সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা পর্ব চার

সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা চতুর্থ পর্ব

কবিতা লেখার ক্লাসের ৩য় পর্বে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করেছি ইংরেজি ছন্দের এবং পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি শ্বাসাঘাত ভিত্তিক (accentual-syllabic) ছন্দ মাপার প্রণালীগুলি। এই চতুর্থ পর্বে আমরা আবার ফেরত আসব বাংলা ছন্দে, বিশেষ করে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে (মিশ্রকলাবৃত্ত / তানপ্রধান নামদুটিও ব্যবহার করা হয়)।

খণ্ড কবিতা

এই প্রসঙ্গে পুনরুল্লেখ করি একটা প্রচলিত ভুল ধারণার – অনেকেই মনে করেন যে কবিতায় অন্ত্যমিল না থাকা মানে সে কবিতায় ছন্দ নেই। আবারও বলি, যে ছন্দ আর অন্ত্যমিল এক নয়, ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না। কোনও কোনও কবিতায় থাকে ছন্দের দীর্ঘ পরিসীমা ক্রম (কথাটা সলিড-স্টেট-পদার্থবিদ্যা থেকে ধার করলাম, পদার্থবিদরা বলেন long-range order) – পুরো কবিতাটা যেন একটা ল্যাটিস, একই দুলুনি পুরো কবিতা জুড়ে, আবার কোনও কোনও কবিতায় ছন্দ থাকে দানাদানা বা কণিকা সাজে, short-range order। সমসাময়িক বাংলা কবিতার একটা বড় অংশ লেখা হয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কণিকা সাজে, তাই আমাদের আবার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ফিরে আসা।

আবার মনে করিয়ে দিই, বাংলা ছন্দে রুদ্ধদল বলতে আমরা বুঝি সেই সব শব্দ যাদের ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে শেষ আর মুক্তদল হচ্ছে সেই সব শব্দ যাদের স্বরধ্বনি দিয়ে শেষ।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ মাপা হয় এই ভাবে –

স্বরধ্বনি/মুক্তদল  –  ১ মাত্রা
ব্যঞ্জনধ্বনি/ রুদ্ধদল – শব্দের প্রথমে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে বা একক ভাবে থাকলে ২ মাত্রা

বাঙলা যেভাবে আমরা লিখি তাতে একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটে – একটা সরলীকরণ করা যায় এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ মাপায়। তার আগে বলি “অক্ষর” শব্দটির সংজ্ঞা। নীরেন চক্রবর্তীর সংজ্ঞায়
অক্ষর = স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, মিশ্র, যুক্তাক্ষর – সবকিছু বা “stuff”। উদাহরণ হিসেবে মেঘনাদ বধ কাব্য থেকে এই অংশটুকুর আমরা অক্ষর মাপি –

জাগে রথ, রথী, গজ, (মোট ৮ অক্ষর ) অশ্ব, পদাতিক (আরও ৬ অক্ষর)
অগণ্য। দেখিলা রাজা (মোট ৮ অক্ষর) নগর বাহিরে,( আরও ৬ অক্ষর)
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ(মোট ৮ অক্ষর) সিন্ধুতীরে যথা, (আরও ৬ অক্ষর)
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা (মোট ৮ অক্ষর) আকাশ-মণ্ডলে।(আরও ৬ অক্ষর)

অর্থাৎ প্রতিটি লাইনেই এখানে মোট ১৪ অক্ষর রয়েছে, সে স্বরবর্ণ হোক কি ব্যঞ্জনবর্ণ হোক, বা মিশ্রবর্ণ কি যুক্তাক্ষরই হোক। এবার যদি আমরা অক্ষরবৃত্তের ছন্দের নিয়ম ধরে মাপি, তাহলেও দেখব যে প্রত্যেক লাইনই ১৪ মাত্রার। অর্থাৎ সরলীকরণ করে শুধু মোট অক্ষর সংখ্যা গুনুন আর
সেটাই হয়ে দাঁড়াবে অক্ষরবৃত্তের মাত্রা। (এই প্রণালী কাজ করে ৯৯% ক্ষেত্রে, কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে) ।

এবার আমরা পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব আধুনিক কবিতায় প্রায়শই ব্যবহার করা হয় এরকম কিছু কলাকৌশল বা টেকনিকের সঙ্গে।

১) Enjambmentপংক্তিপ্রবাহের ধারাবাহিকতা অর্থাৎ এক পংক্তি থেকে অন্য পংক্তিতে বিরতি ছাড়া ধারাবাহিকতা

কবিতার লাইন বা পংক্তিগুলো কীভাবে নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে তোলে, সেটাই একটা কবিতার সাবলীলতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। এই সাবলীলতা গড়ে তুলতে কবির হাতে অনেক মালমশলা, সরঞ্জাম আছে। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে এই ধারাবাহিকতা (enjambment) – কী ভাবে কবিতার চরণ ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, পংক্তি থেকে পংক্তিতে, যতিচিহ্ন ব্যবহার না করে। এতে কবিতার বিন্যাস বা texture বাড়ে। এর প্রথম উদাহরণ আবার মেঘনাদবধ কাব্য থেকে – enjambment আমি বোল্ড করে দেখিয়েছি।

“এতক্ষণে” –অরিন্দম কহিলা বিষাদে
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ? –শূলীশম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”

আধুনিক এবং সমসাময়িক বাংলা কবিতায় enjambment এর ব্যবহার করা হয় একটা stress বা শ্বাসাঘাত আর তার সঙ্গে tension বা টান তৈরী করতে, প্রথমে বাড়তে থাকে একটা চাপা উত্তেজনা আর তারপর আসে সেই stress এর release বা টানকে মুক্তি দেওয়া। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি –

পিতলের বাজুটা গড়িয়ে পড়েছে,
নথ ঝুলছে পর্দায়, তোমার ফেলে যাওয়া
রিস্টওয়াচটা দেয়ালঘড়ি হয়ে উঠেও
এমন করে বাড়ছে যে
একটু পরেই ঘরটা চৌচির হয়ে যাবে        (“মকরসংক্রান্তি,”অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)

যে-কোন ভিড়ের মধ্যে সহসা নিশ্চিত
একটি উজ্জ্বল মুখ অসম্ভব আলো জ্বেলে
আবির্ভূত হবে। নাকি ঠিক আলো নয়, প্রবীণ বিক্ষত
বৃক্ষের উপর জ্যোৎস্না, অলৌকিক সমুদ্রের
সাত লক্ষ ঢেউয়ের ফণার তীব্র।       (“মলিন কৌতুক,” আলোক সরকার)

রোদ উঠলে আলগা হয়ে যাওয়া
গ্রন্থিগুলোর মধ্যে যে নিহিত অন্ধকার
সেখানেও রোদ এসে ছড়িয়ে পড়ে।     (“রোদ উঠলে,” হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)

২) Fragments বা কবিতায় খণ্ডাংশ ব্যবহার

কবিতায় খণ্ডাংশ ব্যবহার করার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বোধহয় সাফো (Psappfo) থেকে অদ্ভুত ভাবে এর শুরু। লিরিক কবি সাফো, যাঁকে প্লেটো বলতেন “দশম মিউস,” জন্মেছিলেন গ্রিক দ্বীপ লেসবসে (যার থেকে ইংরেজিতে ‘লেসবিয়ান’ কথাটার উৎপত্তি) এবং বেঁচেছিলেন ৬১২-৫৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।  তাঁর কবিতা উদ্ধার করা গেছে টুকরো বা fragment অবস্থায়। একটা উদাহরণ দিই – এখানে খণ্ডাংশগুলি সাফোর অভিপ্রায় ছিল না, এইভাবেই উদ্ধার হয়েছে কবিতার পাতাগুলি।

সাফো / ক (John Maxwell Edmonds এর অনুবাদ)

স্যাফো – খুঁজে পাওয়া কবিতার খণ্ডাংশ

heart
altogether
[if] I can;
shall be to me
shine back
fair face,

engrained.

সাফো / খ (Stanley Lombardo এর অনুবাদ)

hurt

work
face honored
winter storm

Abanthis, take your lyre and sing
of Gongyla, while desire once again
flutters around
the beautiful girl: her dress
excited when you saw it,
and I am glad,
for the holy Cyprian herself
blamed me when I prayed

this word

I want

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, মর্ডানিস্ট কবিরা খণ্ডাংশকে নতুন সাজে কবিতায় উপস্থাপন করলেন আত্মসচেতনতার উপকরণ হিসেবে। কবিতায় খণ্ডাংশ ব্যবহার যেন হয়ে দাঁড়ালো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের ইউরোপের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, এবং আধ্যাত্মিক বিভাজনের দর্পণ। [১] টি এস এলিয়টের “The Waste Land” তুলে ধরে এক ভেঙে পড়া শহরের যাপনচিত্র – কবিতাটি নিজেই বহু অংশে খণ্ডাংশে সাজানো, টুকরো হয়ে যাওয়া স্তবক এবং লাইন যেন সাংস্কৃতিক জঞ্জালের ঢিবি, যার মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে আধুনিক কালের মানুষ। এলিয়ট ছাড়াও এজরা পাউন্ড, এবং তার পরে আরো অনেক আমেরিকান কবি এই টেকনিক কবিতায় ব্যবহার করেন।

 টি এস এলিয়টের বিখ্যাত কবিতা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর পাণ্ডুলিপি থেকে

সমকালীন বাংলা কবিতা থেকে খণ্ডাংশ ব্যবহারের কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি।

আশ্চর্য গণনাতন্ত্রের তন্ত্রগণ বোঁটা
রক্তের আগে
যেটুকু পাখি
ছায়ানদীলাশ              নদীছায়াব্রণ
পৃথিবীরূপ পার্ক
বহাল হচ্ছে বিচারপতি        বাদামের খুনে
মালতী টুকটাক ছাড়িয়ে খাচ্ছে তাকে…  (বাদামের খুনে / সব্যসাচী হাজরা)

যদিও
সাক্ষ্যরা সব মৃত
ঠনঠনে খঞ্জনী বাজায় তুষার। চোখ বন্ধ করি।আমার ছায়াতে
                  বাহিত আমি
                  কালো ব্যাগ
ভেতরে বেহালা
খণ্ডকাব্যের ভেতরের সত্তা
বোধের সোনামুখি সুঁই
                    আর
মিহিসুতোয় সেলাই
একটা রক্তরঙ বাতাসে ভাসছে
নংপসুক সভ্যতার ভগ্নাংশের ফসিল
                                (“নিশ্চিত ভগ্নাংশবর্তী ভবিষ্যৎ ফসিল,” ইহিতা এরিন)

      (এখানে খণ্ডাংশের ব্যবহার হয়েছে একটু অন্যভাবে, কবিতার বড় লাইনের মধ্যে)

আমি ভীরু পায়ে কোথায় দাঁড়াই, একটা ছবি চাই ভাল,
জোড়া হংসের, একে অন্যকে চায় অথবা আমারই মাপতে ভুল,
তারা আসলে শেষ দর্শনে, আসলেই হানাহানি। এই যে জলের
ওঠানামা, লহরী, ঝিকিমিকি ছেঁড়া, আমি প্রতীক্ষায়,
পরিষ্কার লেন্সে উদগ্রীব, এইই আমার মৃদু জীবন।  (“হংসীরা”, অমিত চক্রবর্তী)

এর পরের ক্লাসে আমরা শিখব আরো কিছু টেকনিক। আজ এই অবধিই।

——————

বাড়ির কাজ

১) Enjammbent ব্যবহার করে ৪-৬ লাইন অক্ষরবৃত্তে লিখুন। অন্ত্যমিল ঐচ্ছিক (optional).
২) খণ্ডাংশ ব্যবহার করে অন্তত এক চরণ লিখুন। (৪ থেকে ৮ লাইন)

তথ্যসূত্র

১) Fragment: Explore the glossary of poetic terms. Poets.org. Available at:  https://poets.org/glossary/fragment#:~:text=A%20fragment%20is%20a%20part,to%20appear%20discontinuous%20or%20incomplete.&text=The%20following%20definition%20of%20the,from%20the%20whole%2C%20something%20imperfect.

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩), এবং “ভুলটা ছিল উপপাদ্যে, প্রমাণেতে নয়” (ই-বুক ২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" অনলাইন কবিতা পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *