চিঠিপত্রের সংকলন – ‘ব্যক্তি সত্যজিৎ’ নতুন আলোয় উদ্ভাসিত
গত বছর (২০২১) সত্যজিৎ শতবার্ষিকীতে বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থটি অবশ্য প্রকাশিত হয়েছে তার আগেই, ২০২০র বইমেলাতে। চিঠিপত্রের সংকলনটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত হলেও তা মানুষ ও শিল্পী সত্যজিৎ সম্পর্কে উন্মোচিত করে বিভিন্ন তথ্য। তাই এই বইটি নিয়ে রইল আমার বিস্তারিত আলোচনা।
গ্রন্থটির নাম – ‘মানিকদার চিঠি, দেবযানীকে’, এই গ্রন্থটিতে রয়েছে সত্যজিৎ রায় লিখিত বহু চিঠি যা তিনি লিখেছিলেন তাঁর পত্রবন্ধু দেবযানী নাগ (পরে রায়) কে। চিঠির শুরু ১৯৭৪ সালে। এবং শেষ চিঠি ১৯৯১ সালে। দীর্ঘ সতের বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই পত্রালাপের বেশ কিছু চিঠি ২০১৩ সালের ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন থেকেই বেশ কৌতূহল ছিল। আরও কৌতূহল ছিল একটি ব্যক্তিগত কারণে।
আমার দিদি তখন যাদবপুরে বাংলাতে মাস্টার্স করছিলেন। তাঁর সঙ্গেই পড়তেন দেবযানী নাগ। দিদির কাছে এই পত্রমিতালীর কথা টুকরো টুকরো শুনেছিলাম। তারপরে ব্যাঙ্গালোরে চলে আসার ফলে সেই নিয়ে আর বিস্তারিত জানা হয়নি। তাই ২০১৩ সালের ‘শারদীয় দেশ’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর যখন শুনেছিলাম বর্ধিত কলেবরে লেখাটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবে, সাগ্রহ অপেক্ষা ছিল।
গ্রন্থ – মানিকদার চিঠি দেবযানীকে
সঙ্কলক – দেবযানী রায়
প্রকাশক – কারিগর
মুদ্রিত মূল্য – ৫৫০টাকা
বইটি পড়তে পড়তে আমরা এক অন্য সত্যজিৎকে আবিষ্কার করি। আমরা যারা সত্যজিৎ রায়কে একজন অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন পরিচালক বা সন্দেশ সম্পাদক বা সাহিত্যিক হিসেবেই জানি, তাদের কাছে এ এক বেশ নতুন ব্যাপার। এই সময়কালে সত্যজিতের অনেকগুলি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এদের মধ্যে আছে তাঁর একমাত্র হিন্দি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র পরিচালক রূপে আত্মপ্রকাশ হয়েছে সন্দীপ রায়ের। দূরদর্শনের পর্দায় আমরা দেখতে পেয়েছি সত্যজিতের চিত্রনাট্যে সন্দীপ রায়ের পরিচালনাতে টেলিফিল্ম। রয়েছে হিন্দি ফেলুদার মুক্তি। সব মিলিয়ে উপরোক্ত সব ব্যাপার নিয়েই সত্যজিতের আন্তরিক, অকপট এবং সনিষ্ঠ মতামত পাই এই চিঠিপত্রে।
প্রথমেই আসি সংকলকের অতি সুলিখিত ভূমিকাটিতে। এখানে এমন কিছু কথা আছে যা চিঠিতে পাওয়া যায় না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যতে পারে। দেবযানী একবার সত্যজিতের বাড়িতে আড্ডায় কথায় কথায় ‘Ape and Super Ape ছবি দেখা নিয়ে কথা হয়। সত্যজিৎ এলিটে দেখা শুনে আপশোস করেন – ‘এ হে গ্লোবে দেখলে আরও মজা পেতে! বড় স্ক্রিনে দেখলে না? অদ্ভুত ছবি। বাঁদরও পিঁপড়ে খাচ্ছে, মানুষও পিঁপড়ে খাচ্ছে। ইসস! গ্লোবে দেখলে আরও ভালো লাগত।” অকল্পনীয়, তাই না? একজনের ঐ উঁচু স্থানের মানুষ এত সহজভাবে মিশছেন! এত সাগ্রহে হাত কামড়াচ্ছেন? এমন উষ্ণ সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন চিঠি জুড়ে।
বইটি খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে যে বিষয়গুলি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার একটা সহজ সরল তালিকা করে মূল বিষয়গুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। আসলে এই চিঠিগুলির মধ্যে দিয়ে সত্যজিতের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভারি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। আমার এবং আমার মত অজস্র সত্যজিৎ অনুরাগীর কাছে তা অমূল্য।
চিঠির শুরু –
এখানে আমার একটু বিভ্রান্তি আছে। লেখাতে জানা যায় প্রথম চিঠি দেবযানী লিখেছেন ‘সোনার কেল্লা’ দেখার পর। কিন্তু সত্যজিতের প্রথম চিঠিতে (৩০/৭/৭৫) তার কোন উল্লেখ নেই। এটি সম্ভবত দ্বিতীয় বা পরের কোন চিঠি।
সম্বোধন –
এই ব্যাপারটি আমার ভারি মজার লেগেছে। দেবযানী একবার ‘রায়মশাই’ বলে সম্বোধন করতে গেলে সত্যজিৎ একেবারেই নাকচ করে দেন। কারণ – প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি বিখ্যাত চায়ের দোকানের মালিককে তাঁরা ঐ নামে ডাকতেন। আমরা যেন সত্যজিতের অনীহা চোখে দেখতে পাই লেখার মধ্যে দিয়ে। শেষমেশ অবশ্য ‘ভাই দেবযানী’ এবং ‘মানিকদা’ দিয়েই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
সময়ের মাপ ও পরিকল্পনা–
বিভিন্ন চিঠিতে উত্তর দেওয়ার সময় দেখি সত্যজিৎ চিঠির উত্তর প্রাপ্তির সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে একটি আভাস দিচ্ছেন। কারণ উত্তর না পেলে দুঃখ হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যেতে পারে ৩৭ পাতার (তারিখ – ৯/৩/৭৭) লিখিত চিঠিখানি। সত্যজিৎ লিখছেন – “তোমার চিঠি পেলাম। এর পরে -অর্থাৎ কাল থেকে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ব যে মাস খানেকের মধ্যে আর চিঠি লেখা হবে না – তাই এখনই লিখে রাখছি।” কী অসাধারণ না! তাঁর একজন অনুরাগিণীর প্রতি কতটা নিষ্ঠা থাকলে এত বড় একজন মানুষ এত গভীর ভাবে ভাবতে পারেন যে তাঁর উত্তর না পেলে অপরপ্রান্তের মানুষটির দুঃখ হতে পারে? শুধু একটি চিঠি নয়, আরও অনেক চিঠিতেই এই অনুভূতি ধরা পড় – ৩৩, ৩৫, ৬৯, ১১৫, ১৬৫ পাতার চিঠিগুলিই তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
দেখার আগ্রহ ও শিশুসুলভ কৌতূহল–
তাঁর পত্রবন্ধুকে দেখার জন্য সত্যজিৎ কতটা উদগ্রীব ছিলেন তা ধরা পড়ে প্রথম দিকের চিঠিগুলিতে। ৪১ পাতার চিঠিতে (তারিখ – ৯/৫/৭৭) দেখি তিনি লিখছেন –“—তুমি যে লোকটিকে চিঠি লিখছ, তার হাবভাব চেহারা এমনকি কন্ঠস্বরও বোধহয় মোটামুটি তোমার জানা আছে, কিন্তু আমি যাকে লিখছি তার শুধু হস্তাক্ষর, এবং তার চিঠির ভাষা ও বক্তব্যের ভিতর দিয়ে তার মনের খানিকটা পরিচয় ছাড়া আর কোন পরিচয় আমার কাছে নেই।” অনুমান করতে মুশকিল হয় না যে দেবযানী প্রথম দিকে এত বড় ব্যক্তিত্বের সামনে উপস্থিত হতে দ্বিধা বোধ করছিলেন। তাঁর পত্রবন্ধু পরের দিকে প্রায় সস্নেহ হুমকি দিয়ে সেই দ্বিধা দূর করিয়েছেন।
উত্তর না দিতে পারার কৈফিয়ৎ–
কখনো আবার এমন হয়েছে যে কখনো তাঁকে ‘কৈফিয়ৎ’ দিতে হয়েছে কেন উত্তর দেওয়া হয়নি! ভাবা যায় – চিঠির একপ্রান্তে সত্যজিৎ – দেশে বিদেশে সমাদৃত ব্যক্তিত্ব আর অন্যপ্রান্তে তাঁর তাঁর একজন অনুরাগিণী! কিন্তু কী আন্তরিক, সনিষ্ঠ সেই কৈফিয়ৎ – সত্যজিৎ শুরু করছেন চিঠি – “এ চিঠিটা মনে হচ্ছে কৈফিয়তেই ভরে যাবে। প্রথমত একমাস ত টানা ছিলাম – ছবির শেষ পর্বের কাজে নাজেহাল—-শঙ্কুর বড় গল্প লিখতে গিয়ে Writer’s cramp হল – মশার কামড় খেয়ে হল ম্যালেরিয়া —।” অর্থাৎ তিনি যে সত্যিই ব্যস্ত ছিলেন আর উত্তর না দেওয়ার কারণ অবহেলা নয় তা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি রীতিমতো ব্যগ্র। আরও কৌতূহলোদ্দীপক ১৪৫ পাতার (তারিখ – ১৫/৬/৮২) । সেখানে অনেক বুঝিয়ে তারপর শেষে সত্যজিৎ লিখেছেন – “আশা করি তোমার মন থেকে সংশয় দূর করতে পেরেছি।” এই মহানুভবতা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য!
নবপ্রজন্মের কথা –
অনেক চিঠিতেই দেখা যায় সত্যজিৎ নবপ্রজন্মের শিল্পীদের সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন সেতারবাদক বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়, গায়ক অজয় চক্রবর্তী, সরোদ বাদক ইমরাত খান ইত্যাদিরা। ১৪৫ পাতার চিঠিতে (তারিখ – ২৮/৬/৮৩) উল্লেখ আছে ভারতের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয় নিয়ে তাঁর উত্তেজনা – “সম্প্রতি TVতে World Cup Final দেখে আবার সেই কৈশোরের স্কুলজীবনে ফিরে যাওয়া গেল। এমন আনন্দ যে শেষ কবে দেখেছি তা মনে পড়ে না।” এর মধ্য দিয়ে আমরা এক মানুষকে আবিষ্কার করি যিনি নতুনদের মধ্যেও আনন্দের সন্ধান করে চলেছেন। রবিঠাকুরের মতই যেন তাঁর উচ্চারণ- “পাড়ার যত ছেলে এবং বুড়ো, সবার আমি একবয়সী জেনো।”
সত্যি কথা বলতে বইটি পড়তে পড়তে আমার বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে সেই কৈশোরের দিনগুলোতে। এতবড় এক মানুষ এক কিশোরীকে চিঠিকে লিখতে লিখতে নিজেই যেন হয়ে গেছেন এক কিশোর বা যুবক। প্রতিটি চিঠিই যেন তারুণ্যের আলোতে দীপ্যমান। রবীন্দ্রনাথের সেই রানু অধিকারীকে লেখা চিঠিগুলি যা পরে ‘ভানুসিংহের পত্র’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল তার কথা মনে পড়ে। দুই ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজের উঁচু আসন ত্যাগ করে একেবারে তাদের স্তরে নিজেকে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। তার ফলে চিঠিগুলি এত প্রাণবন্ত হয়েছে। সেজন্য এই আবিষ্কারের আনন্দ আমাদের দেওয়ার জন্য আমি সংকলক এবং প্রকাশকের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।
দুটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই প্রকাশক ও সংকলকের।
প্রথমত – যেহেতু সত্যজিতের স্বহস্ত লিখিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গেই চিঠি মুদ্রিত অংশ প্রকাশিত হয়েছে, তাই সহজেই মুদ্রিত অক্ষরের আকার আরও একটু বড় করে দিলে দুই পাতার মধ্যে আরও বেশি সামঞ্জস্য আসবে। মুদ্রিত চিঠির পাতায় নীচের দিকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা থাকায় একটু চোখে লাগছে।
দ্বিতীয়ত – টীকার ব্যাপারে। টীকার ক্রমাঙ্ক চিঠিতে দিলে নীচে টীকার সঙ্গে মূল চিঠিটি চট করে মিলিয়ে পড়তে সুবিধে হয়। অধিকাংশ বইতেই এমন দেখি। বিশেষ করে যেখানে টীকার সংখ্যা বেশি যেমন ৬৭, ১২৩, ১২৯, ১৮৯ ইত্যাদি পাতাগুলিতে। অনুরাগী পাঠকেরা যাঁরা পরে এই বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চান তাঁদের অনেক সুবিধে হবে।
এছাড়া বইটির মুদ্রণ, অক্ষরবিন্যাস, বাঁধাই ও প্রচ্ছদ দুর্দান্ত। এটি সত্যিই একটি সংরক্ষণযোগ্য বই। ফিরে ফিরে পড়ার মতই। এক উদারমনস্ক, চিরকিশোরকে বারেবারে আবিষ্কারের আনন্দের জন্যই।
2 Comments