কেমন
ছিল সে যুগের পুলিশ? (১২)
[এই
বিভাগ এখনও UNICODE ফণ্ট-এ অসমাপ্ত| হরফ ফণ্ট-এ বাংলায় এটি দেখতে
পারবেন ইণ্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করলে| তারজন্য এইখানে
ক্লিক করুন|]
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬)
(৭) (৮) (৯) (১০) (১১)
(১২)
শিক্ষকতার
জীবন (১)
দিল্লীতে ইন্টেলিজেন্স
ব্যুরোতে প্রমোশন দিয়ে আমাকে মনোনয়ন করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের
তদানীন্তন আই জি শ্রী হীরেন্দ্রনাথ সরকার। আমার মত অন্যান্য
রাজ্য থেকে পুলিশ অফিসার মনোনীত হয়েছিলেন। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর
কর্তৃপক্ষ কিন্তু সরাসরি রাজ্যগুলি থেকে পাঠানো মনোনয়ন গ্রহণ
করলেন না। তাঁরা তাঁদের নির্বাচন করবেন আমাদের ইন্টারভিউ নিয়ে
পরীক্ষা করে। আমাদের নির্বাচনের জন্য এক বিশেষ বোর্ড গঠিত হয়েছিল
তিনজন ডেপুটি ডাইরেক্টর নিয়ে। এদের মধ্যে মুখ্য নির্বাচক ছিলেন
মিঃ কে এফ রুস্তমজী যিনি পরে মধ্যপ্রদেশের আই জি হয়েছিলেন। দস্যু
অধ্যুষিত চম্বল উপত্যকার অভিশাপ মান সিং প্রভৃতি শীর্ষস্থানীয়
দস্যু নেতার বিরুদ্ধে অভিযানে তাঁর সার্থকতা অবিস্মরণীয়। তিনি
বিশেষ করে আমার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। আমার কতগুলি দুরূহ কেসের
সাফল্যের রিপোর্ট ইতিমধ্যে তাঁরই সম্পাদিত ইণ্ডিয়ান পুলিশ জার্নালে
প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বোর্ডে আমাকে অন্যান্য প্রশ্ন করার পর
শেষে জিজ্ঞাসা করলেন- ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষকতায় আমার
আগ্রহ আছে কিনা। আমি জানালাম- আমার এই রকম শিক্ষকতার কোন অভিজ্ঞতা
নেই, যোগ্যতাও নেই। আমার নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে আমার নিজেরই
দ্বিধা- সন্দেহ আমি অকপটে প্রকাশ করলাম। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত
স্থির করে ফেলেছেন আগেই। আমার হাতে কলমে ডিটেকটিভের অভিজ্ঞতাই
আমাকে আমার নূতন কাজে বিশেষভাবে যোগ্য করে তুলবে, এই তাঁর রায়।
এর পর, দু তিন মাস পরে
১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে আমি দিল্লীতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে যোগ
দেবার নিয়োগপত্র পেলাম। দিল্লীতে অবশ্য এর আগে কয়েকবার এসেছি
অন্য সব কেসের তদন্ত নিয়ে। কিন্তু দিল্লীতে আমার জানা শোনা কেউ
নেই, কোথায় উঠবো, কোথায় থাকবো, সেই এক সমস্যা। তখনই ফ্যামিলি
নিয়ে যেতে তাই ভরসা করতে পারলাম না।
দিল্লীতে আই বি অফিসে সে জন্য লিখলাম আমার আবাসনের অসুবিধার
কথা। অনুরোধ জানালাম আমার জন্য সাময়িকভাবে হলেও তাদের অফিসারের
হোস্টেলে স্থান দেওয়া যদি সম্ভব হয়। বেশ সহানুভূতিজনক উত্তর
এলো। আমাকে তাঁরা হোস্টেলে স্থান দিতে সম্মত, তবে দুটি শর্তে-
এক, একমাসের মধ্যেই আমাকে অন্যত্র স্থানের ব্যবস্থা করে নিতে
হবে। আর দ্বিতীয়- সেটাই সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ- আমার আবাস
স্থান হোস্টেলের নাম-ঠিকানা কাউকে প্রকাশ করা চলবে না। স্থানটি
খুবই নাকি গুপ্ত স্থান।
এই দ্বিতীয় শর্তই আমাকে
ভীষণ চিন্তান্বিত করলো। আমি যেখানে যেতে চাই সেটা কাউকে বলা
যাবে না, আবার জায়গাটা আমি চিনি না, শুনিও নি কখন। ভাবতে ভাবতেই,
সমস্যার কোন সমাধান না খুঁজে পেয়ে দিল্লী স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।
প্রথমেই সঙ্কটে পড়লাম। মালপত্র কুলির মাথায় চাপিয়ে স্টেশনের
বাইরে আসতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার, টাঙ্গাওয়ালা, অটো রিক্সা সব
ছেঁকে ধরল। কোথায় যেতে চাই জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলো, যেমন অন্য
সব বড় স্টেশনে করে।
আমার তো বলতে মানা, কোথায় যাবো- কী তার ঠিকানা। যাই হোক অনেক
মাথা চুলকিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে হোস্টেলের কাছাকাছি একটা জায়গার
নাম করলাম। সে জায়গাটায় আমি আগে গেছি, আমার এক আত্মীয় অনেক আগে
সেখানে থাকতেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে নিয়ে চলল। আমি সাদা
পোষাকে ছিলাম। ড্রাইভারটা বেশ চালাক ছিল মনে হয়, সে বুঝতে পেরেছ
আমি খুফিয়া পুলিশ, অর্থাৎ সি-আই-ডির কেউ। সে বুঝে নিয়েছে আমি
কোথায় যাবো, এরকম যাত্রী সে আগে অনেকবার নিয়ে গেছে। সোজা সে
আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিল, আমার শত গোপনীয়তা রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও।
দেখলাম এই আবাসস্থান সকলেই জানে, বিশেষ করে ড্রাইভাররা। আমি
ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলাম। আমার এখানের চাকরির প্রথম ফাঁড়া কাটল
আমি কে, কোথায় যাবো - সে আমার গোপন কথা, কাউকে প্রকাশ করিনি-
ঈশ্বর সাক্ষী।
আমার নূতন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। বিশাল
জন অরণ্য, অসংখ্য শাখা প্রশাখা, এক শাখার কর্মী আর এক শাখার
কর্মীকে চেনে না। কর্মসমুদ্রের মধ্যে থেকে এসে আমি যেন অন্ধকার
কূপে পড়েছি। জানি না আমাকে কি করতে হবে? আমার জয়েনিং রিপোর্ট
দিলাম মূল অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের কাছে। তিনি আমার
জন্য একটি ঘরে টেবিল- চেয়ার নির্দিষ্ট করে দিলেন। আমি অফিসে
যাই, চুপ করে বসে থাকি। আমি কি জন্য এসেছি, কি করতে হবে কেউ
বলেনা। জিজ্ঞাসা করলে বলে- এত তাড়া কি। একটু যেন বিরক্তই হয়।
আমি নিজেই বেশী বিরক্ত হই আমার উপর।
অবশেষে হঠাৎ নিজে নিজেই
আবিষ্কার করলাম নিজের প্রকৃত ঠাঁই। এক পরিচিত সহকর্মী যিনি মাদ্রাজ
থেকে এসেছিলেন আমরই সঙ্গে ইণ্টারভিউ দিতে, তিনিই আমাকে চিনিয়ে
দিলেন আমার প্রকৃত শাখা। আমি এত দিন ভুল পথে ভুল কক্ষে বিচরণ
করছিলাম। আমার স্থান অন্য শাখায় যেখানে সেণ্ট্রাল ডিটেকটিভ ট্রেনিং
স্কুল স্থাপনের প্রস্তুতি পর্ব চলছে। সেখানে গিয়ে পেলাম আমার
প্রকৃত বসকে- মিঃ কে এফ রুস্তমজী।
ইতিমধ্যে আমার মত আরও তিন চার জন অফিসার অন্যান্য রাজ্য পুলিশ
থেকে অনুরূপভাবে নির্বাচিত হয়ে এসে গেছেন। আমাদের প্রথম কাজ
হল সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের অপরাধ অনুসন্ধানের শিক্ষণ
ব্যবস্থার মান কেমন, শিক্ষাব্যবস্থায় কোন ত্রুটি আছে কিনা, বর্তমান
অনুসন্ধান পদ্ধতি কতটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে উন্নত করা যায় তার
বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা। এই বিচার বিশ্লেষণের পর সমগ্র ভারতবর্ষের
উপযোগী একটি ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করা ও তার জন্য একটি
সিলেবাস প্রণয়ন করা।
এর জন্য প্রথমে আমরা ছড়িয়ে পড়লাম প্রতিটি রাজ্যের পুলিশ ট্রেনিং
স্কুল অথবা কলেজ পরিদর্শন করতে ও সেখানের সিলেবাস পরীক্ষা করতে।
এই সব সিলেবাসের কতটা গ্রহণীয়, কতটা বর্জনীয়, কতটা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত
অনুসন্ধান শিক্ষার উপযোগী তারই পর্যালোচনাতে আমরা নিয়োজিত হলাম।
এখানে সব সিলেবাস ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অনুশীলন করার পর ভারতের
বাইরের উন্নত দেশের অনুসন্ধান পদ্ধতি শিক্ষা ও পরিশীলন করার
জন্য সে সব দেশের ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের সিলেবাস ও শিক্ষণ
প্রণালী সম্যকরূপে জানবার জন্য আমরা নিয়োজিত হলাম। আমাদের একটি
দল নির্বাচিত করা হল প্রথমে লণ্ডন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ
ট্রেনিং স্কুলের ট্রেনিং কোর্সে যোগ দিতে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের
ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলই আদর্শস্থানীয় বলে সিদ্ধান্ত হলো। স্কটল্যাণ্ড
ইয়ার্ডের অনুসন্ধান পদ্ধতি চিরকালই শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে-
তাই সেখানেই আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থা সব দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট বিবেচিত
হলো। বলা বাহুল্য উত্তেজনায় আনন্দে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।
তখন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের
ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল ছিল লণ্ডন সহরের উপকণ্ঠে হেণ্ডন (Hendon)
বলে একটি জায়গায়। এখানে ট্রেনিংএর সময়সীমা ছিল তিন মাস। আমরা
চার জন ভারতীয় শিক্ষার্থী ছিলাম। তাছাড়া মালয়, সিঙ্গাপুর, সুদান,
ইজিপ্ট, উগাণ্ডা, কেনিয়া- এই সব দেশ থেকে আমাদের মত পুলিশ অফিসার
এই ট্রেনিং নেবার জন্য এসেছিলেন । আমেরিকা থেকে এসেছিলেন আমেরিকার
এয়ার ফোর্সের একজন ক্যাপ্টেন। বাকি সকলেই বৃটেনের নানা পুলিশ
বিভাগ থেকে।
ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের প্রিন্সিপ্যালকে কম্যানডাণ্ট বলা হতো।
তিনি ও অন্যান্য শিক্ষকরা সবাই ছিলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের অভিজ্ঞ
পুলিশ অফিসার। কিছু কিছু বিষয়ে- যেমন ফোরেনসিক সায়েন্স, মেডিক্যাল
জুরিসপ্রুডেন্স ইত্যাদি বিষয়ের লেকচার দিতে আসবেন বাইরে থেকে-
তাঁরা সবাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ নিজ বিষয়ে।
স্কুলের নিজস্ব হোস্টেল কিছু ছিল না। কিছু কিছু অফিসার ছাত্র
লণ্ডন থেকে নিজেদের গাড়িতে আসতেন, কিছু টিউব ট্রেনে আসতেন। লণ্ডনের
আশেপাশেই তাঁরা থকতেন।
আমাদের থাকার জন্য স্কুল
থেকে কতকগুলি ঠিকানা দেওয়া হলো যেখানে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকার
ব্যবস্থা আছে। আমি ও আমার এক পাঞ্জাবী সহকর্মী সেরকম একটা ঠিকানা
পেলাম- হেণ্ডনেই। আমরা দুজনে একত্রে সেখানে গেলাম। বাড়ির মালিক-
মিসেস মানরো এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। গত যুদ্ধে তাঁর স্বামীকে
হারিয়েছেন। বাড়িটি আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল। তার প্রধান
কারণ ভদ্রমহিলা ভারতীয় পেয়িং গেস্ট রাখেন, তাছাড়া ভারতীয় রান্নাও
কিছু কিছু জানেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে আমরা দুজনেই মুগ্ধ হয়ে
গেলাম।
তবে একটি মুস্কিল হলো- থাকার বাসনায় আমরা দুজন, কিন্তু সেখানে
একজনের বেশী থাকার স্থান নেই। তাঁর কাছে অনেক আগে থেকেই দুজন
পেয়িং গেস্ট আছেন- একজন ইন্দোনেশিয়ান ছাত্র, আর এক জন আছেন বাঙালী,
অবশ্য নামেই। নাম মিস্টার গোহো, আসলে তাঁর পদবী গুহ তবে পৈতৃক
পদবী গোহো নামই প্রচলিত রেখেছেন। ব্যারিস্টারি পড়ছেন সাত বৎসর
ধরে- পড়ছেনই, পাশ করেন না।
যাই হোক আমরা দুজনেই প্রার্থী, কেউ কারো অনুকূলে সরে দাঁড়াচ্ছি
না দেখে মিসেস মানরোই প্রস্তাব করলেন টসে যে জিতবে তাকেই তিনি
নেবেন। আমি প্রমাদ গনলাম। আমি আজ পর্যন্ত কখনও লটারিতে জিতি
নি, টসে বরাবরই হেরে এসেছি। কিন্তু আশ্চর্য এই প্রথম ও শেষ আমি
টসে জিতলাম।
খুব যত্ন ও আরামেই তাঁর
আশ্রয়ে ছিলাম তিন মাস। আমার সুবিধা অসুবিধার দিকে তাঁর সতত দৃষ্টি
ছিল। আমার গেঞ্জি, আণ্ডারওয়ার, রুমাল পর্যন্ত কেচে দিতেন। তাঁর
ডাইনিং রুমে অন্য একজন পেয়িং গেস্ট ছিল বলে আমরা তাঁর কিচেনে
বসেই খেতাম। এর জন্য অনেক সময় তিনি আক্ষেপ করতেন, লজ্জা পেতেন।
আমি তাঁকে প্রবোধ দিতাম, রান্নাঘরে খাওয়াতে আমরাও আরো অন্তরঙ্গতা
অনুভব করি; আমাদের দেশের অন্তঃপুরে গৃহিণীরা খুব আপনজনদেরই রান্নাঘরে
বসিয়ে খেতে দেন, আমি আমি তো সেই রকম আপন জন হবারই স্বাদ পাচ্ছি
ইত্যাদি। তিনি আনন্দে গলে যেতেন। আমার উপর তাঁর স্নেহের টান
ছিল বলে মনে হতো।
একদিন আমার স্কুলে টার্মিনাল
পরীক্ষার নির্ঘণ্ট ছিল। সাধারণত সব পরীক্ষার আগেই আমি ভীষণ নার্ভাস
হয়ে যাই। সেদিন আমাদের প্রথম পরীক্ষা- মন এত উত্তেজিত, স্নায়ুচাপ
এত বেশী যে আমি ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে কিছুই খেতে পারলাম না।
না খেয়েই বেরিয়ে গেছি। দরজা থেকে যেই বেরিয়ে একটুকু গেছি, একটা
প্রায় আর্তনাদের মত আওয়াজে ফিরে দেখি মিসেস মানরো হাত নেড়ে বেশ
জোর গলায় আমাকে ডাকছেন। পরীক্ষায় বেরিয়েছি, একেই ভীষণ নার্ভাস
হয়ে আছি, তার পর এই পিছু ডাকা- আমার অন্তরের ভয় আরো বেড়ে গেল।
আমি কাছে যেতেই দেখি তাঁর দুচোখে জল। দুহাত ভরে স্যাণ্ডউইচ আর
চকোলেট আমার ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো খেয়ে নিও
সময় করে, তুমি কিছুই খাও নি, আমার খুব খারাপ লাগছে। পিছু ডাকার
জন্য আমার বিরক্তি ভাব প্রথমটা চেপে রাখতে পারি নি। তাঁকে বলেই
ফেললাম আমাদের দেশে এরকম পিছু ডাকা খুবই অমঙ্গলসূচক। ভদ্রমহিলা
আরও অপ্রস্তুত হয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। পরিস্থিতি সামলে নেবার
জন্যই আমার মুখ থেকে তখনই সান্ত্বনা বাণী বেরোল- বললাম আমাদের
সমাজে আরও বলে পিছু ডাকা খুবই ভালো, যদি ডাকে মা। মিসেস মানরোর
মুখ হাসিতে আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। স্নেহ চুম্বনের সঙ্গে আমাকে
জানালেন গুড লাক।
গতানুগতিক ভাবে দিন কেটে
যাচ্ছে, ছকে বাঁধা জীবন। ব্রেকফাস্ট খাই, স্কুলে যাই। স্কুলেই
লাঞ্চ খাই- খুব পরিমিত ও সামান্য। এক গাদা আলু সিদ্ধ, মাংসের
কাটলেট জাতীয় কিছু, কেক ও তার সঙ্গে কফি বা চা। রাত্রে ডিনারের
জন্য মিসেস মানরো বানাতেন চাপাটি, ডাল, তাছাড়া মাংস ও একটা কোন
সুইট ডিস। খাওয়াটা আদৌ পর্যাপ্ত হচ্ছিল না বলে আমার মনে হচ্ছিল
ক্রমশ: কৃশকায় হয়ে যাচ্ছি। আমাদের অবস্থিতি এখানে খুবই অল্প
দিনের। এর মধ্যে না আমাদের দেশী অভ্যস্ত খাবার ভুলতে পারছি,
না পারছি বিলাতী খানায় রপ্ত হতে। যাই হোক, এতে বিশেষ কিছু এসে
যায় নি। সপ্তাহান্তে যেতাম লণ্ডনে রাসেল স্কোয়ারে আমার ভাগ্নে
সুনীল ও তার গৃহিণী সুনেত্রার ফ্ল্যাটে। সেখানে পাক্কা বাঙ্গালী
খানা খেতাম আর লণ্ডনে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম।
এর মধ্যে একটা বিপর্যয়
হয়ে গেল। দেশ ছাড়ার আগে দিল্লী থেকে আমি আমেরিকান এক্সপ্রেসের
ট্রাভেলার্স চেক সঙ্গে নিয়ে গেছলাম এক হাজার টাকার মত পাউণ্ডের।
আমার পক্ষে তার বেশী নেবার সামর্থ্য বা সঙ্গতি ছিল না। ইংলণ্ডে
থাকা খাওয়ার জন্য প্রতি পনেরো দিন অন্তর আমরা ইণ্ডিয়ান হাই কমিশন,
ইণ্ডিয়া হাউস, থেকে এলাউন্স যা পেতাম তা যথেষ্ট ছিল। এই ট্রাভেলার্স
চেক রেখেছিলাম কোন কিছু কেনাকাটার জন্য। অলডুইচে ভারতীয় লাঞ্চ
ছিল অপূর্ব- ভাত, ডাল, মাংসের ঝোল বা কালিয়া। মাঝে মাঝে আমার
ইংরাজ সহপাঠীদের সেখানে নিয়ে যেতাম আমাদের ভারতীয় লাঞ্চ খাওয়াতে।
তার জন্য যা অল্প খরচ হতো সেও এই ট্রাভেলার্স চেকের ওপর নির্ভর
করে।
বিপর্যয় হয়ে গেল আমার এই
সামান্য সম্বলটুকুর উপর। একদিন লণ্ডনে অক্সফোর্ড স্ট্রীট-পিকাডিলি
সার্কাস অঞ্চলে ঘুরছি আমার দু একজন ইংরেজ সহপাঠীর সঙ্গে। বাড়ী
ফিরে এসে পর দিন সকালে দেখি আমার ট্রাভেলার্স চেকের বই উধাও।
আমার শেষ সম্বল হারিয়ে মন ভীষণ বিষণ্ণ, কী করে বাকি ক 'মাস চালাবো
ভাবছি-- আকাশ পাতাল চিন্তা করছি কোথায় ফেলেছি ট্রাভলার্স চেক।
আমার মুখ দেখে ল্যাণ্ডলেডি মিসেস মানরো আন্দাজ করলেন, দেশ থেকে
বোধহয় কোন দুঃসংবাদ পেয়েছি। খুলে বলাতে তিনি শুধু শুধু মন খারাপ
করতে মানা করলেন, তাঁর তরফ থেকে কোন তাগাদা নেই ভরসা দিলেন।
সে দিক থেকে কোন চিন্তাই ছিল না। হাই কমিশন থেকে যে এলাউন্স
পাচ্ছি ল্যাণ্ডলেডিকে দেবার পক্ষে ও অন্যান্য খরচের জন্য তা
যথেষ্ট। তাহলেও অতগুলো টাকা, আমার পক্ষে মহামূল্য সম্বল। সেটা
হারানোতে খুবই বিশ্রী লাগছিলো।
অনেক ভেবে অলডুইচে আমাদের হাই কমিশন অফিসে গেলাম, আমাকে কিছু
অগ্রিম এলাউন্স দিতে পারেন কিনা জানতে। সব শুনে তাঁরা আমাকে
অগ্রিম এলাউন্স দিতে দ্বিরুক্তি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে
গোপনে একটি পরামর্শ দিলেন- আমি যেন আমার চেক হারানোর ব্যাপারটা
ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলে আমার কোন ইংরেজ সহপাঠীর কাছে প্রকাশ
না করি। ঘুণাক্ষরেও সেটা জানতে পারলে তারা আমাকে লাঞ্চ ইত্যাদি
খাওয়াবার জন্য নিয়ে যাবে বা অনুরূপ সাহায্য করবে। সেটা হবে আমাদের
দেশের পক্ষে খুব অমর্যাদাকর। সে সব আমি কিছুই করি নি, মিসেস
মানরো ছাড়া কাউকে কিছু বলিনি।
হারানোর দুদিন পর আমার হঠাৎ মনে হলো একবার লণ্ডনে আমেরিকান এক্সপ্রেসের
অফিসে গেলে যদি কোন উপকার হয়, তারা যদি কোন ব্যবস্থা করেন। আমি
সেখানে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলাতে তিনি
আমাকে কিছুক্ষণ বসতে বললেন। অল্প কিছুক্ষণ পরেই এসে তিনি আমার
পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। পাসপোর্টে আমার ট্রাভেলার্স চেকের নম্বর
ও অন্য বিবরণ লেখা ছিল। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে পাসপোর্টে
আমার ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে বার করলেন আমার সেই হারানো
রতন ট্রাভেলার্স চেক - সবই অটুট অক্ষুণ্ণ। আমাকে চেকবই দিয়ে
জানালেন একজন পথচারী ভদ্রলোক সেটা অকস্ফোর্ড স্ট্রীটে কুড়িয়ে
পেয়ে আমেরিকান একস্প্রেসে জমা দিয়ে গেছেন। নিশ্চয়ই অনবধানতায়
আমার পকেট থেকে পড়ে গেছলো। মনে শান্তি ফিরে পেলাম, ভাগ্য আমাকে
একেবারে পরিত্যাগ করেনি।
(চলবে)
নবেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়: পুলিশী জীবন সুরু হয় সাব-ইনস্পেক্টর হিসাবে
এবং কর্মদক্ষতায় সুপারিন্টেনদেন্ট পদ পর্যন্ত উন্নীত হ'ন। ১৯৫৩
সালে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসাবে রাষ্ট্রপতি পদক পান । ১৯৫৪
সালে বদলী হন ভারত সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্যুরো- তে। ইংলণ্ড ও
পশ্চিম জার্মানী (তদানীন্তন) থেকে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে প্রথম
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শিক্ষণ বিদ্যালয়ের অন্যতম স্থাপক ছিলেন।