সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা – দ্বিতীয় পর্ব

সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা - দ্বিতীয় পর্ব

সৃজনী লেখার ক্লাসের প্রথম পর্বে আমরা শিখেছি যে – কবিতা তো আর কিছুই নয়, শব্দকে ব্যবহার করবার এক ধরণের গুণপনা, ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয় [] । এই দ্যোতনা জিনিসটা সংজ্ঞা দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল, তবে ছন্দ একটা বড় অংশ দ্যোতনার। আমরা বাংলা ছন্দের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেব আমাদের এই দ্বিতীয় ক্লাসে। প্রফেসর জে. ডি. এন্ডারসনকে লেখা রবি ঠাকুরের একটি চিঠি [] দিয়ে আজকের ছন্দ আলোচনা শুরু করছি। এই চিঠিতে উনি বাংলা ছন্দের মূল কথাটা এবং ইংরেজি ছন্দের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায় তা সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন –

“‘সন্মুখসমরে পড়ি বীরচূড়ামণি বীরবাহু’ — এই বাক্যটি আবৃত্তি করিবার সময়ে আমরা “সম্মুখ” শব্দটার উপর ঝোঁক দিয়া সেই এক-ঝোঁকে একেবারে “বীরবাহু” পর্যস্ত গড়গড় করিয়া চলিয়া যাইতে পারি। আমরা নিশ্বাসটার বাজে-খরচ করিতে নারাজ, এক নিশ্বাসে যতগুলা শব্দ সারিয়া লইতে পারি ছাড়ি না। আপনাদের ইংরেজি বাক্যে সেটা সম্ভব হয় না কেননা আপনাদের শব্দগুলা বেজায় রোখা মেজাজের। তাহারা প্রত্যেকেই ঢু মারিয়া নিশ্বাসের শাসন ঠেলিয়া বাহির হইতে চায়। She was absolutely authentic, new, and inexpressible — এই বাক্যে যতগুলি বিশেষণপদ আছে সব কটাই উঁচু হইয়া উঠিয়া নিশ্বাসের বাতাসটাকে ফুটবলের গোলার মতো এক মাথা হইতে আর এক মাথায় ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া চালান করিয়া দিতেছে। প্রত্যেক ভাষারই একটা স্বাভাবিক চলিবার ভঙ্গি আছে। সেই ভঙ্গিটারই অনুসরণ করিয়া সেই ভাষার নৃত্য অর্থাৎ তাহার ছন্দ রচনা করিতে হয়।

আপনি বলিয়াছেন, বাংলা বাক্য-উচ্চারণে বাক্যের আরম্ভে আমরা ঝোঁক দিয়া থাকি। এই ঝোঁকের দৌড়টা যে কতদূর পর্যন্ত হইবে তাহার কোনো বাঁধা নিয়ম নাই, সেটা আমাদের ইচ্ছা। যদি জোর দিতে না চাই তবে সমস্ত বাক্যটা একটানা বলিতে পারি, যদি জোর দিতে চাই তবে বাক্যের পর্বে পর্বেই ঝোঁক দিয়া থাকি। “আদিম মানবের তুমুল পাশবতা মনে করিয়া দেখো’– এই বাক্যটা আমরা এমনি করিয়া পড়িতে পারি যাহাতে উহার সকল শব্দই একেবারে মাথায় মাথায় সমান হইয়া থাকে। আবার উত্তেজনার বেগে নিম্নলিখিত করিয়াও পড়া যাইতে পারে–

               ।       ।         ।       ।    ।

আদিম মাবের তুমুল পাবতানেরিয়া দেখো।

এই বাংলা-শব্দগুলির নিজের কোনো বিশেষ দাবি নাই, আমাদের মর্জির উপরেই নির্ভর। কিন্তু, Realize the riotous animality of primitive man– এই বাক্যে প্রায় প্রত্যেক শব্দই নিজ নিজ এক্‌সেন্টের ধ্বজা গাড়িয়া বসিয়া আছে বলিয়া নিশ্বাস তাহাদিগকে খাতির করিয়া চলিতে বাধ্য।

বাংলা ছন্দে যে পদবিভাগ হয় সেই প্রত্যেক পদের গোড়াতেই একটি করিয়া ঝোঁকালো শব্দ কাপ্তেনি করে এবং তাহার পিছন পিছন কয়েকটি অনুগত শব্দ সমান তালে পা ফেলিয়া কুচ করিয়া চলিয়া যায়। এইরূপ এক-একটি ঝোঁক-কাপ্তেনের অধীনে কয়টা করিয়া মাত্রা-সিপাই থাকিবে ছন্দের নিয়ম-অনুসারে তাহার বরাদ্দ হইয়া থাকে।”

এবার আমরা প্রস্তুত বাংলা ছন্দের কথা বলতে। তার আগে কয়েকটা দরকারি কথা –

১) আমরা প্রথমে লক্ষ্য করি যে বাংলা শব্দ হয় দু’ ধরণের –

  • স্বরবর্ণ দিয়ে শেষ —- টানা যায় অনেকদূর – মুক্তদল
  • ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শেষ — টানা যায় না, থেমে যায় – রুদ্ধদল

২) ছন্দ নিয়ে খেলা করতে গেলে, শব্দকে syllable এ ভাঙতে হয়, বাংলায় বলে দলমাত্রা (বা সংক্ষেপে দল) – এটা হচ্ছে একটা Minimum unit, ন্যূনতম চেষ্টায় যতটা বলতে পারি – যেমন উদাহরণ স্বরূপ

কবিকঙ্কণ– কো+বি+কং+কণ = চার (৪) দল বা 4 syllables

ছন্দ –      ছন+দ = ২ দল বা 2 syllables

৩) কতটা সময়মূল্য ওই দলগুলিকে আমরা দেব, যখন তারা উপস্থিত হবে কবিতায়?  আর সেই সময়মূল্য কী ভাবে আমরা মাপব? সময়মূল্যের এই ইউনিটকে আমরা বলব কলামাত্রা বা সংক্ষেপে মাত্রা [৩] ।

৪) যুক্তাক্ষর একটা অনন্য (unique) নির্মাণ বাংলায় – তাই যুক্তাক্ষর কী ভাবে ভাঙা হবে সময়মূল্য মাপার কাজে সেটাও আমাদের জানতে হবে।

৫) আর একটা জিনিস আমাদের জানা দরকার – পর্ব। শব্দের যেমন syllable বা দল, পংক্তির তেমন পর্ব। এটাতেই একটা পংক্তির চাল বা চলন – এইখানে আমরা স্বল্পক্ষণের জন্যে থামি বা যতি দিই। যতি নিয়ে আরো অনেক বিশদ আলোচনা সম্ভব [৩], আমরা সহজ করে এখানে লঘুযতি বা অর্ধযতির মধ্যে তফাত টানবো না, এবং দুটোকেই “হ্রস্ব যতি” হিসেবে দেখবো। 

পর্ব: পংক্তির এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন-

“একলা ছিলেম ∣ কুয়োর ধারে ∣ নিমের ছায়া ∣ তলে ∣∣
কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এবার ছন্দের কথা সহজ ভাবে শুরু করা যাক – যেখানে প্রতিটি দলই এক মাত্রা। এই হচ্ছে স্বরবৃত্ত ছন্দ (ওরফে দলবৃত্ত বা শ্বাসাঘাতপ্রধান)

স্বরবৃত্ত ছন্দের কতকগুলি উদাহরণ নীচে দিলাম

১) ৪-৪-৪-১ চলন

আম রা খা ব /মুড় কি মু ড়ি / তোম রা চি কেন / চাউ
তোম রা হ লে / এ সেন শি য়াল / আম রা হ লাম/ ফাউ
তোম রা খাও য়াও /গ নেশ কে দুধ/ ইঁ দুর কে দাও/কোক
আর /রি মোট ঘো রাও/ ইচ ছে ম তন/ হা ঘরে দর শক

খেল ছে শ চীন,/ খেল ছে শ চীন/ মার ছে শ চীন / ছয়
খেল ছে শ চীন, /খেল ছে শ চীন / মার ছে শ চীন / চার
(চন্দ্রবিন্দু)

২) ৪-৪-৪- চলন

বৃষ্টি নামলো/ যখন আমি/ উঠোন-পানে/ একা
দৌড়ে গিয়ে/ ভেবেছিলাম/ তোমার পাব/ দেখা।
হয়তো মেঘে-/ বৃষ্টিতে বা/ শিউলিগাছের/ তলে
আজানুকেশ/ ভিজিয়ে নিচ্ছো/ আকাশ-ছেঁচা/ জলে
কিন্তু তুমি/ নেই বাহিরে–/ অন্তরে মেঘ/ করে
ভারি ব্যাপক/ বৃষ্টি আমার/ বুকের মধ্যে/ ঝরে!

যখন বৃষ্টি নামলো’, শক্তি চট্টোপাধ্যায় (এটি সুদীপ্ত বিশ্বাসের বিশ্লেষণ [৪])

আরেকটা সহজ এবং পরিচিত উদাহরণ নিই আমরা –

সকালে উঠিয়া আমি/ মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন/ ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা/ মোর গুরু জনে
আমি যেন সেই কাজ/ করি ভাল মনে।

এবার যদি মাত্রা মাপি প্রত্যেকটা দলকে এক মাত্রা দিয়ে, তাহলে আমরা দেখব এই চলন –

৩ ৩ ২        ২ ২ ২

৩ ৩ ২        ২ ২ ২

২ ২ ২        ১ ২ ২

২ ২ ১ ১      ২ ২ ২

দেখাই যাচ্ছে যে এই ভাবে প্রত্যেকটা দলকে একমাত্রার সময় দিলে, প্যাটার্নটা নষ্ট হয়ে যায়। অথচ কানে শুনতে কবিতাটা একেবারেই খারাপ লাগছে না। তাই মাপাটা ভুল হচ্ছে কোথাও – সব দলকে সমান মাত্রা দেওয়া চলবে না এখানে।

তাই আমরা এবার শিখব আর একটি ছন্দ। এর নাম অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ( বা মিশ্রকলাবৃত্ত বা তানপ্রধান)।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আমরা সময়ের মাত্রা মাপব এই ভাবে –

  • স্বরধ্বনি / মুক্তদল   – – মাত্রা
  •  ব্যঞ্জনধ্বনি / রুদ্ধদল — শব্দের প্রথমে বা মাঝে বসলে মাত্রা,  শব্দের শেষে বা একক ভাবে বসলে মাত্রা

আবার তাহলে ফেরত আসি আগের উদাহরণটায় যেখানে আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম –

সকালে উঠিয়া আমি/ মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন/ ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা/ মোর গুরু জনে
আমি যেন সেই কাজ/ করি ভাল মনে।

অক্ষরবৃত্তের রেসিপি অনুযায়ী মাপলে একেবারে নিটোল ৮-৬ চলন।

৮ ৬
৩ ৩ ২ ২ ২ ২
৪ ২ ২ ২ ২ ২
৩ ৩ ২ ২ ২ ২
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২

বাঙলা যেভাবে আমরা লিখি তাতে একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটে – একটা সরলীকরণ এসে যায় এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ মাপায়।

অক্ষর (নীরেন চক্রবর্তীর সংজ্ঞায় [১]) অক্ষর = স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, মিশ্র, যুক্তাক্ষর – সবকিছু “stuff”) এই হিসেব মত

অক্ষর = ৩ অক্ষর
বেদনা = ৩ অক্ষর
সংজ্ঞা = ৩ অক্ষর
ব্রহ্ম = ২ অক্ষর

তাহলে আমরা যদি শুধু অক্ষর গুনি, তাহলেই পেয়ে যাব ৮/৬ এর মাপ এখানে –

সকালে উঠিয়া আমি/ মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন/ ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা/ মোর গুরু জনে
আমি যেন সেই কাজ/ করি ভাল মনে।

এই ৮/৬ চলন অক্ষরবৃত্তের একটা বিশেষ তান তুলে ধরে, এটাই আমাদের বহু প্রচলিত পয়ার। (পাঁচালী ছন্দ)

আর একটি উদাহরণ দিই – এটি যুক্তাক্ষরে ঠাসা কিন্তু সেই ৮/৬ চলন

ওই শোনো সাড়ম্বরে । প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ । ঢোল বেজে যায়।
গর্জনে-হুংকারে ওই । সভা জমে ওঠে
ভক্তদের ঘন-ঘন । পতনে মূর্ছায়।

তাহলে এবার আমরা আবার বলি কী শিখলাম আজ এখনো অবধি

স্বরবৃত্ত – দ্রুত চলন বা লয় – সাধারণত পর্ব ৪ মাত্রার

“ছিপখান তিনদাঁড়। তিনজন মাল্লা”

অক্ষরবৃত্ত – ধীর চলন বা লয় – পর্ব ৮ বা ৮/৬ (পয়ার) খুব প্রচলিত কিন্তু আমরা আরো অনেক মাত্রা এবং প্রকরণ দেখব, যখন আবার ফেরৎ আসব অক্ষরবৃত্তের বিস্তারিত আলোচনায় (সৃজনী ক্লাসের পরের সংখ্যাগুলিতে)।

এবার আমরা পরিচয় করিয়ে দেব একটি মধ্যগামী ছন্দের যারা নাম মাত্রাবৃত্ত ছন্দ : এই ছন্দের কবিতা আবৃত্তির গতি স্বরবৃত্ত ছন্দের চেয়ে ধীর, কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চেয়ে দ্রুত।

একটা উদাহরণ দিই –

এইখানে তোর \ দাদির কবর \ ডালিম-গাছের \তলে
তিরিশ বছর \ ভিজায়ে রেখেছি \ দুই নয়নের \ জলে ∣
(কবর; জসীমউদদীন)

স্বরবৃত্তে মাপলে – ৩ ১\২ ২\২ ২ \ ২
৩ ২\ ৩ ৩\১ ২ \ ২

অক্ষরবৃত্তে মাপলে – ৩ ২\৩ ৩\৩ ৩ \ ২
৩ ৩\৩ ৩\ ২ ৪\ ২

এই দুটো মাপের কোনোটাই ঠিক ছন্দ প্যাটার্নটা ধরতে পারে না ওপরের উদাহরণে, তাই আমরা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের এই মাপ জানাই এবার –
অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়; আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, যেখানেই থাকুক ২ মাত্রা গুনতে হয়; য় থাকলে, যেমন- হয়, কয়; য়-কে বলা যায় semi-vowel, পুরো স্বরধ্বনি নয়, তাই এটিও অক্ষরের শেষে থাকলে ২ মাত্রাই হয়
উদাহরণ ১

এ ই খানে তোর ∣ দাদির কবর ∣ ডালিম-গাছের ∣ তলে
১+১+২+২=৬ ১+২+১+২=৬ ৩+৩ =৬
তি রিশ ব ছর ∣ ভিজায়ে রেখেছি ∣ দুই নয়নের ∣ জলে ∣∣
৩+৩ ৩+৩ ২ + ২ +২

উদাহরণ ২-

রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ পর্বের কবিতায় মাত্রাবৃত্তের আবিষ্কার। কবির কথায়, “যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।”

ফাল্ গুনে বিকশিত কান চন ফুল ,
২+২ ৪ ২+২ ২
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল ।
২ ২ ২+২ ২+১+১+২ (আম ম্রো …)
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায় ,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায় ।
স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে ,
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে ।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার হয়। মাত্রাবৃত্তের আরো কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আজ শেষ করব-

৫ মাত্রা
আসতে-যেতে /এখনো তুলি /চোখ
রেলিঙে আর /দেখিনা নীল/ শাড়ি।
কোথায় যেন/ জমেছে কিছু /শোক,
ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি।
এখন সব স্তব্ধ নিরালোক;
অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি। —নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

৫ মাত্রা
ভদ দ্রো মোরা /শান্ত বড়ো/ পোষ মানা এ /প্রাণ
বোতাম আঁটা /জামার নীচে /শান্তিতে শয়ান
(রবীন্দ্রনাথ, দুরন্ত আশা)

৫ মাত্রা
বেণীমাধব /বেণীমাধব/ তোমার বাড়ি/ যাব-(৫/৫/৫/২)-
বেণীমাধব/ তুমি কি আর /আমার কথা /ভাবো?(৫/৫/৫/২) (জয় গোস্বামী)

৭ মাত্রা
মর্ ত জীবনের / শুধিব যত ধার
অমর জীবনের লভিব অধিকার।
(রবীন্দ্রনাথ, স্ফুলিঙ্গ ১৮৬)

৭ মাত্রা
কে যেন বারেবারে /তার
পুরনো নাম ধরে /ডাকে;
বেড়ায় পায়েপায়ে, /আর
কাঁধের পরে হাত /রাখে। (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)

এবার একটি বিশেষ ধরণের উদাহরণ ৭/৫ কলাবৃত্ত, অন্ত্যমিল ছাড়া

বৃথাই জপিয়েছি তোমারে মন
থামাও অস্থির চ্যাঁচামেচি
কোথায় অর্জুন, কোথায় কামরূপ
এক বসন্তেই শূন্য তৃণ। (বুদ্ধদেব বসু, অসম্ভবের গান)

হোমওয়ার্ক – দু’ ধরণের হোমওয়ার্ক দিচ্ছি, বিশ্লেষণের এবং লেখার।

বিশ্লেষণের হোমওয়ার্ক
ছন্দ বিশ্লেষণ

১) জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা,
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।

২) নীল-অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর
হে গম্ভীর!
বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর–
ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর, হে গম্ভীর॥
বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,
কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে–
নন্দিত তব উৎসবমন্দির, হে গম্ভীর॥

জয়তী চক্রবর্তীর কন্ঠে গানটি শোনা যাবে এইখানে – https://www.youtube.com/watch?v=e8Rioteeo18

৩) বিমলচন্দ্র ঘোষের “উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা”র অংশ

সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে
চঞ্চল পাখনায় উড়ছে

দুপুরের রৌদ্রের নিঃঝুম শান্তি শান্তি
নীল কপোতাক্ষীর কান্তি
এক ফালি নাগরিক আকাশে
কালজয়ী পাখনার চঞ্চল প্রকাশে

সলিল চৌধুরীর সুরে উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা পুজোর গান হয় ১৯৫৩ সালে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে গানটি শোনা যাবে এইখানে –

৪) সলিল চৌধুরীর “কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা”

“কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা” (১৯৪৯) পাওয়া যাবে এইখানে
https://www.youtube.com/watch?v=vSf9I8m7QmY

শুনতে হবে পুরোটা 1949 version অন্য পরের version হলে চলবে না

গানটির Lyrics পাওয়া যাবে এইখানে –
https://www.ebanglalibrary.com/banglalyrics/1912/%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%A7%E0%A7%81/

কবিতা করে পড়লে – প্রথম ১০-১২ লাইন কোন ছন্দ মনে হচ্ছে?

লেখার হোমওয়ার্ক

১) অন্তত চার (৪) লাইন ৪৪৪১ বা ৪৪৪২ স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখতে হবে।
২) অন্তত চার (৪) লাইন ৮/৬ পয়ার / পাঁচালী ছন্দে লিখতে হবে।
৩) ৫ বা ৬ মাত্রায় (৭/৫ ও ভীষণ ভাবে চলবে! ) অন্তত চার লাইন মাত্রাবৃত্তে লিখতে হবে।

 

উল্লেখসূত্র:

[১] নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, “কবিতার ক্লাস”, নবযুগ সংস্করণ (২০১৩)
[২] https://www.tagoreweb.in/Essays/chhanda-125/chithipotro-2-7610
[৩] নীলরতন সেন, “আধুনিক বাঙলা ছন্দ”, দে’জ পাবলিশিং (২০১৩)
[৪] বাংলা ছন্দের সহজপাঠ – সুদীপ্ত বিশ্বাস

বাংলা ছন্দের সহজপাঠ – সুদীপ্ত বিশ্বাস

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩), এবং “ভুলটা ছিল উপপাদ্যে, প্রমাণেতে নয়” (ই-বুক ২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" অনলাইন কবিতা পত্রিকা।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • বিমান মৈত্র , May 15, 2023 @ 6:18 pm

    চমৎকার বোঝানোর ভংগি। সহজ এবং আনন্দদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *