আমার লেখালেখি
না, এ গরুড়ের রচনার শিরোনামটা বোধহয় ঠিক হল না। শিরোনাম বরং, ‘আমার ব্যর্থ লেখালেখির গল্প’ দিলেই ঠিক হত। কারণ আমার লেখালেখিতে সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। অনেক আটঘাট বেঁধে যাই লিখি না কেন, সবই প্রায় বাতিল হয়ে যায়। অনেক পত্রিকার দপ্তরে তো লেখা খুলে দেখে না পর্যন্ত। এই তো মাস খানেক আগের কথা, এক অল্প সাহিত্য বেশি সাজ পোশাক পত্রিকার দপ্তরে ফোন করে, আমার সব থেকে বিনীত স্বরের ওপর আরও এক পোঁচ ডাবর হানির প্রলেপ মাখিয়ে জানতে চেয়েছি যে, “আমি, শ্রীযুক্ত পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, আজ থেকে মাস ছয়েক আগে আপনাদের দপ্তরে আমার একটি সম্পূর্ণ মৌলিক ও অপ্রকাশিত (‘অপ্রকাশিত’ শব্দটি টাইপ করতে গিয়ে মহা বিপত্তি। যতবার টাইপ করি, হয়ে যায়, ‘অপ্রত্যাশিত’। কিবোর্ডও যেন কী করে জেনে ফেলেছে, আমার পক্ষে গল্প লিখে ফেলা, একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনাই বটে।) গল্প পাঠিয়েছিলাম, সেটি কি মনোনীত হয়েছে?”
তা জবাব পেলাম, “আপনার গল্প পড়া হয়নি।” আমি তখন আরও বিনীত। বিনয়ের শেষ সীমান্তে গিয়ে, নিজের গলাকে খাদে নামিয়ে এনে বললাম, “তবে কি কিছুদিন বাদে আবার ফোন করব?” ভদ্রলোক, এ বার খেঁকিয়ে উঠলেন, “না মশায় আপনার গল্প পড়া হবে না, ও আমরা বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছি।” এ বার আমি একটু উত্তেজিত হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন কেন? আমার অপরাধ?”
ভদ্রলোক বললেন, “কারণ আপনি মোটেই শ্রীযুক্ত নন, আপনি একজন ইয়ে। (যেটা বলেছিলেন, সেটা লেখা উচিত হবে না বলে ইয়ে দিয়ে কাজ সারলাম।) এর আগে আপনার একটা গল্প ছেপে আমাদের ঘাট হয়েছে। কী যেন গল্পটার নাম, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, ‘কালনাগিনীর থাবা’।” আমি আপত্তি করলাম, “দেখুন, কালনাগিনী এক প্রকারের সাপ, তার থাবা হয় কী করে? গল্পটার নাম ছিল, কালো চিতাবাঘের থাবা।” তিনি বললেন, ওই হল। ওই তো গল্পের ছিরি, ছেপেছি বলে কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবেন, তা নয়, পরের পাক্কা তিন মাস ধরে আমাদের ম্যাগাজিনের সমস্ত লেখা আগাগোড়া পড়েছেন আর একশো বানান ভুল বার করেছেন, সেই ভুল ধরিয়ে দিতে দপ্তরে দু’শো বার ফোন করেছেন। আপনার কোনও আক্কেলজ্ঞান বলে কিছু নেই? এত পড়ে কে? কেন পড়েছেন মশাই? আপনার গল্প পড়ে তো কেউ আমাদের দপ্তরে ফোন করেননি, না পড়াটাই দস্তুর। পড়লে, আপনার লেখাতেও হাজারটা খুঁত বার হত। গল্প ছাপা হলে নিজের নাম দেখে সন্তুষ্ট থাকবেন, অন্যের লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তার খুঁত বার করতে কে বলেছে? আরে অত যদি বানানবিধি ব্যবহারবিধি জানব, তবে গল্প পড়ে মনোনয়নের কাজ না করে নিজেই তো লেখক হয়ে যেতাম। আপনি জানেন, পেট চালানোর জন্য আপনার মতন ওঁচা লেখকের কত জঘন্য গল্প রোজ পড়তে হয়? তারপর আপনি ভুল বার করে আমার চাকরিটা খাবেন, আর আমি আপনার গল্প ছাপব? ফের যদি কোনওদিন গল্প পাঠাবার চেষ্টা করেন তো আপনার মজা বুঝিয়ে ছাড়ব।” আমি বুঝলাম, এই পত্রিকার দরজা বরাবরের মতন আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। তবে তাতে আমার রাগ হওয়ার বদলে ভদ্রলোকের প্রতি মায়া হল। কারণ ওর বক্তব্যের মধ্যে সরাসরি হুমকি থাকলেও, শেষের দিকে গলার স্বরটা ছিল কান্নাভেজা। সত্যিই তো ওইসব অখাদ্য কুখাদ্য লেখা যদি রোজ গলাধঃকরণ করতে হয় তবে কিঞ্চিৎ কান্না পেতেই পারে। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে। এত দুঃখের মধ্যেও প্রায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, “দেখুন ‘আক্কেলজ্ঞান’ বলে কোনও কথা হয় না, আক্কেল মানেই তো কাণ্ডজ্ঞান, তবে শেষ পর্যন্ত নিজের আক্কেল ঠিক সময়ে ফিরে পাওয়ায় কথাটা গিলে নিয়েছিলাম, নয়তো আজ সশরীরে এই লেখা আর লিখতে হত না। ভদ্রলোক আমাকে অশরীরী বানিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে মোটেই কার্পণ্য বোধ করতেন না।
তবে টেল এন্ডার ব্যাটাররাও যেমন মাঝে মাঝে সেঞ্চুরি করে ফেলে, তেমনি আমার দু’-একটা লেখাও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যায়, সম্পাদকরা ছেপে ফেলেন। এ রকমই হয়েছিল একবার, তাতেও বিপদ আর পিছু ছাড়ল কই! সে বার, একটা নয় দু’টো নয় আমার একেবারে তিন তিনটে লেখা এক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর দ্বারা মনোনীত হল। প্রথম দু’টি নিবন্ধ এবং শেষেরটি ছোটগল্প। একে একে লেখাগুলো প্রকাশিত হল, পত্রিকাটি বেশ নামী হওয়ায়, আমা হেন অনামী লেখককেই সেই পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে সৌজন্য সংখ্যা এবং সাম্মানিক নিয়ে আসতে আজ্ঞা হল, বা সেই পত্রিকার তেমনই কিছু নিয়ম থেকে থাকবে, সঙ্গে সনির্বন্ধ অনুরোধ, যেন আমার লেখা একটি ছোটগল্প নিয়ে যাই। আমি তো শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে একটা গল্প লিখে ফেললাম। আমাকে লিখতে বলে কে! আমিই তো লেখা আহ্বানের বিজ্ঞাপন খুঁজে খুঁজে লেখা পাঠাতে থাকি আর সুযোগ থাকলে কিছুদিন বাদে মোলায়েম স্বরে ফোন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধ্যাতানি খাই। সে যাই হোক, ধান ভাঙতে শিবের গীত এখন থাক। উল্লিখিত এই পত্রিকাটিতে মেইলের মাধ্যমে কোনও লেখা গ্রহণ করা হয় না, বাই পোস্ট লেখা পাঠাতে হয় অথবা পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে লেখা জমা দিতে হয়। আমাকে তো সঙ্গে করেই নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। অমি সমস্ত লেখাই টাইপ করে লিখি, হাতে লেখার প্রশ্নই নেই, কেননা আমার হাতের লেখা যদি আমাকেই পড়তে হয়, তবে অবশ্যই গাঁটের কড়ি খরচ করে একজন কম্পাউন্ডার ভাড়া করতে হবে। খারাপ হাতের লেখা পড়ার দক্ষতায় একমাত্র ওঁরাই ডক্টরেট করেছেন। সুতরাং, আমার টাইপ করাই একমাত্র ভরসা।
তা গল্পটি কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট নিয়ে বুঝলাম কেলেঙ্কারি কাণ্ড, একটা অক্ষর একটার ঘাড়ে উঠে গেছে, আর একজন অপর জনের কোলে উঠে পড়েছে। টেনিদার ভাষায় যাকে বলে পুঁদিচ্চেরি কেস। অথচ কম্পিউটার স্ক্রিনে গল্পটা চমৎকার পড়া যাচ্ছে। আমার কম্পিউটার জ্ঞানে সে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় পত্রিকার দপ্তরে খালি হাতেই যেতে হল। ব্যাপারটা ওঁদের খুলে বললাম বটে, তবে উত্তরে একটা অবজ্ঞাসূচক, ‘হুঁ’ শুনে বুঝলাম, খুব একটা বিশ্বাস করেননি। ভেবে নিয়েছেন, এ ব্যাটা লিখতে পারেনি বলে গুল দিচ্ছে। ওঁদের দোষ দেওয়া যায় না, আমার ‘পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামটা শুনে বোধহয় মানসচিত্তে একটা চিত্র কল্পনা করে নিয়েছিলেন, সামনাসামনি আমার মানচিত্র দেখার পর সে ভরসা ফর্সা হয়ে যেতেই পারে।
এই পর্যন্ত যারা ধৈর্য ধরে পড়েছেন এবং ভাবছেন, আমি প্রচুর পরিমাণে লেখালেখি করি, তারা ভুল ভাবছেন।
তোড়জোড় করে কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে লেখা শুরু করাই সার, লেখা ধরেই আমি ছেড়ে দিই। মারাত্মক কুঁড়ে তো। খাটতে চাই না মোটে। লিখতে গেলে জ্বর আসে। বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য এখন তো পুরো ছুটি। নো লেখালেখি, নো কিচ্ছু। বাংলা সাহিত্যের বিশেষ উপকার তাতে। কয়েকটা অহেতুক লেখার হাত থেকে সে রক্ষা পাবে।
আমি একে তো গড়িমসি ছাড়া কখনও লিখি না, তা হয়েছে কী, ওই গড়িমসির করতে করতেই কয়েক মাস আগে একটা গল্প লিখে এক পত্রিকায় তো পাঠালাম। আশ্চর্যের বিষয়, গল্পটা মনোনীত হল, সম্পাদক বললেন গুগল পে নম্বরটা দিন, পত্রিকা প্রকাশের সময় টাকা পাঠানো হবে। টাকা পেতে তো ভারী ভালো লাগে, ভাবতে থাকলাম যে টাকা পেলে কী কী করব। শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ঘটক মহাশয় একবার বলেছিলেন, “ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।” বিদ্বজ্জনের কথা অমান্য করতে নেই, তাই আমিও কষে ভাবা প্র্যাকটিস করতে লাগলাম। সামান্য ওই ক’টা টাকায় কী বা আর হয়? তবে সাম্মানিকের মুল্য তো ঠিক অঙ্কের বিচারে নির্ধারণ করা যায় না, এই আপ্তবাক্যটুকু সম্বল করে, মহাভারত থেকে ম্যাকবেথ হয়ে বিরিয়ানি টু চায়নাটাউন ভেবে ফেললাম। গ্র্যান্ড হোটেলেও ঢুকলে হত, তবে সেটা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে, ওই রাস্তায় আর ভাবিনি।
ভেবে ভেবে বেশ ক’টা দিন তো আনন্দে কেটে গেল। ওঃ হরি! সে পত্রিকা ছ’-মাসে বেরোল না। আমার টাকা পাওয়ার কী যে হবে! সম্পাদক কিছুই বলেন না। পত্রিকা ছাপবেন না, বলে দিলে গল্পটা অন্য কোথাউ দিতে পারতাম। হাতে গল্প থাকতে, আবার গল্প লেখার পরিশ্রম করারও মানে হয় না। তাই, ওরাও ছাপছে না, আমিও লিখছি না।
গল্পটা একবার ছেপে বেরলেই আপনারা জানতে পারবেন, মানে না জানিয়ে ছাড়ব না। অতি বিরল সে ঘটনা যখনই আমার লেখক জীবনে ঘটে, তখনই আমি হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস, ফেসবুক স্টোরি এবং ফেসবুক ফিডে ফিড করে দিই, তারপর লাইক কমেন্টসের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকা। সাত আটটা হ্যা হ্যা রিঅ্যাকশনের পাশে দু’-চারটে লাইকও জুটে যায় মাঝে মাঝে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আচ্ছা এ লেখা ছেপে বেরলে না হয় একবার আমার ফেসবুক পাড়ায় ঘুরেই আসবেন।
পুনশ্চ : আপনি ভাবছেন তো, এই এলানো লেখা ছাপা হবে বলে কী করে নিশ্চিন্ত হচ্ছি! সত্যি কথাটা চুপিচুপি বলেই ফেলি। এই পত্রিকার সম্পাদককে আমি সকালে গুড মর্নিং থেকে রাতে গুড নাইট পাঠানোর মাঝে বিকেলের গুড আফটারনুন, সন্ধ্যায় গুড ইভনিং পাঠাতে কখনও ভুলি না। এতেই শেষ নয়, আরও যতরকমের তোষামোদ আমার তূণীরে আছে, তার সব ক’টা প্রয়োগ করতে কোনও দ্বিধা করি না। ওঁর প্রত্যেক ফেসবুক পোস্টে লাইক দেওয়ার পর, সেই পোস্টটিকে অভূতপূর্ব, অসাধারণ, অনবদ্য, বিশ্বশ্রেষ্ঠ বলে মন্তব্য করে থাকি। এমনকী একবার এই পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে ওঁর সম্পাদনার ভূয়সী প্রশংসা করে আমার সাড়ে সাত লাইনের একটি চিঠি প্রকাশ করায়, বারংবার অমার অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি। এরপরও আমার লেখা ছাপবেন না বলছেন!