“গানের ভিতর দিয়ে যখন …” / স্মৃতিচারণ এবং …
রেডিও দিয়ে শুরু – জলসার সাথে বেড়ে ওঠা
আমাদের বাড়িতে কাউকে কখনো গানবাজনার চর্চা তথা রেওয়াজ করতে দেখিনি বা শুনিনি – কাছের কোন আত্মীয়-স্বজনকেও না। তাহলেও, গানের প্রতি আমার নিজের আকর্ষণ খুব ছোটবেলা থেকেই – সকাল-বিকেলে রেডিওতে গান শোনা দিয়ে যার শুরু। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নানা গানের নির্ধারিত প্রোগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল শনি-রবিবারের ‘অনুরোধের আসর’ – বেলা একটা চল্লিশ থেকে আড়াইটে পর্যন্ত। মনে আছে, শনিবারে ইস্কুল থাকত ‘হাফ্-ডে’ – মানে ঐ দেড়টা কি দুটো নাগাদই ছুটি হত। সেদিন হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশের বাড়িগুলো থেকে ভেসে-আসা গান শুনতে শুনতেই পা চালাতাম, কখনো-বা কোনও প্রিয় গানের কলি কানে এলে সেখানেই থেমে দাঁড়িয়ে শুনে নিতাম পুরো গানটা। এছাড়া গান বলতে আশ্বিনে শারদপ্রাতে, মহালয়ার একেবারে ভোর-রাতে – আধো-ঘুমে আধো-জাগার মধ্যে বাণীকুমার আর বীরেন-ভদ্রের পরিবেশনে ‘মহিষাসুর-মর্দিনী’-র মায়াবী আকর্ষণ তো ছিলই! তার পর থেকেই শুরু হত পাড়ায়-পাড়ায় মাইকে নতুন-পুরনো পুজোর গান বাজানো – না শুনে উপায় ছিলনা কারো। প্রতিবছর এভাবেই পুজোর আমেজ পৌঁছে যেত ঘরে ঘরে।
তবে গানের প্রতি আমার প্রকৃত ভালবাসা গড়ে উঠেছিল ঐ পুজোর পরে পাড়ায় পাড়ায় জলসা শুনে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা! মনে হয় আজকের কিশোর-কিশোরীদের সে-সুযোগ আর নেই। বিকেল থেকেই ট্র্যাফিক থামিয়ে, ফাঁকা রাস্তায় প্যান্ডেল বেঁধে পাড়ার জলসা এখন তো শুনি শহর থেকে বেবাক উধাও; তারা স্থান করে নিয়েছে নামীদামী হলে – টিকিট কেটে শুনতে যেতে হয় সেখানে – তাও তাদের তবিয়ৎ সেকালের মত মোটেও নয়। এখনকার ভাষায় বলা যায় – ‘বড়ী আপশোস কী বাত’! কিংবা তখনকার-দিনের সেই কাঁচি-সিগারেটের বিজ্ঞাপনের ভাষা ধার করে বলতে হয় – ‘আপনি জানেন না আপনি কী হারাইয়াছেন।’
যাকগে, জলসা সম্বন্ধে আমার সেকালের অভিজ্ঞতাই এখন শোনাই তবে – হয়ত নতুন লাগবে কারো কাছে, আবার কারো মনে জাগিয়ে তুলবে নস্টালজিয়ার জোয়ার। তবে ভয় হয়, তাতে পাঠকদের ধৈর্যের ওপর জুলুম করা না হয়ে যায়! কলম তো এদিকে উৎসাহের চোটে নেমে পড়েছে মাঠে – থামানো যাচ্ছে না তাকে – এখন যা থাকে কপালে!
আমি বোধহয় সাত-আট বছর বয়েস থেকেই জলসার পোকা। সেই বয়েসে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও অনেক রাত অব্ধি একা-একা থাকার অনুমতি পাবার সম্ভাবনা ছিল না, তবে আমার সৌভাগ্যক্রমে তার প্রয়োজনও ছিল না। আমাদের পাড়ায় শ্রীশ্রীকালীপুজোর দুয়েকদিন আগে-পরে বসতো গানবাজনার জলসা – আর সেটা হোত আমার মামার বাড়ি থেকে ঠিক যাকে বলে ‘দুই-পা ফেলিয়া’ – রাস্তার ওপারে, চক্রবেড়িয়ায় আমাদের তেকোনা পার্কের পূজো-প্যান্ডেলে। বিসর্জনের ফাঁকা-ফাঁকা ভাবটা কাটিয়ে উঠে, বিজয়ার প্রণাম সেরে আর পেটপুরে মিষ্টি খেয়ে – তার পরে লক্ষীপুজোর একদিনের উৎসবের রেশটা কাটতে না কাটতেই শবরীর প্রতীক্ষাশেষের মত এসে পড়ত বহু-আকাঙ্ক্ষিত সেই দিনটি। দিনভর জল্পনা-কল্পনা চলত – এ-বছর চেনা শিল্পীদের মধ্যে কারা আসবেন, আর নতুন-পুরনো জানা-অজানা গান কী কী শুনতে পাব স্টেজের সামনে বসে। উৎসাহের চোটে আগের রাত্তিরে তো ঘুমই আসত না একেবারে!
পাড়ার জলসাতে নামী শিল্পীরা
আমাদের পাড়ায় নামী শিল্পী বলতে ছিলেন শ্রী শচীন গুপ্ত – তিনিই পাড়ার জলসার হোতা। থাকতেন পার্কের ঠিক মুখোমুখি বাড়িটাতে – ওঁর বারান্দা থেকে স্টেজ, ঠিক যেন ব্যালকনি সীট – বাড়ির মহিলারা সেখানে বসেই দিব্যি গান শুনতে পেতেন, ইচ্ছে থাক বা না থাক! শচীনবাবুই জলসার উদ্বোধন করে দিতেন প্রতিবছর – সাধারণত ‘আগুনের পরশমণি’ গানটি দিয়ে। তখন গান বা গায়কের মান বোঝার না ছিল আমার বয়স, না ক্ষমতা। তবে ওঁর গান আমার ভালো লাগত নিপাট পরিচ্ছন্ন গলার গুণে। ওঁর একটা আধুনিক গান ছিল আমার পছন্দের – ‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে/ অনেক কিছু জীবনে যোগ দিলাম।’ সহজ সুরে বাঁধা গানটি উনি খুব দরদ দিয়ে গাইতেন, কথাগুলো ভাল লাগত। ঐ বয়েস থেকেই গানের কথা আমাকে টানত – আর হয়ত মন দিয়ে শুনতাম বলে অনেক আধুনিক গানের কথাই গেঁথে যেত মনে। এখনো তারা স্মরণে আসে বিনা চেষ্টায় – ভালো লেগেছিল বলেই। গানের ব্যাপারে বিশেষ সহবতের অভাবে, আমার গানের বিচার চিরকালই নির্বিকল্প ভালো-লাগা দিয়ে।
শচীনবাবুর সঙ্গে পরিচয়ের খাতিরেই বোধহয়, এই জলসায় তখনকার দিনের নামকরা শিল্পীদের কখনো অভাব হত না – আর তাই বলতে গেলে স্থানীয় উঠতি শিল্পীদের খুব একটা দেখা মিলত না স্টেজে। তবে তখনকার কিছু উদীয়মান শিল্পীর দেখা পেয়েছি, গানও শুনেছি সে-আসরে, বিভিন্ন সময়ে – যেমন, আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, দীপক মৈত্র। তাঁদের পাশাপাশি সে-আসরেই পেয়েছি সুপ্রভা সরকার, জগন্ময় মিত্র, সুপ্রীতি ঘোষ, বেচু দত্ত প্রমুখ সেকালের প্রবীণ শিল্পীদের। শেষোক্ত শিল্পীর উদাত্ত-কণ্ঠের একটি গান – “ওরে ও মাঝি, রাঙা স্বপনদেশে যাবো – পাল তুলে দে, নৌকার পাল তুলে দে…” – এখনও কখনো স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে – মনটাও উদাস হয়ে স্বপ্নলোকেই পাড়ি দেয় যেন।
তখন গোড়ার দিকে আসরে আসতেন খ্যাতনামা অখিলবন্ধু ঘোষ – একরাশ জনপ্রিয় গান একে একে পরিবেশন করে জমিয়ে দিতেন আসর।
‘ঐ যে আকাশের গায়, দূরের বলাকা ভেসে যায়,
ওরা বাসা বাঁধে না, ওরা চঞ্চল ওরা উদ্দাম’,
কিংবা
‘পিয়াল-শাখার ফাঁকে ওঠে,
একফালি চাঁদ বাঁকা ঐ’ –
এই গান দুটি মনের কোণে অনুরণন তোলে এখনো। কথায়-ছন্দে-তালে তাঁর সাধা গলায় সুর খেলত অনায়াসে। বাংলা আধুনিক গানের আসরে তিনি তখন ছিলেন এক উজ্জ্বল তারকা।
তবে আসর জমাতে সেকালে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যেমন পাকা আমের মত ফর্সা টুকটুকে চেহারা, তেমনি মনমাতানো মিষ্টি গলা – সেইসঙ্গে প্রাণঢালা পরিবেশন। মাথাজোড়া টাক ঘামে চকচক করে উঠত, চশমা ঠিকরে পড়ত কখনো গানের চটুল তালে মাথা-ঝাঁকানিতে – ছুটন্ত তবলার বোলের সঙ্গে দ্রুত থেকে দ্রুততর লয়কারির আবেশ সানন্দে উপভোগ করত আবালবৃদ্ধবনিতা শ্রোতারা সকলেই। তাঁর গায়কীতে মূর্ত হয়ে উঠত প্রাণভরা আবেগের উচ্ছ্বাস। সে এক পরিপূর্ণ আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন!ওঁর গাওয়া ‘পান্না-হীরা-চুনি তো নয় তারার মালা’, কিংবা ‘দোল-দোল চতুর্দোলায় চড়ে আহা’, অথবা ‘কোনদিন বন্ধু, কান পেতে শুনেছ কি’, বা একটু ঢিমে-তালে ‘কাজল-নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে’ – আরো কত গান আর তাদের গায়কী জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির মণিকোঠায়। মনে হয় – সে-এক সময় গেছে, ফিরে আর আসবে না সেদিন।
সেকালের বাংলা গানের প্রায় সব নামী শিল্পীকেই পেয়েছি সে-সব জলসার আসরে। ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে’ হলে অবশ্য এই-ফাঁকে কবুল করি – জলসায় কখনো পাইনি যাঁদের দেখা, তাঁরা হলেন – শচীনদেব বর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, এবং মান্না দে। অতি সঙ্গত ছিল তাঁদের অনুপস্থিতি – প্রথমোক্ত শিল্পীর বয়েস, আর উপরোক্তদের কলকাতার বাইরে সারাবছর অধিষ্ঠানের কারণে। তবে মুখ্যত কলকাতার শিল্পী হলেও, কোনো অজানা কারণে যাঁকে কখনো পাইনি আমার-শোনা জলসার আসরে – তিনি শ্যামল মিত্র। তখন তিনি ছিলেন খ্যাতির তুঙ্গে – ‘বাংলা আধুনিকের রাজা’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
তার জন্যে দুঃখ ছিল না বিশেষ সে-বয়সে – আশ মিটিয়ে, কান পুরিয়ে, যা শুনেছি – প্রাণ ভরিয়ে তা উপভোগ করতে করতেই হয়ে যেত রাত কাবার! নানা শিল্পীর নানা-মেজাজের গানে-বাজনায়-কৌতুকহাস্যে মন ভরে উঠত কানায়- কানায়। এতদিনের ব্যবধানে আজ লিখতে বসে ওঁদের সবারই নাম ভীড় করে আসছে মনে – কীভাবে গুছিয়ে বলবো যে, তা জানি না।
হেমন্তবাবুর অনুপস্থিতিতে ধুতি আর শাদাসার্টে অনুরূপ আরেক দীর্ঘদেহী শিল্পী – যিনি নিজেও তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক গানের জগতে সমান জনপ্রিয় – তাঁর কথা লিখি।
তিনি হলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। তাঁর ঐ মেঘমন্দ্র-স্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত এক জমকালো বাণীরূপ পেত আপন গৌরবে। ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা’ গানটির অন্তর্নিহিত বেদনা ওঁর গলায় যেমন মূর্ত হয়ে উঠত, তেমনটা আর কারো গলায় যেন অভাবনীয়; অন্য শিল্পীরাও বুঝি কথাটা মনে-মনে জানতেন, তাই ও-গানটা আর কাউকে গাইতে শুনিনি জলসায়।
আধুনিক গানেও সুরে-তালে তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ – তাঁর ‘একটি দুটি’, ‘কপালে সিঁদুর-সিঁদুর’, ‘সাতনরী হার দেবো’, ‘ওগো কৃষ্ণচূড়া’ গানগুলি এখনো কানে বাজে, মন ভরে ওঠে যথার্থ ভালো-লাগায়।
পাড়ার জলসায় সাধারণত রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষ পরিবেশিত হত না – দ্বিজেনবাবু ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নইলে হয়ত-বা কোনও শিল্পী তাঁর আসরের শুরুতেই একটি গাইতেন – ব্যস, সেইটুকুই। তাই বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী – যেমন সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, বা সুমিত্রা সেনকে কখনো পাড়ার জলসায় পেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। তার অনুরাগী শ্রোতা অন্য – বড় হয়ে তার স্বাদ উপভোগ করেছি অন্যত্র – যেমন রবীন্দ্রসদনে।
গানের বৈচিত্র্যের অবশ্য কোন অভাব থাকত না জলসায়। পল্লীগীতি পরিবেশন করতেন স্বনামধন্য নির্মলেন্দু চৌধুরী – তাঁর সেই ভরাট উদাত্ত গলায় প্রাণ পেয়ে যেত গ্রামবাংলার নদী-মাঠ-মানুষ। শহর-কলকাতার গানের আসরে তাঁর আবির্ভাব নিয়ে যে কিংবদন্তী প্রচলিত, তার যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না ওঁর খোলা-গলায় গান শুনলে – প্রমাণ হয়ে যায় ওঁর ক্ষেত্রে মাইক নিতান্তই অবান্তর। আর সত্যিই কীসব গান! ‘পান দিলাম, সুপারি দিলাম রে’, ‘সোহাগ চাঁদবদনি ধনি’, ‘আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে’, ‘ইস্সা করে পরাণডারে গামছা দিয়া বান্ধি’ – গানগুলোর ভাষায়- ভাবে- ছন্দে- তালে সত্যি যেন ঢেউয়ের মাথায় চড়ে কখনো ভাসতাম, কখনো ডুবতাম – বাঁধনহীন পরাণের খুশিতে; সে এক অনাস্বাদিতপূর্ব অনন্য অভিজ্ঞতা – কানে-শোনা আর কিছুর সঙ্গে মেলেনা।
অন্যস্বাদের গান পরিবেশন করতেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর ঐ একান্ত পরিশীলিত ঈষৎ কাঁপা-কাঁপা দরদী কণ্ঠস্বর তাঁকে দিত এক আশ্চর্য অনন্যতা। আমার সেই বয়েসেই – ‘লালু-ভুলু’ ছায়াছবির রূপোলী পর্দায় নেপথ্যে ওঁর গলায় ‘সূর্য তোমার সোনার তোরণ খোলো’ ও আরো কয়েকটি গান শুনে আমি তো মুগ্ধ! নজরুলগীতি আর আধুনিক, দুয়েই তিনি ছিলেন সিদ্ধ। তিনি যেভাবে সুরের আবেশ আর তালের আমেজ লাগাতেন তাঁর গানে, আর তা সঞ্চারিত করতে পারতেন শ্রোতাদের প্রাণে, তার কোনও তুলনা নেই। তাঁর সঙ্গে তবলাসঙ্গত খুব সহজ ছিল না – বিশেষত উনি যখন রীতিমত মুডে থাকতেন- গানের অপ্রত্যাশিত অন্ধিসন্ধিতে অনায়াস-বিচরণ করতেন ওঁর ঐ সাধা গলায়, সুর তুলতেন নিপুণ-হাতে হারমোনিয়ামে – তখন তা শ্রোতাদের মাতিয়ে তুলত বটে, তবে তার সঙ্গে তাল রাখতে পাড়ার তবলচি হিমসিম খেয়ে যেত দেখেছি। তখনকার কিংবদন্তী তবলাবাদক ছিলেন রাধাকান্ত নন্দী – তাঁর কথা অবশ্যই আলাদা! যদি সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে পেতাম কোনো জলসার আসরে, সে হত এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা – মানবেন্দ্রের সেই বল্গাহারা মাতাল গানের সঙ্গে তিনি যে শুধু অক্লেশে তাল দিতেন তাই নয়, রীতিমত পাল্লা দিতেন – আর আমরা সানন্দে উপভোগ করতাম দুই শিল্পীর সেই ঊর্ধ্বশ্বাস যুগলবন্দি-খেলা! সঙ্গীতের মাদকতায় যেন শিল্পীদের সঙ্গে মিশে মাতোয়ারা হয়ে উঠত সারা আসর। ওঁর আধুনিক গানগুলোর মধ্যে ‘বনে নয় মনে মোর’ বা ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা’ নিঃসন্দেহে বেশ জনপ্রিয় ছিল; তবে আমার মতে, ওঁর গাওয়া ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ গানটি বাংলা আধুনিক গানের জগতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ – প্রেমের নিবিষ্ট আবেশ সত্যিই ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে’ প্রবেশ করত।
কলকাতার সব সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমকক্ষ তখন ছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। জলসায় সামনে বসে ওঁর গানও শুনেছি। বড়সড় চেহারা, পরনে সাদা লম্বা শার্ট আর ধুতি – স্টেজে উঠে হারমোনিয়ামটাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে সুর সেধে গান ধরতেন। পান খেতে ভালবাসতেন খুব – আর গাইবার সময়ে খুব ছোট করে মুখ খুলতেন, ঠিক মনে হত মুখে বুঝি পান রয়েছে গালের ভেতরে – সত্যিমিথ্যে জানিনা! কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে যে গলা বেরত, তারই গুণে উনি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন শ্রোতাদের। আমি যে-সময়ে ওঁকে পেয়েছি জলসার আসরে, তখনই তিনি প্রবীণ শিল্পীদের দলে। বাংলা ছায়াছবিতে ওঁর গানের ব্যাপক ব্যবহার হত সেযুগে। ওঁর গাওয়া বাংলা আধুনিক গান ‘চামেলি মেলো না আঁখি’, ‘বাসরের দীপ’, ‘তন্দ্রা এল, বল জাগি কেমন করে’,’এই ঝিরঝির ঝির বাতাসে’, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে’, কিছুটা রাগাশ্রয়ী ‘ঝনন ঝনন বাজে’, বা পুজোর গান ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’ সেদিন সমঝদারদের মুখে মুখে ফিরত। আধুনিক গান ছাড়াও উনি গাইতেন শ্যামাসঙ্গীত। তবে আসরে ওঁর ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য উপস্থিত থাকলে ধনঞ্জয়বাবু সেদিন আর শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন না – ওঁদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকত; কারণ পান্নালালবাবু শ্যামাসঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন – শুধুমাত্র তাই-ই গাইতেন। ওঁরা দুই ভাই বাংলা গানের জগতে বাঙালীর পরম সম্পদ।
আমরা যারা সমঝদার নই মোটেই, তাদের কাছে অন্য দাপুটে শিল্পীদের মাঝে গায়ক-হিসেবে একটু আড়ালে পড়ে যেতেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় – তাঁর ঐ মৃদুকম্প কণ্ঠস্বর আর অতিনম্র স্বভাবের গুণে। যাঁরা গানের দুনিয়ার যথার্থ জহুরী, তাঁরাই দিতে পারতেন তাঁর গানের প্রকৃত মর্যাদা। শোনা গেছে – স্বয়ং বড়ে গোলাম আলি সতীনাথের গান শুনে ওঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন – ‘সতীনাথ নয়, তুমি সাক্ষাৎ শিউনাথ।’ উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতে যথেষ্ট তালিম আর যথার্থ ক্ষমতা থাকায় বাংলা আধুনিক গানের খাতে উনি তাকে বইয়ে দিতে পারতেন অনায়াস-নৈপুণ্যে। পাণ্ডিত্যের গোলযোগ নয়, লাবণ্যের সংযোগ তাই তাঁর গানকে করে তুলত সুরে-তালে শ্রুতিসুখকর। তাঁর ঐ ভাবে-ভোলা নম্রতার আড়ালে ছিল এক প্রেমিক সত্তা – গানে-গানে যা দেখা দিত বিরহ-মিলনের মাধুর্যে। ‘রাধিকা-বিহনে কাঁদে’, ‘জীবনে যদি দীপ’, ‘দুটি জলে-ভেজা চোখ’, ‘আজো তো এলো না সে’, ‘মরমিয়া তুমি’, ‘বোঝো না কেন’ – এইসব গানে সেই আকুতি মূর্ত হয়ে উঠত শতরূপে।
আর সেই প্রেমিক সত্তাই যেন আমাদের চোখের সামনে যুগলরূপে দেখা দিত উৎপলা-সতীনাথ জুটিতে। সেদিন ওঁদের দ্বৈতকণ্ঠের গানে ছোটদের নির্বোধ হাসাহাসি আর বড়দের অতি-বোধ কানাকানিতে মেশা প্রেমের যে ভাবরূপ বাণীরূপ হয়ে ধরা দিত – তখন তা আমার বোঝার বয়েস ছিল না। এক বিদেশী কবির সেই অমর কথা – ‘ Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts’ – বুঝতে হলে চাই মরমিয়া মন – যা ছিল এই শিল্পীদের; ওঁরা জানতেন – ‘বিরহ মধুর হল আজি, এই মধুরাতে।’ পরিণত বয়েসের ঐ বোধ, এ’ সহমর্মিতা সে বালক-বয়সে কারো থাকে না। তখন মনে হত, এগুলো শুধু মন-খারাপের গান। এই প্রসঙ্গেই বলি – উৎপলা সেন তখনই বাংলা গানের স্বনামধন্যা গায়িকা। তাঁর সুরেলা একক কণ্ঠের ‘প্রান্তরের গান আমার, মেঠো সুরের গান আমার’ – কী এক অনির্বচনীয় উদাসীনতায় ভরিয়ে দিত সে-বয়েসেও আমার সেই অজ্ঞান অবুঝ মন।
মনমাতানো আধুনিক গানের ডালি সাজিয়ে আসরে আসতেন আর এক শিল্পী – নাম মৃণাল চক্রবর্তী। তখনকার দিনে তিনি ছিলেন কিছুটা নবাগত – প্রতিষ্ঠিত নামী শিল্পীদের তুলনায় স্বল্পপরিচিত। স্বভাবতই ওঁর নিজস্ব গানের পসরাও ছিল অন্যদের চেয়ে সীমিত। তবে তাঁর পছন্দসই গলা আর যুৎসই গায়কী ক্রমশই শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলছিল তাঁকে। তাঁর বেশ কয়েকটি গান – ‘কথা দাও ভুলবে না গো’, ‘খোলা জানালার ধারে মাথা রেখে’, ‘কেন জানিনা যে শুধু’, ‘কথা রাখার কথা ছিল’, ‘যমুনা কিনারে সাজাহানের’ – পরিচিত ছিল অনেকের কাছেই। ‘ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে’ গানটি তো সুর-তাল-গায়কীতে মাতিয়ে তুলত ঝিমিয়ে-পড়া শ্রোতাদেরও।
কয়েকটি বিশিষ্ট গানের পসরা নিয়ে আসরে আসতেন তখনকার অনন্য শিল্পী সনৎ সিংহ। ভাবে-ভাষায় গানগুলি ঠিক আর কারো গানের মত নয়। সেই বৈশিষ্ট্য ছাড়াও, তিনি শ্রোতাদের মন জিনে নিতেন তাঁর গায়কীর নিজস্বতায় – তাঁর কণ্ঠস্বরেও যেন ছিল চেনামাটির স্পর্শ। তাঁর গাওয়া ‘একেক্কে এক, দুয়েক্কে দুই’ গানটি মনের কোণে স্থায়ী আসন পেতেছে – পায়ে-পায়ে ফেলে-আসা পুজোর দিনের স্মৃতিমেদুর অনুভূতি বুকে নিয়ে।
এমনই কিছুটা একেবারে অন্যধরণের গান গাইতেন শিল্পী অপরেশ লাহিড়ী – যার কথার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠত সবার পরিচিত পথচলতি শহুরে-জীবন। তাঁর ‘লাইন লাগাও, লাইন লাগাও’ গানটি তখনকার জনজীবনে একান্ত প্রাসঙ্গিক বলেই খুব জনপ্রিয় ছিল; গানটিকে হয়ত আজকের শ্রোতা আর এ-লেখার পাঠক ভেবে নিতে পারেন – অধুনা ‘জীবনমুখী’ গানের পূর্বসূরি।
যন্ত্রসঙ্গীতেরও কদর ছিল
যন্ত্রসঙ্গীতের কথায় আসি এবার। প্রতিভাশালী শিল্পী ভি বালসারাকে জলসার আসরে আমি পেয়েছি প্রতিবছর। প্রথম-প্রথম কাঁধে-ঝোলানো অ্যাকর্ডিয়ন, তার পরে ওঁর নিজের উদ্ভাবিত ‘ইউনিভক্স’ যন্ত্রটি নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হতেন তিনি স্টেজে – কোনবার ব্যতিক্রম দেখিনি। মনে হয়, আজকের ‘কী-বোর্ড’ বা ‘সিনথেসাইজার’ যন্ত্রটি যেন ওঁর সেই ‘ইউনিভক্স’-এর কাছে ঋণী! বাজনার হাত ছিল তাঁর অসাধারণ। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, বাংলা-হিন্দী-উর্দু সব ভাষারই পরিচিত ও অপরিচিত গানের সুর ওঁর আঙুলের যাদু-ছোঁয়ায় যেন প্রাণ পেয়ে জেগে উঠত আপন মাধুর্যে। বহুযুগ ধরে কলকাতাবাসী ও বাংলাভাষাভাষী সদাহাস্যমুখ এই শিল্পীর অক্লান্ত আর অনবদ্য পরিবেশন যাঁরা শুনেছেন, যাঁদের সৌভাগ্য হয়েছে ওঁর সান্নিধ্যে আসার – তাঁরা কেউই বোধহয় ভুলতে পারবেন না ওঁকে। অনেক কালের ব্যবধানে, এই কয়েকবছর আগে আমার একান্ত সৌভাগ্য হয়েছিল – রবীন্দ্রসদনের এক সম্বর্ধনা-বাসরে ওঁকে আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে ব্যাকস্টেজে গিয়ে পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে আসার। সম্বর্ধনার উত্তরে বালসারাজি বাজিয়েছিলেন ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’; আর দ্বিজেনবাবু গেয়েছিলেন ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। সেদিনটির পরিপ্রেক্ষিতে গান-দুটি সার্থক নির্বাচনের গুণে স্থায়ী আসন পেতেছে আমার মনের মণিকোঠায়। তার দু-চার বছর পরে দুজনেই তো চলে গেলেন পরপর – আমাদের ছেড়ে ওপারে।
অন্য যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে গীটারে বোধহয় একবারই শুনেছি কাজী অনিরুদ্ধের নিখুঁত বাজনা – স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে সেই অভিজ্ঞতা। পরে হাওয়াইয়ান গীটারে পেয়েছি বটুক নন্দী আর তাঁর সতীর্থ রজত নন্দীকে। ছোটবেলায় যে কোন যন্ত্রেই হোক – হয়ত শুধু আমি নয়, প্রায় সকলেই – জানা গান শুনলে বা গানটা নিজে থেকে চিনে উঠতে পারলে যতটা আনন্দ পেতাম, অচেনা গান শুনে ততটা নয়; শিল্পীরাও সেকথা জানতেন এবং শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের ও হাততালি পাওয়ার জন্যে যথাসম্ভব চেনা গানই বাজাতেন। দুয়েকজন শিল্পী হলিউড-ছবির জনপ্রিয় পাশ্চাত্য সুর – যেমন ‘কাম্ সেপ্টেম্বর’, ‘কে সারা সারা ’, ‘বার্লিন মেলডি’, বা ‘টাকিলা’ বাজিয়েও বেশ হাততালি পেতেন – ভিন্ন স্বাদের জিনিস পেয়ে একটু ‘মুখবদল’ হোতো শ্রোতাদেরও। আমার জলসা-শোনার শেষের দিকে অ্যাকর্ডিয়ন শুনেছি আরেক শিল্পীর কাছে – তাঁর নাম ওয়াই এস মুলকি। তিনি তখন নতুন – হাত ততটা সাধা নয় – বাজানো গানের পুঁজিও কিছু সীমিত। বোধহয় তখনও তিনি ছিলেন বালসারার মত গুরুর মন্ত্রশিষ্য।
কমেডি গান ও কৌতুক নক্সা
সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের গান জলসার আসরে পরিবেশন করতেন অসাধারণ জনপ্রিয় শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত। তিনি যে-ধরণের গান গাইতেন, তা হল ‘প্যারডি’ – সেকালের অন্য বিখ্যাত গানের সুর-তাল অক্ষুণ্ণ রেখে, অর্থাৎ ‘নকল’ করে, তার কথার পরিবর্তন করে একেবারে নতুন গান বেঁধে আনতেন। সে-সব গান তখন ছিল শ্রোতাসাধারণের ভীষণ পছন্দের। বিশেষত যখন নতুন কথাগুলো হত মজার – সবার পরিচিত বিষয় নিয়ে। যেমন, তখন শ্যামল মিত্রের একটি অতিপরিচিত আর জনপ্রিয় গান ছিল – ‘কার মঞ্জীর বাজে রিনি ঠিনি ঠিনি…’- তার অন্তরার কয়েকটি লাইন হল – ‘দেখেছি তোমায় ঐ মুখর মেলায়, পথেরই বাঁকে আর রঙেরই খেলায়’। মিন্টুবাবু কথাগুলি বদলে করলেন – ‘তোমার বাবাকে তুমি বুঝিয়ে বোলো, বেকার হলেও আমি ছেলে তো ভালো’! তখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অনুরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি যে কোনও কর্মহীন যুবকের মনে এ-কথাগুলি যে বিশেষ অনুরণন তুলবে, রসদ যোগাবে যথাস্থানে ব্যাকুল প্রেমনিবেদনে – তাতে আর আশ্চর্য কী? অন্য সব গানের কথা এখন আর মনে পড়ে না। এমনি অনেক গানের জন্যে শ্রোতারা উদগ্রীব প্রতীক্ষায় থাকত প্রতিবছর।
কৌতুকহাস্য পরিবেশনেরও পর্যাপ্ত আয়োজন থাকত জলসার আসরে। সেখানে যাঁদের দেখা পেয়েছি, আর সে-রসের মধুর স্বাদ উপভোগ করেছি, তাঁরা সবাই সেদিনকার স্বনামধন্য শিল্পী – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, ও নবদ্বীপ হালদার – বাংলা ছায়াছবির কল্যাণে উপস্থিত সকলেরই পরিচিত। প্রথমোক্ত দুজন হাস্যরস পরিবেশন করতেন ‘বলনে’, মানে কথা বলে – আর শেষোক্তজন তা করতেন ‘চলনে’, মানে স্রেফ চেহারায় আর চলাফেরায়। ওঁকে দেখলেই আমাদের পেটের ভেতর থেকে হাসি যেন গুড়গুড়িয়ে উঠে আসত। জনপ্রিয়তায় ওঁদের তিনজনের মধ্যে অবশ্য তারতম্যও ছিল। ভানুবাবুর কমিক বা ক্যারিকেচারের কিছু রেকর্ডের তখনই বাজারে বেশ কদর ছিল – সেগুলো করার জন্যে অনুরোধ আসত শ্রোতাদের কাছ থেকে। কখনো ভানু-জহর জুটি বেঁধে হয়ত ছোট কোন হাসির স্কেচ শ্রোতাদের উপহার দিতেন – সরস সংলাপের গুণে, আর পরস্পরের উতোর-চাপানের মাধ্যমে তা সবার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠত। একটা কথা বিশেষভাবে বলার মত – তখন বয়েস ‘কাঁচা’ ছিল বলে কিছু রঙ্গরসিকতা হয়ত সেদিন না বুঝে থাকতে পারি – তাতে আমার জন্যে রসের ন্যূনতম ব্যাঘাত হলেও, শিল্পীরা আসরে কখনোই ‘কাঁচা’ রসিকতা করেন নি – যাতে ঘটতে পারে রুচির ব্যাঘাত। আমার মনে হয়, নানা-বয়সী নানা অবস্থার শ্রোতার কথা মনে রেখে শিল্পীদের নির্মল হাস্যরস পরিবেশনের পরিকল্পনা করা বিশেষ প্রশংসনীয়।
ছিলেন মহিলা শিল্পীরাও
উৎপলা সেন ছাড়া অন্য মহিলা শিল্পীদের কথা তো এখনো কিছু বলিনি; তার একটা বড় কারণ, তখন সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন কমই – আর জলসার আসরে উপস্থিতি আরো কম। তাঁদের মধ্যে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাব-বিনয়ী গায়িকা, একগাল হাসিমুখে স্টেজে এসে বসতেন – নেহাৎই সাদাসিধে চেহারার, ঠিক যেন চাবিবাঁধা আঁচল পিঠে-ফেলা বাঙালীর আটপৌরে ঘরের বৌ – সাজগোজেরও বিশেষ বালাই ছিল না তাঁর। কিন্তু হারমোনিয়ামের চাবি টিপে যখন গান ধরতেন, তখনই বোঝা যেত – তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ ঐ গলার স্বরে, সেখানে তিনি একান্ত অপরূপা, নানা-সাজে সজ্জিতা। অমায়িক নিরহঙ্কার মানুষটি গান গাইতে আর শোনাতে ভালোবাসতেন। তাঁর দরদী-গলায় গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ গানটি জল আনত শ্রোতাদের চোখে, অনুনয়ের সুরে গাওয়া ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ গানটি সত্যিকারের সহানুভূতিতে ভিজিয়ে দিত শ্রোতাদের মন – আবার তাঁর সাধা গলায় রাগাশ্রয়ী গান দুটি – ‘নিঙাড়িয়া নীলশাড়ি শ্রীমতী চলে’, এবং ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’ – শ্রোতাদের প্রাণে এঁকে দিত সুর-তালের নিখুঁত বুননে এক অসামান্য রঙবাহার। চোখের আলোয় দেখা সাধারণ ছবি অন্তরের দেখায় কখন যেন অজান্তেই হয়ে উঠত অসাধারণ!
সেদিনকার প্রবীণাদের অন্যতমা সুপ্রভা সরকারকে খুব আবছা মনে পড়ে – কিন্তু ওঁর কোনো গান আজ আর মনে করতে পারিনা স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে। আশা করি, শিল্পী হয়ত আমায় নিজগুণে ক্ষমা করবেন। তখনকার মহিলা- শিল্পীদের মধ্যে আর একটি চেনা নাম সুপ্রীতি ঘোষ। শ্রুতিমধুর ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি তাঁর একটি গান রেকর্ডে আর রেডিওতে খুব জনপ্রিয় ছিল – ‘যেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো’; জলসায় গানটি ওঁর মুখে শুনতে ভাল লাগত – দুঃখের গান হলেও।
বাংলা আধুনিক গানের জগতে বাণী ঘোষাল আর গায়ত্রী বসু ছিলেন তখনকার মহিলা-শিল্পীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নবাগতা। গায়ত্রী বসুর গলা ছিল জোরালো। জলসাতেই প্রথম শোনা তাঁর গাওয়া একটি গান – ‘দূরের পাহাড় যেন কত শান্ত ছেলের মতো’ সেইবয়সে ছিল আমার খুব প্রিয় – মনে-মনে গুণগুণ করতাম যখন-তখন। তার কথাগুলোর ভেতর থেকে যেন একটা গল্প বেরিয়ে আসত – আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকত। তবে বাণী ঘোষাল ছোটদের উপযোগী গান বেশী গাইতেন বলে আমাদের মনোমত ছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ছড়ার গান ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো’ উনি খুব ভালো গাইতেন – শুনে বেশ মজা পেতাম আমরা। তবে শুধুমাত্র ছোটদের জন্যেই ছড়ার গান – যেমন ‘হাট্টিমাটিম্ টিম্’ বা ‘দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি’ – গাইতেন তখনকার উঠতি শিল্পী জপমালা ঘোষ। প্রথমদিকে এধরণের কিছু গান শুনেছি আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেলা আর ছেলেমানুষি মিষ্টি গলায়। তাঁর আরো অজস্র গানের মধ্যে ছিল ‘উঠ উঠ সুরযাই’, ‘আবছা মেঘের ওড়না গায়ে’, ‘তারাদের চুমকি জ্বলে আকাশে’, ‘আকাশ আর এই মাটি ঐ দূরে’, ‘এত মঞ্জরী কেন আজ ফুটেছে’, ‘বকুলগন্ধে যদি’, আর তাঁরই নামাঙ্কিত গান ‘আমি আল্পনা এঁকে যাই আলোয়-ছায়ায়’। আমার ছোটবেলায় এসব গান ছিল অসম্ভব জনপ্রিয় – অনেকের মুখে-মুখে ফিরত। দুঃখের কথা, পরে আর ওঁকে পাইনি জলসার আসরে। বড়দের মুখে শুনেছি, বিয়ের পর ওঁকে গান গাওয়া ছাড়তে হয়েছে – সত্যি-মিথ্যে অবশ্য ঠিক জানতে পারিনি কখনো। বাংলা গানের এক অসামান্য সম্ভাবনা অসময়ে হারিয়ে গেলেন শ্রোতাদের কাছে – মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোর সামনে থেকে চির-বিস্মৃতির ছায়ার অন্তরালে।
তেকোনা পার্কে নয়, পাশের পাড়া নর্দার্ন পার্কের জলসায় প্রথম গান-শোনা এক নবীনা শিল্পীর – নাম নির্মলা মিশ্র। নিতান্তই অল্পবয়সী বেণীদোলানো সদ্যতরুণী – গান শুরু করতেই শুদ্ধ নিখাদে সাধা সেই তাঁর পরিশুদ্ধ কণ্ঠস্বর নিখাদ সোনার তরল স্রোতের মতই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শ্রোতাদের – প্যান্ডেল ছাড়িয়ে, পার্কের সীমানা অনায়াসে অতিক্রম করে, আশপাশের বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা মেরে, সরব প্রতিধ্বনি হয়ে আসরে ফিরে এসে কুণ্ঠাহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল – এ’শুধু আগমন নয়, এ’ আবির্ভাব! সেদিনের নবীনা শিল্পী তার পরে কালের ধাপে-ধাপে পা ফেলে পরিণত হয়ে উঠেছেন, স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখে। একে-একে বিভিন্ন মুডের ওঁর সব গান – ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, ‘ও তোতাপাখি রে’, ‘ওরা ঘুমায়, আবার জাগে’, বা ‘সোনা-রোদে মেঘের ঝিলমিল’ – সব শ্রোতাদের মন কেড়েছে নিমেষে। তারপর থেকে ওঁর গান শুনেছি, দেশে এবং বিদেশে – মন ভরিয়ে প্রাণ হরিয়ে সে-সব অতুলনীয় গান বিস্মৃতির অতল থেকে অজান্তে উঠে এসেছে মগ্ন-চেতনায়, উত্তরিত হয়েছে মনের মণিকোঠায় নতুন স্মৃতির সম্পদ হয়ে। বাংলা আধুনিক গান সমৃদ্ধ হয়েছে ওঁর কণ্ঠে।
নর্দার্ন পার্কের জলসায় সেসময় আর কোনো নতুন শিল্পীকে পাইনি। ইতিমধ্যে বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার রাত্তিরে বাইরে থাকার গণ্ডীটাও একটু বেড়েছে। জানা গেল, ল্যান্সডাউন রোড ধরে আর একটু দক্ষিণে নতুনবাজারের সামনে রামকৃষ্ণ পার্ক বলে একটা ছোট্ট পার্কে খুব জমাটি জলসা হয় – কালীপুজোর পরদিন, ল্যান্সডাউন রোড বন্ধ করে দিয়ে – সেটা চলে সারারাত। সেখানে নাকি কলকাতার তাবড় তাবড় সব শিল্পী তো আসেনই, মাঝে-মাঝে বোম্বের শিল্পীরাও এসে উপস্থিত হন। সেই জলসার কর্ণধার অজয় বিশ্বাস আমাদের ইস্কুলের, মানে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র – এবং তাঁর স্ত্রী রাখী বিশ্বাস তখন বোম্বের ফিল্ম-জগতের উঠতি তারকা। সেই সুবাদেই এই আসরে বোম্বের শিল্পীদের দর্শন মেলে। তাঁদের দর্শনের উদ্দেশ্যে নয় – আমার আগ্রহ ভাল শিল্পীর গান শোনায়, অন্যত্র যাঁদের কখনো পাইনি – তাই একাধিক বছর হানা দিয়েছি সেখানেও। রাস্তায় ইট পেতে বসে গান শুনতে শুনতে কাটিয়ে দিয়েছি সারারাত। তবে যাঁদের গান আগে শুনিনি, এমন কাউকে সেখানে পেয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। একবছর অবশ্য মহানায়ক উত্তমকুমার মঞ্চে দেখা দিয়েছিলেন, আর মনে আছে – মাইকে অজয় বিশ্বাসের অজস্র স্তুতিবাক্য ও প্রশংসাবাণীর উত্তরে দুয়েকটি কথা বলার পরে গেয়েছিলেন – ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। গলা ভাল, বেশ সুরেলা – শোনা যায় গান শিখেছিলেন প্রথম-জীবনে। দুধ-সাদা ধুতি-পাঞ্জাবীতে সুন্দর-বেশে সেজে সেই সন্ধ্যায় তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন শ্রোতা তথা দর্শকদের মন, আবারও! তখন উনি কেবল দর্শনধারী – তাঁর গুণবিচারের ক্ষমতা আমার অন্তত তখন ছিল না। রূপোলী পর্দার বাইরে ওঁর সে রূপ এখনো চোখের সামনে দেখা দেয়। ওঁর বাড়ী ভবানীপুরে, টাউনসেন্ড রোডে – রামকৃষ্ণ পার্ক থেকে খুব দূরে নয়।
মনে পড়ে ঐ জলসারই একেবারে শেষরাতের দিকে স্টেজে ঘোষণা হল – ‘এখন নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে মঞ্চে আসছেন লতা-কণ্ঠী শিল্পী শ্রীমতী অনুরাধা লাহা’। ওঁকে বোম্বের শিল্পী বলে পরিচয় করিয়েছিল কিনা, সেকথা এখন ভুলেছি – তবে কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে এ-নাম আগে শুনিনি – হতে পারে আনকোরা নতুন। ঘোষণার পরে যিনি মঞ্চে এলেন, তাঁকে বয়সে খুব নবীনা বলে মনে হল না। কল্কার কাজের লাল-পাড় শাদা সিল্কের শাড়ি-পরা দোহারা চেহারা। অল্প প্রাথমিক অস্বাচ্ছন্দ্য জয় করে উঠে বেশ কয়েকটি গান শোনালেন, বাংলা ও হিন্দীতে – শ্রোতাদের অনুরোধে – হ্যাঁ, সবই লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া। কণ্ঠস্বরে লতার সুস্পষ্ট অনুকরণ – দু-একটি গানের কথার উচ্চারণে কিছুটা তারতম্য কানে আসছিল, কান পেতে শুনলে। অনুশীলিত গলায় চেষ্টার ছাপ মুছে ফেলতে তিনি নিঃসন্দেহে সক্ষম হয়েছিলেন। সে-রাত্রে ‘না যেও না …’ গানটি দিয়ে যখন শেষ করলেন তাঁর পরিবেশন, আকাশের অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে – ফুটে উঠেছে শুকতারার সঙ্কেত – ভোর ভয়ি। সেই প্রথম আলোয় আমিও ধরলাম বাড়ীর পথ।
অনেকটা হেঁটে বাড়ী পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত মনের মধ্যে অনুরণন চলছিল ঐ শেষ গানটির – সুর ভাঁজছিলাম অস্ফুটে। রাগরাগিণীর জ্ঞান আমার বিন্দুমাত্রও নেই – শুধু জানি দিনের বিভিন্ন প্রহরের সঙ্গে আছে বিভিন্ন রাগের মিতালী – যেমন শেষরাতের সাথে দরবারীর, ভোরের সাথে ভৈরবীর। এ কি তবে ভৈরবীর সুর? কে জানে! পরক্ষণেই ভাবলাম – আমি আদার ব্যাপারী – মূর্তিমান অ-সুর – সুরের খোঁজে যাওয়ার আমার দরকার কী বাওয়া! গানের বিচারে যে আমি নেহাৎই অজ্ঞ, কেবলমাত্র ভালো-লাগাতেই আমি মশ্গুল – সেই আমার একমাত্র মাপকাঠি – সেকথা তো আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আর এইজন্যেই আমার কখনো গান-শেখা হল না – কারণ আমার কেমন স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল, গান শিখতে গিয়ে ব্যাকরণের চাপে চেপ্টে সেই আঘাতে আমার ঐ ভালো-লাগা নির্ঘাত অকালেই যাবে মরে!
বাড়ী পৌঁছে দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে ঘরের চৌকাঠে পা রাখার আগেই কানে এল ঠাকুমার বকুনি – ‘এতক্ষণে বাড়ী ফেরার সময় হোল তোর? তুই জানিস, এ-সময়ে রাস্তায় ঘোরে শুধু মোদো-মাতালরা।’ সেই মুহূর্তে আমি ঠাকুমাকে বোঝাতে পারতাম না কিছুতেই – আমি তখন যে-রসের মাতাল, তা ঠিক সোমরস নয়! তাই সে-চেষ্টায় জলাঞ্জলি দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা সঁপে দিলাম সর্বংসহা বিছানার কোলে।
সে-ই বোধহয় আমার শেষ জলসা-শোনা। পরে জেনেছি – বাংলার রাখী বিশ্বাস হারিয়ে, বোম্বের মোহবশে গুলজার হয়ে বাঁধা পড়েছিলেন নতুন পরিণয়-সূত্রে। অজয়ের কোনো খবর আর পাইনি – তবে রামকৃষ্ণ পার্কের জলসা সমাধি-লাভ করেছিল কয়েক-বছরের মধ্যেই। আমিও তখন কলকাতার মায়া কাটিয়ে বেপাত্তা। ভেঙে গেছে খেলাঘর – রয়ে গেছে কিছু স্মৃতি আর ভালো-লাগা।
অন্যত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর
জলসার পাশাপাশি, বা সে-যুগের অব্যবহিত পর থেকে – বোধহয় আমার তের-চোদ্দ বছর বয়েস থেকেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভালবাসাটা মনের মধ্যে শেকড় গেড়েছে, আর বেড়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। তার কারণটা এখন ভেবে বলতে পারব না – মনে হয় গানের কথা ভালো-লাগা আর তার অর্থ বুঝতে পারাটা হয়ত ধীরে ধীরে কাজ করেছে মনের মধ্যে। জলসায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবটা বোধ করে, তখন আমি সুযোগ-সুবিধেমত যেতে শুরু করেছি শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে – শিশির মঞ্চে, কলাভবনে, রবীন্দ্রসদনে – বা ‘অন্য কোনখানে’। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি যখনই পেরেছি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের তখনকার সব শিল্পীকে সামনে বসে শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই সব দিকপাল শিল্পীদের মধ্যে আছেন সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতু গুহ, পূরবী মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, পূর্বা দাম, দেবব্রত বিশ্বাস, সুবিনয় রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন – আর তার একটু পরের যুগে গীতা ঘটক ও পীযুষকান্তি সরকার। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে একেই বোধহয় বলা যায় ‘প্রতিভার মিছিল’। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমি যে এঁদের গান সামনে বসে শুনতে পেরেছি – সে-সৌভাগ্যে আমি ধন্য। ঠিক আসরে না হলেও, শান্তিনিকেতনে একবার পূর্ণিমা-তিথিতে কয়েক বন্ধুর মধ্যে এক নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়, খোলা আকাশের নীচে ফাঁকা মাঠে বসে-শোনা স্বপন গুপ্তের গাওয়া দুটি গান – “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে”, আর “পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে” – নানা কারণে স্মৃতির পটে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
আজ নতুন করে ভাবতে বসে দেখি – কালের নিয়মে ‘একে একে নিভিছে দেউটি’ – আসর ছেড়ে বিদায় নিচ্ছেন সেদিনের চেনা সব উজ্জ্বল তারকারা। স্তিমিত আলোয় যখন বুক বাঁধছি আঁধারের আশঙ্কায়, তখনই পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন উদীয়মান শিল্পীরা – নবীন গলায় নতুন-পুরনো গান সেধে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে পেয়েছি স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, জয়তী চক্রবর্তী, শ্রীকান্ত আচার্য-কে – সেই সঙ্গে পেয়েছি সুমিত্রা সেনের দুই কৃতী কন্যা ইন্দ্রাণী আর শ্রাবণী সেনকে – আপন অধিকারে যাঁরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। পুরনোদিনের শিল্পীদের সঙ্গে তুলনা না করেই আজ বলব – তাঁদের অভাব পূরণ করতে এঁরা আমায় দেখিয়েছেন আশার আলো। নস্টালজিয়া চিরকালই ‘সুদূরের পিয়াসী’; অনেকের কাছে হেমন্ত পঙ্কজের ছাত্রই রয়ে যাবে, সায়গল অতুলনীয়! আমার মতে, আর সব কিছুর মতই – মহাকালই নয় করুক সে বিচার।
বাকী রইল গান নিয়ে এলোমেলো মনে-আসা দুয়েকটা টুকরো কথা। অন্যের গান পারতপক্ষে জলসায় বা জনসমক্ষে তখন করতেন না শিল্পীরা – যদি না তাঁরা হন ‘পাড়ার হেমন্ত’ – অর্থাৎ যাঁরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নকল-করা উঠতি বা ‘উড বি’ শিল্পী – প্রায় সব পাড়াতেই পাওয়া যেত যাঁদের বহুরূপে। মহিলাদের মধ্যেও তেমনি ছিলেন ‘পাড়ার লতা’। তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য সত্যিই ভাল গাইতেন – যেমন আমাদের পাড়ার ‘হিরো’ দেবীদা – বা দেবী তথা সমীর মল্লিক। পাড়ার জলসার আসরে যখন তিনি গাইতেন, চোখ বুজলে সত্যিই মনে হত – হেমন্ত মুখার্জী গাইছেন। শ্রোতাদের হাততালি আর জনগণের তারিফের নিরিখে এঁদের মধ্যে কেউ-বা কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে প্রকৃতই উত্তরিত হয়েছেন ভবিষ্যৎকালের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীতে।
গানের অনুষঙ্গে বাজনার এত বাড়াবাড়ি ছিল না তখন – সে ছিল শুধুমাত্র হারমোনিয়াম আর তবলার একান্ত সখ্যতার যুগ। দক্ষ শিল্পী তাই-ই অবলম্বন করে সুরে-তালে ভেল্কি খেলাতে পারতেন আসরে – বাড়াবাড়ি ছিল না কোনো, ছিল না তার প্রয়োজনও – না শিল্পীর কাছে, না শ্রোতাদের। যন্ত্রসঙ্গীতের অসঙ্গত সঙ্গতের সঙ্গে অ-সঙ্গীত আর্তনাদের দুর্বিষহ যন্ত্রণায়, আর বেয়াড়া শব্দের অহেতুক অত্যাচারে শ্রোতাদের কান ঝালাপালা করে – গানটাকে গলা টিপে হত্যা করা হত না হামেশাই। আমার তো মনে হয়, এ-যুগে গানের আসরে এই শিল্পগত এবং রুচিগত পরিমিতি-বোধ ব্যবহৃত হলে শ্রোতারা অন্তত পালিয়ে না বেঁচে বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, শিল্পীরাও মানে গায়ক-গায়িকাও তথৈবচ! আর হ্যাঁ, যেটার কথা তালেগোলে প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলাম – অতিনির্ঘোষে চাপা-পড়ে যাওয়া সেই বেচারা গানটাও নাভিশ্বাস না ছেড়ে অবশেষে বেঁচে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।
গীতিকাররা, সুরকাররা রয়ে যান আড়ালেই
বাংলা আধুনিক গানের কথা নিয়ে কিছু কথা লেখার সময় এসেছে এবার। গানের কথা যাঁরা লেখেন, তাঁরা কেউই প্রায় শ্রোতাদের কাছে তাঁদের যথাযোগ্য প্রাপ্য সম্মান পান না – সার্বিক অজ্ঞতাই তার মূলগত কারণ। আমার কাছে পুরনোদিনের বেশ কিছু গানের কথা অসাধারণ – কাব্যিক ও সুন্দর – আমার মতই অন্য শ্রোতাদের মনেও তাদের আবেদন অনিবার্য ও অনস্বীকার্য। অথচ, কোন গানের কথা বিশেষ ভাল লাগলেও, কে যে সেটি লিখেছেন তা জানা যায় না বলে অবশ্যপ্রাপ্য ধন্যবাদটুকুও তাঁর কাছে পৌঁছয় না – সম্মান বা আর কোনও পুরস্কার তো দূর্ অস্ত্! সেটা গায়কদের দায়িত্ব বলব কিনা জানিনা – বা ইচ্ছে থাকলেও শ্রোতাদের সে-কথা জানাবার সুযোগ বা সময় তাঁদের দেওয়া হয় কিনা, জানিনা তা-ও।
বাংলা ভাষা আর বাংলা গান দুই-ই আমি অন্তর থেকে ভালবাসি – সেকথা এখানে কবুল করে যাই। আর সেইসঙ্গে, আজীবন বাংলা গান শোনার পরিপ্রেক্ষিতে – সেই অজস্র ভালো-লাগা গানের রচয়িতা বলে যাঁদের জানি, তাঁদের নামও আমি উল্লেখ করে যাই এ-লেখায়। তাঁরা হলেন – কমল দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সলিল চৌধুরী, অলোকনাথ দে, শ্যামল গুপ্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুলদেব বর্মণ, শ্যামল মিত্র, পবিত্র মিত্র, ভূপেন হাজারিকা ও সুমন চট্টোপাধ্যায়। গায়ক-গায়িকার নেপথ্যে থেকে এঁরা কেউ-বা লিখেছেন কথা, কেউ দিয়েছেন সুর — কেউ-বা দুই-ই – তবেই সার্থক হয়েছে গান।
এই গীতিকার তথা সুরকারের দলে সলিল চৌধুরী গানের জগতে এক বিস্ময়কর প্রতিভা – ভাবে-কথায়-সুরে অতুলনীয়। ওঁর “গাঁয়ের বধূ” প্রথম-শোনার অভিজ্ঞতা আমার কাছে চিরজাগরূক – শিহরণ খেলে গিয়েছিল দেহেমনে – সেদিন থেকে বাংলা আধুনিক উত্তরিত হয়েছিল পূর্বতন উচ্চতা ছাপিয়ে। মনে আছে সমপ্রাণ এক বন্ধুকে বলেছিলাম – “এই গানটায় সলিল সঙ্গীতজগতে রবিঠাকুরের পায়ের কাছে পৌঁছে গেছেন।” ওঁর পরবর্তী সব কীর্তি তো সেই অনন্য প্রতিভারই অদম্য জয়যাত্রা। আর সলিল-
হেমন্ত জুটি তো বাঙালীর স্বপ্নের ধন, পরম-পাওয়া এক দুর্লভ সৌভাগ্য! হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেও অবশ্যই পড়েন এই দলে, সে-কথা অনস্বীকার্য। তবে গায়ক-হিসাবে তাঁর সহজাত ক্ষমতা ও অবিসংবাদিত খ্যাতির সুবাদেই তিনি অন্য সব ভূমিকা ছাপিয়েও বাঙালী শ্রোতাদের কাছে থাকবেন একক মহিমায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং চিরস্মরণীয়।
জানি অনেক নামই অনুক্ত রয়ে গেল এ-তালিকায়, এ-বিষয়ে আমার অজ্ঞতাই তার একমাত্র কারণ। আজকাল কানে আসে – লেখকরা বা সুরকাররা কোনো-কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পান, কথাটা ভাল লাগে শুনে। গানের জগতে সর্বকালেই সেটা তাঁদের ন্যায্য অধিকার।
ওপরের তালিকায় শেষোক্তজন তো একাধারে লেখক, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রশিল্পী, ও গায়ক – একালে বাংলা আধুনিক গানের মোড় ঘুরিয়ে নতুন পথের সার্থক পথপ্রদর্শক। ওঁর গান আমি উপভোগ করেছি এবং এখনো করছি – গানের পথে আমার পরবর্তী কালের পথচলায়। নতুন করে উপলব্ধি করেছি, কথা আর সুরের মেলবন্ধনেই গানের সৌকর্য – বিশেষ করে জেনেছি কথার মূল্য – মন ছুঁয়ে যাওয়া পরশমণি লুকোনো থাকে যেখানে। সম্প্রতি-শোনা ওঁর ধারাবাহিক প্রচারিত ‘বেজে ওঠা স্মৃতি’-র ভরা পসরা আমার মনেও নতুন করে আনে এক অনির্বচনীয় স্মৃতিমেদুরতা – ঐ পঞ্চাশ থেকে সত্তরের গানের জগৎ যে আমারও পরম-চেনা – আমার এ-লেখার প্রেরণাও তো তাই! বয়সে উনি ঐ তালিকায় অন্যদের চেয়ে অনেকটাই নবীন, তাঁদের সঙ্গে ওঁর প্রায় গুরুশিষ্যের সম্পর্ক – তাই আমার জলসা-পরিক্রমার কালে ন্যায্যকারণেই তিনি অনুপস্থিত। তবে আধুনিক বাংলাগানের ক্রমবিকাশে তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল, অনন্য এবং অনস্বীকার্য।
আমি আগে লিখেছি, জলসায় কখনো পাইনি যাঁদের দেখা তাঁদের নাম – শচীনদেব বর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, এবং মান্না দে – হ্যাঁ, আর সেইসঙ্গে শ্যামল মিত্র। এঁদের মধ্যে শচীনদেব ছাড়া আর সবাইকেই পরে জীবনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনে বসে শোনার সুযোগ আর সৌভাগ্য আমার হয়েছে – সেকথা না জানালে অসমাপ্ত রয়ে যাবে এ-লেখা।
প্রবাসের জলসাতে বাংলা গান
জন্মভূমি-মাতৃভূমিতে নয়, বলতে গেলে পিতৃব্য-ভূমিতে – সাক্ষাৎ আঙ্কল স্যামের দেশ আমেরিকায় – ওঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আর গান-শোনা। আমি আজ পঞ্চাশ বচ্ছর দেশছাড়া গৃহত্যাগী হয়ে ‘প্রবাসীর বেশে ভ্রমি’ সেদেশে। আর সে-সুবাদে, সচরাচর প্রথম-প্রজন্মের প্রবাসীরা স্বদেশের সংস্কৃতির ছোঁয়া পরদেশী-জীবনে বাঁচিয়ে রাখতে যা যা করে থাকেন, সবই হয়েছে করা – নিজেদের জন্যে সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ, পরবর্তী-প্রজন্মের জন্যে বাংলা স্কুল, বাংলা লেখার চেষ্টা ও অল্পবিস্তর সাহিত্যচর্চা – ইত্যাদি। এদেশে সাংস্কৃতিক সম্মিলনে দেশের শিল্পীরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছেন – সেই-সূত্রেই ওঁদের গান সাক্ষাতে শোনা। ব্যক্তিগতভাবে আমার বাড়তি সৌভাগ্য – সুবীর সেন এদেশে আমার আতিথ্যে কয়েকদিন কাটিয়ে গেছেন – অনেক গান শোনা ছাড়াও ওঁর সঙ্গে অনেক অন্তরঙ্গ কথাবার্তার স্মৃতি রেখে গেছেন আমার মনে – সে আমার পরম-পাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা! আমি ওঁর গানের, বিশেষত ওঁর কণ্ঠস্বরের প্রকৃতই গুণমুগ্ধ। মাথায় থাকুন হেমন্তবাবু, উনি তর্কাতীত – কিন্তু আর কোনো পুরুষকণ্ঠ আমাকে মিষ্টত্বে বা ভাবে অভিভূত করতে পারে না ওঁর মত। ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল’ সে-কণ্ঠ – তাকে ভালো-লাগার আর কোনো ব্যাকরণ আমার জানা নেই।
১৯৮৫-তে আমাদের এই সানফ্রান্সিসকো অঞ্চলে ‘প্রবাসী’-র এক অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান সামনে বসে শোনার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল – সঙ্গে আবার তবলায় ছিলেন প্রবাদপ্রতিম রাধাকান্ত নন্দী – একেবারে রাজযোটক! ঐ অনন্য সুরেলা কণ্ঠে অসাধারণ নৈপুণ্যে ও আন্তরিক নিষ্ঠাভরে একে একে উপহার দিলেন তাঁর অসামান্য জনপ্রিয় গানের ডালি। সেইসঙ্গে শোনালেন ছোটবেলায় না-শোনা একটি নতুন গান ‘মা ও মেয়ে’ – ওঁর মেয়েও উপস্থিত ছিলেন সেদিন।
দেখলাম, কী অসীম যত্নের সঙ্গে উনি মেয়েকে মনের মত তৈরী করে তুলছেন – উত্তরসূরীর গলায় তুলে ধরছেন আপন গানের ইন্দ্রধনু। মনে পড়ছে মাইক গণ্ডগোল করছিল বলে রাধাকান্তবাবুর কাছে সেদিন শুনেছিলাম প্রাপ্য ভর্ৎসনা – “আপনাদের এই সিলিকন ভ্যালি তো শুনেছি ইলেক্ট্রনিক্সের পীঠস্থান – এখানেও কেন এই অবস্থা?”
এই সব প্রখ্যাত শিল্পী নতুন করে অন্য কোনো পরিচয়ের অপেক্ষা রাখেন না – তাঁদের গানের মধ্যে দিয়েই তাঁরা চির–প্রোজ্জ্বল – বাংলা গানের আকাশে এক একটি চিরস্থায়ী জ্যোতিষ্ক-স্বরূপ। আমার এ-লেখায় ওঁদের সম্বন্ধে নতুন কিছু বলার প্রচেষ্টা হবে বাহুল্যমাত্র – তাই এখানেই শেষ করি ওঁদের সম্বন্ধে আমার এই সশ্রদ্ধ স্মৃতিমুখরতা।
আমার বাল্যকাল কেটেছে পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশক জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমার যৌবনের উন্মেষ-কাল। তাই কালের নিরিখে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সাক্ষী আমি – সেদিক থেকে আমার অসীম সৌভাগ্যের কথা মনে করেছি বারবার। সেই সব দিনগুলো বুকে করে আগলে নিয়ে কবেই চলে এসেছি এই বিদেশে। সময় পেলেই মনের নিভৃতে তাদের নাড়াচাড়া করি পরম যত্নে, দামী গয়নার মত – দেশকালের ব্যবধান কোথায় যায় হারিয়ে।
এ-লেখা স্মৃতিমেদুরতার রসে ভরপুর, সেকথা স্বীকার করে নিই। তবে শেষ করার আগে একটা কথা লেখা হয়ত একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবেনা এখানে। আজকের-দিনের গানও এখন আমি শুনি – কিন্তু মন ভরে না। তাই আমার কাছে ভাল বাংলা গানের অভাবটা সেদিনের সঙ্গে তুলনায় যেন প্রকট হয়ে ওঠে – যদিও তার কারণটা ঠিক কি, তা জানি না। শুধুমাত্র স্মৃতিমেদুরতা এ নয়। এ-বিষয়ে আমার অনুমান – কালের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে রুচি পাল্টাচ্ছে, ভাষা বদলাচ্ছে, গান লেখার উৎসাহে ভাঁটার টান দেখা দিচ্ছে; রচয়িতার সংখ্যা কমেছে কিনা জানিনা, তবে লেখার মান নিয়ে টানাটানি চলেছে – সব মিলিয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটছে বাঙালীর মানসিকতায়।
শুনি ঐ নূতনের ডাক
আজকাল গানের আসরে দেখেছি, এমন-কী রেকর্ডে বা সিডিতেও শুনছি – নতুন-যুগের শিল্পীরা অকাতরে পুরনো জনপ্রিয় গান নির্দ্বিধায় পরিবেশন করে চলেছেন। না, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অতুলপ্রসাদী নয় – পুরনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের আধুনিক গান! এমনটা ছিল না আগে। এটা অবশ্য একান্তই আমার নিজস্ব মত – তবে এখনকার শিল্পীদের হয়ে আমি এটুকু নিঃসন্দেহে বলব – তাঁদের ‘প্রাণে গান নাই’ যে তা মোটেই নয় – শুধু তুলনামূলকভাবে এখন ভাল গান লেখা হচ্ছে না বলেই তাঁরা পুরনোদিনের নামী শিল্পীদের পুরনো গানই গাইছেন, আপন ক্ষমতা অনুযায়ী। আর একটা কারণ, প্রাথমিক শিক্ষার অবকাশে নবীনরা সেইসব গানই গেয়ে এসেছেন এবং গলায় সেধেছেন – হেমন্ত-সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সুমন ইস্তক। সে-সব গান জনপ্রিয়তার সুনিশ্চিত ছাপমারা, কালের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ – কোনো মার নেই তাদের। শ্রোতারা মন দিয়ে শুনবে,তাঁরাও চেনা গানই বেশী পছন্দ করেন – দুপক্ষই নিশ্চিত জানেন সেকথা। নবীনদের মধ্যেও অধুনা-প্রাক্তন এক গায়কের মুখ থেকে এ-নিয়ে খেদোক্তি শুনেছি। আরো সমস্যা – কালে-কালে অনিবার্যভাবে তুলনা চলতে থাকবে পুরনোর সঙ্গে নতুনের গানে – সেটা নতুনদের পক্ষে ভাল হবে কি না, তা তাঁদেরই বিচার্য।
হয়ত সবদিক বিচার করেই নতুনেরা মাঠে নেমেছেন, যাকে বলে ‘অগত্যাই’ – শেষ-বিচার তো সেই কালের অথবা জনগণেশের হাতেই! হাতে যা তাস আছে, খেলতে তো হবে তাই দিয়েই – তাঁদের তাই-ই সম্বল। । হ্যাঁ – রুচি পাল্টাচ্ছে, ভাষা বদলাচ্ছে, গান লেখার উৎসাহে ভাঁটার টান, সর্বোপরি বাংলা-শেখার উপযোগিতা নিয়ে দ্বিমত তথা বিতর্ক চলছে এবং চলবে – এসব অনেক বৃহত্তর সমস্যার সঙ্গে সর্বদা মোকাবিলা করতে করতেই এগোতে হবে ওঁদের। সেটা খুব আশ্চর্যের নয় – নতুনেরা চিরকালই তা করেছে – পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পায়ের বেগে পথ কেটে এগিয়েছে – ‘নান্যঃ পন্থাঃ বিদ্যতে অয়নায়’। আমি কিছুদিন হয়ত থাকবো তার মূক সাক্ষী হয়ে, তারপর কালের নিয়মে …’হবো ইতিহাস’। তবে তার আগে, এ-লেখার মাধ্যমে আমার সব প্রিয় শিল্পীদের পাঠাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য, জানিয়ে যাই আমার অন্তিম প্রণাম – আর একান্তে বলে যাই – আমি ধন্য।