প্রোফেসর শঙ্কু – একটি পর্যালোচনা
বয়স পঁয়ষট্টি। বিজ্ঞানী ডারউইনের মতো মাথাজোড়া টাক, কানের ওপরে ও পেছনে অবিন্যস্ত কয়েক গোছা কাঁচাপাকা চুল। গালভরা কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। রোগাটে গড়ন হলেও বেশ শক্তসমর্থ। খ্যাপাটে চেহারা। পরণে শার্ট, কোট ও ঢোলা প্যান্ট। বাড়ি বিহারের গিরিডি। সুয্যি ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে উশ্রী নদীর ধারে প্রাতঃভ্রমণে যান। পেশায় পদার্থবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আর নেশায় বিজ্ঞানের গবেষক। তাই দিনের বেশিরভাগ সময়ই নিজের বাড়িতে তৈরি ল্যাবরেটরিতে ডুবে থাকেন নানা ‘উদ্ভট’ গবেষণায়। আয়নাতে কদাপি নিজেকে দেখেন না। বাড়িতে তিনি ছাড়া আর দুটি প্রাণী থাকে – প্রহ্লাদ ও নিউটন। প্রহ্লাদ তাঁর সাতাশ বছরের বিশ্বস্ত পরিচারক, আর নিউটন হল পোষা বিড়াল। অবশ্য দুটি অ-প্রাণীও থাকে – বিধুশেখর ও রোবু। এরা হল তাঁর তৈরি অদ্ভুত যন্ত্রমানুষ। তাঁর প্রতিবেশীদের মধ্যে অন্যতম অবিনাশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কার নিয়ে বাড়ি বয়ে এসে প্রায়শই ব্যাঙ্গবিদ্রূপ করেন যা তাঁর একেবারেই না-পসন্দ।
তাঁর জন্মতারিখ হল ১৬ জুন। পিতৃদত্ত নাম ত্রিলোকেশ্বর। ডাকনাম তিলু। বাবার নাম ত্রিপুরেশ্বর। গিরিডির নামী আয়ুর্বেদ ডাক্তার ছিলেন। গরিব মানুষদের বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতেন। পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। পিতামহের নাম বটুকেশ্বর। তিনি ছিলেন শ্রুতিধর মানুষ। সব মিলিয়ে তাঁর বংশপরিচয় যেটুকু জানা যায় তা যথেষ্ট গৌরবময়। শৈশব থেকেই তিনি অসামান্য মেধাবী। তিনি নিজেই ডায়েরিতে লিখেছেন তাঁর “পাঁচ বছর বয়স থেকে বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রকাশ” হয়। বন্ধু ভুতোর সাথে টিডলি উইংকস খেলার সময় তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার প্রকাশ দেখে বাবা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষায় সর্বদাই প্রথম হতেন। মাত্র বারো বছর বয়সে গিরিডির স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর চোদ্দো বছর বয়সে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি এবং ষোলো বছর বয়সে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান দুটি বিষয়ে অনার্স নিয়ে পাশ করেন। তারপর মাত্র কুড়ি বছর বয়স থেকে স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পান্ডিত্যের লক্ষণ হিসেবে ১৩ বছর বয়সে তাঁর মাথায় প্রথম পাকা চুল দেখা যায়। সতেরো বছর বয়সে টাক পড়া শুরু হয়। আর ২১ বছর বয়সে কানের দু’পাশে, ঘাড়ের কাছে আর ব্রহ্মতালুতে একগাছা করে চুল ছাড়া পুরো মাথা থেকে চুল ভ্যানিশ হয়ে যায়!
এ হেন অসীম প্রতিভাধর মানুষটি আদতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও কোন বিষয়ে তাঁর পান্ডিত্য নেই? বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় তাঁর অবাধ গতি, বিপুল পান্ডিত্য। বিশ্বের নানা দেশের ভূগোল, ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়েও তিনি সমান জ্ঞানী। তিনি ৬৯ টি ভাষা জানেন ও বলতে পারেন। হায়ারোগ্লিফিক লিপি পড়তে পারেন। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর লিপিও তিনিই প্রথম পাঠ করেছেন।
তাই বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর খ্যাতি জগৎজোড়া। তিনি যেমন বিশ্বের অধিকাংশ খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকে চেনেন ও জানেন, তাঁরাও শঙ্কুকে চেনেন ও জানেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্মানও পেয়েছেন অনেক। সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স তাঁকে বিশেষ সম্মান দিয়েছে। ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন ব্রাজিলের রটানটান ইন্সটিটিউট থেকে। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র, ঔষধ, অস্ত্র, ফর্মুলা ইত্যাদির সংখ্যা সব মিলিয়ে বাহাত্তর। কোনও বৈজ্ঞানীক পরীক্ষায় তিনি কখনও ব্যর্থ হননি। আর তাই পাঁচটি মহাদেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারের নিরিখে তাঁকে টমাস আলভা এডিসনের পরেই স্থান দিয়েছেন।
তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পাবে তাঁর দেশ-বিদেশে অভিযান। কোথায় নয়? সাহারা মরুভূমি, কঙ্গোর অরণ্য, বলিভিয়ার গুহা, বাগদাদের গুহা, সমুদ্রের তলা, তিব্বতের পর্বত প্রভৃতি দুর্গম স্থানেই শুধু নয়, পৃথিবী ছাড়িয়ে তিনি একবার পাড়ি দিয়েছেন মঙ্গল গ্রহেও। তাঁর প্রতিটি অভিযান রহস্য-রোমাঞ্চে জমজমাট। প্রতিটি অভিযানে গিয়ে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা প্রবল প্রাণসংশয়ের মধ্যে পড়েন কিন্তু তাঁর সাহস, বুদ্ধি, স্থিতধী মানসিকতা আর তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র বা ঔষধের প্রয়োগের মাধ্যমে ঠিক বেঁচে ফিরে আসেন।
তিনি নির্লোভ, সৎ, শান্তিপ্রিয় ও একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। প্রাণীহত্যার বিরোধী। এজন্য তাঁর গবেষণার কাজে প্রাণী ব্যবহার করলেও তাদের হত্যা করেন না। এই কারণে তিনি নিরামিষাশীও। বেদ, উপনিষদ ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। তিনি জ্যোতিষে অবিশ্বাসী। তবে ভূত-প্রেত, আত্মা ও পরলোকে অবিশ্বাস নেই। তিনি নিজের পান্ডিত্য ও আবিষ্কারের জন্য খুব গর্বিত। তাঁর নানা কথা ও কাজের মধ্যেও সেই অহঙ্কার প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে কারও অসুবিধে নেই, তিনি কে? তিনি হলেন বাংলা কিশোর সাহিত্যের এক এবং অদ্বিতীয় চরিত্র প্রোফেসর শঙ্কু। আর তার স্রষ্টা হলেন এক এবং অদ্বিতীয় সত্যজিৎ রায়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায়ের চল্লিশতম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁদের পারিবারিক পত্রিকা “সন্দেশ”-এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সেই সংখ্যায় তিনি “ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি” নামে একটি কাহিনিতে প্রথম প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রকে পাঠকের সামনে হাজির করেন। পরপর তিনটি সংখ্যায় (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ) কাহিনিটি শেষ হয়। কাহিনিটির শুরুতে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন, তিনি তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে লাল রঙের একটি অদ্ভুত ডায়েরি পান। তারকবাবু আবার ওই ডায়েরিটি পান সুন্দরবন থেকে। সুন্দরবনে উল্কাপাতের ফলে সৃষ্ট একটি গভীর গর্তের মধ্যে থেকে তারকবাবু সেটি আবিষ্কার করেন। ডায়েরিটি অদ্ভুত, কারণ তার লেখাগুলি দিনের নানা সময়ে রঙ বদল করে। আর ডায়েরিটি আগুনে পোড়ে না, এর পৃষ্ঠা সজোরে টানলেও ছেঁড়ে না, বরং ইলাস্টিকের মতো বেড়ে যায়। এই কান্ড দেখে লেখক ডায়েরির মধ্যে থাকা লেখাগুলি পড়ার জন্য প্রবল কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। রাত জেগে তিনি লেখাগুলি পড়ে ফেলেন, আর তা পত্রিকায় ডায়েরির লেখা আকারেই প্রকাশ করেন। বলাবাহুল্য, ডায়েরিটি প্রোফেসর শঙ্কুর।
প্রথম কাহিনিতেই সত্যজিৎ প্রোফেসর শঙ্কুর সাথে সাথে প্রহ্লাদ, নিউটন আর বিধুশেখরের সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই ডায়েরি-কাহিনিতে প্রোফেসর শঙ্কু নিজের তৈরি করা রকেটে চেপে রওনা দিয়েছেন মঙ্গলগ্রহে। সঙ্গী প্রহ্লাদ, নিউটন ও বিধুশেখর। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত মঙ্গলীয় জীবদের খপ্পরে পড়ে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। তারপর তারা রকেটে চেপে পৌঁছোয় অতি বুদ্ধিমান প্রাণীতে ভারাক্রান্ত এক গ্রহ “টাফা”-তে। সেখানে গিয়ে খুবই আরামপ্রদ পরিবেশে টাফাবাসীদের আতিথ্যে আনন্দেই কাটাচ্ছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু অ্যান্ড কোং। কাহিনি অর্থাৎ ডায়েরির লেখা ওখানেই শেষ। অর্থাৎ কাহিনির শুরুতে অনেকটা মজা, কিছুটা সাসপেন্স, আর কিছুটা কল্পবিজ্ঞানের মিশেলে যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল শেষে এসে যেন হঠাৎই তা মিলিয়ে গেল। পাঠক যেন চাইছিল আরও কোনও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটুক। মনে হয়, সত্যজিৎ রায় এই লেখাটি “সন্দেশ”-এর জন্য কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছাড়াই লিখেছিলেন। পরপর তিনটি সংখ্যায় প্রকাশের সময় তিনি এই কাহিনির প্রতি পাঠকের আগ্রহ লক্ষ্য করে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি স্থির করেন, প্রোফেসর শঙ্কু সিরিজ প্রকাশ করবেন। ফলে প্রায় দু’বছর পর ১৯৭০ সালে “সন্দেশ”-এর বৈশাখ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় প্রকাশ করেন দ্বিতীয় কাহিনি “প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক’।
সিরিজের সেই শুরু। তার পর রোমাঞ্চকর এক একটা কাহিনির মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের দরবারে শঙ্কুকে হাজির করেছেন ৩৩ বছর ধরে। প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে তাঁর লেখনি থেকে বেরিয়ে এসেছে ৩৮টি সম্পূর্ণ কাহিনি। কাহিনিগুলি মূলতঃ “সন্দেশ” ও “আনন্দমেলা” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরে আটটি গল্পগ্রন্থে কাহিনিগুলি সঙ্কলিত হয়েছে। সত্যজিৎ শঙ্কুকে নিয়ে দুটি কাহিনি লেখা শুরু করে শেষ করে যেতে পারেননি। একটি হল ‘ইনটেলেকট্রন’ এবং অপরটি ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’।
সত্যজিৎ রায়ের প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্র সৃষ্টির পেছনে তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের লেখা “হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি”-এর প্রভাব স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যায়। সত্যজিৎ রায় যেমন শঙ্কুর সমস্ত কাহিনি তারিখভিত্তিক ডায়েরি আকারে লিখেছেন, “হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি”-ও একইভাবে লেখা। সেখানে সুকুমার রায় যেমন স্বভাবের সাথে মিলিয়ে মজাদার নামের সব কাল্পনিক জীবজন্তুর নামকরণ করেছেন (যেমন হ্যাংলাসেরিয়াম, গোমড়াথেরিয়াম, ল্যাগ-ব্যাগর্নিস, ল্যাংড়াথেরিয়াম, চিল্লানোসোরাস, বেচারাথেরিয়াম ইত্যাদি) তেমনই সত্যজিৎ শঙ্কুর যাবতীয় আবিষ্কারের আজব নাম দিয়েছেন। তিনি শঙ্কুর পোষ্য বিড়ালের নাম যেমন বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের নামে রেখেছেন তেমনই শঙ্কুর বন্ধু বিজ্ঞানী হামবোল্টের পোষ্য কুকুরের নাম রেখেছেন সম্রাট নেপোলিয়নের নামে! “আশ্চর্য প্রাণী” গল্পে তিনি একটা সলিউশনের নাম দিয়েছেন ‘প্রোটোভিট্রোমর্ফিজেনারাস সলিউশন’! এই সলিউশনে ‘নিউট্রাল ইলেকট্রিক বম্বার্ডমেন্ট’ করে শঙ্কু ও হামবোল্ট কৃত্রিমভাবে প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।
তবে প্রোফেসর শঙ্কুর প্রতিটি কাহিনি পড়লে পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে সত্যজিৎ রায় দেশ-বিদেশের সেইসব জায়গায় গিয়েছেন। নইলে এত নিখুঁত বর্ণনা দেন কী করে? কিছু জায়গায় তিনি নিশ্চয়ই গিয়েছেন। তবে তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায় (সূত্র: এই সময় পত্রিকা, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৯) সত্যজিৎ রায় ফেলুদাকে নিয়ে যত কাহিনি লিখেছেন সব কাহিনির ঘটনাস্থলে তিনি নিজে গিয়েছিলেন, কিন্তু যেসব জায়গায় তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেখানেই তিনি প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে গিয়েছেন। অদেখা জায়গাকে পাঠকের কাছে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করার জন্য সত্যজিতকে যে বিস্তর পড়াশুনা ও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে প্রোফেসর শঙ্কুর স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে গিরিডিকে বেছে নেওয়ার কারণ ছোটোবেলা থেকেই গিরিডির সাথে সত্যজিতের সম্পর্ক। তিনি ওখানে ছোটোবেলায় বেড়াতে যেতেন। তখন প্রহ্লাদ নামে এক পরিচারকের সাথে তিনি গিরিডিতে থাকাকালে খেলতেন। আর লক্ষ্যণীয় যে প্রোফেসর শঙ্কুর চাকরের নামও প্রহ্লাদ। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথেও গিরিডির সম্পর্ক ছিল। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর গিরিডিতেই এই দেশবরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। গিরিডিতে তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালাও রয়েছে। হয়তো এজন্যই প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রটি সত্যজিৎ গিরিডিতেই সৃষ্টি করেছেন।
প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিগুলো যে প্রতিটিই সমান রোমাঞ্চকর তা মনে হয় কোনও একনিষ্ঠ পাঠক স্বীকার করবেন না। কোনওটায় রয়েছে রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার, টানটান উত্তেজনা। আবার কোনওটায় থ্রিলারকে ছাপিয়ে গিয়েছে অচেনা দেশে, অচেনা জায়গার ঝকঝকে ভ্রমণ-বিবরণ। পড়তে পড়তে পাঠকের মানস-ভ্রমণ হয়ে যায়। আর প্রতি কাহিনির আনাচে-কানাচে রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের নানা উপকরণ। যেমন “প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল” যে কোনও বিখ্যাত থ্রিলারের সাথে এক সারিতে স্থান পাওয়ার যোগ্য। “প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু”-তে অবিকল মানুষরূপী রোবট নকল বোর্গেল্ট যখন শঙ্কুকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, আর সেই মূহুর্তে শঙ্কুর রোবট রোবু হাজির হয়ে নকল বোর্গেল্টের ধড় থেকে মুন্ডুকে আলাদা করে দেয় তখন চরম সাসপেন্স তৈরি হয়। পড়তে পড়তে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, লোম খাড়া হয়ে ওঠে। কিংবা “প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা” গল্পে রহস্যভেদ করতে যখন শঙ্কু ও বিজ্ঞানী ডামবার্টন গুহার মধ্যে প্রবেশ করেন, ভেতর থেকে খুটখুট শব্দ শোনা যায়, আর গুহার বাইরে থেকে তাঁদের সঙ্গী প্রহরী পেদ্রোর আর্তনাদ শোনা যায় তখন পাঠকের রক্ত হিম হয়ে আসতে বাধ্য। কিংবা “ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি”-গল্পের কথাই ধরা যাক। রীতিমতো গোয়েন্দা কাহিনি। সত্যজিৎ প্রোফেসর শঙ্কুকে এই কাহিনিতে পাকা গোয়েন্দা বানিয়ে ছেড়েছেন। এই কাহিনিতে বিজ্ঞানী শেরিং-ই যে মারণাস্ত্র তৈরির ফর্মুলা বিক্রি করে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে সহবিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তা শঙ্কুই ধরেছেন। আবার “প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু”-তে যখন শঙ্কু লেখেন ‘নেকার নদী শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে, পেছনে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বনে ঢাকা পাহাড়’ তখন মানসপটে হাইডেলবার্গ শহরের দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। কিংবা “শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান” গল্পে যখন পাঠক পড়ে ‘জঙ্গলের গা ঘেঁসে পুবদিকে রয়েছে পর পর সব আগ্নেয়গিরি। মুকেঙ্কু, মুকুবু, কানাগোরাউই। রোয়ান্ডা ছাড়িয়ে কিভু হ্রদ পেরোলেই এই সব আগ্নেয়গিরির গা দিয়ে জঙ্গল শুরু।’, তখন মনের মধ্যে কঙ্গোর অরণ্যের পারিপার্শ্বিকতার দৃশ্যপট স্পষ্ট তৈরি হয়।
রইল বাকি মজা। সত্যজিৎ প্রায় সব কাহিনিতেই একবার না একবার অবিনাশবাবুকে হাজির করিয়েছেন। অনেকটা সিনেমার রিলিফ কমেডিয়ানের মতো। যেমন প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে লেখা সত্যজিতের শেষ ও অসম্পূর্ণ কাহিনি “ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা”-তে অবিনাশবাবু যখন শঙ্কুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেন “Many happy days of the return” তখন হাসি চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশ্য অবিনাশবাবু “প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য” এবং “প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা” গল্পে দু’বার শঙ্কুর অভিযানের সঙ্গী হয়েছেন, আর “স্বপ্নদ্বীপ” কাহিনির ডায়েরির একাংশ লিখিয়েছেন। তবে মজার আসল উপকরণ রয়েছে প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কারগুলোর নাম ও উপাদানের মধ্যে। প্রতিটি আবিষ্কারের নাম যেমন মজার, তেমনই নাম শুনে তার কাজ সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। তাঁর ৭২ টি আবিষ্কারের মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যাক। প্রথমে কিছু ওষুধের কথা বলা যাক। মিরাকিউরল। প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কৃত এ এক আশ্চর্য বড়ি। স্বপ্নপর্ণী নামে এক গাছের পাতা থেকে তৈরি এ হল সর্বরোগহর আশ্চর্য ওষুধ। কেবল মরা মানুষ বাঁচাতে পারে না এ ওষুধ। আর এক ওষুধ হল সমনোলিন। খেলেই দশ মিনিটের মধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুম! বট ফলের রস থেকে শঙ্কুর তৈরি বটিকা-ইন্ডিকা বড়ি একটা পেটে পড়লেই খিদে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আর তৃষ্ণাশক বড়িতে তেষ্টা ভ্যানিশ। লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার বড়ি রিমেমব্রেন কিংবা মানসিক আঘাত পেলে নার্ভকে চাঙ্গা করার জন্য নার্ভাইটা বড়ি হল অব্যর্থ ওষুধ। তাঁর তৈরি করা এয়ার কন্ডিশনিং পিল জামার পকেটে রাখলে গরমের সময় ঠান্ডা ও ঠান্ডার সময় গরম অনুভব হবে! বেশি উঁচুতে উঠলে যাতে শ্বাসকষ্ট না হয় সেজন্য তৈরি করেছেন অক্সিমোর পাউডার। শঙ্কু ঘ্রাণশক্তি বাড়ানোর জন্যও একটা ওষুধ তৈরি করে নিজের উপর প্রয়োগ করে “প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা” গল্পে সফল হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এর নামকরণ করতে মনে হয় ভুলে গেছেন! প্রিয় পোষ্য নিউটনের আয়ু বাড়িয়েছেন মার্জারিন বড়ি খাইয়ে। আর ফিশপিল। নিউটনের জন্য তৈরি এ এমনই মাছের বিকল্প এক বড়ি যা একবার খেলে বিড়াল তার পর থেকে মাছ ফেলে বড়িই খেতে চাইবে আর এক সপ্তাহের খিদেও চলে যাবে!
এবার আসি যন্ত্রের কথায়। শঙ্কুর তৈরি দুই যন্ত্রমানুষ বিধুশেখর ও রোবুর কথা বাদ দিলে সবচেয়ে মজার আবিষ্কার হল নস্যাস্ত্র বা স্নাফ গান। এ এমনই এক বন্দুক যা কোনও ব্যক্তির নাক তাক করে মারলে সে তিরিশ ঘন্টা হেঁচে মরবে! তাঁর আবিষ্কৃত আর এক আশ্চর্য পিস্তল হল অ্যানাইহিলিন (প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক-রহস্য গল্পে অবশ্য একই নামে একটি ট্যাবলেটের কথা লেখা হয়েছে যা ২৭৭ রকমের রোগ সারাতে সক্ষম)। চার ইঞ্চি লম্বা এই পিস্তল দুষ্টু লোকের দিকে তাক করে ট্রিগার চাপলেই দুষ্টু লোক ভ্যানিশ! আত্মরক্ষার জন্য শঙ্কুর আবিষ্কৃত আর একটা পিস্তল হল অ্যানিস্থিয়াম পিস্তল। এ পিস্তলের ঘোড়া টিপলে একটা তরল গ্যাস তীরের মতো বেরিয়ে এসে শত্রুর গায়ে লাগবে, আর তাতেই সে কয়েক ঘন্টার জন্য অজ্ঞান হয়ে যাবে। শঙ্কু তৈরি করেছেন অশ্রুতিগোচর শব্দ শোনার জন্য যন্ত্র মাইক্রোসোনোগ্রাফ, বুদ্ধি মাপার যন্ত্র ইনটেলেকট্রন, যে কোনও ভাষা বাংলায় অনুবাদ হয়ে ছেপে বেরোনোর যন্ত্র লিঙ্গুয়াগ্রাফ, রঙিন ছবি তুলে তা পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসার ক্যামেরা ক্যামেরাপিড, বিদ্যুৎ বা ব্যাটারির সাহায্য ছাড়াই জোরালো আলোর ল্যাম্প লুমিনিম্যাক্স, ভূত দেখা ও ভূতের সাথে কথা বলার যন্ত্র নিওস্পেকট্রোস্কোপ, আত্মার সাথে যোগাযোগের যন্ত্র কম্পিউডিয়াম, মাইক্রোস্কোপ ও টেলিস্কোপের কাজ একইসঙ্গে করার যন্ত্র ওমনিস্কোপ, পাখিদের শেখানোর যন্ত্র অরনিথিন, আরও কত কী। শঙ্কু আবিষ্কার করেছেন মাধ্যাকর্ষণবিরোধী ধাতু শ্যাঙ্কোভাইট। আর তা দিয়ে তৈরি করেছেন বিশেষ বিমান শ্যাঙ্কোপ্লেন। এই বিশেষ বিমানের জ্বালানি হল তাঁরই আবিষ্কৃত টার্বোলিন যার গন্ধ চন্দন কাঠের মতো। শঙ্কুর আবিষ্কৃত কার্বোথিনের গেঞ্জি পুরোপুরি ইলেকট্রিক শক প্রতিরোধী। শঙ্কু জামার তলায় সবসময় এই গেঞ্জি পরে থাকেন বলে অনেকবার শত্রুর খপ্পর থেকে বেঁচে ফিরেছেন। প্রবল শীতের সময় ভারী কোট বা সোয়েটার এড়ানোর জন্য তৈরি করেছেন হালকা পোশাক নিজের আবিষ্কৃত শ্যাঙ্কলন প্লাস্টিক দিয়ে। শঙ্কুর আর এক আশ্চর্য আবিষ্কার এক্স ও অ্যান্টি এক্স। এক্স দিলে সুস্থ মানুষ হিংস্র দানবে পরিণত হয় এবং অ্যান্টি এক্স দিলে সাথে সাথে আবার স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়। প্রোফেসর শঙ্কু যে উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণাতেও সিদ্ধহস্ত তার প্রমাণ তাঁর বাগানে ম্যাঙ্গোরেঞ্জ বা আমলা গাছ। আম আর কমলা গাছের সংকর নাকি এই গাছ! ভাবা যায়!
প্রোফেসর শঙ্কুর তৈরি নানা যন্ত্র বা ওষুধের উপাদানও তাঁর চরিত্রের মতো বিচিত্র। যেমন তিনি রকেট তৈরি করেছেন যে সংকর ধাতু দিয়ে তার উপাদান হল ব্যাঙের ছাতা, সাপের খোলস, কচ্ছপের ডিমের খোলা আর ভেলোসিলিকা নামে এক আজব ধাতু। তাঁর বিখ্যাত ওষুধ মিরাকিউরলের অন্যতম উপাদান হল গলদা চিংড়ির গোঁফ! তাঁর অদৃশ্য হবার ওষুধ যা যা দিয়ে তৈরি তা তাঁর নিজের কথায় দেখে নিই – “এক্সট্রাকট অফ গরগনাসস, প্যারানইয়াম পোটেনটেট, সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, বাবুইয়ের ডিম, গাঁদালের রস আর টিনচার আয়োডিন।” তিনি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টান উপেক্ষা করার সংকর ধাতু শ্যাঙ্কোভাইট তৈরি করেছেন পারদের সাথে তামার গুঁড়ো, ষাঁড়ের খুর, চকমকি পাথর ইত্যাদি মিশিয়ে। তাঁর ল্যাবরেটরির তেজি অ্যাসিডের নাম হল কার্বোডায়াবলিক, নাইট্রোঅ্যানাইহিলিন ও ফোরোসোটানিক অ্যাসিড। বলাবাহুল্য, সব নামই কাল্পনিক ও মজাদার।
বলা হয়ে থাকে যেখানে বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান শেষ হয়ে যায় সেখান থেকেই শুরু হয় কল্পবিজ্ঞান। ফলে কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে যেসব কল্পনা থাকে তা যেমন হতে হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুক্তিবোধনির্ভর তেমনই তার ভিত্তিতে থাকে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান। মোদ্দা কথা অদ্ভুতুড়ে কান্ড হোক, আকাশকুসুম কল্পনা হোক কিংবা অবিশ্বাস্য ম্যাজিক – বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধের জায়গা থেকে বিচ্যুত হলে তা আর কল্পবিজ্ঞান থাকে না। তাছাড়া কল্পবিজ্ঞানের কাহিনির অন্য একটি অভিমুখ থাকাও বাঞ্ছনীয় – তা হল বিজ্ঞানমনস্কতা। ভূত-প্রেত, আত্মা-পরলোক, মন্ত্র-তন্ত্র ইত্যাদি যদি কাহিনিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তবে তা কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী কিশোর পাঠকের চেতনার অবনমন ঘটায়। আবার যুক্তিহীন ও প্রাচীন ধারণার ভিত্তিতে লেখা কল্পবিজ্ঞান কিশোর পাঠকের চিন্তাশক্তিকে দৈন্য করে দেয়। সেক্ষেত্রে পাঠক কেবল রোমাঞ্চটাই গ্রহণ করে।
এই প্রেক্ষিতে প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবো কাহিনিগুলোতে যতটা রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, মজা ও ভ্রমণকাহিনি রয়েছে ততটা বিজ্ঞান নেই। যদিও প্রোফেসর শঙ্কু একজন বিজ্ঞানী এবং নানা রহস্য উদঘাটনে তাঁর নানা বিচিত্র আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। বাঙালি পাঠকমহলে কিন্তু প্রোফেসর শঙ্কু মানেই সেরা কল্পবিজ্ঞান। জনপ্রিয়তার নিরিখে কাহিনিগুলোকে কল্পবিজ্ঞান বলা হলেও প্রকৃত অর্থে সেগুলোকে কল্পবিজ্ঞান বলা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট তর্কের অবকাশ আছে। দু’একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সাসপেন্সে ভরপুর “প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল” কাহিনিতে দুষ্টু বিজ্ঞানী লিন্ডকুইস্ট একজন মানুষকে বিশেষ ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে ছ’ইঞ্চির মানুষে পরিণত করে দিলেও তাঁর পরণের জামা-প্যান্ট কীভাবে আনুপাতিক হারে ছোটো হয়ে যায়? এর কিন্তু কোনও ব্যাখ্যা নেই কাহিনিতে। আবার এই কাহিনিতেই নরওয়ের ইঁদুরজাতীয় প্রাণী লেমিং (Lemming)-দের কথা বলা হয়েছে যারা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে জঙ্গল থেকে কাতারে কাতারে বেরিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। বলাবাহুল্য এটি একটি প্রচলিত ভুল ধারণা। “স্বর্ণপর্ণী” কাহিনিতে এই নামে যে গাছের কথা উল্লেখ রয়েছে শঙ্কু বলেছেন হিন্দিতে তার নাম সোনেপত্তী। একদম ঠিক। এই নামে গাছ কিন্তু আদৌ কাল্পনিক নয়। আর এর অসাধারণ ভেষজ গুণ নিয়েও প্রচলিত ধারণা রয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, শঙ্কু বলছেন “এক কোমর উঁচু হলদে পাতায় ভরা একটা গাছড়া”। কিন্তু এই গাছ হল ১০-১৬ ফুট উঁচু বৃক্ষ এবং আদৌ বিরল গাছ নয়। আর এর পাতাও সোনার রঙের মতো হলুদ নয়। মহারাষ্ট্রে সনাতন প্রথা অনুসারে দশেরার দিন এই গাছের পাতার সাথে সোনা বিনিময় করা হয় বলে এমন নাম। আসলে এটা হল বিড়িপাতার গাছ। সুতরাং তথ্যগত বিভ্রান্তি রয়েছে ওই কাহিনিতে। আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। “প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক-রহস্য” গল্পে বলা হয়েছে সৌরজগতের ক্ষুদ্রতম টেরাটম গ্রহ কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়েছে। সেই গ্রহের বাসিন্দারা হল ভাইরাস যাদের কথা মাইক্রোসোনোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে শঙ্কু শুনতে পেয়েছেন। শঙ্কু একটা কাচের জার দিয়ে সেই গ্রহকে চাপা দিয়ে রাখলে অক্সিজেনের অভাবে সেই গ্রহের বাসিন্দারা চিৎকার করতে থাকে। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে গ্রহ এত ছোটো তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও অতি সামান্য হওয়ার কথা। যে পাঠক জানে যে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক কম বলে সেখানে কোনও বায়ুমন্ডল নেই, সে কীভাবে মেলাবে যে ওই টেনিস বলের সমান গ্রহের বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন আছে? আর যে পাঠক জানে যে কোনও ক্ষুদ্র মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে সঙ্ঘর্ষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সে কীভাবে মেলাবে যে টেরাটম গ্রহ এবং তার বাসিন্দারা অবিকৃত অবস্থায় উশ্রী নদীর ধারে এসে পড়ল? তাছাড়া সব কিশোর পাঠক জানে ভাইরাস কোষহীন এবং জীবদেহের বাইরে জড়ের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। অথচ সেই ভাইরাস অক্সিজেনের অভাবে চেঁচাচ্ছে। পাঠক কীভাবে মেলাবে তার পূর্বজ্ঞান? “স্বপ্নদ্বীপ” গল্পে শঙ্কুর আবিষ্কৃত শ্যাঙ্কোপ্লেন ২৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে গেলেও তাতে প্লেনের দরজা খোলা রাখা যায়! না, তাতে প্লেনের ভেতরে বায়ুর চাপ বজায় রাখার বা অক্সিজেন সরবরাহ করার কোনও ব্যবস্থা নেই। আবার এই গল্পেই ইন্দোনেশিয়ার বানরজাতীয় প্রাণী স্লো লোরিস-এর প্রসঙ্গে সঠিকভাবে এদের নিশাচর ও মানুষ দেখলে ফ্রিজ হয়ে যায় বলা হলেও দিনের বেলা সে গাছ থেকে শঙ্কুর বাড়ানো হাতে নেমে আসে কী করে? “আশ্চর্য প্রাণী” গল্পে শঙ্কু ও হামবোল্ট ল্যাবরেটরিতে দু’দিনের মধ্যে এককোষী জলজ প্রাণী থেকে উভচর, একদিনের মধ্যে উভচর থেকে এক ইঞ্চির মিনি ব্রন্টোসোরাস, ১৬ ঘন্টা পর হিমযুগের উলি রাইনোসেরস, আর পরের দিন জঙ্গলসহ বানর তৈরি করে ফেলেন যা সৃষ্টি হতে আড়াইশো কোটি বছর লেগেছে। এমন অজস্র বিজ্ঞান ও যুক্তিবিরোধী ধ্যানধারণা ছড়িয়ে রয়েছে অধিকাংশ কাহিনিতে। আসলে প্রোফেসর শঙ্কু যেমন কোনও বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের তোয়াক্কা না করে হুটহাট নানা জিনিস বানিয়ে ফেলেন, তেমনই তাঁর সঙ্গে নানা অবিজ্ঞানসুলভ কান্ডকারখানা ঘটে।
তবে সত্যজিৎ প্রোফেসর শঙ্কুর মাধ্যমে প্রতিটি কাহিনিতেই যেসব বিদেশি বিজ্ঞানীর সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়েছেন তাঁরা সবাই কিন্তু সুবুদ্ধি ধরেন না। বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কের ক্ষুরধার বুদ্ধি যে কেবল মানবকল্যাণে সর্বদা ব্যবহৃত হয়েছে বাস্তবে তা কিন্তু নয়। পরমাণু বোমা কিংবা জৈব অস্ত্র তো বিজ্ঞানীদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। সম্ভবতঃ এই কারণেই সত্যজিৎ অনেক কাহিনিতেই ভিলেন-বিজ্ঞানীকে হাজির করেছেন, যেমন বোর্গেল্ট (প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু), লিন্ডকুইস্ট (প্রোফেসর শঞকু ও আশ্চর্য পুতুল), শেরিং (ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি) প্রমুখ। আসলে সত্যজিৎ বিজ্ঞানের আলো-আঁধারের বাস্তব দিকটি কিশোর পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন, আদৌ কিশোর পাঠকদের থেকে আড়াল করতে চাননি। সুস্থ ও সরল মস্তিষ্কের বিজ্ঞানীদের তুলনায় কুটিল মস্তিষ্কের বিজ্ঞানীরা যে অনেক বেশি বিপজ্জনক তা তিনি দেখিয়েছেন। আবার প্রতি কাহিনিতেই কুচক্রি বিজ্ঞানীর পরাজয় ঘটেছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রোফেসর শঙ্কু ও তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানীদের কাছে। কাহিনিগুলির এই ইতিবাচক দিক অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
প্রোফেসর শঙ্কু যতটা না বস্তুবাদী তার চেয়ে বেশি তিনি অতীন্দ্রিয়বাদী। তাই তিনি আত্মা, পরলোক, প্ল্যানচেট, জ্যোতিষ, মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্রেত চর্চায় আগ্রহী। দু’একটা নমুনা দেওয়া যাক। ‘শঙ্কুর শনির দশা’ গল্পে শঙ্কু জ্যোতিষে বিশ্বাস নেই বলার পরও বলেছেন, “তিন মাস আগে অবিনাশবাবু যে জ্যোতিষীকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন, আজ আমি বলতে পারি যে তাঁর গণনা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।” আবার “মরুরহস্য” গল্পে বিখ্যাত জীবতত্ত্ববিদ হেক্টর ডিমেট্রিয়াস-এর ডায়েরির একটি লেখা শঙ্কু অনুবাদ করেছেন। সেখানে ডিমেট্রিয়াস লিখেছেন যে তাঁর পঁয়ষট্টি বছরের জন্মদিনে একটা ‘মস্ত ফাঁড়া’ আসবে বলে এক ‘বেদে বুড়ি’ ভবিষ্যৎবাণী করেছিল। যেহেতু বুড়ির সব ভবিষ্যৎবাণী ফলেছে তাই ‘এটাও ফলবে বলে মেনে নিতে পারি’! আবার এ বিষয়ে শঙ্কুও লিখেছেন নিজের মতামত, “এ ধরণের ভবিষ্যৎবাণী অনেক সময় ফলে যায় সেটা আমিও দেখেছি। যদিও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দিয়ে এর কারণ এখনও স্থির করতে পারিনি।” প্রবল প্রতিভাধর ও বুদ্ধিমান শঙ্কু এ কথা বলছেন! ভাবা যায়! আবার গল্পে ভবিষ্যৎবাণী ফলেও গেল! জ্যোতিষীর ভাষায় “শনি” হল শঙ্কুর ডুপ্লিকেট! এই গল্পেই সাহারা মরুভূমির মাঝে শঙ্কু অদ্ভুত ‘অঙ্গভঙ্গি করে তারস্বরে একটার পর একটা সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোক আওড়াতে’ অদ্ভুত শব্দ ও তীব্র হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়! আবার “শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ” গল্পে শঙ্কুর বন্ধু বিজ্ঞানী উইলহেলম ক্রোল স্পেন রওনা হবার আগে জ্যোতিষী ম্যাডাম রেনাটা-কে দিয়ে সবার ভাগ্য গণনা করান। বিজ্ঞানীরা ভাগ্যগণনা করাচ্ছেন – এটা হয়তো বিরল নয়, কিন্তু কিশোর পাঠকমহলে এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই গল্পেই ৭০০ বছর আগেকার একটা ক্যাসেলের দরজা ৭০০ বছর তালাচাবি দিয়ে বন্ধ – এটা ভেবে নিতেও বড্ড বেমানান লাগে। তালা-চাবির আবিষ্কার ঊনবিংশ শতকে। তাহলে কীভাবে এত আগে তালাচাবি থাকা সম্ভব? এসব কিন্তু অবিজ্ঞানের বিপজ্জনক উপকরণ। সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনিগুলি তাই কল্পবিজ্ঞানের তুলনায় অনেক বেশি অলৌকিকতায় ভরপুর।
তাহলে কি প্রথাগত বিজ্ঞানের কোনও উপাদান নেই প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিগুলোতে? উত্তর যদি ‘না’ বলা হয় তবে সত্যের অপলাপ হবে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। “হিপনোজেন” গল্পে শঙ্কু তাঁর ভূগোল ও আবহাওয়াবিজ্ঞানে জ্ঞানের যথার্থ প্রকাশ করেছেন। কেন নরওয়ের উত্তর প্রান্ত দক্কিণ প্রান্তের চেয়ে কম ঠান্ডা তার সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। “মানরো দ্বীপের রহস্য” গল্পে যখন শঙ্কু লেখেন, “ ‘এ’ গ্রুপের রক্ত যেমন মানুষের হয়, তেমনই অনেক শ্রেণীর বাঁদরেরও হয়” তখন জীববিজ্ঞানে শঙ্কুর পান্ডিত্যের সঠিক প্রকাশ ঘটে। “একশৃঙ্গ অভিযান” গল্পে শঙ্কু জানাচ্ছেন যে অক্সিজেনের অভাবে মার্কোভিচের শ্বাসকষ্ট ছাড়াও মস্তিষ্কের বিকার হওয়ায় সে হো-হো করে হাসছিল। মানব শারীরবিদ্যার এই জ্ঞান প্রোফেসর শঙ্কুর ছিল। আবার “কর্ভাস” গল্পে শঙ্কু অস্ট্রেলিয়ার ম্যালি ফাউল ও গ্রিব পাখি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য দিয়েছেন। ম্যালি ফাউল ডিমে তা না দিয়েও কীভাবে ডিম ফোটানোরে জন্য বাসার তাপমাত্রা ৭৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রেখে দেয় কিংবা জলে ভাসমান অবস্থায় কোনও শত্রুর উপস্থিতি টের পেলে গ্রিব পাখি তার দেহ ও পালক থেকে বাতাস বের করে দেহের আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) বাড়িয়ে দিয়ে গলা অবধি জলে ডুবে যায় তা চমৎকারভাবে শঙ্কু বর্ণনা করেছেন। “প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা” কাহিনিতে চার বছরের খোকার মুখ দিয়ে চড়ুই ও কাকের বিজ্ঞানসম্মত নাম এবং মস্তিষ্কের অংশ ‘Os temporale’ একেবারেই সঠিক বলিয়েছেন। আবার “প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য” কাহিনিতে শঙ্কু গভীর সমুদ্রের জীবের Bioluminescence ধর্মের কথা সঠিক উল্লেখ করেছেন। “প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা” কাহিনিতে বোঝা গেছে যে শঙ্কু উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, গোরিলা ইত্যাদি প্রাণীর স্বভাব ও প্রকৃতি সঠিকভাবে চর্চা করেছেন। আর “প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু” কাহিনিতে শঙ্কু যখন বলেন “কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেই আমি সম্পূর্ণ মানুষের সৃষ্টি বলে মনে করতে পারি না। সম্ভাবনাটা আগে থেকেই থাকে, হয়তো চিরকালই ছিল; মানুষ কেবল বুদ্ধির জোরে না হয় ভাগ্যবলে সেই সম্ভাবনাগুলোর হদিস পেয়ে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নেয়।”, কিংবা “প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক” কাহিনিতে যখন বলেন “আসলে বৈজ্ঞানিকরা ভিন্ন দেশবাসী হলেও তারা কেমন যেন পরষ্পরের প্রতি একটা আত্মীয়তা অনুভব করে।”, তখন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর শাশ্বত সত্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আবার “প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু” কাহিনিতে এই প্রোফেসর শঙ্কুই যখন বলেন “বৈজ্ঞানিকরা সম্মানের যোগ্য হলেও, তাঁরা সকলে বিশ্বাসের যোগ্য নন” তখন পরমাণু বোমা বা জৈব অস্ত্রের মতো বিজ্ঞানের অভিশপ্ত দিকের কথা মনের মধ্যে জেগে উঠে পাঠকের চেতনাকে ঝাঁকুনি দেয়।
সত্যজিৎ প্রথাগত বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও বিজ্ঞানের বেশ কিছু জটিল তত্ত্ব যেমন তাঁর কিশোর পাঠকের সামনে এনেছেন তেমনই অনেক বিদেশি শব্দ বা বাক্যের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন। তিনি কখনও পাঠকের বয়সের কথা বা বোধগম্যতার কথা ভেবে নিজেকে নিরস্ত করেননি। আসলে তিনি তাঁর কিশোর পাঠককে ‘কম জানে বা কম বোঝে’ এমনটা ভাবতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি অনায়াসেই প্রোফেসর শঙ্কুর বন্ধু বিজ্ঞানী পমারের মুখ দিয়ে রোবট রোবুকে জার্মানিতে প্রশ্ন করিয়েছেন, “Welche arbeit machst du?” অর্থাৎ “তুমি কী কাজ করো?” উত্তরে রোবুও জার্মানিতে বলেছে, “Ich helfe meinem herrn bei senier arbeit, und lose mathematische probleme” অর্থাৎ “আমি আমার মনিবের কাজে সাহায্য করি, অঙ্কের সমস্যার সমাধান করি।” সত্যজিৎ তাঁর কাহিনির মধ্যে দিয়ে তাঁর পাঠককে বিদেশি ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য লিখনশৈলি আর প্রাসঙ্গিক স্কেচের গুণে প্রোফেসর শঙ্কুর প্রতিটি কাহিনি পাঁচ দশক ধরে আমপাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় ও আদরণীয়। টানটান উত্তেজনা আর অজানা জায়গার অসামান্য বর্ণনা পাঠককে কাহিনির শেষ পর্যন্ত আটকে রাখে। বিজ্ঞানের নামে শঙ্কুর অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা প্রতিটি কাহিনিকে সরসতায় সিঞ্চিত করে। নাইবা হল প্রকৃত কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি, নাইবা থাকল সুচিন্তিত বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ, সরস রোমাঞ্চকর কাহিনি হিসেবে প্রোফেসর শঙ্কুর প্রতিটি কাহিনি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে চিরকাল প্রথম সারিতেই থাকবে। আর খ্যাপাটে কিন্তু সৎ ও সাহসী এক বিচিত্র আবিষ্কারক হিসেবে প্রোফেসর শঙ্কু বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে সগর্বে বসত করবেন।
1 Comment