সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা - তৃতীয় পর্ব
আগের ক্লাসে আমরা আলোচনা করেছি বাঙলা ছন্দের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে। আজকের ক্লাসে আমরা শিখব ইংরেজি ছন্দের বুনিয়াদি গঠনগুলো। বাঙলা এবং ইংরেজি ছন্দের মধ্যে যে মূল তফাত তা রবীন্দ্রনাথ সহজ করে বলে গেছেন প্রফেসর জে. ডি. এণ্ডার্সন্কে লেখা একটি চিঠিতে [১]। এ চিঠি থেকে আমি বিস্তৃত উদ্ধৃতি দিয়েছি পর্ব ২ তে। অনুরোধ করব পর্ব ২-এর ওই গোড়ার অংশটুকু আবার একবার ঝালিয়ে নিতে।
ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখার ট্র্যাডিশনে (অর্থাৎ Shakespeare থেকে WB Yeats এবং তার সঙ্গে সমসাময়িক অনেক কবি) ছন্দের যে ব্যবহার হয় তা syllable (দল) এবং stress (শ্বাসাঘাত) ভিত্তিক। এই “accentual-syllabic” প্রণালীতে ছন্দ মাপলে ইংরেজি কবিতা পাঠের সময় আমাদের কানে শব্দতরঙ্গের যে ওঠানামা ধরা পড়ে, তার একটা পরিমাণগত বিশ্লেষণ করা যায়।
আমরা প্রথমে শিখতে চাই এই শব্দতরঙ্গের ওঠানামা সনাক্ত করতে যাকে চলিত ভাষায় বলে – “কান তৈরি করা”। আমরা চিনতে চাই stress বা শ্বাসাঘাত আর তার সঙ্গে tension বা টান, একটা চাপা উত্তেজনা আর তারপর stress release বা টানকে মুক্তি দেওয়া। এই চিনতে শেখার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল বিশেষ ধরণের গান শোনা। তাই আজ ক্লাস শুরু হবে দুটি গান শুনে – ১) প্রথমটিতে দেখবেন পীযূষকান্তি সরকারের গলায় শ্বাসাঘাতের গভীর ঝোঁক ব্যবহার।
লিঙ্ক – https://www.youtube.com/watch?v=szSsm3lh31k
২) আর দ্বিতীয়টিতে দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় সূক্ষ্ম শ্বাসাঘাতের ব্যবহার
লিঙ্ক – https://www.youtube.com/watch?v=oqMHNmgXNzY
দুটি গানই অসাধারণ।
এরপর আমরা কবিতা পড়ে stress analysis করব। দুটো উদাহরণ দিচ্ছি বাঙলা কবিতা থেকে যাতে stress word গুলি bold করে দেখানো হয়েছে।
১ অন্নপূর্ণা ও শুভকাল ৭ (গৌতম বসু)
আর নয়, অন্ধ-বিক্রেতার থেকে ধূপ কেনার সুযোগ নষ্ট হয়েছে
একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, অন্তরীক্ষ-পাশায় খাটে
তৃতীয়টি অধুনা যষ্টির পরচুলায়, দিন আনে, খায়,
মাঝির সংসার দুলে চলেছে।
২ মুক্ত কবিতা : ১ (অরুণাভ ভৌমিক)
অভিমান খামখেয়ালি ধার করে লক্ষ্মীর
পাঁচালি থেকে, চোখে তার ভাতঘুম,
উপচে পড়া কুয়াশা, এটা তিন্নির শহুরেপনা
নয়, এত সহজে ভাঙ্গে না সে গোলাপ, যেন
তিস্তায় ভেসে উঠে আসছে হাটবার, যেন
ব্যক্তিগত ক্রমশ খোঁজে অপার্থিব আলোকবর্ষ
আর বেওয়ারিশ ব্যালকনিতে অসুখের দিনগুলি।
লক্ষ করে দেখবেন শব্দতরঙ্গের ওঠানামাগুলি – নিয়মিত নয় সেই উত্থান-পতন এই কবিতাংশ দুটিতে, একটা যে বাঁধাধরা তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে কোথাও তাও নয়, কিন্তু এই কবিতাদুটির স্বর্গীয় তান পড়ামাত্র ছুঁয়ে যায় আমাদের। stress analysis সেই আকাশজাত গানের স্বরলিপি মেলে ধরে আমাদের কাছে। এই জন্যেই আমাদের ইংরেজি ছন্দগুলো ভালো ভাবে শেখা দরকার।
এবার আসি ইংরেজি কবিতায়। সহজ একটা ছোটদের কবিতা দিয়ে শুরু করি।
Round and round the mulberry bush
The monkey chased the weasel
Round and round the mulberry bush
Pop! goes the weasel.
এখানে আমি stress syllable গুলিকে bold ভাবে দেখিয়েছি, এখানেই শব্দতরঙ্গের শীর্ষ বা peak অনুভব করা যায়।
ইংরেজিতে নানান accentual-syllabic মাত্রার মধ্যে চারটে মিটার বহু প্রচলিত [২, ৩]
o Iambic (আয়াম্বিক)
o Anapestic (অ্যানাপেস্টিক)
o Trochaic (ট্রোকেয়েক)
o Dactylic (ড্যাক্টিলিক)
প্রত্যেকটি মিটারেই একটা ইউনিট থাকে (ইংরেজিতে বলে “foot”) যা গড়ে ওঠে দুই বা তিনটে সিলেবল এবং একটা জোরালো স্ট্রেস নিয়ে। এদের চলন বোঝাতে আমরা বাইনারি নম্বর ব্যবহার করব এই লেখায় – 1 বোঝাবে জোর স্ট্রেস (শীর্ষ) আর 0 বোঝাবে স্ট্রেসের অভাব (খাদ)।
আয়াম্বিক এর চলন দুই সিলেবল নিয়ে এইরকম 01 01 01 … – অর্থাৎ প্রথম সিলেবলে স্ট্রেসের অভাব (খাদ) আর দ্বিতীয় সিলেবলে থাকে জোর স্ট্রেস (শীর্ষ)। এইটাই ইংরেজি ভাষার স্বাভাবিক চলন। কয়েকটা ইংরেজি শব্দ দিচ্ছি এই প্যাটার্নে – “attain,” “portray,” “describe” আর তার সঙ্গে এই কবিতাংশটি যেখানে জোরালো স্ট্রেস দেখানো হয়েছে বোল্ড দিয়ে আর আয়াম্বিক ফুট দেখানো হয়েছে ব্যাকস্ল্যাশ (/) দিয়ে।
I wandered lonely as a cloud by William Wordsworth
I wan-/dered, lone-/ly as /a cloud
That floats /on high /o’er dales/ and hills
When, all /at once, /I saw/ a crowd
A host/ of gol-/den daff-/odils.
এখান প্রত্যেকটা লাইনে ৪টি ফুট আছে – এই হল আয়াম্বিক টেট্রামিটার। আর ৫টি ফুট থাকা লাইনের কবিতাকে বলা হয় আয়াম্বিক পেন্টামিটারে লেখা।
অ্যানাপেস্টিকের চলন ৩ সিলেবল নিয়ে এই রকম ভাবে – 001 001 … বা da da DUM da da DUM – ঠিক যেন ঘোড়া ছোটানো মাত্রা (galloping)। একটা উদাহরণ দিচ্ছি –
The Destruction of Sennacherib (By Lord Byron)
“The Assyrian came down like the wolf on the fold,
And his cohorts were gleaming in purple and gold;
And the sheen of their spears was like stars on the sea,
When the blue wave rolls nightly on deep Galilee.
ট্রোকেয়েক এর চলনও দুই সিলেবল নিয়ে কিন্তু এ চলে আয়াম্বিকের উল্টো ভাবে 10 10 10 …
আর সেই জন্যেই এই মিটার স্বরবৃত্ত / দলবৃত্তের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। উদাহরণ –
The Tyger – William Blake
Tyger! Tyger! burning bright
In the forests of the night.
অন্যদিকে ড্যাক্টিলিক আবার ৩ সিলেবল নিয়ে চলে, কিন্তু এর চলন অ্যানাপেস্টিকের চলনের ঠিক উল্টো – 100 100 … এই চলন পুরনো গ্রীক বা ল্যাটিনে বেশি দেখা যায় এবং এর মধ্যে একটা রাজকীয় ভাব দেখা যায়। যেমন –
This is the forest primeval. The murmuring pines and the Hemlock. (Henry Wadsworth Longfellow: Evangeline) এই চলন মনে পড়িয়ে দেবে:
‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সততসঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত, অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপ সমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নলিলা গোদাবরী, তরঙ্গ বিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরঃ “সীতার বনবাস”)
আবার এই ড্যাক্টিলিকই কিন্তু এর রাজকীয় বেশভূষা ছেড়ে একেবারে হাস্যরসাত্মক রূপ ধরতে পারে; যেমন এখানে – Pussycat, pussycat, where have you been?
এবার আমরা শিখব আর একটি মিটারের কথা যেটা ভিক্টোরিয়ান যুগের কবি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সের (Gerard Manley Hopkins) হাতে গড়া। আয়াম্বিক পেন্টামিটার (অর্থাৎ ৫ ফুট নিয়ে এক লাইন) ইংরেজি কবিতায় বহুল ব্যবহৃত কিন্তু হপকিন্সের কাছে তা একঘেয়ে মনে হতো। তাই এই বহুল প্রচলিত ফর্ম ভেঙে Hopkins তৈরি করেন sprung rhythm [৪]। এর প্যাটার্ন অনিয়মিত – এতে স্ট্রেস সিলেবলের সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু unstressed সিলেবলের (খাদ) এর সংখ্যা অনির্দিষ্ট। দুটো উদাহরণ দিই:
১) কবিতার নাম Binsley Poplars যার প্রথম তিন লাইন:
My aspens dear, whose airy cages quelled,
Quelled or quenched in leaves the leaping sun,
All felled, felled, are all felled:
লক্ষ্য করবেন একটার পর একটা স্ট্রেস সিলেবল শেষ লাইনটায়।
২) কবিতার নাম The Wreck of the Deutschland (verse 31).
…Heart, go and bleed at a bitterer vein for the
Comfortless unconfessed of them –
No not uncomforted: lovely-felicitous Providence
Finger of a tender of, O of a feathery delicacy, the
breast of the
Maiden could obey so, …
লক্ষ্য করবেন একটার পর একটা unstressed সিলেবল এই লাইনটায় “Finger of a tender of, O of a feathery delicacy”
Sprung Rhythm এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় হপকিন্সের কবিতায় – যেমন Spring and Fall, The Windhover, Inversnaid এবং আরো অনেক। একটা উদাহরণ দিই The Windhover থেকেঃ
I caught this morning morning’s minion, king-
dom of daylight’s dauphin, dapple-dawn-drawn Falcon, in his riding
Of the rolling level underneath him steady air, and striding
High there, how he rung upon the rein of a wimpling wing
In his ecstasy! then off, off forth on swing,
আর তার সঙ্গে আসুন একটু ‘গৌতম বসু’ পড়িঃ
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল/ ৩
একটি মানুষ ঘাসের জনতায়
রয়ে গেছে, যখন ফলকের সঙ্গে ফলকের সংঘাত
ধাতুর ক্রোধে বীর পড়েছে ভূতলে, রথ
টলতে-টলতে প্রবেশ করল যুদ্ধের আরও ভিতর;
সহস্র পদাতিক ঘাসফুল ঘিরে ধরেছে, শুঁড় দোলে
ঐরাবতের এই বুঝি শেষ হিংস্র দিন, ঘাসের
পায়ে অন্য ঘাসের মাথা, মাথা থেকে চিৎকার
নির্গত হলে হাওয়া ঘুরে ধুলো আঘাত করবে।
একসময় সূর্য আলো ফিরিয়ে নিলেন, মনে হল
অবিমিশ্র হাহাকারের কাল, ঘাস থেকে মাঠ,
মাঠ থেকে বালকের দল, তাদের উল্লাসের
উপর দিয়ে হাহাকার বয়ে চলে, আকাশের বিরুদ্ধাচারী
রাশি-রাশি ছুটন্ত হাত, একটি ঘুড়ি আজকের ভোজন।
Hopkins আরো একটা টেকনিক বহুবার ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায় যাকে তিনি বলতেন “consonant chiming,” – এটা উনি শিখেছিলেন বোধহয় ওয়েলস কবিতা থেকে – এতে অনুপ্রাস এবং মধ্যমিলের বিশেষ ব্যবহার হয়। একটা উদাহরণ দিই The Caged Skylark থেকেঃ
Though aloft on turf or perch or poor low stage,
Both sing sometímes the sweetest, sweetest spells,
Yet both droop deadly sómetimes in their cells
Or wring their barriers in bursts of fear or rage.
মনে রাখবেন, Hopkins যখন এইসব নতুন ছন্দে কবিতা লিখছিলেন ১৮৭০ নাগাদ, কেউ ছাপতে রাজি হয়নি সে লেখা। আর আজ? আজ তাঁকে মনে করা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কবি হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি আসে কবিতাগুলি লেখার প্রায় ৫০ বছর পরে।
কবিতায় মধ্যমিল ব্যবহার করা আমার খুব প্রিয় তাই লোভ সামলাতে পারলাম না আমার একটা পুরনো কবিতা শুনিয়ে শেষ করতে আজ – কবিতার নাম “গূঢ় অর্থে” (“আমার প্রথম কবিতার বই “অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা” তে গ্রন্থিত):
“একজনই শুধু ভালবেসেছিল
তাকে দূরত্বে রেখে, আমি গূঢ় অর্থে বুনেছি জীবন”–
শুনেছি এইভাবে শেষ হয়
পৃথিবীর যত গাথা, যত মহাকাব্য।
আমি তাই ভাববো না সেই দর্শনের কথা
আমি তাই অদর্শনে রাখবো না চোখে
সুরমার টোলের ব্যথা;
আমি ফের সন্ধানী হয়ে খুঁড়বো না অবিরত
চন্দ্রাণী হারা ক্ষত।
আমি শুধু সাবধানী হয়ে রয়ে যাব তার ঝোঁকে
যারা ভালবাসে স্থির, আকালে ও অসুখে।
একজনই শুধু ভালবেসেছে,
আমি তার বন্ধনে।
এবার হোমওয়ার্ক। একটি মাত্র।
১। নীচে দেওয়া এই কবিতাটি পড়ুন । বেশ কয়েকবার । কয়েকটা জায়গা আমি বোল্ড করে দেখিয়েছি। সেই অংশগুলি বারবার পড়ুন। কোন আইকনিক বাঙলা কবিতার কথা মনে পড়ে?
To Helen
Helen, thy beauty is to me
Like those Nicéan barks of yore,
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.
On desperate seas long wont to roam,
Thy hyacinth hair, thy classic face,
Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece,
And the grandeur that was Rome.
Lo! in yon brilliant window-niche
How statue-like I see thee stand,
The agate lamp within thy hand!
Ah, Psyche, from the regions which
Are Holy-Land!
তথ্যসূত্র:
[১] https://www.tagoreweb.in/Essays/chhanda-125/chithipotro-2-7610
[২] Writing Poetry, Michelle Boisseau and Robert Wallace, Pearson-Longman, New York, 6th Edition (2004).
[৩] An Introduction to Poetry, X. J. Kennedy and Dana Gioia, Pearson-Longman, New York, 13th Edition (2010).