কেমন
ছিল সে যুগের পুলিশ? (১২)
[এই
বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসমাপ্ত| হরফ ফণ্ট-এ বাংলায় এটি দেখতে
পারবেন ইণ্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করলে| তারজন্য এইখানে
ক্লিক করুন|]
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬)
(৭) (৮) (৯) (১০) (১১)
(১২)
ইউনাইটেড কমারশিয়াল ব্যাঙ্ক ডাকাতি- ১
পর পর কটি ডাকাতির সফল অনুসন্ধানে বড় বড় দস্যুদল প্রায় সব
কটিই নির্মূল নিষ্কৃয় হয়ে গেছে মনে এইরকম একটা ধারণা হলো। আসানসোল
ধানবাদ শিল্পাঞ্চলে ডাকাতি বা সেই জাতীয় গুরুতর অপরাধ বেশ উল্লেখযোগ্য
ভাবে উপশমিত হয়েছে। রাজ্য সিআইডি ও স্থানীয় পুলিস একটু স্বস্তির
অবকাশ পেয়েছে।
আমারও আসানসোলের কর্মভার হালকা হয়ে গেল। সেই জন্যে এর পর অর্থাত্
১৯৫২ সালে আমি সিআইডি সদর দপ্তরে ফিরে এলাম। চব্বিশ পরগণা জেলার
একটি সুবৃহত্ দস্যুদলের বিরুদ্ধে গ্যাং কেসের অনুসন্ধান পরিচালনার
দায়িত্ব পেয়ে মনে একটু স্বস্তি পেলাম, এখন কিছুদিন অন্তত পরিবার
পরিজনদের সঙ্গে থাকতে পারবো। সকলেই খুসী, আমিও খুসী। কিন্তু
বেশী দিন না। আসানসোল যেন আমার অপরাধ অনুসন্ধান জীবনে গভীরভাবে
জডি়য়ে আছে। আবার জরুরী তলব পেলাম। আসানসোল ও বর্ধমান পুলিশ
কর্তৃপক্ষ আমাকে এখনই চান। আসানসোল অঞ্চলে জি টি রোডের উপর এক
ব্যাঙ্কের ক্যাশ ভ্যানের উপর প্রকাশ্য দিবালোকে এক সশস্ত্র ডাকাতি
হয়েছে, ক্যাশ ভ্যানের প্রহরী নিহত এবং ভ্যানের চেস্ট থেকে ব্যাঙ্কের
সব টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। আততায়ীরা অজ্ঞাত, সবাই পলাতক। আমার উপর
আদেশ হলো দু ঘণ্টার মধ্যেই আসানসোল যেতে।
ঘটনাটি এই রকম। ১৫ই নভেম্বর ১৯৫২ সাল সকাল দশটার কিছু পর ইউনাইটেড
কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের আসানসোল শাখার ক্যাশ ভ্যান জি টি রোড দিয়ে
তীব্র গতিতে ছুটেছে। ভ্যানের মধ্যে দুটি আয়রণ চেস্ট তালাবন্ধ।
আয়রণ চেস্টে তখন আছে ছাব্বিশ হাজার টাকা। ভ্যানের পিছন দিকের
দরজা শক্ত তালাবন্ধ। ভ্যানেই আছেন ব্যাঙ্কের অন্যতম ক্যাশিয়ার
শৈলেন্দ্র গুহরায়, তাঁর পকেটে ভ্যানের দরজার ও আয়রণ চেস্টের
চাবি। তিনি ভ্যানের ড্রাইভার পবিত্র ঘোষের পাশের সীটেই আসীন।
ড্রাইভারের পিছন দিকে ব্যাঙ্কের প্রহরী রাম প্রকট দুবে, কার্তুজভরা
বন্দুক হাতে সতর্ক।
ভ্যানের মধ্যে যে দুটি আয়রণ চেস্ট ছিল, অণ্ডালের কাছে দুটি
কলিয়ারিতে শ্রমিকদের বেতন দেবার জন্য সে দুটি নামিয়ে দেবার কথা।
ভ্যানটি জি টি রোডে একটি অপরিসর ব্রিজ পার হবার জন্য গতি একটু
মন্থর করেছে , এমন সময় একটি প্রাইভেট মোটর কার পিছন দিক থেকে
ভ্যানের সামনে এসে হঠাত্ ব্রেক কষে দাঁডি়য়ে গেল। ব্রিজটি পার
হবার জন্য ব্যাঙ্কের ভ্যান আগেই একটু শ্লথগতি হয়েছিল, তার উপর
সামনে এসে অতর্কিতে গাডি় থামাতে ব্যাঙ্ক ভ্যানের ড্রাইভারের
গাডি় না থামিয়ে গত্যন্তর ছিল না।
নিমেষের মধ্যে প্রাইভেট গাডি় থেকে ছয়জন ঝডে়র মত বেগে লাফিয়ে
এল ব্যাঙ্কের গাডি়র সামনে। তাদের দৃঢ় কণ্ঠের আদেশ- খবরদার এক
পাও এগিয়ো না, যে যেমন ভাবে আছে, সেই ভাবেই বসে থাকো, কোন আওয়াজ
কোন শব্দ কোন প্রতিরোধ করলেই খতম। যে আদেশ দিল তার হাতে গুলিভরা
রিভলভার। ব্যাঙ্কের রক্ষী তার বন্দুক উঠিয়ে গুলি করতে উদ্যত
হতেই দুর্বৃত্তের রিভলভার গর্জে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই প্রহরী কোন
প্রতিরোধ দেবার আগেই তার প্রাণহীন দেহ গাডি়তেই লুটিয়ে পড়লো।
দস্যুদের অন্য যারা তারা তাদের স্টেনগান, পিস্তল এবং রিভলভার
থেকে গুলি বর্ষণ আরম্ভ করে দিল যাতে অন্য কোন পথচারী বা গাডি়
প্রতিরোধ করতে না আসে। একটা গুলি ব্যাঙ্ক ভ্যানের সামনের কাঁচ
চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল। কাঁচের টুকরোয় ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার রক্তাক্ত-
আহত হলেন, তাঁদের সৌভাগ্যক্রমে আততায়ীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায়
ক্যাশিয়ার আর ড্রাইভারের কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। তাদের দুজনকেই
আততায়ীরা ভ্যান থেকে টেনে বের করে নিয়ে এল। প্রায় হতচেতন ক্যাশিয়ারের
পকেট থেকে দুর্বৃত্তেরা চাবি কেডে় নিয়ে ভ্যানের দরজার তালা
খুলে নিল। উত্তেজনায় ও তাড়াতাডি়তে তারা আয়রণ চেস্টের চাবি
খুঁজে না পয়ে আয়রণ চেস্টের তালা ভেঙে ফেললো। আয়রণ চেস্টের সমস্ত
নোটের বাণ্ডিল ও টাকা, তার সঙ্গে প্রহরীর বন্দুকটি নিয়ে আততায়ীরা
তাদের অপেক্ষমান প্রাইভেট গাডি়তে উঠে তারা যে দিক থেকে এসেছিল
সেই দিক দিয়েই খুব দ্রুত বেগে গাডি় চালিয়ে পালিয়ে গেল। একজন
পথচারী লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের গাডি়র নম্বর ছিল WBC ১৩০৯।
আততায়ীদের গাডি় প্রায় এক ফার্লং অগ্রসর হতেই তাদের হঠাত্ থামতে
হলো। সামনে রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং, গেট বন্ধ। গুলির আওয়াজ পেয়ে
লেভেল ক্রসিংয়ের কর্তব্যরত গেটম্যান বুঝেছে বিপদের আভাস। সে
খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গেট বন্ধ করে দিয়েছে। আততায়ীরা নিরুপায়,
সন্ত্রস্ত, ধরা পড়ার ভয়ে তারা তাদের গাডি় ছেডে় পাশের ধানক্ষেতের
মেঠো রাস্তা দিয়ে ঊধর্বশ্বাসে ছুটতে আরম্ভ করেছে। ধানক্ষেত পেরিযে
কিছু দূর গিয়েই তারা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। নাহ্, কেউ
তাদের পিছু নেয়নি, তারা নিশ্চিন্ত, নিরাপদ।
স্থানীয় পুলিশ খবর পেয়ে দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থলে এসে তাদের তদন্ত
শুরু করে দিল। তারা জানে এরকম একটা কেসের সম্যক ভার নেবার সামর্থz
তাদের নেই, সিআইডির সাহায্য অবিলম্বে দরকার। আসানসোল থেকে সেখানের
এডিশনাল পুলিশ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট জরুরী টেলিফোন মেসেজ দিলেন
পশ্চিম বঙ্গ সিআইডির সাহায্য চেয়ে। তাদের আরও বিশেষ অনুরোধ,
আমাকেই যেন এই কেসের তদন্ত ভার দিয়ে পাঠানো হয়।
আমি আদেশ পেয়ে ঘটনাস্থলে যাবার জন্য তাড়াতাডি় তৈরি হলাম।
যাবার আগে আসানসোলে জরুরী বেতার বার্তা পাঠিয়ে নির্দেশ দিলাম-
ঘটনাস্থলে ও ডাকাতদের প্রস্থান পথে তারা যা কিছু ফেলে গেছে সেগুলি,
ডাকাতদের গাডি়, ব্যাঙ্কের ভ্যান সব কিছু যেখানে যে অবস্থায়
ছিল, সেইরকমেই যেন সুরক্ষিত থাকে, কেউ যেন হাত না দেয়।
ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে যাবার জন্য একটি টিম গঠন করে নিলাম- ক্যামেরাসহ
একজন ফোটোগ্রাফার, ফিংগার প্রিণ্ট এক্সপার্ট ও ফুটপ্রিণ্ট এক্সপার্ট
তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার সঙ্গে যাবে। একটি বিশেষ পুলিশ জীপে
আমরা ঘটনাস্থলে পোঁছে গেলাম, তখন সকাল হয়ে গেছে।
আমাদের পৌঁছানোর আগেই আততায়ীদের প্রস্থান পথের বরাবর তল্লাশী
শুরু করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ তাদের প্রারম্ভিক তদন্ত কার্যে।
সন্নিকটস্থ জঙ্গলে জঙ্গল, ধান ক্ষেত, মেঠো পথ পাঁতি পাঁতি করে
খোঁজার পর পাওয়া গেল ব্যাঙ্কের বন্দুকটি। সঙ্গে থাকলে ছুটবার
অসুবিধা হবে বা অন্যের সন্দেহ হবে- এই আশঙ্কাতেই তারা সেটা ফেলে
গেছে। এর মধ্যে নিহত ব্যাঙ্কের প্রহরীর পোস্ট মর্টেম হয়ে গেছে।
ডাক্তার অভিমত দিয়েছেন মৃত্যুর কারণ গুরুতর গুলির আঘাত। মৃতের
দেহে গুলিটি ডাক্তার বার করেছেন, গুলিটি আমাদের হাতে দিলেন।
আমরা ঘটনাস্থল পৌঁছেই আরও গভীরভাবে ডাকাতদের প্রস্থান পথ খুঁজে
চলেছি, যদি আরও কিছু পাওয়া যায়। রাস্তায়, জঙ্গলে, মেঠো পথে কোথাও
কোন গ্রহণযোগ্য ফুটপ্রিণ্ট পাওয়া গেল না। মেঠো পথটা অনেক দূর
চলে গেছে, পথটা পাথুরে রাঙামাটির। কিছু দূর গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে
একটা ঝোপের ভিতর খুঁজে পেলাম মোটর গাডি়র দুটো নম্বর প্লেট,
তাতে নম্বর আছে UPR ৭০৬৫। সন্দেহ নেই নম্বর প্লেট দুটো ডাকাতদের
গাডি়রই। কিন্তু আগের পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের গাডি়তে তো
অন্য নম্বর প্লেট লাগানো আছে, WBC ১৮০৯। UPR ৭০৬৫ অথবা WBC ১৮০৯
-এর মধ্যে একটি নিশ্চয় ভুয়ো, জাল। যাই হোক আসল নম্বর কোনটি নির্ণয়
করতে খুব অসুবিধা হবে না। কলকাতা হেডকোয়ার্টারে মেসেজ দিয়ে নির্দেশ
দিলাম মোটর ভেহিকল ডিপার্টমেণ্টে এখনই অনুসন্ধান করে জানতে WBC
১৮০৯ গাডি়র মালিক এবং UPR ৭০৬৫ গাডি়রই বা মালিক কে?
ডাকাতদের গাডি়টা পুলিশ পাহারায় সুরক্ষিত ছিল, ব্যাঙ্কের ভ্যানটিও
অনুরূপভাবে রক্ষিত ছিল যাতে কেউ তাতে হাত না দেয়। এই সতর্কতার
জন্যই একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ আবিষ্কৃত হলো। খুব গভীরভাবে
পরীক্ষা করার পর আমাদের ফিংগারপ্রিণ্ট একস্পার্ট আততায়ীদের গাডি়তে
কয়েকটি ফিংগারপ্রিণ্ট দেখতে পেলেন ও প্রিণ্টগুলি পাউডার দিয়ে
ডেভেলপ করার পর তার ফটোগ্রাফ নিলেন আমাদের ফটোগ্রাফার। আততায়ীদের
গাডি় তল্লাশ করে কিছু পরিধেয় বস্ত্র, একটি ব্যাগে টাকা ও খুচরো
পয়সা মিলিয়ে পাঁচশো টাকা ও একজোড়া জুতো পাওয়া গেল। সেগুলো সব
আমরা হেফাজতে নিলাম। গাডি়টির লাগেজ ক্যারিয়ারের হাতল ও একটি
চাকার হুইল ক্যাপ ছিল না। ব্যাঙ্কের ভ্যানে স্টেনগানের দুটি
ম্যাগাজিন ডাকাতরা ফেলে গিয়েছিল। সেগুলোও আমরা নিলাম।
মনের মধ্যে তখন একমাত্র চিন্তা আলোড়ন দিচ্ছে- আততায়ীরা কোথা
থেকে এলো, কোথায় থাকে, কোথায় বা তারা গেল, তারা কে হতে পারে।
এই ডাকাতির প্রক্রিয়াতে যেগুলি বিশেষত্ব সেগুলি বিশ্লেষণ করে
একটা আনুমানিক সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করলাম। সূত্র তখন পর্যন্ত
এই কটাই:-
১) দস্যুদলের অসমসাহসিকতা ও দুর্ধর্ষতা
২) স্টেনগানের মত আধুনিক অস্ত্রের সমাবেশ
৩) মটর গাডি়র সাহায্যে ব্যাঙ্কের গাডি়র গতিরোধ
৪) প্রকাশ্য দিবালোকে জি টি রোডের মত সদা ব্যস্ত ও ট্রাফিকবহুল
স্থানকে রাহাজানির জন্য নির্বাচন।
এই সব আনুষঙ্গিক থেকে একটি ইঙ্গিত- স্থির নির্দেশ আমার কাছে
স্পষ্ট হলো। আর কোথাও নয়, আততায়ীরা কলকাতা থেকেই এসেছিল, গেছেও
সেই দিকে। কিন্তু কলকাতার কোথায় তাদের পাবো?
আততায়ীদের গাডি়র নম্বর ঢভছ ১৮০৯@, সেটাও তো একই নির্দেশ দেয়,
গাড়ী এবং সেক্ষেত্রে সম্ভবত বাডি়ও কলকাতায়। কিন্তু আর একটা
নম্বর প্লেট পাওয়া গেছে, ুঋ ৭০৬৫@, তাদের প্রস্থান পথে। এর মধ্যে
কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা; ুঋ ৭০৬৫@-টাই বোধহয় আসল নম্বর, যেটা
তারা যাবার পথে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। সত্যিটাই লুকিয়ে
রেখে মিথ্যাটাই প্রকট করে রেখেছে আমাদের ধাঁধায় রাখবার জন্য।
এই সব পারিপাশ্র্বিক অবস্থা ও তার বিশেষত্ব সব বিচার-বিশ্লেষণ
করে আমি একরকম অবধারিত ঠিক করলাম, আততায়ীরা কিছুদূর হেঁটে গিয়ে
কোন সুবিধামত জায়গা থেকে ট্রেন ধরবে, এবং হাওড়া অথবা শিয়ালদা
তাদের গন্তব্যস্থল হওয়ার সম্ভাবনাই খুব বেশী।
অন্য পথচারী যারা দস্যুদের পালাতে দেখেছিল বিশেষ করে লেভেল ক্রসিংএর
গেটম্যান আততায়ীদের যা বর্ণনা দিল তাতে মনে হয় তারা পাঞ্জাবী
শিখ ও হিন্দুস্থানী ছিল। তাদের পোষাক ছিল ফুল প্যাণ্ট বা পাজামা
-শার্ট, কারও কারও মাথায় পাগড়ী।
আমি হাওড়া ও শিয়ালদার রেলওয়ে পুলিশ ও আসানসোল থেকে কলকাতা যাবার
মধ্যবর্তী সব পুলিশকে জরুরী নির্দেশ পাঠালাম, তারা যেন এই রকম
বর্ণনার লোককে সন্দেহজনক ভাবে দেখলে আটক করে। জি টি রোডের সব
চেক পোস্টেও অনুরূপ সতর্ক সিগন্যাল দিলাম।
ইতিমধ্যে নম্বর প্লেটগুলি সম্বন্ধে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অনুসন্ধান
করা হলো। উত্তর প্রদেশ পুলিশের কাছে টেলিফোন সংযোগে জানতে পারা
গেল ুঋ ৭০৬৫@ গাডি়র মালিকের নাম অম্বিকাপ্রসাদ সিং, ঠিকানা
রায়পুর জেলা, কানপুর। খোঁজ করে জানা গেল সেখানে সে নামে কেউ
নেই, অম্বিকাপ্রসাদের কোন হদিসও সেখানে পাওয়া গেল না।
তবে আরও অনুসন্ধান করে যা পাওয়া গেল সেটি বেশ মূল্যবান তথ্য।
গাডি়টির মালিক অম্বিকাপ্রসাদ সিং ঠিকই। সে গাডি়টা কিনেছিল
কিস্তি হারে দেয় দামে কলকাতার এক মোটর ব্যবসায়ীর দোকান থেকে।
মোটর ব্যবসায়ীর দোকানের কাগজপত্র পরীক্ষা করে অম্বিকাপ্রসাদের
যে ঠিকানা পেলাম সেটা কানপুরের নয়, সেটা ১৭, চাঁদমারী রোড, হাওড়া।
অনেক আশা, অনেক উত্সাহ নিয়ে হাওড়ায় চাঁদমারী রোডের ১৭ নম্বর
বাডি় খুঁজে বার করলাম। জানলাম অম্বিকাপ্রসাদ এই বাডি়তেই একটি
কুঠুরীতে থাকে। তবে প্রায় ৫।৭ দিন আগে থেকেই সে ঘর তালাবন্ধ
করে কোথায় গেছে কেউ জানে না। তার কোন গাডি়ও নেই, তবে মাঝে মাঝে
একটা ছোট গাডি়তে তাকে দেখা যায় তার সঙ্গী সাথী নিয়ে। তার গাডি়র
নম্বর কেউ বলতে পারল না।
যাই হোক তালা ভেঙে ঘরটি সার্চ করলাম। সেখানে তেমন কিছুই পেলাম
না। কিন্তু দামী একটি জিনিষ পেলাম, UPR ৭০৬৫ গাডি়র Âবু বুক।
এর থেকেই জানা গেল UPR ৭০৬৫ গাডি়র মালিক অম্বিকাপ্রসাদ সিং
এবং তার বাসস্থান এটাই- ১৭ চাঁদমারী রোড, হাওড়া। Âবু বুকে বর্ণিত
গাডি় আর যে গাডি় আততায়ীরা জি টি রোডে ফেলে পালিয়েছে একই গাডি়
UPR ৭০৬৫।
আরও এক মূল্যবান তথ্য পেয়ে গেলাম এক বিশ্বস্ত গোপন সূত্র থেকে।
অম্বিকাপ্রসাদ একটি আফিং চোরাচালানকারEী দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে
যুক্ত। আফিং চোরাচালানের অভিযোগে একটি মামলা তার বিরুদ্ধে হাওড়া
কোর্টে ঝুলছে।
একটু যেন আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি। তাড়াতাডি় গেলাম হাওড়া
পুলিশ কোর্টে। কোর্টে খোঁজ করে নথিপত্র দেখে আরও আলো, আরও আশা
আমাকে উত্সাহিত করলো। দেখলাম সত্যিই অম্বিকাপ্রসাদ আফিংএর মামলায়
চালান হয়েছে, এখন জামিনে মুক্ত। তার স্থানীয় জামিনদার জনৈক চঞ্চলকুমার
ঘোষ। চঞ্চলকুমার হাওড়া কোর্টে নিয়মিত জামিনদার, এটাই তার পেশা।
চঞ্চলকুমারকে খুঁজে বার করতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। তাকে একটি
হোটেলে নিরালায় নিয়ে এলাম। নানা প্রশ্নের মধ্যে অম্বিকাপ্রসাদের
কথা প্রসঙ্গে আনতে সে একটু যেন সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। তবে অম্বিকাপ্রসাদ
যে ুঋ ৭০৬৫@ গাডি়র মালিক সেটা চঞ্চলকুমার স্বীকার করলো কোন
দ্বিধা না করেই। সে ভালো করেই জানে, এই গাডি়টাই আফিংএর কেসে
আবগারী বিভাগ থেকে হেফাজতে নিয়েছিল, পরে অম্বিকাপ্রসাদের আবেদনে
গাডি়টা কোর্ট থেকে মুচলেকায় খালাস হয়। সেই মুচলেকাতেও জামিনদার
ছিলেন চঞ্চলকুমার।
ুঋ ৭০৬৫ গাডি়র প্রকৃত মালিকানা এই ভাবে স্থিরীকৃত হয়ে গেল।
শুধু গাডি়টার মালিকানা নয়, চঞ্চলকুমারের কাছে আরও কিছু মূল্যবান
তথ্য পেলাম।
জি টি রোডের এই ক্যাশ ভ্যানের উপর হামলা হওয়ার দুদিন আগে চঞ্চলকুমার
অম্বিকাপ্রসাদকে দেখেছে হাওড়ার এক কুখ্যাত পল্লীতে তার তিন
চারজন সাকরেদের সঙ্গে। তারা হলো সতীশ কর, নির্মল মুখার্জি ও
কালান। সতীশ করের আরও একটা নাম আছে- রমেন মজুমদার- এর আগে একটি
রাহাজানি কেসে একবার সাজা হয়েছে। নির্মল মুখার্জির আর একটা নাম
আছে, ঊষা। তেমনি কালানের আর একটা নাম পবিত্র ভট্টাচার্য। এদের
ঠিকানা চঞ্চলকুমার বলতে পারলো না। অম্বিকাপ্রসাদের সাকরেদদের
মধ্যে পাঞ্জাবী বা অবাঙ্গালী কাউকে দেখেছে বা জানে কিনা- চঞ্চলকুমারের
কাছ থেকে এ সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলাম না।
চঞ্চলকুমারের সঙ্গে কথা বার্তা বলে এবং অন্য সব সূত্র থেকে
সব খবর নিয়ে আমার মোটামুটি ধারণা হলো অম্বিকাপ্রসাদের বাঙালী
বা অবাঙালী- যে কোন দলেই যোগ দেবার একটা সুবিধা আছে, সুবিধাটা
তার নিজের গাডি় থাকার জন্য। ডাকাতি হোক বা রাহাজানি হোক, কিংবা
চোরাচালান- সবেতেই তার একটা বিশেষ লাভজনক ভূমিকা আছে তার গাডি়র
দৌলতে। তার গাডি় সে নিজে চালায়, অন্য কাউকে ধার দিতে চায় না
বিপদের আশঙ্কায়।
এদিকে আমার সহকারী মোটর ভেহিক্ল্ ডিপার্টমেণ্ট থেকে WBC ১৮০৯
গাডি়র মালিক ও ঠিকানা সংগ্রহ করে ফেলেছেন। ১৮০৯@ গাডি়র মালিক
একটি ব্রিটিশ কোম্পানীর ম্যানেজার। গাডি়টা তাঁর কাছেই আছে,
বাইরে কোথাও যায়নি। আমিও গাডি়র কাগজপত্র দেখে নিঃসন্দেহ হলাম।
যদিও আততায়ীদের গাডি়টি পুরানো হিন্দুস্থান- ১৪ এবং ঘটনার পর
থেকেই ঘটনাস্থলে আমাদের হেফাজতে আছে এবং তার প্রকৃত নম্বর যে
ুঋ ৭০৬৫@ ছাড়া আর কিছুই নয়- তাহলেও আমাদের অনুসন্ধানে কোন ফাঁক
রাখা উচিত নয়- আমিও যুক্তিযুক্ত মনে করিনি। অনুসন্ধানে কোন ছিদ্র
থাকলেই আসামী তার সুযোগ নিতে পারে- তার দোষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত
হয় না, এই অজুহাতে। তাই আমার দরকার অচ্ছেদ্য প্রমাণ, সন্দেহাতীত
প্রমাণ।
১৪ই নভেম্বর এই ব্যাঙ্ক ভ্যানের উপর হামলা হয়। ১৫ই ও ১৬ই নভেম্বর-
এই দুই দিনেই আমরা বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। অবশ্য
এখনও আততায়ী দস্যুদের কেউ ধরা পডে় নি। তবে হানাদারদের গাডি়র
মালিক অম্বিকাপ্রসাদ ও তার কিছু সাকরেদদের নাম পাওয়া গেছে। অম্বিকাপ্রসাদের
পাত্তা এখনও পাওয়া যায়নি। গোপনসূত্রে খবর পেলাম সে উত্তর প্রদেশে
গোরখপুর জেলায় তার গ্রামে পালিয়ে গেছে। তার আসল ঠিকানা অম্বিকাপ্রসাদের
হাওড়া কোর্টে যে আফিং চোরাচালানের মামলা চলছিল তারই নথিপত্র
ও কেস-ডাইরি পেলাম। আমার এক সহকারী ইন্স্পেক্টর, উত্তর প্রদেশেরই
লোক, তাকে পাঠালাম গোরখপুরে অম্বিকাপ্রসাদের তল্লাসে।
আমার গভীর সন্দেহ আততায়ীরা কলকাতার দিকেই গেছে- ট্রেনে অথবা
ট্রাক বা বাসে। আগে থেকেই হাওড়া ও শিয়ালদা স্টেশনের পুলিশকে
সতর্ক করে দেওয়া আছে। আততায়ীরা যে মেঠো পথ দিয়ে পালিয়েছিল তার
ধুলোমাটি ছিল একটু বিশেষ লালচে ধরনের- রাঙা মাটির পথে যে রকম
হয়। আমার সতর্কতা মেসেজে দস্যুদের বিশেষ বর্ণনা দেওয়া ছিল- তারা
পাঞ্জাবী শিখ এবং হিন্দুস্থানী, তাদের পাজামা বা প্যাণ্টের নীচের
দিকে এই রকম লালচে ধুলোমাটির লেশ লেগে থকলেও থাকতে পারে_ এটা
বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম।
১৭ই নভেম্বর এক অভিনব ব্যাপার ঘটে গেল। হাওড়া ও শিয়ালদা স্টেশনে
আমাদের জাল পাতা- সাদা পোষাকে পুলিশের সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
ভোরে দেরাদুন এক্স্প্রেস ধীরে ধীরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলো। একটি
লোক, বেশ দীর্ঘদেহী শিখ, একটা ইণ্টার ক্লাস কামরা থেকে নামলো।
তার সঙ্গে বিছানাপত্র, সুটকেস, বাক্স- কিছুই নেই। শুধু একটা
কাপডে়র থলি নিয়ে ত্রস্তগতিতে প্ল্যাটফর্মের শেষে গেটের দিকে
এগোচ্ছে। সাদা পোষাকে পুলিশ সতর্ক দৃষ্টিতে মোতায়েন। লোকটিকে
দেখে তার গতিভঙ্গীকে কেমন যেন একটু সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। তারা
তার থলিটি পরীক্ষা করতে চাইলো। শিখটিও একটু শঙ্কিত- পাশ কাটিয়ে
পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। তখন সন্দেহ আরোও ঘনীভূত হলো। তাকে
তখনই গ্রেপ্তার করে হাওড়া জি আর পি থানায় নিয়ে আসা হলো।
তার থলি পরীক্ষা করে যা পাওয়া গেল সে আরো আশাতীত অর্থবহ। তাতে
অন্যান্য জিনিষের মধ্যে ছিল কিছু জামা কাপড়, একহাজার নশো ছাপ্পান্ন
টাকা, যার বেশীরভাগই নোট, আর একটি .৩৮ ওয়েবলি স্কট রিভলভার,
১৭টি কার্তুজ ও একটি পুরানো প্যাণ্ট। তস্খন পর্যন্ত পুলিশের
সন্দেহ হয়নি সে এক ব্যাঙ্ক ভ্যান হামলার পলাতক আসামী। তাই বিনা
লাইসেন্সে রিভলভার রাখার জন্য আর্মস্ অ্যাক্টের একটা কেস তখনকার
মতো তার নামে লেখা হলো। লোকটির নাম ডাইরিতে লেখা হলো কত্র্তার
সিং- তার উক্তি মাফিক।
(চলবে)
নবেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়: পুলিশী জীবন সুরু হয় সাব-ইনস্পেক্টর হিসাবে
এবং কর্মদক্ষতায় সুপারিন্টেনদেন্ট পদ পর্যন্ত উন্নীত হ'ন। ১৯৫৩
সালে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসাবে রাষ্ট্রপতি পদক পান । ১৯৫৪
সালে বদলী হন ভারত সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্যুরো- তে। ইংলণ্ড ও
পশ্চিম জার্মানী (তদানীন্তন) থেকে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে প্রথম
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শিক্ষণ বিদ্যালয়ের অন্যতম স্থাপক ছিলেন।