সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা পঞ্চম পর্ব

সৃজনী লেখার ক্লাস – কবিতা লেখা
পঞ্চম পর্ব

অবসরে প্রকাশিত চতুর্থ পর্বে আমরা পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি আধুনিক কবিতায় প্রায়শই ব্যবহার করা হয় এরকম কিছু কলাকৌশল বা টেকনিকের, যেমন,

১) Enjambment – পংক্তিপ্রবাহের ধারাবাহিকতা অর্থাৎ এক পংক্তি থেকে অন্য পংক্তিতে বিরতি ছাড়া ধারাবাহিকতা

২) Fragments বা কবিতায় খণ্ডাংশ ব্যবহার

এই পঞ্চম পর্বে আমরা শিখব আরো কিছু টেকনিক।

৩) কবিতায় বড় লাইনের ব্যবহার

 কবিতায় বড় লাইন ব্যবহার করার পথিকৃৎ বোধহয় Walt Whiman (উনিশ শতকের বিখ্যাত আমেরিকান কবি, যার আব্রাহাম লিঙ্কনকে নিয়ে লেখা “O Captain, My Captain” আমাদের সময়ে হাইস্কুলে পাঠ্য ছিল)  – Allen Ginsberg তাঁর “Salutaions to Fernando Pessoa” কবিতায় যে স্টাইলকে আদর করে বলেছেন –

“… method particularly longwinded, diarrhea mouth some people say…”

উইটমানের একটা কবিতা তুলে ধরছি, যেটা পুরো কবিতাটা এক চরণে, এই কবিতাটায় আমরা ফেরত আসব পরেও আবার।

When I Heard the Learn’d Astronomer
WALT WHITMAN

When I heard the learn’d astronomer,
When the proofs, the figures, were ranged in columns before me,
When I was shown the charts and diagrams, to add, divide, and measure them,
When I sitting heard the astronomer where he lectured with much applause in the lecture room,
How soon unaccountable I became tired and sick,
Till rising and gliding out I wander’d off by myself,
In the mystical moist night-air, and from time to time,
Look’d up in perfect silence at the stars.

বড় লাইনের ব্যবহার কবিতার গতি হ্রাস করতে পারে, একঘেয়েমির একটা চিত্রকল্প আঁকতে পারে, বা কবিতাকে স্নিগ্ধ করতে পারে। বাংলা কবিতায় এই ধরনের শৈলী দেখতে পাওয়া যায় অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতাতেই। যেমন, এই টেকনিকে সিদ্ধহস্ত ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শম্ভু রক্ষিত, এবং তুলনামূলক ভাবে কম পরিচিত শঙ্করনাথ চক্রবর্তী।

ওঁদের লেখা থেকে নীচে তিনটে উদাহরণ দিচ্ছি –

১)
আমি লাল রঙ পরিমিতভাবে সূর্যকিরণের মত সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি
শঙ্কুর মত ধূসর ছাইরঙের কিছু গ্রাম, কিছু শহর দেখা যাচ্ছে
গড়িয়ে পড়ছে রঙিন ঘাসের ঘোড়া
আমি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি-অনুসন্ধানযানের ওপর শুয়ে প্রতিধ্বনি খুঁজছি।
(শম্ভু রক্ষিত, “চিন্তন”)

২)
লোকজনের স্বভাব-টভাব আজো ঠিক সেইরকম আছে কিন্তু
হক্ কথা বললেও ফুটো খুঁজে অন্দর দ্যাখে
মানতে চায় না, ভেবে দেখবে বলে হাত চেপে আঁধারের কাছে নিয়ে পকেট পালটায়,
মুখে-মনে, টাকা থেকে চাবি আর চাবি থেকে টাকার প্রসঙ্গ !
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়, “আবার একা একা সেই ঘরের পাল্লা দুটোর মতন”)

৩)
প্রিয় অক্ষরগুলিকে একদিন কার্পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে জল বাতাস
শস্যের খোঁজে আমি অলিগলি রাঁড়পল্লী পার হয়ে মলিদাচূর্ণ
ও গেরোবাজ হায়না, ঢুকে পড়েছি আবহমান কোনো গাঁজার আড্ডায় –
শ্রীমৎ দোম আন্তোনিও ও কতিপয় ছেঁড়া ব্রাহ্মণের সঙ্গে অতঃপর
ফাটা মাছ, অর্কবীজ, যোনিমনস্কতা বিষয়ে আলাপ শুরু হয়েছে
আমার…
(শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, “এইসব অক্ষরের জন্য”)

অন্যদিকে তুলনা করুন মল্লিকা সেনগুপ্তের এই কাব্যাংশটির সঙ্গে, যেখানে ছোট বাক্যাংশ দিয়ে পংক্তি গড়ায়, কবিতার গতি অনেক বেশি –

কুয়াশা ঘিরে নিল, নৌকো ঢেকে নিল, বাতাসে খুলে নিল তন্তুবাস
আমি তো জলনারী, ভীষণ ভয় পেয়ে খুঁজছিলাম কোনও নির্ভর
একটি ডিঙি ছিল আমার সঙ্গিনী, সবুজ ভাগীরথী শিক্ষিকা
আমাকে দিয়েছিল শ্যাওলা পায়জোর, দিয়েছে সারা গায় পলির ঘ্রাণ
তখন ঝড় এল, তখন মেঘ এল, বর্ষাজল যেন নামবয়ে ঘাসে
কিন্তু নামল না, এগিয়ে এল এক কৃষ্ণরূপ মেঘ আমার দিকে
(মল্লিকা সেনগুপ্ত, “সূর্যস্পর্শা”)

৪) পংক্তির গোড়ায় পুনরাবৃত্তি (Anaphora)

পুনরাবৃত্তি কবিতার বিন্যাস বা texture এর জন্য অপরিহার্য। কিন্তু একটা বিশেষ শৈলীসম্পদ হচ্ছে, পুনরাবৃত্তি করা পংক্তির গোড়ায়।

আমরা দেখেছি Walt Whitman এর কবিতায় আগে –

When I heard the learn’d astronomer,
When the proofs, the figures, were ranged in columns before me,
When I was shown the charts and diagrams, to add, divide, and measure them,
When I sitting heard the astronomer where he lectured with much applause in the lecture room,

চারটি লাইনই শুরু হচ্ছে When শব্দটি দিয়ে, এটি একটি anaphora র বিশেষ উদাহরণ। উইটমান এখানে এই শৈলী ব্যবহার করেছেন, ক্লাসরুমের একঘেয়েমি বর্ণনা করার জন্য।

বাংলা কবিতায় এই anaphora র ব্যবহারে অতিশয় দক্ষ ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় – একটা উদাহরণ নিচে দিচ্ছি –

তুমি তোমাদের সেই হলুদ বাগানে জল দিচ্ছ এখন
এখন তোমার পায়ের পাতায় পড়েছে কাদা জলের ছিটে

এখন তোমার মুখের উপর এসে পড়েছে তালতমালের আলো
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়, “তাঁকে চিরদিন পাওয়া যায় না”)

এখানে শক্তির anaphora ব্যবহারে কবিতাটি স্নিগ্ধতায় ভরেছে, একঘেয়েমিতে নয়।

৫) কবিতার প্রথম পংক্তি

কবিতার প্রথম লাইন বিশেষ গুরুত্ব পায় যে কোনো কবিতায় – সর্বদাই পেয়েছে – তবে ইদানীং চঞ্চলমতি সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, এটির তাৎপর্য যেন বেড়েছে অনেকগুণ। প্রথম লাইন পাঠককে বেঁধে রাখবে পুরো কবিতাটা পড়ার জন্য, এমনই আমরা চাই। তার জন্যে প্রথম লাইনে থাকতে হবে হয় রহস্য বা বিস্ময় অথবা একটি মনভোলানো চিত্রমালা যেটা বাস্তব বা রূপকে বর্ণনা করা। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক –

১) অষ্টপ্রহর তোমার খবর নিতে আমার কাছে লোক আসছে (শক্তি চট্টোপাধ্যায়, “আবার একা একা সেই ঘরের পাল্লা দুটোর মতন”) – রহস্য

২) বকুল গাছের নীচে অকস্মাৎ নেমেছিল প্রেত (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, “বকুল গাছের নীচে”) – বিস্ময়

৩) মহিলাসাংবাদিক তাঁর দুই নয়নের নীল কাজল (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, “আজ, এই নিখিলে”) – চিত্র, বাস্তব 

৪) সবুজ পাতার মতো ভালবাসা জেগে ওঠে প্রৌঢ়ের গভীরে (মল্লিকা সেনগুপ্ত, “শ্যাম মহীরুহ”) – চিত্র, রূপক

৬) কবিতার শেষ লাইন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “প্রথম আলো” বইতে রবি ঠাকুরের “দাঁড়াও আমার আঁখির আগে” গানটির লিরিক প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রথম পঙক্তিটি আসে আকাশ থেকে সহসা অশনিপাতের মতন। কোনও পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, মনের গহন কোণেও যেন এই চিন্তার অস্তিত্ব ছিল না। পর পর ঠিক এই চারটি শব্দ আগে কেউ সাজায়নি, যদিও কোনও শব্দই নতুন নয়। “

কিন্তু কবিতার শেষ লাইন কিভাবে আসে? এই শেষ লাইনও তো বিশেষ তাৎপর্যের – পুরোপুরি বিচ্ছেদ না হলেও – ভালো কবিতার রেশ পড়ে থাকে কবিতা পড়া শেষ হওয়ার বহু পর অবধি – পাঠকের সঙ্গে কবির সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটছে এই শেষ লাইন দিয়ে – এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে কবিতায়।

মনে রাখার মতন কিছু শেষ লাইনের উদাহরণ দিই নীচে –
১) …
দুজনের কানাকানি কথা দুজনের মিলনবিহ্বলতা,
জ্যোৎস্নাধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে।
এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা কালকে দিনের তরে
তোমার অলস দ্বিপ্রহরে॥ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে”)

২) …
জানাই তোদের কারা আছিস ঘৃণ্য পরগাছা
কোটি বুকের কলজে ছিঁড়ে রক্ত করিস পান
বুকে শ্বাপদ মুখে তোদের অহিংসা অছিলা
এবার তবে করবি তো আয়
আমার মোকাবিলা
(সলিল চৌধুরী, “শপথ”)
৩)
সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানা-লেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমি
মন-পড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?

আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।

(উৎপল কুমার বসু, “রাক্ষস”)

৪) গদ্যশহর উধাও হবে তোমার তুড়ি-র শব্দে –
‘কোথায় থাকে? দেখতে কেমন? জন্মেছে কোন অব্দে?’
– তোমার খোঁজে, উত্তেজনায়, খেয়ে দু’ঢোঁক কফি,
পথ বিপথে রাত কাটাবো, তোমার জন্যে ট্রফি
আগলে ধরে, মৃত্যুদিনেও, কেবল তুমি যদি

দুরন্ত এক পঙক্তি লেখো, যেমন তোর্সা নদী …

(রণজিৎ দাশ, “তরুণ কবির প্রতি”)

৫) …
কাকিমা, মিতালি, ভাল আছে ?
ওরা কি তোমার কাছে কাছে
আসে, দ্যাখে, কোনও দাগ খোঁজে ?

কাল যাব তোমার অফিসে
ঠিক ঠিক চারটে পঁচিশে
তারপর ভুল দিগ্বিদিক …

শহিদমিনারে উঠে গিয়ে
বলে দেব আকাশ ফাটিয়ে
ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক।
(মন্দাক্রান্তা সেন, “একটি অসম পরকীয়া”)

এবার শেষ লাইন লেখা নিয়ে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। দ্বীপ সরকার সম্পাদিত অনলাইন পত্রিকা “কুয়াশা”র জন্য আমার “নিলাম” কবিতাটা এই অবধি এসে কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল –

নিলাম
অমিত চক্রবর্তী

সে নিলাম ডেকেছিলো তার শেষ লেখা বইটার
আমরা কিশোরী বালিকা, দগ্ধ এবং অসম্পূর্ণ,
খিলখিলিয়ে হেসে, এ দেশে তাহলে এখনও
মতিচ্ছন্ন মানুষ আছে, পুরুষ বা মহিলা, কে আবার
বই নিলাম দেয়, ছায়া লম্বা হয় এদিকে
পটদীপ বিকেলে তার ছায়া লম্বা হয়
মতান্তর, অবিশ্বাসের খটকা আঁকা
ছায়া লম্বা হয়, আমি লোকটিকে দেখি –
গর্বে বুকভরা তার, আঘাতে, বুকভরা সন্দেহে।
“মৃত আত্মাগণ,
তোমরা এবারের মত বেঁচে ফিরে গেলে”, সে
ঘোষণা করেছিল নিলাম ডাকার আগে,
মাইক জড়িয়ে বেখাপ, সেই খিন্ন আইভি লতা …

কবিতাটা প্রথমে শেষ হয়েছিল “মাইক জড়িয়ে বেখাপ, সেই খিন্ন আইভি লতা”এই লাইনটা দিয়ে। কিন্তু কিছুতেই সেটা মনের মত হচ্ছিলো না, খালি মনে হচ্ছিল কিসের যেন একটা অভাব রয়ে গেছে কবিতাটায়। লুঈজ গ্লিকের সম্বন্ধে শুনেছি উনি মনের মত লাইন না পেলে দিনের পর দিন কিছু না লিখে বসে থাকতেন, ওনার নিজের ভাষায় – “I feel like a tracker in the forest following a scent.” – আমি আর অরণ্য কোথায় পাব কাছাকাছি, হাতের কাছে তাই রকিং চেয়ারে চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকি, আস্তে আস্তে একটা ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠে “মাইক জড়িয়ে বেখাপ, সেই খিন্ন আইভি লতা” মূর্তি – মিক জ্যাগার মাইকস্ট্যান্ড জড়িয়ে, কোমরে বাঁধা নীল গিটার। তারপর শুধু গিটারটা পড়ে থাকে, ভাসমান, আর তার চারধারে নীল রঙটা জমাট বাঁধতে থাকে, নীল নীলাভ নীলাব্জ তানে গড়ে ওঠে এক বৃদ্ধ গিটারিস্টের অবয়ব। পিকাসো! “পিকাসোর প্রাচীন (Old) গিটারিস্ট” হয়ে দাঁড়ালো কবিতার শেষ লাইনটা।

হোমওয়ার্ক


১) বড় লাইন ব্যবহার করে অন্তত এক চরণ লিখতে হবে (৪ থেকে ৮ লাইন)

২) কবিতার প্রথম লাইন – ৫টা প্রিয় কবিতার প্রথম লাইন জমা দিতে হবে (কবিতার নাম, কবির নামও দিতে হবে)।

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩), এবং “ভুলটা ছিল উপপাদ্যে, প্রমাণেতে নয়” (ই-বুক ২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" অনলাইন কবিতা পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *