আমার কালকূট ভ্রমণ - (শেষ পর্ব)
কালকূটের মনের মধ্যে ছিল একজোড়া পাখা, প্রায়ই সে ঝাপটা মারত, উড়াল দিতে চাইত। তার ফসল আমরা পেয়েছি তাঁর লেখার পাতায়। তিনি বলেছিলেন, “লিখি তাই ঘুরি নয়, ঘুরি তাই লিখি।” কার বাঁশি শুনে তিনি বারবার বেরিয়ে পড়তেন, তাকে তিনি চেনেন না, আমরাও চিনতে পারিনি, কেবল তাঁর লেখায় আমরা পেয়েছি অক্ষয় পরমানন্দের সন্ধান।
এবারের বাঁশি বেজেছে সুদূর গৌহাটি থেকে। এক বন্ধু থাকতেন, তাঁর ডাকে কালকূট চলেছেন গৌহাটি। কেবল গৌহাটি নয়, গৌহাটি যাবার সময়কার ট্রেনযাত্রার বিবরণও আকর্ষণীয় করে তোলার দায়িত্ব কালকূট যথাযথ পালন করবেন সেও কি বলার? প্রতিবারের মতো যথারীতি এখানেও এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর, নাম বিমলা পবিত্রী, যিনি একজন সাধিকা।সেই বিমলা পবিত্রী ও তাঁর সেবিকা জগতের সঙ্গে কালকূটের এবারের ট্রেনের আলাপ একটু অন্যরকম। একজন আদ্যন্ত নাস্তিক লোক, “মন করে কেবল খাজনা খাজনা, কে করে বলো আমার হরিভজনা”— এই যাঁর নীতি, তাঁর কাছে সাধন ভজনে অমাবস্যায় চাঁদের উদয় করতে পারে এমন সাধিকার আলাপ যে বিজাতীয় লাগবে, এ তো সহজ ব্যাপার। বোধহয় সেজন্যই কালকূটের এ রচনার নাম “অমাবস্যায় চাঁদের উদয়।” ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে জানার জন্য, কীভাবে বিমলা পবিত্রীর হাত ধরে অমাবস্যায় চাঁদের উদয় হয়। বহু কথোপকথনে, মনান্তরে, বিমলা মায়ের কোয়েই জর্দার গন্ধে, জগতের গানের সুরে ফুল ঝরাতে আর কালকূটের অনুভবী উদগ্র আগ্রহে যখন বিভোর হয়ে আছি আমরা, তখন হঠাতই রাত শেষ হয়ে এসে গেছে গন্তব্য। পুষ্পাবন পরবে নেমন্তন্ন পেলেন কালকূট, যে পরবে কামাখ্যার সঙ্গে উমানন্দের বিয়ে হয় আর তার সঙ্গে সুদ জুটল জগতের গান শোনার আমন্ত্রণও। আমিন গাঁয়ে নেমে স্টিমারে চড়ে যখন চলে যাচ্ছেন বিমলা মা, তখন কালকূটের মনে পড়ে প্রণাম করা হয়নি মা’কে। কালকূটের প্রণাম বাকী আর আমরা উদগ্রীব বাকীটুকু দেখার জন্য।
বন্ধুর আশ্রয়ে একটু থিতু হয়ে কালকূট যাত্রা করলেন কামাখ্যা। সেখানে প্রথম দর্শন পান্ডাদের সঙ্গে। তার আগে আমরা শুনে নিয়েছি কামাখ্যা নিয়ে পুরাণের কাহিনী। নরকাসুরের খনন করা পুষ্করিণীর জল মাথায় নিয়ে অতঃপর প্রাণতোষ ভৈরববাবার আশ্রমে প্রবেশ। এর ঠিক আগে গোপীনাথ চৌধুরীর মতো বিরল গোত্রের পান্ডার দেখা মেলে, যিনি আশ্রয় দেন অথচ প্রণামী নেন না। প্রাণতোষ ভৈরববাবার আশ্রমে জগত আর বিমলা পবিত্রী মায়ের সঙ্গে লেখকের পুনর্দর্শন হয়। আর সাক্ষাত মেলে আশ্রমের প্রাণপুরুষ প্রাণতোষ ভৈরববাবার। আশ্চর্য সে সাক্ষাৎ। কীভাবে অত বড় সাধকের সঙ্গে মন চেনাচিনি হয় কালকূটের, বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না। আসল প্রেমের সম্পর্ককে ঠিক একটি বাক্যে কালকূট ব্যাখ্যা করেন, ‘চাঁদের মতো অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাবো।’ মুগ্ধ হন অতবড় সাধক, সাধিকা – সঙ্গে আমরাও। বলা যায় এইখান থেকেই প্রাণতোষ ভৈরব শুরু করেন অমাবস্যায় চাঁদের উদয়ের ব্যাখ্যা। লেখকের সঙ্গে সদ্য দেখা হওয়া মস্ত সাধক প্রাণতোষ ভৈরব, সাধিকা বিমলা পবিত্রীর যে আলাপ জমে ওঠে তাকে অন্তরঙ্গ, আন্তরিক, হৃদয়বেদ্য ছাড়া কিছু বলা যায় না। প্রেমের সহজ ব্যাখ্যা দেন প্রাণতোষ, ‘আঁতের গরজ’ বলে, আকুল প্রেমিক কালকূট আদ্যন্ত মজেন, গোটা কাহিনীর মধ্যে কেবল এখানকার বর্ণনা তাই বোধ হয় বার বার পড়া যায়। যাই হোক, আবার আসবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নেন লেখক।
পরের দিনের অভিজ্ঞতা প্রথমে ভয়াবহ হলেও পরে ফুল ঝরানো। কামাখ্যা দর্শন, অপরূপ প্রকৃতির মাঝে জগতের গান যেন গাছে গাছে ফুল ধরাল। এই কাহিনি, শেষ হয়েও না হল শেষ – এর অতৃপ্তি রাখে মনে। অমাবস্যায় চাঁদের উদয় জিনিসটা প্রকৃত কী আমাদের দেখা হল না বটে, কিন্তু যে আভাস এ রেখে গেল অল্পেও, তার জন্য কালকূটের অন্যান্য কাহিনির মতো এরও প্রাপ্য একটি শব্দ – মুগ্ধতা।
“অমৃত বিষের পাত্রে” শুরু থেকেই অমৃত ঝরিয়েছে। হলাহলের নাম নিয়ে যে ‘হা অমৃত হা অমৃত করেছে,’ আমরাও তার যাত্রার শরিক হয়েছি যে। আর কালকূটের কৃতিত্ব এইখানে যে, বারবার রেলগাড়িতে চেপে মন সারাতে দূর থেকে বহুদূরে গেছেন, আমরাও গেছি, একঘেয়ে লাগেনি সে যাত্রা, পুনরাবৃত্ত হয়নি আগের বর্ণনা। প্রতিবার নতুন, বারবার দ্বিতীয়রহিত হয়ে ধরা দিয়েছে। এখানেও ট্রেন যাত্রা, ট্রেনে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মোলাকাত। তখনও জানতে পারিনি এবার যাত্রা দিল্লীতে। দিল্লিতে নির্বাসন নিতে গিয়ে টলটলানো বিষের পাত্রে কী অমৃত তিনি লাভ করলেন, সেটাই এই কাহিনির উপজীব্য। যাঁরা লেখকের নির্বাসন বিঘ্নিত করেছে তাদের সবার কথা থাক। কেবল রঞ্জিতা রিজভি বর্ণনার গুণে যে কাঁপন ও আগুন ধরায় তা মনে রেশ রেখে যায় বহুক্ষণ। তবু লেখকের চলতা নদীতে কোনো পলিই জমতে পারে না তা যতই উর্বর হোক। অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছেদের দাঁড়ি লেখক টেনে দেন হঠাৎ। কিন্তু স্বীকার করতে ভোলেন না নারীটির মাধুর্য, তাকে এই কাহিনিতে জড়িয়ে রেখে। আমরাও স্বীকার না করে পারি না, কালকূট লেখায় যেমন, জীবনেও তেমন। আড়াল আবডালরহিত স্বচ্ছ এক হীরক বিশেষ।
“তৃষ্ণা মিটে নাই” নিয়ে কী বলি? শুরুতে কালকূটের একটা নতুন রেলযাত্রা, গন্তব্য বোম্বাই হয়ে ঔরঙ্গাবাদ, সেই রেলের চাকায় লেগে গেল সহযাত্রিনী জেসমিনের রক্তের দাগ। কালকূটের সঙ্গে একই কামরায় ছিল হাফেজ, ইয়াকুব ও তার সহধর্মিণী প্রাণবন্ত জেসমিন। এই জেসমিন কেন একটি ছোট স্টেশনে নেমে আত্মনাশের সিদ্ধান্ত নেয় আমরা জানতে পারি না। একটু থমকাই বটে। কিন্তু কালকূটের গন্তব্যে পৌঁছনোর পর তাঁর পত্র-বন্ধু ফুলকলির তাঁকে নিতে আসা থেকে শুরু করে তার বাড়ির প্রতিটি সদস্যের পরিচয় যেভাবে পেলাম, মন প্রতি মুহূর্তে ভিজেছে, চোখ দুটোও বটে। ফুলকলিকে লেখক তার লেখা চিঠিতে চিনেছেন , বর্ণনার প্রসাদে আমরাও চিনলাম ভীষণ। কালকূটের অসাধারণ সাধারণত্বের বিপরীতে ফুলকলির অকপট সারল্য কী যে ভাল লাগার রেশ ছড়িয়েছে তা মুখে বলা যায় না। কেবল প্রথম আলাপের আন্তরিকতায় বন্ধু পুরন্দরের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে ফুলকলিদের বাড়িতে আসেন কালকূট। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফুলকলির সৌভাগ্য কালকূটের সমগ্র পাঠককুলের যেন পেতে ইচ্ছা করে এই মুহূর্তে।
পরের ঘটনা প্রবাহ করুণ বলব না অন্তরের নিভৃত ছুঁয়ে হৃদয়ের মাঝখানে প্রবেশ করাব তা নিয়ে দ্বিধা জাগে। শুধু এটুকু বলে রাখি অজন্তা ইলোরার নিভৃত স্বর্গীয় নিসর্গ ভোগ কালকূটের একক থাকে না, বন্ধু পুরন্দর ও ফুলকলি তাতে ভাগ বসায়। শেষ দৃশ্যের বিয়োগ ও বিচ্ছেদ, এই ঘটনার কুশীলবদের সঙ্গে আমাদেরও বাস্তবের কঠোর মাটিতে আছড়ে ফেলে, পুরন্দরের বন্ধু থেকে কালকূট শত্রু হওয়ার আগেই বোধহয়!
“তুষার সিংহের পদতলে” নিয়ে বলতে গেলে দুটি শব্দ বলতে হয়, ভাব আর অভাব। কালকূটের মতো ভাব আমার নেই সেখানে তাই অভাব, আবার ঐ লেখা পড়তে গেলে ঐরকম না ভাবলে চলে না, তাই আমাদের ভাব। লেখকের মেজদার বন্ধু দত্ত ও তাঁর পরিবার, মিলিটারির মিস্টার ঘোষাল, লেখকের পার্বতী, আগেকার উপন্যাস স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে টুকুন উঁকি দিয়েছে, কুশীলব হিসেবে তারা যথাযথ। কিন্তু কুন্দনন্দিনী কায়া রূপে দেখা দিয়ে যেভাবে বিশাল থেকে বিশালতর ছায়া হয়ে ছাইল, জবাব নেই তার। লেখকের নিজের কাছেও ছিল কি? সোনার খাজাঞ্চিখানা কাঞ্চনজঙ্ঘা, চঞ্চলা তিস্তা, তুষারসিংহকে কালকূট দুচোখ খুলে ও ভরে দেখেছেন, আমরা দুচোখ মুদে – তফাত এই যা। অমন করে দেখালে না দেখে উপায় কী! তবে কুন্দনন্দিনী নায়িকা হতে চেয়ে এই কাহিনীর নায়িকা হল না, সে প্রকৃতপক্ষেই আমাদের নিয়ে গিয়ে তুষার সিংহের পদতলে দাঁড় করালো, এছাড়া আর বলিটা কী! কুদোস কুন্দনন্দিনী আর ধন্য লেখনী কালকূটের।
“মন চল বনে।” চল যাই, কালকূটের সনে। কোথাকার বনে, না জেরাইকেল্লা; উড়িষ্যা আর বিহারের মাঝে যার অবস্থান। পথে ট্রেনে তিপুদের পরিবারের সঙ্গে দেখা। তিপু সেই কিশোরী যে পড়েছে কালকূটের বই, তার বাবার সঙ্গে তাদের দাওয়ায় বসে গল্প করে গেছেন বনদেব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর লেখক চলেছেন তাদের বাড়ির কাছে তাঁর বন্ধুর ভাই গোপালের বাড়ি। গোপালের ভাই নিতু তাঁকে নিতে আসে স্টেশনে। গোপালের বাড়ি গিয়ে জেমার সঙ্গে আলাপ। সেখানে কিছু বিশ্রাম নিয়ে অনবরত বনভ্রমণ। ওহে বনবিলাসী বনপ্রেমিক মন রেখো মনে। তিনি আমাদের একথা বলে সাবধান করেও বর্ণনায় ক্রমশ নিয়ে গেছেন বনাভ্যন্তরে। উইলিয়াম সাহেবের বাড়ি, সিংজীর বাড়ি, ট্রেনে আলাপ হওয়া তিপুদের বাড়ি, ইস্পাতস্বচ্ছ কোয়েল নদীর ধার, লরি করে ছোটনাগরায় ভেতরে যাওয়ার সময় – এক এক জায়গায় এক এক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করল আমাদের। নিতু-তিপুর অনবরত খুনসুটি, কানে তালা দেওয়া ঝিল্লিরব যা আসলে ঝিল্লিক্রন্দন বলে পরিচিত, বনবাসিনী নার্স তৃপ্তির বিষণ্ণতা লেখককে যত স্পর্শ করেছে আমাদের তার চেয়েও বেশি, কেবল বর্ণনার গুণে। ‘বনের সঙ্গে খেলা’ এর পরের অংশ যেখানে লেখক যাচ্ছেন এদেলবা, যার অর্থ শিমুলফুল। তিলুয়া নামের ফুলের মাতাল গন্ধে, মধুফুলের দুলে, রাধারাণী তিপুর চুলে গুঁজে দেওয়ার সময় যে মুহূর্তগুলি তৈরি হয়েছে তা মনে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো।
‘শিমূল পাগল হইয়া মাতে, অজস্র ঐশ্বর্যভার ভরে তার দরিদ্র শাখাতে।’ এদেলবা। শিমুলফুল। আর সুরসতিয়া। না আছে বিভূতিভূষণের ঝমঝমানো জ্যোৎস্না, না আছে সেই আরণ্যক বনদেবের ছায়া হতে চাওয়ার কণামাত্র চেষ্টা। কেবল মানুষ থিকথিক করছে, বনের গাঢ় আঁধারে ঝলমলানো আলোয় ঝিলমিল করেছে তাদের জীবনযাত্রা। সেই ঝলমলানো আলোয় কোনও নিয়নের কৃত্রিমতা নেই, তা আসলে কালকূটের অন্তরের ঐশ্বর্যে ভরা। এর আগের অংশ অর্থাৎ “মন চল বনে” পড়ে নেওয়া আবশ্যিক, কারণ নাগরিক জীবন থেকে বনে প্রবেশ করার মুহূর্তে বননিবিড় জীবন কেমন সেটা না বুঝে নিলে প্রকৃত বন্য জীবনের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম ফারাকটা বোঝা যাবে না। সূক্ষ্ম অর্থে সামান্য নয়, বরং অসামান্য। বননিবিড় জীবনে ছিল নিতু, তিপু, গাঙ্গুলি মশাই, সুরীন, জেমা, গোপাল। আর বন্য জীবনে সুরসতিয়া, সূর্যমণি, সুরসতিয়ার দিদি, ওদের তৈরি ডিয়েং, তিলুয়া ফুল, মারিং। যেখানে বছরের পর বছর জঙ্গলের কারবারি হয়ে বন্য নাগরিকতা আপন করতে পারে না মোহন, মাত্র এক রাতে আন্তরিকতায় আর অকপটতায় কালকূট হয়ে ওঠেন ওদের অংশ। কালকূট তুমি কার? বনের। বনের সঙ্গে খেলতে গেলে বন্য হতে হয়, শহুরে লজ্জা আর কূটকচালিকে নিয়ে চলা যায় না সেখানে। পাথরে কোঁদা বনদেবী সুরসতিয়ার সঙ্গে অলৌকিক বন অবগাহনের আনন্দ পূর্ণ লাভ করে বিদায় নেবার সময় সুরসতিয়াকে জানতে দিতে চান না কালকূট, জানিয়ে বিদায় নিলে বিদায়ের মহিমাকে খর্ব করা হয় যে। তিনি সেই কৃষ্ণকামিনীর ঘুমন্ত পায়ে রেখে যান তাঁর প্রণাম, যা আসলে অনন্ত প্রীতির নামান্তর। আমরাও তাঁকে প্রণাম জানাই এত দূর থেকে, তাঁর মুগ্ধ ভবিষ্যৎ থেকে। তিনি বনে ফেলে এসেছেন বিষণ্ণ তৃপ্তি, তিপুর সজল মুখ আর সুরসতিয়া। তৃপ্তির নাম শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, তিপুর ভাল নাম তৃপ্তি নয় তো? আমারও মনে হয়েছিল বটে। ওরা সবাই যেন একাকার এই বনে। অপূর্ব এই আরণ্যক কাহিনী, অথচ ভীষণ মৌলিক, অন্যপূর্ব নয়।
শাম্ব হল জাম্ববতীর পুত্র। জাম্ববতী কৃষ্ণ জায়া। শাম্ব কৃষ্ণপুত্র। অসম্ভব রূপবান এক পুরুষ। রূপ থেকে কুরূপে যাত্রা আর সেই যাত্রা ফেরতের কাহিনী লেখা আছে শাম্বতে। মন চল ভ্রমণের মাঝে হঠাৎ পুরাণ কেন? তবে বুঝি মন চলো পুরাণে। পুরাণে মানে পুরনো যুগে, সময়ঘড়ি বেয়ে, ঐখানে আছে নারদের অভিশাপে শাম্বর কুরূপ লাভ ও সুরূপ ফেরতের কাহিনি।
রূপবান শাম্ব রমণীমোহন ছিলেন সর্বার্থেই। এহেন রমণীরঞ্জনের সময় তার চোখে পড়ে না মহর্ষি নারদের আগমন। মহর্ষি রুষ্ট হন এবং কৃষ্ণের কাছে মন্ত্রণা দেন শাম্বকে কৃষ্ণ রক্ষিত ষোলহাজার গোপিনী কামনা করেন। কৃষ্ণের অবিশ্বাসে একদা গোপিনীদের স্নানের সময় শাম্বকে সেখানে ডেকে আনেন, সত্যই তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দেখে রুষ্ট হন কৃষ্ণ, শাম্ব ও গোপিনী উভয়ে অভিশাপপ্রাপ্ত হন তাঁর দ্বারা। রূপবান শাম্ব পান ভয়ানক কুষ্ঠরোগের অভিশাপ। সেই অভিশাপমুক্তির উপায় হিসেবে তিনি বলেন চন্দ্রভাগা নদীর তীরে গিয়ে তপস্যা করতে। শাম্ব পিতৃ অনুমতি নিয়ে সেখানে যান, এবং রোগমুক্ত হন। যত সহজে বলছি মুক্তিলাভ তত সহজ ছিল না। তবে রূপবান এই বৃষ্ণিসিংহটির কুরূপ থেকে সুরূপযাত্রা পেশ করার ভঙ্গিটি এতই আন্তরিক ও মনোলোভা যে, ভাল না লেগে পারা যায় না।
‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ, কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রেমের ফাঁদ।’ কালকূটের চিরপ্রেমিক সত্তার জন্য যেমন এই কথা ঠিক, তেমন তাঁর বনপ্রেমের জন্যও। বন মনে ঢুকেছে মানে রেহাই নেই। বনে প্রেম, মনে বন। সেই প্রেমে মশগুল হয়ে কালকূট সিংজির সঙ্গে যাত্রা করছেন এদেলবা থেকে থলকোবাদের দিকে। এদেলবায় ফেলে এসেছেন বনবালা সুরসতিয়াকে, যে তাঁকে দিয়েছে অকপট আত্মসমর্পণের আনন্দ। থলকোবাদের রাজকীয় বাংলো কী নিয়ে অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য সেটাই এবার দেখার।
এখানে তিনি সিংজীর অতিথি। জরাইকেলায় থাকার সময় আমরা শুনে নিয়েছি সিংজীর বিলাসপ্রাচুর্যের মধ্যে থাকা কাঁটাগুলির কথা। একমাত্র ছেলে পোলিওয় আক্রান্ত – টাটায় চিকিৎসাধীন, প্রেমিকা সীমা এখন জার্মান সাহেব ফিলিপের বক্ষলগ্না। সিংজীর বিবাহিত জীবন, ছেলের রোগ, সীমার সঙ্গে আলাপ থেকে অন্তরঙ্গতা, সব আমরা বাংলোর বারান্দায় বসে শুনি কালকূটের সঙ্গে। অনুভব করি, যিনি শুনছেন, তিনি কালকূট নাম নিলেও যিনি শোনাচ্ছেন তিনিও কালকূটের চেয়ে কম নন, কমবেশি একইরকম বিষজর্জর। এরই মাঝে চমক লাগে, সেই বাংলোয় পরের দিন ফিলিপের সঙ্গে সীমা আসার কথা শুনে।
চমকের আরও কিছু বাকি ছিল। পরের দিন থলকোবাদের বাংলোয় তৃপ্তি আসে, সেই তৃপ্তি, যে বনবিভাগের নার্স, যার পরিবার পড়ে রয়েছে বেহালায়। বনের সঙ্গে একাত্ম হওয়া লেখকের সবুজ মন যখন উত্তরোত্তর সজীব হচ্ছে হঠাৎ পাওয়া এই বন্য অকপট আন্তরিকতায়, ঠিক তখনই ধাক্কা! অজিত সিং গত দু’দিনে ওথেলো আউড়েছে বহুবার, উচ্চারণেও জ্ঞানে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে, লেখকের কান হয়ে আমাদের কান দিয়ে মরমে পশেছে সেসব। কিন্তু… শেষদিনের নাচের উৎসবের শেষে যখন সিংজীর গলায় ওথেলো শোনা যায়, হুজ ব্রিদ ইনডিড দিজ হ্যান্ডস হ্যাভ নিউলি স্টপড, তখন বাস্তবিকই থেমে গেছে সীমার জীবন, হয়তো অজিতের ধাক্কায় খাদে পড়ে গিয়ে। ফিলিপের চিৎকার সীমার আর্তনাদে মিশেও লাভ হয়নি, এতই মর্মন্তুদ এই কাহিনীর শেষ। সবাইকে ফিরতে হয়। লেখকও ফিরলেন। প্রেম নামে বন তাঁর না ফিরতে চাওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকে।
‘ঘরের কাছে আরশিনগর’ বহুদূরে নিয়ে যায় না, বেঁধে রাখে কাছে। এবার সেই মেমারিতে যাত্রা, আবার। ভাবতে গিয়ে রোমে হর্ষ উৎপাদন হয়। বৈঁচির পরে দেবীপুর, তারপর বাগিলা, তারপর মেমারি আর ঐ বৈঁচিতে আমার বাড়ি। রোমে হর্ষ জাগবে না! পরের অনুচ্ছেদে চমক, রোমে হর্ষ জাগার কিছু বাকি ছিল তখনও! বৈঁচিগ্রামের ব্যারেলা (আমাদের অবিকল এই উচ্চারণ), বৈঁচি, বৈদ্যপুর সবই বিরাজমান, কালকূটের কলমের ছোঁয়ায় তারা প্রাণ পেয়েছে। আমাদের মেমারির ‘ম্যামারি’ উচ্চারণ কালকূট খেয়াল করেছেন ও লিখেছেন, এও এক হর্ষ জাগানোর বিষয় বৈকি!
এবারের গন্তব্য কাছে আগে বলেছি। মেমারিতে নেমে যেতে হয়, শুঁড়া দুর্গাপুর, কালকূটের বন্ধুর শ্বশুরবাড়ি। তবে তার আগে সেই বন্ধুর কনে দেখার বিবরণ বেশ মনোলোভা। বন্ধুর শ্যালিকা পঞ্চমী, শ্বশুরমশাই চাটুজ্যেবাবুর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক কখন গড়েছে তা টের পাইনি আমরা। এবারে ট্রেন নয়, ভাঙা মোটর গাড়ির যাত্রার বিবরণ হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়েছে। আবার এইখানে এই যাবার পথের হরেক দৃশ্য আমাদের চোখে বুনে দেন কালকূট অবলীলায় – বিশাল এক ঝাঁক চড়ুইয়ের কালো জালের মতো আকাশ থেকে এসে পড়া, কবুতরদের ঝাঁপাইঝোড়া, গোরুর গাড়ির মুখোমুখি লজঝড়ে মোটর গাড়ির ভীষণ সর্বনাশের আশঙ্কা, পুকুরের পাড় দিয়ে যাবার সময় গাড়ির জলে পড়ে যাবার ভয় – সব মিলিয়ে এত সুপাঠ্য সে বর্ণনা যে সুদূর ট্রেনযাত্রার বিবরণের সঙ্গে একাসনে বসতে পারে তা। এত সুপরিচিত দৃশ্য এমন সোনালি মোড়কে মুড়ে পরিবেশন এ জাদু যে তাঁর ভীষণ করায়ত্ত এতো বারবার আমরা দেখেইছি। গন্তব্যে পৌঁছনোর পর সেই সুখ সোনার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হন লেখক। সেই সান্নিধ্যের শান্তি। বন্ধুর শ্বশুরবাড়ির গ্রামীণ লোকেদের আন্তরিকতায় ফের তাঁর হৃদয় জুড়োনোর পালা। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “গ্রামীণ রূপের এই স্নিগ্ধ স্বরূপে, আমার দুচোখের নজর নগর ছাপিয়ে আর একটা অরূপ হৃদয়ের দুয়ার খুলে গেল।”
…জীবনে রাঢ় বঙ্গের কিঞ্চিৎ গ্রাম আমি আনা যানা করেছি। অতিথি হিসাবে আশ্রয় পেয়েছি নানা গৃহে। কিন্তু মাঘের শীতার্ত অন্ধকার আকাশের আবছায়ায় তারার ঝিকিমিকি, উঠোনের ওপর বিশাল এক আমগাছ, একপাশের দুটো মরাই, একটি ইঁটের পাঁচিল, আর খানকয়েক ঘর ঘিরে একটি ছোট উঠোন, কাঠের, খড়ের ধোঁয়া, আর কেরোসিনের হারিকেন লম্ফর গন্ধ ছড়ানো, এই সব কিছুর মধ্যে বড়দির ছেলে খুদে বালক দুখু আর একটি মুনিষ ছাড়া কোনো পুরুষ নেই এমন গৃহের কথা মনে করতে পারি না।… “লেখকের নজর নগর নিভৃত যতনে কত কী লক্ষ করে সূক্ষ্ম বিশদতায় মন ভরিয়েছে এমন, তা নিয়ে বারবার আর কী বলি! আহা!
এরপর শ্রীচৈতন্যদেব চরণধূলি ধন্য কুলীনগ্রামের মেলা, সেখানে বাড়ির মহিলামহলের বিশেষত রাণীদির নতুন এক রূপ দর্শন, পবনের ভাবী বৌ দুর্গার সাক্ষাত পাওয়া এমনকি চাটুজ্যে বাড়ির মেয়েদের রেশমি চুড়িতে হাত সাজানো সব কিছু ছবির মতো দেখি যেন সেই অপরূপ বর্ণনার খাতিরে। মেলা থেকে ফিরে এসে শঙ্করের শ্বশুরমশাইয়ের, তাদের আসার খবর শুনে সুদূর চাকরি স্থল থেকে ছুটে আসা, চোখের জলে আপ্যায়ন লেখকের কাছে এক অরূপ হৃদয়ের গলন ছাড়া কিছু মনে হয়নি। স্বাভাবিক। অরূপ হৃদয়ের গলন অপরূপ হৃদয় ছাড়া বুঝতে পারে সাধ্য কার? কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঐ বাড়ির সব সদস্যের ভবিষ্যৎ পরিণতি দেখতে পাই, শেষ হয় কাহিনি।
পরবর্তী কাহিনি “মন ভাসির টানে।” এ লেখার সামনে একটা “কচকচি” আছে লেখকের ভাষায়। ‘কচকচি’ বলতে যদি ভূমিকা বোঝায় তো তাই। কেউ তা নিয়ে তর্ক করতে বসলে তা নিয়ে লেখকের কিছু যায় আসে না। তবে সেই কচকচি করতে গিয়েই অকপটে কালকূট বলেছেন তাঁর বেড়ানোর বিবরণ বলতে তাঁর চলন বলন বিবরণ। যা হোক, নিজের দেওয়া মনভিখিরি আখ্যায় এবার তিনি চুঁচুড়োর ভেতর দিয়ে ত্রিবেণী বাঁশবেড়ের পথে। বাসে যেতে যেতে হঠাৎ দেখা গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা এক সবুজ চরের হাতছানি এড়াতে পারেন না লেখক, নেমে যান, নৌকোয় চড়েন, মাঝি মরদ ও এক বুড়ির সঙ্গে বাতচিত করতে করতে পৌঁছে যান সেই চরে। জানা যায় মাঝির নাম ভরত, ঐ বুড়ি তার নানী। চরে পৌঁছনোর পর অন্য গল্প। মহৎ শিল্প, অনন্য ভাস্কর্য এসবের সামনে নত হতে দেখেছি লেখককে, কিন্তু গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা এক সামান্য চর-ও বর্ণনায় অসামান্য করলেন তিনি। তাঁর এই মন-ডুবের খেসারতও দিতে হল। তাঁকে না নিয়ে ফেরত এল নৌকা। অবশ্য ঐ চরের বাসিন্দারা, নুরী তাঁকে দিল মন গুণে ধন – সেই অন্তরের মাধুর্য, যা ভরে দিয়েছে তাঁকে বারবার, দেবেও, বলা বাহুল্য।
“মুক্ত বেণীর উজানে”-তেও,গন্তব্য কাছেই। ত্রিবেণীর গাজীর দরগা দেখার আগে রিফ্যুজি মেয়েদের ‘নিখুঁজি’ শব্দে অভিহিত করা বুড়ো, নতুন একটি শব্দ লেখকের কলমে তুলে দেয় শুধু তাই নয়, আমাদেরও চমৎকৃত করে ভাবায় রিফ্যুজি আর নিখুঁজি – অর্থে একাকার প্রায়। জাফর খাঁ গাজীর তৈরি মসজিদ দেখতে গিয়ে ফের মন-ডুব দেন লেখক, ইতিহাসের আনাচ-কানাচ ঘুরে আসেন দীর্ঘক্ষণ, ততক্ষণে সঙ্গ নেওয়া লোকটি অর্থাৎ এমদাদ সঙ্গী হয়ে উঠেছে। গল্প, ইতিহাস, গানে যখন জমে ওঠে এক অসম অথচ আন্তরিক আড্ডা, তারও শেষ হয়, লেখক পা বাড়িয়েছেন অন্য কোথাও যাবেন বলে। এর পর চমক। ত্রিবেণী শ্মশানের পানে শবদেহ নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন চার নারী, আরও চমক এরপর। তাদের মধ্যে একজন নিতান্ত অপারগ হয়ে ডাকেন লেখককে সেই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লেখক কী করব কী করব না ভাবতে ভাবতেই দেখেন সেই দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন। চমকের শেষ হয় যখন জানা যায় সেই মৃতদেহ এক বারাঙ্গনার। এরপর এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হই আমরা। শ্মশানের ক্রিয়াকর্ম সেরে দুটো অন্নগ্রহণের বন্দোবস্ত হয় গৌরহরি চক্রবর্তী নামে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে যেখানে তাঁর মুগ্ধ পাঠিকা বসে আছে চক্রবর্তী মশাইয়ের মেয়ে হয়ে, সে নাম শুনেই বুঝেছিল, সবাইকে জানাবার দায়িত্বও সে নয়। চক্রবর্তী মশাইয়ের বাইরে কঠোর অথচ ভেতরে তপতপে নরম এক অপরূপ হৃদয়ের সঙ্গে মোলাকাত হয় লেখকের। আরেকটা শব্দ যোগ হয়, বারাঙ্গনার শবদেহ কাঁধ দেওয়ায় লেখককে কর্মনষ্ট শ্রেণিতে ফেলেন গৌরহরি, যাঁর মেয়ের কাছে জানা যায় তা আসলে কমিউনিস্ট শব্দের অপভ্রংশ। শব্দের ভাঁড়ার ভরানোর দায়িত্ব যদি কালকূটের মতো মাস্টারমশাই নেন, সেখানে এইসব হিরেমোতি ছড়ানো থাকবে সে ব্যাপারে আর কী বলার? যা হোক, সেখান থেকে বিদায় নিয়ে লেখক শ্মশানে আসেন ক্ষ্যাপা বাবার সঙ্গে সাক্ষাত করতে। তাঁর আন্তরিকতার হৃদয়বেঁধা বন্ধনে বাঁধা পড়ে তাঁর সঙ্গে নৌকোয় ভেসে পড়েন লেখক যখন, তখন বুঝি এইভাবেই চলার গতি কালকূটকে দিয়েছে চলমানতার অপূর্ব আনন্দ, যার রসে জারিত হয়েছি আমরাও।
“চলো মন রূপনগরে” ঠিক এর পরের কাহিনি যেখানে খেপা বাবা বা শ্যামা বাবার আশ্রম থেকে ফিরছেন লেখক, পথে পড়েছে কুন্তী নদী, সে নামিয়ে নেয় তাঁকে যেন এক অমোঘ টানে। সে ছিল মাঘের কথা, এখন চৈত্রের শেষ। সেই টানে ফের আসা কুন্তীর কাছে। এবার কুন্তীর ধারে ঠিক নয়, নদী পেরিয়ে ডুমুরদহ স্টেশনে নামা। পুবে নিবিড় গাছপালার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া উত্তরে বাঁক নেওয়া রাস্তায় যাওয়া তারপর।পথে অম্বিকা বাঁড়ুজ্যের মতো লোকের সঙ্গে সাক্ষাত, যিনি একদিন স্বচক্ষে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথের দর্শন আর শ্রুতির মধ্যে শ্রুতিকাতরতা তিনি মনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, বইয়ে ডুবে থাকেন, চেনেন কালকূটকেও। গ্রামের সামান্য এক মানুষের ভাব গভীরতায় ও আলাপে অন্তরের ছোঁয়া পেয়ে শেষে আপনাআপনি তাঁর পায়ের ধুলো কালকূট মাথায় নেন। তাঁর কাছে খোঁজ নিয়ে গোলকদাস বাবাজীর আখড়ায় আসেন শ্রীপুরে। গঙ্গার ধার, শুক্লা অষ্টমীর জ্যোৎস্না , নিস্তব্ধচরাচর – গোলকদাস বাবাজীর আখড়ায় আপনাআপনি হারিয়ে যান কালকূট, ভেতরটা আবেগে থইথই করে ওঠে। সেখানে প্রকৃতি মনোহরার মুখে পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব কথা কেড়ে নেয় কালকূটের। শেষরাতে যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন গোটা আখড়া তখন মজেছে কালকূটের। সেখান থেকে মন চলে পুরনো ডেরায়, শ্যামাখেপার আশ্রমে। ওখান থেকে পালিত মেয়ে গঙ্গাকে নিয়ে বেলেরহাট যাত্রা, সেখান থেকে বুড়োরাজের গাজনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে কালকূট যাত্রা করেন নিমাইয়ের সন্ন্যাসস্থানে। গঙ্গা একা ফেরে আশ্রমে।
“পিঞ্জরে অচিন পাখি” শুরু হয়েছে, কালকূটের সেই, “ত্বরায় চলো হে ত্বরায় চলো” নীতির গুনগুন দিয়ে। অদ্ভুত সে যাত্রা। বিজ্ঞাপন জগতের টাইকুন অনঙ্গ মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বা এ এম জি হঠাৎ দেখা করতে আসেন কালকূটের সঙ্গে। তিনি কতগুলি পুরাণের লেখার বরাত নিয়ে আসেন কালকূটের কাছে। তারপর সে সঙ্গ নেয় লেখকের। কিন্তু অবাধ সে সঙ্গ হতভম্ব করে দেয় লেখককে। তাঁর মতো শিক্ষিত, নৈয়ায়িক পিতা ও অধ্যাপক পরিবারের ভদ্র সন্তান সন্ধের পর কীসের বশে অবাধ নারীসঙ্গ করে, ঘরে উপযুক্ত স্ত্রী সন্তান থাকা সত্ত্বেও বশ হয় তা বুঝে উঠতে পারেন না তিনি নিজে, কালকূটও। প্রকৃতির বশ কালকূট দেখেন প্রবৃত্তির বশ অনঙ্গমোহনকে। এই যাত্রাও আশ্চর্যের বটে!
কালকূটের অকপট কলম বারেবারে ব্যক্ত করেছে সাহিত্য জীবন সহিতে যায়। প্রতি শব্দে, প্রতি অক্ষরে। কালকূট একজায়গায় লিখেছেন “মাল সে যেমনই হোক কে না আপন মালা বিকিয়ে খায়? আমার জীবন কি তার থেকে বাদ? মালাগাছি বিকোতে গিয়ে অনেক পরখের পরেও স্নেহহীন চিত্ত নিয়ে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু মন টলানো নজর? সে আবার কী? যতদূর জানি সেও তো আমার মালা গাঁথা, মালা বেচা সব কিছুর সঙ্গে জড়ানো। আর টলাই না নিজেই টলি? এখন তো কারো কৃষ্ণ কালো চোখের তারায় আমি নিজেই মন্ত্রমুগ্ধ।” জীবনের সঙ্গে সাযুজ্য রাখা এহেন আন্তরিক সত্য কেবল মুগ্ধ বা বিস্মিত করে না, তাঁর পায়ে মাথা ছুঁইয়ে বলতে বাধ্য করায়, “সহস্র প্রণাম তোমায়, কালকূট।”
সুনীল একবার লিখেছিলেন, অনেক দূরে সমুদ্রের মাঝখানের একটা দ্বীপের মধ্যে একটা দামী মুক্তো আছে। আমরা যারা লেখালিখি করি তারা সবাই আসলে ঐ মুক্তোটা পেতে চাই।
উঁহু। না। মুক্তো নয়, একটা সোনার কলম তুলে রাখা আছে কোথাও। সোনার নিব, হীরে জহরত আর যতরকম মণিমুক্তো দিয়ে বাঁধানো। ঐটা পেতে চাই। ঐটা।
“মাল সে যেমনই হোক কে না আপন মালা বিকিয়ে খায়?” আহা!
কালকূট, আপনাতে মুগ্ধ ভবিষ্যৎ আপনার সামনে জানু পেতে বসে রয়েছে, অবনতমস্তকে। আপনি যুগ যুগ তাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করুন, এই প্রার্থনা।
আমার কালকূট ভ্রমণ শেষ হল এখানেই। তবে যে যাত্রা শুরু করেছিল, সে-ই ঘরে ফিরল কি? কে জানে!