প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কেমন ছিল সে যুগের পুলিশ? (১২)

[এই বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসমাপ্ত| হরফ ফণ্ট-এ বাংলায় এটি দেখতে পারবেন ইণ্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করলে| তারজন্য এইখানে ক্লিক করুন|]

(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯) (১০) (১১) (১২)

ইউনাইটেড কমারশিয়াল ব্যাঙ্ক ডাকাতি- ২

আমি অচিরেই এই খবরটা পেলাম। কিছু আশা নিরাশা নিয়ে আমার সহকারীদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম হাওড়া রেলওয়ে পুলিশ থানায়। কর্তার সিংকে প্রশ্ন করার আগে মনে হলো দেখি না তার সঙ্গের জিনিষগুলি, হয়তো মিলতে পারে অমূল্য রতন। জিনিষগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটা আমাকে আকৃষ্ট করলো সেটা কর্তার সিংএর পুরানো ট্রাউজার। দেখি নীচের দিকে লালচে রঙের মাটির দাগ, যে মাটি আমি দেখেছি আততায়ীদের পলায়ন পথে, সেই রাঙা মাটির পথে। এর থেকে কর্তার সিংএর দেরাদুন থেকে ট্রেনে আসার কাহিনী একটু অবিশ্বাস্য মনে হলো, সে দেরাদুন থেকে আসছে এই কাহিনী ধোপে টেকে না। তার থেকেও আরো গভীর সন্দেহ হলো যখন তার নোটগুলি দেখতে লাগলাম। দেখি কতগুলি নোটে ইংরেজিতে যেন নাম সইএর মতো। কার সই বোঝা যায় না। আমার মনে সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে, সইটা ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারের বা স্থানীয় আর কারো নয়তো!
আমার নির্দেশমতো কর্তার সিংকে এই ব্যাঙ্ক ভ্যান ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। তাকে অতি নিভৃতে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলাম প্রাথমিক পর্যায়ে। কোন ফল হলো না, সে নিশ্চল, নীরব, অনড়- কঠিন পাথরের মতো। তার দেরাদুন কাহিনী থেকে সে একচুলও নড়তে চায় না। আমি জানতাম এত শিগ্গির কোন ফল আশা করা বৃথা।
এবার আবার সেই অন্য পন্থা। দেখা যাক তার বিরুদ্ধে প্রমাণের চাপে তার মানসিক ভারসাম্যের উপর কী পরিমাণ প্রতিক্রিয়া হয়। কর্তার সিং জানে আর্মস্ এ্যাক্ট মামলায় তার যা সাজা হবে তা তেমন খুব বেশী নয়। কিন্তু ব্যাঙ্ক ভ্যানে ডাকাতিতে শুধু রাহাজানি নয়, তাদের গুলিতে একজন নিহত হয়েছে, তাতে তার প্রাণদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। তাই সে মুখ খুলতে চায় না। জানে তার বিরুদ্ধে তখনও কোন প্রমাণ নেই, আর সে যদি এরকম মুখ বন্ধ করে থাকে পুলিশ হাল ছেড়ে দেবে, ডাকাতি ও খুনের জন্য তার কিছু করতে পারবে না।
তাই স্থির করলাম কর্তার সিংএর বিরুদ্ধে আরও প্রমাণ আমার চাই যে প্রমাণের ভারে সে অভিভূত, আচ্ছন্ন হয়ে যাবে, যে প্রমাণ তার দিকেই আঙ্গুল উঁচিয়ে বলবে- তুমিই হত্যাকারী, তুমিই সেই পলাতক অপরাধী।
এই উদ্দেশ্যে কর্তার সিংকে সেই দিনই, অর্থাৎ ১৭ই নভেম্বর ১৯৫২, নিয়ে এলাম আসানসোল। ব্যাঙ্ক ভ্যান ডাকাতির ঘটনা হয়েছিল আসানসোলের ম্যাজিস্ট্রেটের এলাকায়, সেজন্য আসানসোল কোর্টেই তাকে হাজির করতে হবে। কোর্টে হাজির হবার আগে সেই দিনই সন্ধ্যায় তাকে আসানসোল জেলে পাঠিয়ে দিলাম। তার পরের দিনই তার জন্য সনাক্তীকরণ প্যারেড হলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। এই সনাক্তীকরণ প্যারেডে অন্যান্য মামলার বিচারাধীন, কর্তার সিংএর সম্প্রদায়েরই, কয়েকজন কয়েদীদের সঙ্গে কর্তার সিংকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। প্যারেডে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ব্যাঙ্কের ভ্যানের ড্রাইভার, যে ঐ ডাকাতিতে আক্রান্ত হয়েছিল, অন্য সব কয়েদীদের মধ্যে একমাত্র কর্তার সিংকে দেখেই চিনতে পারলো- ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কর্তার সিংকে দেখিয়ে বলে উঠলো দ্বিধাহীন স্বরে- "এই সেই আততায়ী, যে ব্যাঙ্কের প্রহরীকে রিভলভার দিয়ে খুন করেছে।" আরও দুজন সাক্ষী, যারা আততায়ীদের ছুটে পালাতে দেখেছিল, তারাও কর্তার সিংকে অনুরূপভাবে সনাক্ত করলো। ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরের সনাক্তীকরণ প্যারেডে কর্তার সিংকে চিনতে তাঁরও ভুল হলো না- কর্তার সিংকে দেখেই বলে উঠলেন- "এই ব্যাঙ্কের প্রহরীর হত্যাকারী।"
ক্যাশিয়ারকে আমরা কর্তার সিংএর থলেতে পাওয়া নোটগুলি দেখালাম- নোটগুলিতে পেনসিলে যে সইগুলো ছিল সেগুলো তাঁরই বলে সনাক্ত করলেন।
কর্তার সিংএর ট্রাউজারের সেই লালচে মাটির দাগ, যা এতদিন অনুচ্চারিত গুঞ্জন মাত্র ছিল, সেই মূক যেন ভাষা পেয়ে মুখরিত হয়ে উঠলো। যা ছিল আমার মাত্র অনুমান, থিয়োরী, তা পূর্ণ সত্য প্রমাণিত হলো মাত্র তিনদিনের মধ্যেই। এই নৃশংস ঘটনার মূল নায়ক হত্যাকারী ধরা পড়লো ঘটনার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই- অনস্বীকার্য, ভাগ্য আমাদের অনুকূলে থাকার জন্যই।
এ সেই প্রবাদ বাক্য- ইন্স্পেক্টর ভাগ্য কেসের কিনারা করেছেন। কিন্তু ভাগ্যই কি সব কৃতিত্বের অধিকারী? সেই বেলবাদ ডাকাতির মূল নায়ক শের সিংকে ধরার সময় ভাগ্যই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়চ্ছিল- তা নায় তো চিৎপুরে দস্যুদের প্রধান আস্তানায় সার্চ করে আমার তো নৈহাটি যাবার কথা ছিল না। সেখানে তো আমার উপযুক্ত সহকারী পাঠিয়ে ছিলাম। নৈহাটি যেতে যেতে অত্যধিক শ্রম ও রাত্রি জাগরণে ঘুমে আমার চোখ জুড়ে আসছিল। ঠিক যেখানে শের সিং আর বান্তা সিং বসেছিল হঠাৎ গর্তে আমার গড়ী ধাক্কা খেল ফলে আমার ঘুম ভেঙে গেল- আর আমি আমার ভাগ্যকে খুঁজে পেলাম। শের সিং আর বান্তা সিং এসে গেল একেবারে হাতের মুঠোয়! এ সবই কি ভাগ্য- না একনিষ্ঠতা তথা উদ্যম- না দুইই?
যাক কর্তার সিংএর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কর্তার সিং তখনও অনড়। ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, ব্যাঙ্ক ভ্যানের ড্রাইভার, আরও অন্য সাক্ষী তাকে চিনে ফেলেছে। মনে হলো ভিতরে ভিতরে কিছু একটা চিন্তা তার মনে আলোড়ন দিচ্ছে। জেলে আমার বন্ধুরা গোপনে এই রিপোর্ট দিল। তবুও সে প্রতিক্রিয়ার কোন বহিঃপ্রকাশ দেখছি না তার মুখে বা আচরণে। দেখি আরও কী প্রমাণ পাই তাকে দমিয়ে দিতে।
প্রমাণ আরও পেলাম, এ প্রমাণ বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রমাণ। আমাদের ফিংগারপ্রিণ্ট শাখার এক্স্পার্ট রিপোর্ট দিলেন, তাঁরা আততায়ীদের গাড়িতে যে ফিংগারপ্রিণ্ট পেয়েছিলেন সেটার সঙ্গে কর্তার সিংএর ফিংগারপ্রিণ্ট এক বলে অভিমত দিলেন। কর্তার সিং গ্রেপ্তার হবার পরই তার ফিংগারপ্রিণ্ট আমরা নিয়েছিলাম ও ফিংগারপ্রিণ্ট ব্যুরোতে পাঠিয়েছিলাম, আততায়ীদের গাড়িতে পাওয়া ফিংগারপ্রিণ্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য।
আরও এক মারাত্মক প্রমাণ এলো। যে রিভলভারের গুলিতে ব্যাঙ্কের রক্ষী রামপ্রকট দুবে নিহত হয়েছে- সেটা কর্তার সিংএর রিভলভার থেকেই নিক্ষিপ্ত। আর্ম্স এক্স্পার্ট পরীক্ষা করে দেখে অভিমত দিয়েছেন নিহত রক্ষীর মৃতদেহ থেকে যে বুলেট পোস্টমর্টেমের সময় পাওয়া গিয়েছিলো সেটা কর্তার সিংএর কাছ থেকে পাওয়া রিভলভার থেকেই নির্গত। কর্তার সিংই যে হত্যাকারী সেটা চাক্ষুষ সাক্ষীর বিবৃতি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক প্রমাণে নিশ্চিত রূপে প্রমাণিত হলো। কিন্তু এ সব প্রমাণই তো মাত্র একজনের বিরুদ্ধে। নায়ক কর্তার সিংএর বিরুদ্ধে এই প্রমাণই যথেষ্ট, তার অব্যাহতির কোন আশা নেই। কিন্তু আইন ও সুবিচারের দাবী যে আরও বেশী। কর্তার সিং একলাই তো অপরাধী নয় এই নৃশংস হত্যা ও রাহাজানির জন্য? কোথায় তার দলের আর সব? আর কে কে ছিল তার সাহায্যকারী দস্যু? কে তাদের নাম বলে দেবে, কোথায় তাদের পাবো- এসবই তো কর্তার সিংএর জানা। বৈজ্ঞানিক সাহায্য আমাকে কর্তার সিংএর বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ জোগাড় করে দিয়েছে, কিন্তু তার বেশী দূর তো নিয়ে যেতে পারছে না। তাই আমার চাই কর্তার সিংএর বিবৃতি- তার জিজ্ঞাসাবাদই আরও জোরদার করার জন্য স্থির করলাম।
এবার এক নতুন পদ্ধতিতে তার জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলাম। বিপুল প্রমাণের নাগপাশ কর্তার সিংকে চারপাশ থেকে বেঁধে ফেলেছে। প্রমাণের পর্বতভারে সে এবার জর্জরিত, কোণ ঠাসা। তার বিরুদ্ধে এই সব কঠিন প্রমাণসম্বলিত প্রশ্নবাণ একের পর এক প্রয়োগ করতে লাগলাম। অবিরাম গতিতে তার জিজ্ঞাসাবাদ চলেছে রিলে প্রণালীতে, একের পর এক অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করে চলেছে বিরামহীন, অবিশ্রান্ত।
অবশেষে ঘনিয়ে এল চরম মুহূর্ত, পরম ক্ষণ। অবসন্ন বিদ্ধস্ত কর্তার সিং আর তার মিথ্যাশ্রয়ের কবচ রক্ষা করতে পারছে না। আমার ছকে বাঁধা সময়সীমাতেই তার আত্মসমর্থনের সব চেষ্টা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। সে আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না।
সব স্বীকার করে সে এক দীর্ঘ বিবৃতি দিল। তার বিবৃতি তারই অনুরোধে আসানসোলের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিপিবদ্ধ হলো। তার স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পেল এই ডাকাতিতে তারা যে গাড়ি ব্যবহার করেছিল তার মালিক ও চালক ছিল অম্বিকাপ্রসাদ সিং। এই ডাকাতিতে কর্তার সিং ও অম্বিকাপ্রসাদ ছাড়া আর যারা ছিল তারা গুলজারা সিং, সতীশ কর- যার আর একটা নাম রমেন মজুমদার, নির্মল মুখার্জি- যার অন্য নাম ঊষা, কালাম- যার আর একটা নাম পবিত্র ভট্টাচার্য। ডাকাতির পর তারা দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকে জি টি রোডের জঙ্গলের পথ দিয়ে। কিছু দূর গিয়ে তারা দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। অম্বিকা আর নির্মল মুখার্জি এক দিকে যায়, কর্তার সিং, গুলজারা সিং, সতীশ ও কালাম একটি শুকনো নদী পার হয়ে আসানসোল এলাকার সীমানাস্থিত বাঁকুড়া জেলার সীমার দিকে চলে যায়। তার আগে তারা ডাকাতির সময় যে সব কাপড় জামা পরেছিল সেগুলো যতটা পারে বদলে নেয়, ধূলোয় ময়লা হয়েছিল বলে একটু ভদ্রবেশ ধরে। একসঙ্গে বেশী লোকের দল হলে পাছে সাধারণ লোকের সন্দেহ হয় বা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে জন্য কর্তার সিং ও গুলজারা সিং, সতীশ ও কালান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঠিক হয় যে যেমন করে পারে যে দিকে খুসি চলে যাক। ডাকাতির পর অপহৃত ২৬০০০ টাকার সবটাই সতীশ করের কাছে প্রথমে থাকে। তার থেকে ১০ ০০০ টাকা রেখে দেয় আলাদা করে গাড়ির মালিক অম্বিকাপ্রসাদের জন্য। আরও চার হাজার টাকা সতীশ আলাদা করে রাখে নিজের, নির্মলের আর কালামের খরচের জন্য। কর্তার সিং আর গুলজারা সিং তাদের অংশ হিসাবে আপাতত পায় দুহাজার টাকা করে। সবাই মেনে নেয় কলকাতায় গিয়ে চূড়ান্ত বাঁটোয়ারা হবে।
ইতিমধ্যে সতীশ কর, নির্মল মুখার্জি, কালান, গুলজারা সিংএর গ্রেপ্তারের জন্য কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায় সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের কলকাতার আস্তানা খুঁজে পাবার জন্য লোক লাগিয়েছি। কর্তার সিংএর কাছ থেকেই জানতে পারলাম তার বাঙালী সাকরেদরা- সতীশ-কালান এরা বেলঘোরিয়াতে থাকে। গুলজারা সিং বড়বাজার অঞ্চলে শিখ গুরুদ্বারের কাছে কোথাও থাকে। অম্বিকাপ্রসাদের আড্ডা, হাওড়ায় চাঁদমারী রোডে, আগেই দেখে নিয়েছি। অম্বিকাপ্রসাদের জন্য উত্তর প্রদেশের পুলিশকে আগেই মেসেজ দেওয়া হয়েছে।
২৩শে নভেম্বর সতীশ ও নির্মলকে পাওয়া গেলো বেলঘরিয়ায় তাদের আস্তানায়। সেই দিনই কলকাতা বড়বাজারের ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের (এখন স্টেট ব্যাঙ্ক) সামনে দিয়ে গুলজারা সিং যাচ্ছিল, সেও আমাদের হাতে ধরা পড়ে গেল। গুলজারা সিংএর কাছে পাওয়া গেল আটশো চুয়ান্ন টাকা। এর মধ্যেই সে বাকী টাকার সদ্ব্য্বহার করছে মদ ও মেয়ে মানুষে। সতীশ ও নির্মলের আস্তানায় পাওয়া গেল প্রচুর সম্প্রতি কেনা জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিষ যার দাম প্রায় দুহাজার টাকার মত। কালানকে পাওয়া গেল না।
সতীশ, নির্মল ও গুলজারা সিং তিনজনেই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তাদের নাম কর্তার সিং ফাঁস করে দিয়েছে। আমরাই তাদের বুঝিয়ে দিলাম তাদের পরিত্রাণের পথ নেই। অপরাধের সামগ্রিক প্রমাণ সবই তাদের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। তাদের মানসিক স্থৈর্যের কাঁটা একেবারে নিম্নমুখী।
এর মধ্যে এদের আসনসোলে নিয়ে এসে এদের জন্য আলাদা করে সনাক্তীকরণ প্যারেড করানো হলো। সব সাক্ষী- ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, ড্রাইভার, লেভেল ক্রসিংএর গেটম্যান, পথচারী যারা ওদের পালাতে দেখেছিল- সবাই দ্বিধাহীন ভাবে ওদের সনাক্ত করলো, এরাই সেই হানাদার দস্যুদল, এই বলে।
সতীশ কর, নির্মল মুখার্জি, গুলজারা সিং- তিন জনকেই আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। তাদের চোখের সামনে নির্মমভাবে ভাসছে প্রমাণের কালো ছায়া- কর্তার সিংএর স্বীকারোক্তি, ঘটনার সব সাক্ষীর চাক্ষুষ প্রমাণ, তাদের কাছে পাওয়া টাকা ও দ্রব্যসামগ্রী, যার কোন সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ তারা দিতে পারেনি। এর পর তারা আর চেপে রাখতে পারলো না অপরাধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। স্বীকারোক্তি দেওয়া ছাড়া আর উপায় রইল না। এর মধ্যে সকলের আগে নতশির হলো দুর্ধর্ষ পাঞ্জাবী সর্দার গুলজারা সিং। অল্প আয়াসেই সে স্বেচ্ছায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ তার অপরাধের স্বীকারোক্তি করলো।
সতীশ ও নির্মলও- তাদের প্রশ্ন করা মাত্রই বিনা দ্বিধায় আমাকে প্রায় স্তম্ভিত করে সব কিছু স্বীকার করে বিবৃতি দিল। তারা দুজনেই কিন্তু ঝানু ওস্তাদ, এর মধ্যেই অনেক পোড় খেয়েছে, অনেকবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে, ছাড়াও পেয়েছে প্রমাণের অভাবে। আইন কানুনেও সতীশ বেশ পোক্ত- সে জানে পুলিশের কাছে হাজার স্বীকারোক্তি করলেও আইনের বিচারে পুলিশ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। সে স্বীকারোক্তি পুলিশের খাতাতেই থাকবে, কিন্তু আইনে তার মূল্য কানাকড়ি। তাই সে গড়গড় করে আমার কাছে সব কিছুই স্বীকার করলো। জানে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি, তার তো আশু ক্ষতি কিছুই হচ্ছে না, বরং লাভই হচ্ছে, একটু খাতির পাচ্ছে।
তাই যখন সতীশ ও নির্মলের বিবৃতি লেখার পর প্রস্তাব করলাম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাদের স্বীকারোক্তি লিপিব্দ্ধ করার জন্য, সতীশ মৃদু হেসে প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিল। এটা তার কাছে একটা হাস্যকর প্রস্তাব। যে সব কথা বার্তা তার আর আমার মধ্যে হয়েছে সে সব কথা কি বাইরের কারুর কাছে প্রকাশ করা চলে! এ যেন গোপন দাম্পত্য প্রেমালাপ যা অন্যের কাছে অপ্রকাশ্য। আমি গালে যেন প্রচণ্ড চড় খেলাম। এরকম উত্তর কখনও কারো কাছে পাইনি- আশাও করিনি।
যাই হোক, আমার আর সতীশ কর বা অন্য কারও স্বীকারোক্তির প্রয়োজন ছিল না। তাদের সকলের বিরুদ্ধে যা প্রমাণ পাওয়া গেছে তা তাদের শাস্তির জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত।
এর পর সামান্য বাকি পদ্ধতিগত অনুসন্ধান শেষ করলাম। যেমন, সতীশ যে দোকান থেকে নতুন কাপড় চোপড় ইত্যাদি তার ডাকাতিতে লব্ধ অংশ দিয়ে কিনেছিল সেই দোকানদারকে খুঁজে বার করা হলো। তারা সতীশকে সনাক্ত করলো, সতীশ যে সম্প্রতি তাদের দোকান থেকে কাপড় ইত্যাদি কিনেছে তা কবুল করলো। এই রকম আরও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ সংগৃহীত হলো।
তখনও কিন্তু অম্বিকাপ্রসাদের হদিস পাওয়া যায় নি। অপহৃত টাকার সিংহভাগই সতীশ অম্বিকাপ্রসাদকে কলকাতায় এসে দিয়েছে, সতীশের বিবরণে অন্তত তাই জেনেছি। সে টাকার এখনও পাত্তা পাওয়া যায়নি। অম্বিকা ও কালানের জন্য সর্বত্র অনুসন্ধান চলতে লাগলো। প্রায় সব মূল আসামী অবশ্য ইতিমধ্যেই ধরা পড়ে গেছে। আর বিলম্ব নিরর্থক, তাই তখনকার মত কর্তার সিং, গুলজারা সিং, নির্মল মুখার্জি ও সতীশ করের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৯৬ ধারায় বিচারের জন্য চার্জশীট দিলাম। ২৫শে জুলাই ১৯৫৩ সালে বিচারে কর্তার সিংএর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও বাকি সকলের ১০ বৎসর করে সশ্রম কারাদণ্ড হলো।
এর আগে আমাকে আসানসোল অঞ্চলের এইসব ডাকাতি কেসগুলিতে অনুসন্ধানে সাফল্যের জন্য রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (President's Police Medal For Meritorious Service) প্রাপ্তির ঘোষণা করা হয়েছে।
এই ব্যাঙ্ক ভ্যান ডাকাতির সফল অনুসন্ধানের কিছু পরই আমি প্রমোশন পেয়ে দিল্লীতে সেণ্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে বদলী হয়ে গেলাম।
সেখান থেকে আবার উন্নততর অনুসন্ধান বিজ্ঞান শিক্ষণের জন্য আমাকে লণ্ডনে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ডিটেক্টিভ ট্রেনিং স্কুলে যোগ দেবার জন্য যেতে হলো। সেটা ১৯৫৫ সাল- লণ্ডনে থাকতেই আমি খবর পেলাম অম্বিকাপ্রসাদ উত্তর প্রদেশে তার গ্রামে ধরা পড়েছে ও তার বিচারের দিন স্থির হয়েছে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে আমার কাজ শেষ হবার পর আমি আবার আসনসোল এলাম অম্বিকাপ্রসাদের বিচারে সাক্ষী দিতে। বিচারে অম্বিকাপ্রসাদের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হলো। এই সঙ্গে আমারও সক্রিয় গোয়েন্দা জীবনে ছেদ।
এর পর থেকে আমাকে আবার নতুন উদ্যমে লাগতে হলো এক নতুন প্রস্তুতিতে- অন্য শিক্ষার্থীদের, যারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসবে অপরাধ- অনুসন্ধান বিষয়ে ট্রেনিং নিতে, তাদের শিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ডিটেক্টিভ ট্রেনিং স্কুল সংস্থাপনের জন্য নিয়োজিত হতে হলো। এ আবার এক নতুন জীবন, নতুন অভিজ্ঞতা- শিক্ষকতা। নূতনত্ব থাকলেও পুরাতনের সঙ্গে সঙ্গতিও কিছুটা থাকলো। কলেজী শিক্ষা শেষে জীবিকার জন্য আমার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়েছিল আমার নিজের স্কুলেই সাময়িক অস্থায়ী শিক্ষকরূপে। পুলিশ জীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীরূপে সর্দা ট্রেনিং স্কুলে- আবার সেই পুলিশ বিভাগেই আমাকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে নতুন শিক্ষার্থীদের পুলিশ গোয়েন্দাগিরিতে শিক্ষা দিতে।

(চলবে)


নবেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়: পুলিশী জীবন সুরু হয় সাব-ইনস্পেক্টর হিসাবে এবং কর্মদক্ষতায় সুপারিন্টেনদেন্ট পদ পর্যন্ত উন্নীত হ'ন। ১৯৫৩ সালে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসাবে রাষ্ট্রপতি পদক পান । ১৯৫৪ সালে বদলী হন ভারত সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্যুরো- তে। ইংলণ্ড ও পশ্চিম জার্মানী (তদানীন্তন) থেকে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে প্রথম কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শিক্ষণ বিদ্যালয়ের অন্যতম স্থাপক ছিলেন।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।