চেস ফর লাইফ

চেস ফর লাইফ

বর্তমান  সময়কালকে যদি ভারতীয় দাবার স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করি, তবে বোধহয় সেটা অত্যুক্তি হবে না। পুরুষদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গুকেশ ডোম্মারাজু, মহিলাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দিব‍্যা দেশমুখ। পুরুষদের দলগত ওপেন চেস বিশ্ব চ‍্যামপিয়ন ভারত,  মহিলাদের দলগত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে দিব‍্যা দেশমুখের কাছে পরাজিত হলেও, ফিডে রেটিং অনুসারে বিশ্বে মহিলাদের শীর্ষ স্থানাধিকারী খেলোয়াড় হলেন ভারতের কোনেরু হাম্পি। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে প্রকাশিত ফিডে (FIDE) লাইভ রেটিং অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম দশজন পুরুষ দাবাড়ুর মধ্যে তিনজনই ভারতীয়। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ স্থান যথাক্রমে অধিকার করে আছেন রমেশবাবু প্রজ্ঞানানন্দ, অর্জুন এরিগাইসিরা, ডোম্মারাজু গুকেশ। ভারতীয় দাবার এই জয়যাত্রার পিছনে দক্ষিণ ভারতীয়দের অবদান যে সর্বাপেক্ষা বেশি, সে কথা অনস্বীকার্য। 

ভারতীয় দাবার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, ১৯৮৮ সালে প্রথম ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবধারী বিশ্বনাথন আনন্দের হাত ধরে। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, জীবন্ত কিংবদন্তি ভিশি আনন্দের অনুপ্রেরণাতেই যে আজ এক ঝাঁক ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা দাবাড়ু, দাবা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাতে কোনও সন্দেহই নেই। তিনিও তো জন্ম নিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডু রাজ্যে।

তামিলনাড়ুর মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে দাবা খেলা। তামিলনাড়ুর মানুষেরা বিশ্বাস করেন, মহাদেবের অপর রূপ হচ্ছেন ‘সথুরঙ্গ বল্লভনাথর’ এবং তিনিই দাবা খেলার ঈশ্বর।  এই বিশ্বাসের নেপথ‍্যে রয়েছে চমৎকার একটি লোকগাথা। তামিলনাড়ুর তিরুভারুর জেলার থিরুপুভানুর গ্রামে রয়েছে প্রাচীন এক মন্দির, যার আরাধ্য দেবতা হলেন ভগবান শঙ্কর; তামিল ভাষায় ‘সথুরঙ্গম।’ কিংবদন্তি অনুসারে একদা সেখানকার রাজকন্যা ‘মদাবতী’ দাবা খেলায় এতটাই দক্ষ ছিলেন যে তাঁর কাছে তাবড় দাবাড়ুরা সকলেই পরাজিত হয়েছিলেন। তখন ভগবান শিব স্বয়ং, সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে এসে রাজকন্যার সঙ্গে দাবা দ্বৈরথে অবতীর্ণ হন। সেই খেলায় জয়ী হয়ে শিব, পুরস্কারস্বরূপ মদাবতীকে বিবাহ করার অধিকার পেয়েছিলেন।  দাবার চালে কিস্তিমাত করেই সেদিন মদাবতীর সঙ্গে প্রেমের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মহাদেব। আর সেই প্রেমগাথার সাক্ষী হয়ে আজও স্বগরিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে সথুরঙ্গ বল্লভনাথর মন্দির। এই মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপত্য নয়, এই মন্দির দাবার প্রতি তামিলনাডুর মানুষের আত্মিক সংযোগের এক মূর্ত প্রতীক। দাবার প্রতি তামিলদের আবেগঘন এই গভীর ভালবাসাই, আজ তামিলনাড়ুকে ভারতীয় দাবার আঁতুড়ঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।  ষষ্ঠ শতাব্দীতে দাবা খেলার জন্মও হয়েছিল আমাদের ভারতবর্ষে। তখন অবশ্য এই খেলা, চতুরঙ্গ হিসেবে পরিচিত ছিল।

চৌষট্টি খোপের অসামান্য এই খেলাটি শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, এমনকি রাজনীতির আঙিনা জুড়ে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।

আসুন এই নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা দাবা বিশ্বের একদা জাদুকর, ‘ওসিপ বার্নস্টাইন’ কীভাবে দাবার বোর্ডে নিজের জীবন বাঁচিয়েছিলেন সেই ঘটনা ফিরে দেখি।

‘ওসিপ স‍্যামোলিভিচ বার্নস্টাইন,’ ১৮৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখে ইউক্রেনের ‘জাইটোমির’ নামক ছোট্ট শহরে, এক ধনী ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেইসময় ‘জাইটোমির’ সরাসরি রাশিয়ার অংশ না হলেও, রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সাংগঠনিক কাঠামোর আয়ত্তাধীন ছিল। 

জার্মানিতে আইন পড়তে যাওয়ার পরে, বার্নস্টাইনের দাবা খেলার দক্ষতা জনসমক্ষে আসে। ১৯০১ সালে ১৯ বছর বয়সে, হ‍্যানোভারে নিজের জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পরের বছরই ওই প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী হন। দাবা মানচিত্রে এইসময় থেকে বার্নস্টাইনের দ্রুত উত্থান ঘটে। ১৯০৬ সালের স্টকহোম মাস্টার্সে বার্নস্টাইন এবং আর এক বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড় ‘কার্ল শ্লেকটার’, যৌথভাবে শীর্ষস্থান দখল করেন। 

১৯০৭ সালে আয়োজিত ওস্টেন্ড দাবা প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রথমসারির ২৯ জন খেলোয়াড় অংশ নেন। বার্নস্টাইন, এই প্রতিযোগিতায় ‘আকিবা রুবিনস্টেইন’-এর সঙ্গে যুগ্মবিজয়ীর শিরোপা জিতে নেন। ওই বছরেই তিনি, হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর রাশিয়ায় ফিরে এসে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং উইলমা র‍্যাপোপোর্টের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

 

আইনজীবী বার্নস্টাইনের মক্কেলরা প্রায় সকলেই ছিলেন বড় শিল্পপতি অথবা ব‍্যাঙ্কার। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে বার্নস্টাইন, পরবর্তী ৬-৭ বছরে অনিয়মিত ভাবে সামান্য কয়েকটি দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। ১৯০৯ সালে অনুষ্ঠিত ‘মিখাইল চিগোরিন’ মেমোরিয়াল দাবা প্রতিযোগিতায় তিনি পঞ্চম স্থানে শেষ করেন। ১৯১১ সালে বার্নস্টাইন, ‘মস্কো সিটি’ চ‍্যামপিয়নশিপের শিরোপা জিতে নেন। ওই বছরেরই ‘স‍্যান সেবাস্টিয়ান’ প্রতিযোগিতায় যুগ্মভাবে অষ্টম স্থান পান। ১৯১২ সালে, তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত লিথুয়ানিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ভিনিয়াস অল রাশিয়ান মাস্টার্স’ প্রতিযোগিতায় বার্নস্টাইন দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন, প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন আকিবা রুবিনস্টেইন। ১৯১৪ সালে অনুষ্ঠিত মর্যাদাপূর্ণ ‘সেন্ট পিটার্সবার্গ’ প্রতিযোগিতায় বার্নস্টাইন একেবারেই নিজের সুনামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দাবা উপহার দিতে পারছিলেন না, মাঝামাঝি স্থানে প্রতিযোগিতা শেষ করে, তিনি ফাইনাল রাউন্ডের জন্য উত্তীর্ণ হতে পারেননি। কিন্তু প্রতিযোগিতায় তাঁর সেরা খেলাটি তুলে রেখেছিলেন তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ‘এমানুয়েল ল‍্যসকার’-এর জন্য। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এমানুয়েল সেদিন দুরন্ত ছন্দে থাকা বার্নস্টাইনের কাছে, প্রতিযোগিতায় নিজের একমাত্র পরাজয়টি স্বীকার করে নেন। 

 

ওদিকে রাশিয়ায়, ১৯১৭ সালে ঐতিহাসিক অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে বলশেভিকরা ক্ষমতার দখল নিলেন, পতন হল রোমানভ সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট নিকোলাস টু-এর।

বলশেভিকরা ক্ষমতায় এসে, মার্ক্স-লেনিনের আদর্শ অনুযায়ী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কারে জোর দিলেন। রাশিয়ার ব‍্যাঙ্কগুলোকে বলা হল পুঁজিবাদের ধারক, অশুভ প্রতিষ্ঠান। ব‍্যাঙ্কার এবং পুঁজিপতিদের পরামর্শদাতা আইনজীবী হিসেবে বার্নস্টাইন ঘোর বিপদে পড়লেন। বলশেভিকদের চোখে শ্রেণিশত্রু বার্নস্টাইন, নিজের স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে মস্কো থেকে পালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইউক্রেনের ওডেসা শহরে তিনি, সোভিয়েট গুপ্ত পুলিশ সংস্থা, ‘চেকা’-এর হাতে গ্রেপ্তার হলেন।

প্রতিবিপ্লবী হিসেবে অভিযুক্ত বার্নস্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। আরও কিছু বন্দির সঙ্গে বার্নস্টাইন যখন ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর মুখোমুখি, তখন ভাগ‍্যক্রমে উচ্চপদস্থ এক অফিসার, সেখানে উপস্থিত হয়ে সাজাপ্রাপ্তদের নামের তালিকা খতিয়ে দেখেন। ওই অফিসার ছিলেন দাবাপ্রেমী এবং দাবাড়ু বার্নস্টাইনের নামের সঙ্গে সুপরিচিত। 

কিন্তু বার্নস্টাইনের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে সন্দিহান সেই অফিসার তখন বার্নস্টাইনকে দাবা যুদ্ধে আহ্বান করে বলেন, “খেলা অমীমাংসিত থাকলে বা তোমার পরাজয় হলে, জেনো মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আর তুমি জিতলে প্রমাণিত হবে, তুমিই প্রকৃত বার্নস্টাইন। মৃত‍্যুদণ্ড রদ হবে।”

 

‘চেস ফর লাইফ’ নামে খ্যাত,  ঐতিহাসিক সেই দাবার দ্বন্দ্বযুদ্ধে অনায়াসে জয়লাভ করে মুক্তি পান বার্নস্টাইন, তাঁর দৌলতে মৃত‍্যুদণ্ড রদ হয় ওঁর সহবন্দিদেরও এবং পরে জেল থেকে সকলকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইতিহাসের পাতায় বর্ণিত সেই ‘অনায়াস জয়লাভ’ কি ততটাও অনায়াস ছিল? প্রসিদ্ধ দাবাড়ু হলেও বার্নস্টাইন সেভাবে অনুশীলনের মধ্যে ছিলেন না আর মৃত্যুর করাল ভ্রুকুটি যেখানে চৌষট্টি খোপে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে এবং প্রতিপক্ষ স্বয়ং মৃত‍্যু দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তখন দক্ষতায় আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকলেও স্নায়ুযুদ্ধ জয় করে দাবার ছকে বাজিমাত করা হয়তো তেমন সহজ ছিল না।

অনেকে অবশ্য মনে করেন, এক ‘চেকা’ অফিসারকে দাবা যুদ্ধে পরাভূত করে বার্নস্টাইনের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ঘটনাটি আসলে একটি জনপ্রিয় গল্প ছাড়া কিছু নয়। একজন পুলিশ অফিসারের হস্তক্ষেপে বার্নস্টাইনের মৃত‍্যদণ্ড রোধ হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই এবং এই হস্তক্ষেপের পিছনে বার্নস্টাইনের চেস মাস্টার হিসেবে খ‍্যাতি, প্রধান কারণ হতে পারে। কিন্তু দাবা খেলায় জয়ী হয়ে মুক্তি পাওয়াটা, একটি কিংবদন্তি, যার প্রামাণ্য ভিত্তি নেই।

আবার, আমেরিকান গ্র‍্যান্ডমাস্টার ‘আর্নল্ড ডেনকার’-এর বয়ান অনুসারে, ১৯৪৬ সালে যখন লন্ডনে তার সঙ্গে বার্নস্টাইনের দেখা হয়, তখন বার্নস্টাইন নিজেই ডেনকারকে ১৯১৮ সালে দাবা যুদ্ধে জিতে নিজের মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি লাভের গল্প বলেছিলেন। আর্নল্ড ডেনকার, তাঁর ‘The Bobby Fischer I knew and other stories,’ গ্রন্থে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। 

 

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের তরফে, ওডেসায় বেশ কিছু উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল বিশেষত যাদের জীবনের ঝুঁকি আছে, তাদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করা। বার্নস্টাইন পরিবার, এইরকম একটি জাহাজে করে ওডেসা ছাড়ার অনুমতি পান। কিন্তু বুলগেরিয়া এবং তুরস্ক এইসব শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। শেষে বার্নস্টাইনদের জাহাজ, সার্বিয়ায় গিয়ে পৌঁছোয়। চূড়ান্ত প্রতিকূলতা এবং অনিশ্চয়তায় ভরা সেই যাত্রায় পুরো বার্নস্টাইন পরিবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সার্বিয়ায় ভাগ‍্যদেবী আরও একবার বার্নস্টাইনদের সহায়তা করেন। বেলগ্রেড শহরে এক অফিসারের সঙ্গে বার্নস্টাইনদের দেখা হয়ে যায়, ওই অফিসার ওসিপ বার্নস্টাইনকে চিনতেন এবং তিনি বার্নস্টাইন পরিবারকে ভ্রমণের ছাড়পত্র যোগাড় করে দেন। দীর্ঘ জটিল যাত্রা শেষে বার্নস্টাইন পরিবার ভিয়েনা হয়ে অসলো শহরে পৌঁছে যান। সেখানে এক ধনী মক্কেলের আর্থিক সহায়তায় ১৯২০ সালে ওসিপ বার্নস্টাইন সপরিবারে প‍্যারিসে এসে পৌঁছোন, তখন মাত্র এক মাস সংসার চালানোর মতো অর্থ তাঁর কাছে অবশিষ্ট ছিল। প‍্যারিসে এসে তিনি তাঁর অনেক, পুরনো শিল্পপতি এবং ব‍্যাঙ্কার মক্কেলদের দেখা পেয়ে যান। তারাও সেখানে রাশিয়া থেকে পালিয়ে এসেছেন। এই মক্কেলরা বার্নস্টাইনকে তাদের আইনজীবী হিসেবে তৎক্ষণাৎ নিউইয়র্কে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে বলেন। আমেরিকার ভিসা পেতে তখন প‍্যারিসে লম্বা লাইন। বার্নস্টাইনকে ভিসা পেতে হলে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে, অথচ নিউইয়র্কে পৌঁছোতে দেরি হলে বার্নস্টাইনের মক্কেলদের কোনও কাজ সমাধা হবে না। আবারও দাবাড়ু হিসেবে বার্নস্টাইনের খ‍্যাতি সেই যাত্রায় তাঁকে ঠিক সময়ে ভিসা পাইয়ে দেয়।

বার্নস্টাইন প‍্যারিসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে পুনরায় নিজের পেশাগত সাফল্য লাভ করেন। 

১৯৩২ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘বার্ন’ দাবা প্রতিযোগিতা, যেটি আদতে ছিল ৩৬তম স‍ুইস চ‍্যামপিয়নশিপ। ১০ জন সুইস মাস্টার এবং ৬ জন বিদেশি মাস্টারকে নিয়ে সে বছরের সবথেকে শক্তিশালী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বার্নস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৮ বছর দাবা জগতের সঙ্গে সংশ্রবহীন বার্নস্টাইন সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। দীর্ঘ অনভ‍্যাস সত্ত্বেও বার্নস্টাইন, প্রতিযোগিতায় যুগ্মভাবে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আলেকজান্ডার আলেখাইন। আশাতীত সাফল‍্যে উৎসাহিত বার্নস্টাইন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আলেখাইনের বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত চেস ম‍্যাচে অংশ নেন। ২-২ গেমে অমীমাংসিত ভাবে সেই খেলা শেষ হয়। আলেখাইন শেষ গেমে কঠিন পরিস্থিতি থেকে লড়াই করে ড্র ছিনিয়ে নিতে না পারলে, অঘটন ঘটতে পারত। ১৯৩৪ সালে ‘জুরিখ’ দাবা প্রতিযোগিতায় বার্নস্টাইন যুগ্মভাবে ষষ্ঠ স্থানে শেষ করেন। 

 

১৯৩০-৩১ সালে বার্নস্টাইন চেয়েছিলেন বার্লিনে ফিরে যেতে, কিন্তু মিসেস বার্নস্টাইনের বিরোধিতায় তিনি প‍্যারিসে থেকে যেতে বাধ্য হন। জার্মানিতে ফিরে গেলে একজন ইহুদি হিসেবে তাঁকে হিটলার বাহিনীর হাতে কীভাবে পর্যুদস্ত হতে হত, সে কথা সহজেই অনুমেয়। ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি হিটলার, জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নাজি বাহিনী বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী ও ইহুদিদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার শুরু করে। 

ওসিপ বার্নস্টাইনের জীবন যেন এক রোলার কোস্টার। বার্নস্টাইন পরিবার বার্লিনে না গেলেও, নাজি বাহিনী কিন্তু ফ্রান্সে এল। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্স, জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করল। শুরু হল ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব‍্যাপক অভিযান, ধরপাকড়। ভিন দেশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে চালান করে দেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনা। 

বার্নস্টাইন পরিবারের সদস্যরা আবার স্পেনে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই দেশে বার্নস্টাইনের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। 

বলা বাহুল্য, বার্নস্টাইন পরিবারের সেই স্পেন যাত্রা খুব মসৃণ হয়নি। ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্তবর্তী পাইরেনিস পর্বতমালায় পৌঁছোনোর পরে, নাজি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে চলা আর দিনের বেলায় কোনও পাহাড়ি গুহায় আত্মগোপন করে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে একসময় বার্নস্টাইনরা সত‍্যি সত‍্যিই স্পেনে পৌঁছে গেলেন। স্পেনে ঢোকামাত্র স্প‍্যানিশ ফ্রন্টিয়ার গার্ডসের হাতে বন্দি হয়ে তাঁদের জেলে যেতে হল। আবারও বার্নস্টাইনের প্রভাবশালী বন্ধুদের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পেলেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি স্পেনে থাকার অনুমতি পেলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে, বার্নস্টাইন পরিবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন। 

১৯১৮ সালে রাশিয়ান বিপ্লব, ১৯৩০ সালে ফ্রান্সে দা গ্রেট ডিপ্রেশন এবং ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির ফ্রান্স আক্রমণের সময় মোট তিনবার বার্নস্টাইন কপর্দকহীন হয়ে পড়েন, কিন্তু প্রত‍্যেকবার হার না মানা মনোভাব নিয়ে জীবনে তিনি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

১৯৫৪ সালে, সোভিয়েট ইউনিয়ন চেস টিম, আর্জেন্টিনা যাওয়ার পথে প‍্যারিসে থেমেছিল এবং সেখানে ফ্রান্সের দাবাড়ুদের সঙ্গে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ দাবা খেলায় অংশ নিয়েছিল। ওসিপ বার্নস্টাইন ফ্রান্স দলের প্রতিনিধি হিসেবে বোর্ড ওয়ানে সোভিয়েট দলের ডেভিড ব্রনস্টেইনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিয়েভের ছেলে ব্রনস্টেইনের কাছে তার বিখ্যাত পূর্বসূরি ওসিপ বার্নস্টাইনের সঙ্গে করমর্দন ছিল স্বপ্নের মতো একটি ঘটনা। দুর্দান্ত গল্প বলিয়ে, বিশেষ করে মজার গল্প বলার ব‍্যাপারে ওসিপ বার্নস্টাইনের খ‍্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। সেদিনও গল্পগুজবে তিনি সকলকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ডেভিড ব্রনস্টেইন পরে লেখেন, দ্বিতীয় গেমের পরে ওসিপ তাকে কফি খেতে নিয়ে যান এবং রাশিয়ায় ফেলে আসা তাঁর বোনের খোঁজ করার জন্য ব্রনস্টেইনকে অনুরোধ করেন। ব্রনস্টেইন পরে লেখেন, “ওসিপ তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। তাঁর গলায় ঝরে পড়ছিল ফেলে আসা বোনের জন্য গভীর উদ্বেগ।” ব্রনস্টেইন বলেন কোনও অনুসন্ধানকারী সংস্থার সাহায্যে তিনি অবশ্যই ওসিপের বোনের খোঁজ করতে পারেন, তবে সবথেকে ভালো হয় ওসিপ নিজেই যদি মস্কো চলে এসে বোনকে খুঁজে বার করেন। ওসিপ বার্নস্টাইন, একদা মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসার কথা ভুলতে পারেননি, তিনি আবার সেই দেশে ফিরতে পারেন তেমন ভাবনা তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। ব্রনস্টেইন তাঁকে বলেন, এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। বহু পর্যটক সোভিয়েট সফরে যাচ্ছে, ওসিপও যেতে পারবেন এবং তাঁকে বুঝিয়ে সোভিয়েট দূতাবাসে ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে বলেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালে ফ্রান্স দলের সদস্য হিসেবে, ওসিপ বার্নস্টাইন চেস ওলিম্পিয়াডে অংশ নিতে মস্কো এসে পৌঁছোন। অসুস্থতার জন‍্য অবশ্য বার্নস্টাইন শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেননি, কিন্তু সেই চেস ওলিম্পিয়াডের আসরে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বিজয়ী, সব থেকে সুখী মানুষ। হেঁয়ালি নয়, কারণ সেই সফরে তিনি হারিয়ে ফেলা বোনকে খুঁজে বার করেন। ডেভিড ব্রনস্টেইন বর্ণনা করেন, ওসিপ আমাকে তাঁর বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “দেখো ডেভিড, এই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বোন। আমি ওকে ফিরে পেয়েছি।” ব্রনস্টেইনের দেখে আনন্দ হয়েছিল, ওসিপের বোন এমনভাবে তাঁর ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরে আছেন যেন এক সেকেন্ডের জন্য আর ভাইকে হারাতে রাজি নন। বার্নস্টাইন কিন্তু পরে আর তাঁর মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেননি। ভাই বোনের সেই মধুর মিলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ছ’বছর বাদে ফ্রান্সে ওসিপ বার্নস্টাইনের জীবনাবসান হয়।

পেশাগত কারণে অনিয়মিত খেলোয়াড় হলেও ওসিপ বার্নস্টাইনের নাম দাবা বিশ্বে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করা হয়। স্লোভেনিয়ান গ্র‍্যান্ডমাস্টার মিলান ভিদমার, ওসিপ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আনপ্রেডিক্টেবল!’ এটাই ওসিপ বার্নস্টাইনের যথার্থ মূল্যায়ন। কী দাবার বোর্ডে, কী জীবনের মঞ্চে তিনি সর্বদা আনপ্রেডিক্টেবল থেকেছেন। তাঁকে নিয়ে এত চর্চা হলেও তাঁর দুই সন্তানের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। 

অসমর্থিত সূত্র মাফিক জানা যায় যে বার্নস্টাইনের এক ছেলেকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল এবং তাকে ছাড়াই বার্নস্টাইনকে স্পেনে পালাতে হয়। যুদ্ধ শেষে ফ্রান্সে ফিরে এসে বার্নস্টাইন ওই পুত্রের সঙ্গে পুনর্মিলিত হন। জুনিয়র বার্নস্টাইন নাকি সেই বিরলতম মানুষদের একজন, যিনি পাঁচ বছর নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কাটিয়েও প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। বার্নস্টাইনের দুই সন্তান সম্পর্কে আসলে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তাদের নাম পর্যন্ত জানা যায় না।

১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা প্রথমসারির দাবাড়ুদের গ্র‍্যান্ডমাস্টার খেতাব দেওয়া চালু করার পরে, বার্নস্টাইনও একসময় গ্র‍্যান্ডমাস্টার খেতাবের অধিকারী হন। জীবনের শেষ দিকে বার্নস্টাইন আর খুব একটা প্রতিযোগিতামূলক দাবায় অংশ নিতেন না। ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ আমেরিকার মন্টেভিডিয়োতে অনুষ্ঠিত দাবা প্রতিযোগিতায় মিগুয়েল নাজডর্ফের বিরুদ্ধে খেলাকে অনেকে বার্নস্টাইনের জীবনের সেরা ম‍্যাচ বলে অভিহিত করেন। ওই প্রতিযোগিতায় বার্নস্টাইন দ্বিতীয় স্থান পান এবং ব্রিলিয়ান্সি খেতাবও জিতে নেন। এই প্রতিযোগিতাকে বার্নস্টাইনের শেষ উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা বলা যেতে পারে, কারণ ১৯৫৬ সালের দাবা ওলিম্পিয়াডে অসুস্থতার জন্য তিনি খেলতে পারেননি, সে কখা আগেই বলেছি। 

ওসিপ বার্নস্টাইন দাবার বোর্ডে ছিলেন এক ধ্রুপদী শিল্পী অথচ প্রস্তুতিবিহীন। চিরাচরিত দাবাড়ুদের শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায় তাঁর ছিল না, আর সেটাই বোধহয় প্রতিভার সঙ্গে মিলেমিশে সময়ে সময়ে দাবার বোর্ডে তাঁর অপ্রত্যাশিত চালগুলোর সৃষ্টি করত। জীবনের রঙ্গমঞ্চেও তিনি ছিলেন আনপ্রেডিক্টেবল, রহস্যময়।

জীবনের শেষ কয়েক বছর, বার্নস্টাইন কোলাহলমুখর প‍্যারিস থেকে দূরে, ফরাসি পাইরেনিস (FRENCH PYRENEES) জনপদের অন্তর্গত, ‘সেন্ট অ‍্যারোম‍্যান’ (SAINT ARROMAN) পৌরসভা অঞ্চলে অতিবাহিত করেন। ১৯৬২ সালের ৩০শে নভেম্বর, ৮৯ বছর বয়সে ওসিপ বার্নস্টাইন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ হয়ে যায় দাবা ইতিহাসের এক বর্ণময় অধ্যায়। 

 

তথ‍্যঋণ : An obituary on Bernstein by Edward Lasker

How a game of chess saved a man’s life by Andrew Pourciaux

Secret Notes by David Bronstein and Sergey Voronkov

দা স্টেটসম‍্যান পত্রিকা 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *