
এবং ‘কৃষ্ণকলি।’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন ‘আনন্দধারা,’ সুচিত্রা মিত্রের তেমনই যুগান্তকারী, কালজয়ী নিবেদন ‘কৃষ্ণকলি।’ এ কথা অবশ্যই অকাট্য যে এই সব মহান শিল্পীদের সমগ্র জীবনের সার্বিক সৃষ্টিসম্পদেই তাঁদের যথার্থ মূল্যায়ন যুক্তিসঙ্গত, তবুও, যে কোনও একটি গানের উল্লেখে যদি একটি নামই সর্বপ্রথম মনে এসে যায়, তবে বলতেই হয় যে সেই গান সেই শিল্পীর স্বাক্ষর বহনকারী। তাই সুচিত্রার ‘কৃষ্ণকলি’ নিয়ে দু কথা অনিবার্যভাবে এসে যাবেই।
কিন্তু ‘কৃষ্ণকলি’রও অনেক বছর আগে সুচিত্রা অন্য আর একটি যে গান রেকর্ড করেছিলেন, তার কথা আগে না বললেই নয়। এবং তা রবীন্দ্রনাথের গান নয়। রবীন্দ্রনাথ ময়নাপাড়ার মাঠে যে কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ দেখে এক কাব্যিক কল্পনা চিত্রায়িত করে কথকতায় বাণীময় করেছিলেন, সেই কালো মেয়েকেই অন্য এক সময়ে, অন্য এক কঠিন পরিস্থিতির মাঝে, শহরের রাস্তায় আশ্রয়হীন পরিযায়ীর ক্লিষ্ট রূপ দিয়ে সলিল চৌধুরী সৃষ্টি করলেন এক কঠিন বাস্তবতার গান – ‘সেই মেয়ে।’ এবং সে গান রেকর্ড করালেন সুচিত্রা মিত্রকে দিয়ে।
সালটা ১৯৫০। ‘সেই মেয়ে’ প্রকাশ পাওয়ার পরেই সাড়া ফেলেছিল। আর তার সবটাই ইতিবাচক ছিল না। ‘প্রগতিশীল’ সমাজ ও অনেক সঙ্গীতবোদ্ধারা গানের অভিনব আঙ্গিক, সমসাময়িক মানবিক মূল্যবোধের সমস্যার প্রতিফলন, সুরবৈচিত্র্য, এবং সর্বোপরি সুচিত্রার অসাধারণ অভিব্যক্তিময় গায়কির প্রশংসা করলেন। কিন্তু অন্যদিকে, কতিপয় স্বঘোষিত ‘রবীন্দ্রানুরাগী’ গোষ্ঠী গানটির নিন্দায় শুধু মুখর হয়েছিলেন তাই নয়, জনপথে সক্রিয়ভাবে বিরোধ প্রদর্শনে নেমে এসেছিলেন। এক দাগি কম্যুনিস্টের পাল্লায় পড়ে ‘কৃষ্ণকলির’ প্যারডি গেয়ে সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রনাথের অপমান করেছেন, এমন অভিযোগ আনা হল। সুচিত্রার সামনে ‘সেই মেয়ে’র রেকর্ড রাস্তায় আছড়ে ভেঙে চুরমার করা হল।
পরবর্তী সময়ে একটি নিবন্ধে সুচিত্রা লিখেছিলেন,
আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, সেই মেয়ে কৃষ্ণকলির প্যারডি নয়। …. রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীত প্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।


সলিল চৌধুরী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েও স্বরচিত দুটি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। সে রেকর্ড কিন্তু দিনের আলো দেখতে পায়নি। বিশ্বভারতী থেকে কণিকাকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সে রেকর্ড বেরোলে তাঁকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। অগত্যা কণিকা সলিলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন রেকর্ড যেন প্রকাশ না পায়। টেস্ট প্রিন্ট হাতে পেয়েও সলিল চৌধুরী শেষমেশ রেকর্ডটির মুক্তি বন্ধ করে দেন।

সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সুচিত্রা লিখেছিলেন, “…অনবদ্য সেই গান দুটো বাজারে ছাড়া হল না। …শান্তিকামী মোহর অশান্তির ভয়ে গানদুটো গাইল না বলে আক্ষেপ রয়ে গেল।“
সুচিত্রা মিত্রকে অবশ্য এই সব বৈরী প্রতিরোধ আটকে রাখেনি। পরের বছরই তিনি সলিলের সৃষ্ট আরও দুটি গানে অন্যদের সঙ্গে মুখ্য কণ্ঠ দিলেন – ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’ এবং ‘আমাদের নানান মতে।’ কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে আইপিটিএ-র ব্যানারে সে রেকর্ড প্রকাশ পায়।
আজ এত যুগ পরে সেই বিদ্বেষী প্রতিবাদ কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু সলিল-সুচিত্রার ‘সেই মেয়ে’ সৌভাগ্যবশত আজও এই ইউটিউব ইত্যাদির জমানায় শুনতে পাওয়া যায়।
এর প্রায় এক দশক পরে সুচিত্রা ফিরে গেলেন গুরুদেবের সেই আদি কালো মেয়েটির কাছে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে তাঁর ‘কৃষ্ণকলি’ রেকর্ড হয়ে বেরোল। গুরুদেব শুধু একা রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁর সঙ্গীতগুরু শান্তিদেব ঘোষও বটে। কারণ এই গানটি শান্তিবাবুই গেয়েছিলেন, গানটির নির্মাণেও তাঁর সক্রিয় অবদান ছিল। সুচিত্রাকেও শান্তিদেবই এই গানের তালিম দেন।
রবীন্দ্রনাথের গানের বৈচিত্র্যময় বিবিধতার এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ‘কৃষ্ণকলি।’।আসলে এটি একটি কবিতার গীতিরূপ। ১৯০০ সালে ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটির প্রথম প্রকাশ। শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন –
১৯৩১ সালে বর্ষামঙ্গলের জন্য যখন নতুন গানের প্রয়োজন পড়ল, তখন এই কবিতাটিকে সুরারোপ করে গান করা হয়, এবং সে কর্মে তাঁরও নিজস্ব অবদান ছিল। কবিতাটির অভিনবত্ব লক্ষণীয়। ভারতীয় সাহিত্যে রাধাকৃষ্ণের লীলায় পুরুষ-প্রকৃতির মিলন বিষয় হিসেবে বহু প্রাচীন। কিন্তু এই কবিতায় মেয়েটি কৃষ্ণকায়, সাধারণ, গ্রাম্য। তার কালো চোখে, এলায়িত কেশে, ভ্রুভঙ্গিমায় প্রকৃতি ধরা দেয় এক পুরুষের দৃষ্টিতে। এই কবিতা যখন গান হয়ে দাঁড়াল, সেও এক অনন্য নজিরহীন ব্যাপার।
গানটির প্রসঙ্গে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –
এই গানে ভবিষ্যৎ সুরকারদের জন্যে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। কথকতার ঢঙ নিয়েও যে গানে কত রকমের বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে, তার পরিচয় পেয়ে বিস্ময় জাগে। …. গানটিতে সুর বলতে প্রায় কিছুই নেই।, কেবল এখানে ওখানে একটু-আধটু কেদারা, মল্লারের রেশ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কীর্তন ও বাউল সুরের ছোঁয়াও আছে। ‘কালো’ কথাটিকে ব্যবহার করলেন ঠিক সেই ভাবে যেভাবে আমরা কথা বলি। সবটা মিলিয়ে যা হল তা বাংলা গানের অজানা সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছে।“ (রবীন্দ্রনাথের গান, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এ হেন গান গেয়েছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, তারপর সাহস করলেন সুচিত্রা মিত্র। রেকর্ড বেরোবার পর যে জনপ্রিয়তা অর্জন করলো তা অতুলনীয়। এবার আর কোনও বিরোধ নেই, শুধুই মুগ্ধতা। তিনি গাইলেন শান্তিদেবেরই শৈলীতে, কিন্তু সমগ্র গানে নিজস্ব গায়কি এবং বোধ স্পষ্ট। তাঁর পরে আরও অনেকে ‘কৃষ্ণকলি’ গেয়েছেন, কিন্তু সুচিত্রা মিত্র ও ‘কৃষ্ণকলি’ অবিচ্ছেদ্য, সমার্থক। বলা যায়, একটা benchmark। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অন্য গানের লাইভ রেকর্ডিং-এর সঙ্গে যখন ‘কৃষ্ণকলি’ও ক্যাসেট হয়ে বেরোল, সেই উন্মোচন অনুষ্ঠানের পরে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্য তাঁকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এতদিন কেন কৃষ্ণকলি রেকর্ড করেননি?’ হেমন্ত তাঁকে বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণকলি সুচিত্রারই গান। ওরই থাক। তবে, আমারটাও শুনো।‘
এমন কোন অনুষ্ঠান বোধহয় হত না যেখানে সুচিত্রা গাইতেন এবং কৃষ্ণকলির অনুরোধ আসতো না। কিন্তু পর্যাপ্ত মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া এ গান তিনি গাইতেন না। বলতেন, ‘কৃষ্ণকলি আজ ট্রেনের রিজার্ভেসন পায়নি। আপনারা বরং বসন্তের গান শুনুন।‘ বারংবার বলেছেন, কৃষ্ণকলি যখন তিনি গান, তাঁর মানসচক্ষে ওই পাঁচটি স্ট্যানজার ছবি একের পর এক চলচ্চিত্রের মত ভেসে ওঠে।
‘কৃষ্ণকলি’ সম্বন্ধে সুচিত্রার সঙ্গীতচিন্তা বা বিশ্লেষণ কেমন ছিল, সম্প্রতি তা ব্যক্ত করেছেন ইন্দ্রাণী সেন। বোরোলিন প্রযোজিত একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। এক সময়ে তিনিও ‘কৃষ্ণকলি’ রেকর্ড করেছিলেন। তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন লাগতো, যা এই গানটি পেতে ব্যর্থ হয়। তখন তাঁর মা সুমিত্রা সেন তাঁকে বলেন একবার সুচিত্রাদির পরামর্শ নিতে। সেইমত, রেকর্ডিং নিয়ে গিয়ে ইন্দ্রাণী তাঁর সুচিত্রা মাসিকে শোনান। মন দিয়ে শোনার পর সুচিত্রা মাসি তাঁকে বলছিলেন, ‘তুই খুব ভালো গেয়েছিস। কিন্তু কি জানিস, তোর গাওয়াটা পুরোটাই একটা গান হয়ে গেছে। এই গানটার মধ্যে যত গান আছে, তার সঙ্গে আবৃত্তিও আছে, আবার অভিনয়ও আছে। আবার কোথাও গিয়ে কীর্তনের ছোঁওয়া লাগছে।‘ তখন তাঁর শরীর ভাল যায় না, গলা সঙ্গ দেয় না। সেই অবস্থাতে গানটা পুরো গেয়ে তাঁকে তুলিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আবার রেকর্ড কর। যেদিন করবি, আমাকে বলিস, আমি তোর সঙ্গে যাব।‘ এইভাবে দ্বিতীয়বার রেকর্ড করা ইন্দ্রাণীর ‘কৃষ্ণকলি’ বিশ্বভারতীর ছাড়পত্র পেয়েছিল।
একটি প্রশ্ন ‘কৃষ্ণকলি’ নিয়ে সুচিত্রাকে একাধিক বার শুনতে হয়েছে। তাঁর আত্মজীবনীর অনুলেখক অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁকে এই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কৃষ্ণকলি তো পুরুষকণ্ঠের গান। তবে আপনি এই গান কেন গাইলেন ?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন –
আমি শুধু নারী, এ কথা তোমাকে কে বলেছে ? কোন মানুষই শুধু নারী নয়, শুধু পুরুষ নয়। দুটো সত্ত্বাই থাকে ভেতরে। কৃষ্ণকলি আমার পুরুষসত্তা গায়। (মনে রেখো, অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)
চিরকালের আত্মপ্রত্যয়ী সুচিত্রা মিত্রের কৃষ্ণকলি নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই সামান্য স্পর্শকাতরতাও ছিল। একবার শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্য তাঁর একটি অনুষ্ঠানের আলোচনা লিখেছিলেন। তাঁর কথায়, প্রায় তিন পাতা জোড়া সেই লেখাতে সুচিত্রার গানের ভূয়সী প্রশংসাই ছিল। কেবল শেষের দিকে এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন যে ‘কৃষ্ণকলি’ গানে ‘তারেই’ শব্দ তাঁর কাছে ‘তাঁরেই’ শুনিয়েছিল, এবং সুচিত্রা মিত্রের থেকে এমনটা অপ্রত্যাশিত। দেশ পত্রিকায় এই লেখা প্রকাশ পাওয়ার ছ’মাস পর আরও একটি অনুষ্ঠানেও শঙ্করলাল হাজির ছিলেন। সেটি ছিল সুচিত্রা ও কণিকার বহু আলোচিত দ্বৈত অনুষ্ঠান। সেখানে সব গান গেয়ে উঠে যাওয়ার সময় যথারীতি শ্রোতাদের থেকে ‘কৃষ্ণকলি’র অনুরোধ এলো। কিন্তু সুচিত্রা বললেন, ‘কৃষ্ণকলি আমি গাইব না। কারণ এক বিখ্যাত সমালোচক এই গানে আমার উচ্চারণে ত্রুটি পেয়েছেন।‘ এই বলে তিনি উঠে চলে যান। শঙ্করলাল ও সুচিত্রার এই মানসিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। শঙ্করলালও তাঁর বয়সোচিত আত্মশ্লাঘাবশে যোগাযোগে উদ্যোগী হননি। এই ঘটনার বহু বছর পরে একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে গিয়ে শঙ্করলাল যখন বসার জায়গা খুঁজছেন, শুনতে পেলেন একটি ডাক, ‘এই যে ইন্টেলেকচুয়াল, এখানে জায়গা খালি আছে। চাও তো বসতে পারো।‘ ঘুরে দেখলেন, সুচিত্রা মিত্র। এর পর তাঁদের পারস্পরিক সমীকরণে আর কখনো অমিল হয়নি।
দীর্ঘ ৮৭ বছরের জীবনে সুচিত্রা মিত্র তাঁর অগণিত গুণগ্রাহী শ্রোতার এবং ছাত্রছাত্রীদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যেমন পেয়েছেন, তেমনই আবার অনেক বেদনাময়, কঠিন সময় অতিক্রান্ত করেছেন। তাঁর নিজেরই কথায়, সব সময়ে রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল তাঁর অবলম্বন। কিন্তু পরিণত বয়সে অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণ যখন তাঁর কণ্ঠকেও ব্যাহত করলো, সেই মানসিক যন্ত্রণা তাঁর কাছে অসহনীয় ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তেমনই এক পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন তাঁর লেখায়। আশাপূর্ণা দেবীর জন্মদিনে গান গাইতে বসেছেন। কণ্ঠ কেমন যেন ম্রিয়মাণ। সুনীল দেখলেন, সুচিত্রার চশমার ফাঁক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন সুনীল কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কি ! দিদি, আপনি কাঁদছেন কেন ?’ জবাবটা আর্তনাদের মত শোনালো। ‘গলায় সুর লাগছে না। তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী?’
সৌরভ গাঙ্গুলী বলেছেন, ‘দিদি যখন খুবই অসুস্থ, রবিতীর্থে আসতে পারতেন না, তখনও রবিতীর্থের কোন আসন্ন অনুষ্ঠানের অন্তিম মহড়া তাঁর বাড়ীতে গিয়ে করে দেখানো হত। তিনি চেয়ারে বসে পুরো দেখতেন। কথা বলতেন না, কারণ কথা তখন তাঁর জড়িয়ে যেত। কিন্তু কোথাও অপছন্দ হলে বা ভুল দেখলে চেয়ারে নড়েচড়ে বসতেন। অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকারা বুঝে নিতেন, তিনি কোন জায়গায় কী চাইছেন।’
“এই এক গীতবিতান –
আমার কাছে
গীতা বাইবেল কোরান।”
এই বোধহয় তাঁর জীবনের সার কথা।
তথ্যসূত্র –
১ – https://banglalive.com/memoir-on-music-legend-suchitra-mitra/
২ – https://www.anandabazar.com/patrika/a-write-up-on-suchitra-mitra-1.849190
৩ – https://www.anandabazar.com/editorial/essays/a-special-write-up-about-indian-singer-and-composer-suchitra-mitra/cid/1546780
৪ – https://banglalive.com/memoir-on-suchitra-mitra-by-arijit-maitra/
৫ – https://www.anandabazar.com/editorial/essays/essay-some-unknown-stories-of-artist-suchitra-mitra/cid/1478514
৬ – https://banglalive.com/article-on-suchitra-mitra-by-alolika-mukhopadhyay/
৭ – প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের বন্ধুত্ব সুচিত্রা মিত্র ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শুভজিৎ সরকার, কৃত্তিবাস, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
৮ – সুচিত্রা মিত্র: শতবর্ষীয়াকে প্রণাম, গৌতম রায়, আজকাল.in, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
https://www.aajkaal.in/story/24312/_100_years_birth_anniversary_of_suchitra_mitra_gnr#google_vignette
চিত্রঋণ – অন্তর্জাল