উদ্ভিদ জগতের জিনতত্ত্ব নিয়ে দিশা দেখিয়েছিলেন যিনি:- অর্চনা শর্মা
কথা মুখ:-
সময়কাল পঞ্চাশ-ষাটের দশক। মহিলাদের বিজ্ঞানচর্চা! সেটা কী বিষয়! বেশ হাসি-মস্করার ব্যাপার-স্যাপার ছিল। পরিবার প্রতিপালন, সংসার সামলানো, ছেলে-মেয়ে মানুষ করা বাদ দিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মহিলাদের ইচ্ছে, স্বপ্নের কথা কেই বা জানতে চাইতো সে সময়? পড়াশোনার ক্ষেত্রে সুযোগও সেভাবে ছিল না। তবুও কিছু নারী জীবনে কঠিন পথটাকেই বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ বিজ্ঞানচর্চাকে নিজের জীবনে সাধনার মতো আঁকড়ে থেকেছেন।
এমন কঠিন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি করতে এসেছেন এক মেয়ে। মেয়েটি কৌতূহলী, মেধাবী। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন সর্বদা পথ খুঁজে বেড়ায়। সহজ ও অভিনব পদ্ধতিতে নিখুঁত গবেষণার পথ। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পড়তে এসেছেন সেই তরুণী। তরুণীর আগ্রহের বিষয় গাছেদের জিনতত্ব। বিশেষ করে যে সকল গাছেরা অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
এক সময় মনে করা হত অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করা গাছেদের নাকি নতুন প্রজাতির মধ্যে কোন বিশেষ ভেরিয়েশন হয় না। এমনকি তারা কিভাবে নতুন প্রজাতির গাছের জন্ম দেয় তা নিয়েও ছিল ধন্দ। মেয়েটির জিজ্ঞাসু মন এর ভেতরের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার জন্যে উদগ্রীব ছিল। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে পড়তে এসে এই তরুণী স্থির করে নিয়েছিলেন নিজের গবেষণার বিষয়।
ছোট থেকেই গাছেদের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল এই তরুণীর। মহারাষ্ট্রে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন রসায়নের অধ্যাপক। কর্মসূত্রে বাবা থাকতেন রাজস্থানের বিকানেরে। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এই দুই রাজ্য ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া-জলবায়ু সবকিছুর বিচারেই বড় ভিন্ন। ফলে দুই রাজ্যের উদ্ভিদের প্রজাতিও ছিল একেবারে আলাদা। এই তফাৎ নজর কেড়েছিল সেই তরুণীটির। তাঁর কৌতূহল তাঁকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য অনুপ্রাণিত করত।
একটি ছোট্ট বীজ থেকে কীভাবে জন্ম নেয় এক মহীরুহ? ছোটবেলা থেকে মেয়েটির মনে বাসা বেঁধে থাকা এই প্রশ্ন তাঁকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল তাঁর গবেষণার পথে।
স্কুল, কলেজ যাওয়ার সময় গাছেদের ছুঁয়ে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে চেষ্টা করতেন সেই তরুণী। নিজের পড়াশোনার বিষয় হিসেবে তাই বেছে নিয়েছিলেন উদ্ভিদবিদ্যা। রাজস্থানের বিকানের থেকে স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়তে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরিবারে পড়াশোনার চর্চা ছিল তাই পারিবারিক বাধা তাঁকে সেভাবে পেরোতে হয়নি। গাছেদের জিনতত্ত্ব নিয়ে তাঁর সারাক্ষণ গবেষণা। সাধনার মতো করে নিজের কাজকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। এই ক্ষেত্রে কখনো কোন সূক্ষ্ম বিষয়ের খোঁজ তাঁকে আনন্দ দিয়েছে, কখনো কোনো পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হওয়া অস্থির করেছে তাঁকে। তবুও বিজ্ঞানকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরেছিলেন এই নারী। তিনি অর্চনা শর্মা। উদ্ভিদজগতের জিনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করা অনন্য বিজ্ঞানী।
অভিনব কৃতিত্বের অধিকারিণী অর্চনা শর্মা:-
১৯৫১সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করেছিলেন অর্চনা শর্মা। সেখান থেকেই ডক্টরেট। ১৯৬০সালে তিনি ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এক অনন্য নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন তিনি। অর্চনা শর্মা দ্বিতীয় মহিলা শিক্ষার্থী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সম্মানজনক ডিএসি অর্থাৎ ডক্টরেট অফ সায়েন্স ডিগ্রী লাভ করেন। প্রথম বিএসসি ডিগ্রিধারী নারী ছিলেন বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সময়ে তাঁর সুপারভাইজার ছিলেন অরুণ শর্মা। পরবর্তীকালে অরুণ শর্মাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
১৯৬৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে জিনতত্ত্ব বিভাগে প্রথম মহিলা অধ্যাপিকা হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তাঁর চর্চা ও গবেষণার ইচ্ছেরা প্রাণ পায় এখানে।
স্বামী অরুণ শর্মার সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেছিলেন একটি বই “ক্রোমোজোম টেকনিকস-থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস।” গাছেদের ক্রোমোজোম নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এই বইটিকে বাইবেল হিসেবে ধরা হয়।
ভারতের বাইরে ও অর্চনা শর্মার গবেষণার কথা ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডনের বাটারওয়ার্থস সংস্থা অর্চনা শর্মার এই বইটি সাদরে সম্মানের সঙ্গে প্রকাশ করে।
উদ্ভিদজগতের প্রজনন ব্যবস্থার অভিনবত্ব আশ্চর্য করে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান প্রকৃত অর্থেই বিস্ময়। অর্চনা শর্মার গবেষণার বিষয় ছিল উদ্ভিদকোষের জিনতত্ত্ব।
জীবজগতের বংশগতির ধারকের স্থান যে কোন জীবিত প্রাণীর কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। তাঁর নাম ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড অর্থাৎ ডি এন এ।
কোষ বিভাজনের দুটি পদ্ধতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিচিত। মাইটোসিস ও মিয়োসিস। মাইটোসিস পদ্ধতিতে একটি কোষ থেকে দুটি নতুন কোষের জন্ম হয়।
এই পদ্ধতিতে একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রাণকেন্দ্র নিউক্লিয়াস ও বিভাজিত হয়। জিনের প্রতিলিপি তৈরি হয় এই বিভাজনের সময়। এই প্রতিলিপি তৈরি হওয়ার পদ্ধতিটি নিখুঁত না হলে ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ তৈরি হতে পারে। বিভাজন হয়ে উৎপন্ন নতুন কোষে এই ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ থাকলে নতুন কোষটিও স্বাভাবিকভাবেই ত্রুটিযুক্ত হয়। একে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি বলে।
এর ফলে, নতুন বৈচিত্র্যসম্পন্ন প্রজাতির জন্ম হয় ঠিকই কিন্তু এই বৈচিত্র্য সেই নতুন কোষের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। ফলে পুরনো কোষ বা জন্মদাতা জীবের থেকে তৈরি হওয়া নতুন কোষ অর্থাৎ নতুন জীবটির জীবনসংশয় হতে পারে।
ফলে সেই জন্মদাতা জীবের কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এমনকী সেই প্রজাতির প্রজননের ওপর এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে।
মিউটেশন যেকোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হতে পারে। মিউটেশনের পদ্ধতিকে বলে মিউটাজেনেসিস। এই পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন অর্চনা শর্মা। শুধু গবেষণাই করেননি, এই ধরনের গবেষণা করার পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘ কাজ করেছেন তিনি।
মিউটেশন নিয়ে কাজ করতে প্রয়োজন কোন জীবের ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা করা। অর্চনা শর্মা বিশেষ রঞ্জক ব্যবহার করে প্রথমবার কোষের ক্রোমোজোম দেখার অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। মিউটেশনে ক্রোমোজোমের ভেতরে থাকা ডিএনএ অর্থাৎ ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিকঅ্যাসিডের সজ্জার পরিবর্তন হয়। অর্চনা শর্মার আবিষ্কৃত বিশেষ রঞ্জক ব্যবহারের ফলে ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণার পথ সহজ হয়।
অনন্য স্বীকৃতি:-
বিজ্ঞানী ও গবেষক অর্চনার শর্মার কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল উদ্ভিদের অঙ্গজ জনন নিয়ে চর্চা। একটা সময় এটা মনে করা হতো যে পরাগমিলনের মাধ্যমে যে সমস্ত জীব প্রজনন করে না তাদের বিবর্তন বন্ধ হয়ে যায়। পরে এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্চনা শর্মা এটাই প্রমাণ করেছিলেন। উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে পরীক্ষাগারে কাজ করেছিলেন তিনি। বিশেষ রঞ্জক ব্যবহার করে সেই সকল প্রজাতির ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখেন অঙ্গজ জননের মাধ্যমেও নতুন প্রজাতির সম্পন্ন উদ্ভিদ জন্ম নেওয়ার সম্ভব। বিখ্যাত জার্নাল নেচারে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর গবেষণা পত্র।
প্রাণীজগৎ নিয়েও তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। পলিমরফিজম বা একই জিনের বিবিধতা নিয়েও কাজ করেছিলেন অর্চনা শর্মা। তাঁর বহু কাজ জিনতত্ত্বের গবেষণা ও চর্চার নতুন পথ খুলে দিয়েছিল।
চারশোর ও বেশী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি। সাইটোজেনেটিক্স, হিউম্যান জেনেটিকস নিয়ে তাঁর কাজ ছাত্র-ছাত্রীদের দিশা দেখিয়েছে। স্বামী ও অধ্যাপক অরুণ শর্মার সঙ্গে যৌথভাবে কোষ তত্ত্বের আন্তর্জাতিক জার্নাল নিউক্লিয়াস প্রকাশ করেছিলেন অর্চনা শর্মা। এই বিশেষ জার্নাল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।
মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ অজস্র পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই বিজ্ঞানী। ১৯৭৬সালে জীববিজ্ঞানে শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া জগদীশচন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে জার্মানিতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সদস্য হন। ১৯৮৪সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল তাঁকে।
জেনেটিক্সের বিশেষ দিগন্ত উন্মুক্ত হয়েছিল এই অনন্যা বিজ্ঞানীর হাত ধরে:-
বিজ্ঞানের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা এই নারীকে নিজের কাজকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন অর্চনা শর্মা। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে সকলের প্রিয় দিদি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। অর্চনা শর্মা রচিত এবং সম্পাদিত উদ্ভিদবিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের বইগুলি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরস্তরে আজও অবশ্যপাঠ্য। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা জেনেটিকসের জগতকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন অর্চনা শর্মা। ছাত্র-ছাত্রীরা আপন করে নিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় শিক্ষিকাকে। শিক্ষিকাও স্নেহ করতেন সন্তানের মত। ভালোবাসা দিয়ে হাতে কলমে কাজ শেখাতেন। তাঁর পরীক্ষামূলক কাজকর্ম আধুনিক জেনেটিক্সের গবেষণা সহজ করেছে। ক্রোমোজোম স্টাডির ক্ষেত্রে তাঁর তৈরি রঞ্জক ব্যবহার করা হয় এখনো।
২০০৮সালের ১৪ই জানুয়ারি মারা যান তিনি। ২০১১সালে তাঁর স্বামী অরুণ কুমার শর্মার উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশন শুরু করে অর্চনা স্মৃতি পুরস্কার। উদ্ভিদবিদ্যার যেকোনো শাখায় এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারের জন্য মনোনীত গবেষককে ১০ হাজার টাকা এবং সম্মানফলক দেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের অধিবেশনে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পছন্দ মতো বিষয়ে ভাষণ দেওয়ারও সুযোগ পান এই পুরস্কারে সম্মানিত গবেষক। অর্চনা শর্মার কাজ আজও অনালোচিত। নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে তাঁর কাজ প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।
তথ্যসূত্র:-
১. আত্ম বিকাশ সাহিত্য পত্রিকার অনন্যা বঙ্গনারী বিশেষ সংখ্যা
২.https://feminisminindia.com/2018/07/30/dr-archana-sharma-pioneering-botanist/
৩. https://medium.com/sci-illustrate-stories/archana-sharma-2f6be6b8d819
1 Comment