অমৃতা

অমৃতা

‘অমৃতা’ – বাণী বসু

উপন্যাস: অমৃতা
লেখিকা: বাণী বসু
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স।

বিষয় হল নারী নির্যাতন, সংবাদপত্রের পাতায় বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যার উদাহরণ অগণিত। কিন্তু মনে হল সাহিত্যের পাতা উল্টে একবার দেখি। মনে পড়ল বাণী বসুর অমৃতা উপন্যাসটির কথা। লেখাটি প্রথম পড়ি একটি শারদীয়া পত্রিকায়, দুই দশকেরও বেশি আগে। সম্প্রতি পড়লাম আবার। দুই পাঠের মধ্যে পাল্টেছি আমি, সংসারের নানান অভিজ্ঞতা আমাকে দুনিয়া মানুষ সম্পর্ক দেখতে শিখিয়েছে অন্য দৃষ্টিতে। সারল্য, বিশ্বাস, সাদা কালোর মাঝে সুনির্দিষ্ট একটা রেখা টানতে পারার নিশ্চয়তা, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টালমাটাল হয়েছে এইসবই। তরুণী বয়সে যা পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এমনটাও হয়, আজ পড়ে মনে হল…তাই তো, অমুকের সঙ্গেও এমনটাই হয়েছিল তো! লেখিকা জানলেন কেমন করে!

তবে অন্তর্জগতে পরিবর্তন যাই এসে থাকুক না কেন, বহির্বিশ্বে নারী নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু চিরস্থায়ী। বরং ক্রমবর্ধমানও বলা যেতে পারে। অত্যাচার শারীরিক আর মানসিকও। নির্যাতক উপস্থিত পথে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি আপন গৃহেও।

অমৃতা উপন্যাসটি আবার পাঠের মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করলাম, নারীর দেহমনের ওপর ঘটে যাওয়া অসংখ্য নিপীড়ন, সেই নিপীড়নের পিছনে থাকা মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব, এবং নিপীড়িতার প্রতিক্রিয়া, এইসব কিছুই অত্যন্ত গভীরে গিয়ে দেখেছে, বুঝেছে, বুঝিয়েছে, লেখিকার মরমী কলম। উপন্যাসের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরি।

প্রজনন সংক্রান্ত নির্যাতন (Reproductive abuse) কথাটা প্রথম শুনি কোনো একটি ইংরেজি ক্রাইম শো তে। একটি নারী তার নিজের দেহে একটি নতুন প্রাণ ধারণ করবে কি না, গর্ভসঞ্চার হবে কি না, হলে সেই ভ্রূণকে সে জন্ম দেবে কি না, এই সিদ্ধান্ত যখন নারীটির নিজের হাতে থাকে না, সমাজ সংসার পরিজন যখন তার ওপরে এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, তখন তাকে বলা হয় reproductive abuse। এই নির্যাতনের এক ভয়াল রূপ দেখি আমরা অমৃতা উপন্যাসে।

নায়িকা অমৃতা গর্ভবতী হয়, তার স্বামী শ্বশুরবাড়ি চায় না সেই বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখুক। না, ভ্রূণের লিংগ বিচার করিয়ে গর্ভপাতে জোর করার ঘটনা যেমন শোনা যায়, তেমনটি নয়। স্রেফ, বাড়ির বউ গর্ভাবস্থায় এবং নবজাতক নিয়ে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় সংসারের কাজকর্ম করতে পারবে না, এই অদ্ভুত কারণে তারা অমৃতাকে জোরাজুরি করে গর্ভপাত করাতে। সে রাজি না হওয়ায় জোর করে অজ্ঞান করে নার্সিংহোমের ডাক্তারকে ভুল বুঝিয়ে তারা সেই চেষ্টা চালিয়ে যায়।
অমৃতার ঘটনা জানতে পেরে তার অধ্যাপিকা জয়িতার মনে পড়ে যায় নিজের অজাত সন্তানের কথা। দ্বিতীয় সন্তান এলে খরচ বাড়বে, নেমে যাবে জীবনযাত্রার মান, এই কারণ দর্শিয়ে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করেছিল তার স্বামী। সেই অজাত, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান আজও আসে তার মননে, ক্লাস নেওয়ার সময় যেন পিছনের বেঞ্চে বসে অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে, চোখে অভিমান আর অনুযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অমৃতা আর স্বাধীন স্বাবলম্বী পেশাদারী ক্ষেত্রে সফল ও জনপ্রিয় জয়িতা একই রকম অসহায় নিজেদের জীবনসঙ্গীর দাবির সামনে। তবে ভাগ্যের ফেরে অমৃতা বেঁচে যায়, বেঁচে যায় তার সন্তানও। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা সত্বেও এক্ষেত্রে দেখা যায় জয়িতা পরাধীনই। এখানে বলা যায় অমৃতার বান্ধবী দোলার কথাও। অবিবাহিতা দোলা গর্ভবতী হয়ে পড়ে, প্রেমিকের সঙ্গে তার বিয়েও দিয়ে দেওয়া হয় তড়িঘড়ি। পদে পদে তার নতুন স্বামী নিজের কথা আচরণে অবহেলা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে এই বিবাহ তার অভিপ্রেত ছিল না। গর্ভপাত হয়তো করাতে পারেনি তার স্বামী, তবে এই অনিচ্ছার দাম্পত্য কি দোলার পক্ষে খুব একটা সম্মানজনক?

জয়িতা-অমৃতার কথায় ফেরা যাক। জয়িতা এর পরেও অত্যাচারিত হতে থাকে স্বামীর হাতে। ছাত্রের কাছে আড়াল করতে চায় স্বামীর হাতে মার খাওয়ার ঘটনা। একজন স্বনির্ভর মহিলা কেন চুপ করে মেনে নেবে এই পরিস্থিতি, সেটা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাই উপন্যাসের শেষের দিকে, এবং আঁতকে উঠি অমৃতার ওপর নতুন আঘাতে। এবার, অ্যাসিড হামলা! বললাম না, নারীদেহের ওপর আঘাত অত্যাচারের একটি দলিল যেন লিখে রেখেছেন বাণী বসু এই উপন্যাসটিতে।

তবে, শুধু কি দৈহিক? মানসিক নির্যাতনের কথা ভুলি কী করে! সকাল থেকে রাত অবধি সংসারের পিছনে খেটে মরে অমৃতা। সামান্য শখ আহ্লাদ মেটানোর স্বাধীনতা নেই, স্বাধীনতা নেই নিজের পছন্দের পোশাক পরার, বা ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার। সামান্য একটু সময় শুধুমাত্র নিজের জন্য বরাদ্দ পেতেও তাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়।

আরেকটি বিষাদ বিধুর চরিত্র ডাক্তার কার্লেকারের স্ত্রী রম্ভা। আপাতদৃষ্টিতে ধনী পরিবারের সুখী বধূ, যে নিছক শখে কিছু পেশাদারী কাজে যুক্ত। এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক কৃতি মহিলা ডাক্তার, যে তার একদা প্রেমিক বর্তমান স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় চরম মানসিক আঘাত পেয়ে হারিয়ে ফেলেছে আত্মবিশ্বাস, আর সমাজ হারিয়েছে এক দক্ষ চিকিৎসক। এটাকেও কি মানসিক অত্যাচার বলা চলে না?

আচ্ছা, এত যে ঘটনা বললাম, কেমন যেন নারী মাত্রই পুরুষের হাতে নির্যাতিতা, এমনটাই মনে হচ্ছে, তাই না? আর নারীর সঙ্গে নারী? কেমন আন্তঃসম্পর্ক পাই দেখতে? পরিবারে যখন মেয়েটির ওপর অত্যাচার চলছে, কী করছেন পরিবারের অন্য মেয়েরা?

খিদের রাজনীতি। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বর্ণনা করতে কথাটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আলোচনায় পাওয়া যায়। কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক পরিসরের কথা ছেড়ে যদি ঘর, একেবারে অন্দরমহল, গেরস্থের হেঁসেলের কথা ভাবি, কেমন ভাবে চলে সেখানে এই খিদের রাজনীতি? যেখানে শোষক ও শোষিত দুজনেই মেয়ে?

অমৃতা রাঁধে বাড়ে, কিন্তু তার নিজের ভাগে জোটে কতটুকু? অন্যেরা খায় ডিম, সে খায় ডিমের ডালনার আলু আর ঝোল। ফ্রিজ খুললে শাশুড়ির ভয়, এই বুঝি অমৃতা ফল বা মিষ্টি খেয়ে নিল। কলেজ ক্যান্টিনে তাকে খাবার কিনে খাওয়ায় তার বান্ধবী, কারণ অমৃতা খিদেতে থাকে সব সময়, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়, এবং তার কাছে দোকানের খাবার কিনে খাওয়ায় পয়সা নেই। একদিন এই ঘোর খিদের জ্বালায় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সে পৌঁছে যায় মাতৃস্থানীয়া আপনজনের কাছে, বলে ফেলে, “আমাকে কিছু খেতে দেবে?”

গর্ভাবস্থায় খিদের জ্বালায় জ্বলে তার বান্ধবী দোলাও। ইচ্ছাকৃত নয়, ছন্নছাড়া শ্বশুরবাড়িতে অনিয়মের সংসারে খিদের কষ্টে চোখে জল আসে তার। উপরন্তু আছে পেট ভরে খেলে ঘরের বউয়ের এত বেশি খাওয়া নিয়ে কাজের লোকের টিপ্পনী। অথচ এরা দুজনেই শহুরে শিক্ষিত সচ্ছল ঘরের বধূ। প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র পরিবারে বউদের কী হয় তাহলে!

এই উপন্যাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আপাতভদ্র সুসংস্কৃত আলোকিত ছবির পিছনের অন্ধকার ফুটিয়ে তুলেছেন বাণী বসু। দেখিয়েছেন, ঘরে বাইরে শারীরিক মানসিক কত প্রকার অত্যাচার চলে মেয়েদের ওপর। কিছু খবর হয়, জনমানসে আলোড়ন তোলে। কিছু রয়ে যায় আড়ালে।

তাও সংগ্রাম চলে। অত্যাচার দিয়ে থামিয়ে রাখা যায় না মেয়েদের অগ্রগতি, রুখে দেওয়া যায় না তাদের জয়যাত্রা। মরে মরেও আবার বেঁচে ওঠে তারা – ফিনিক্স পাখির মত।

তাই তারা ‘অমৃতা।’

———-

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

আনন্দিতা চৌধুরীর জন্ম বেড়ে ওঠা কলকাতায়, তবে গত দুই দশক ধরে ঘর বেঁধেছেন নিউ জার্সিতে। তাই তাঁর লেখাতে যেমন উঠে আসে বাঙালি মধ্যবিত্ত যাপনের রোজনামচা, তেমনই থাকে প্রবাসী মনের টানাপোড়েন। পেশার ক্ষেত্র লাইব্রেরি, বইয়ের সঙ্গে কাটে দিন। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা সারাদিন। মানুষ দেখা, মানুষের কথা শোনা, মানুষের গল্প লেখা তাঁর নেশা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *