এসো হে বৈশাখী বিকেল

এসো হে বৈশাখী বিকেল

জীবন আর প্রকৃতির তালমেল বড়ো অপরূপ, আর হবে না-ই বা কেন, জীবন তো প্রকৃতিরই অংশ। মানবজীবনের সঙ্গে বড়ো সুন্দর সমাপতন লক্ষ করা যায় নৈসর্গিক প্রকৃতির। আজও অন্তরে অনুভব করি আমার সেই আবাল্য পরিচিত সই বৈশাখী বিকেলকে। স্মৃতিমেদুরতায় মনে পড়ে যায় এক বালিকার মেয়েবেলা। দীর্ঘ গরমের ছুটির দীর্ঘতর দুপুরে, মা হাতের লেখা শেষ করিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন গল্পের বই। তখনও যুক্তাক্ষর দেখলে বানান করে পড়তে হত মেয়েটিকে। কখনো পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে, কখনো গুপি-বাঘার যাদুই-জুতো পায়ে দিয়ে তার মন ছুটত দেশ থেকে দেশে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অবাক রোমাঞ্চের অজানা অলিগলিতে। একটু বড় হতেই কিশোরীর হাত ধরল চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর কিংবা ফেলুদা-লালমোহন-তোপসে ত্রয়ী অথবা আর কেউ। কখনও শঙ্কু, কখনো ঋজুদা কখনো বা আর কারও হাত ধরে বড় হতে থাকা। আর মনে পড়ে, তারই ফাঁকে গল্পের বই হাতে শুয়ে ক্লান্ত নিদ্রাচ্ছন্ন মায়ের চোখের নাগাল এড়িয়ে যৌথপরিবারের সিঁড়ির ঘরে তুতো ভাই-বোনেদের গোপন জমায়েত, সেখানে তখন হাত পড়েছে ঠামির হাতের আমসত্ত্বে, খালি হচ্ছে জেঠিমার আম-কাসুন্দির শিশি, ফুরোচ্ছে মায়ের হাতের বেলের মোরব্বা। আবার সন্ধের অবকাশে পাড়ার সব ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দলবেঁধে মহলা দেওয়া নববর্ষ উপলক্ষে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মতিথি পালনের জন্য। অন্য যেকোনো উৎসবের থেকে এর আয়োজন বড় কম আনন্দের ছিল না আমাদের কাছে।

বৈশাখী দুপুরে বাতাসে যখন খরতাপ, পায়ের তলার মাটি রবির উষ্ণ উত্তাপে আটফাটা, তখনই হঠাৎ এক-একটা দিন ঈশান আকাশ সমাদরে জায়গা করে দেয় এলোকেশী কৃষ্ণকলিকে, ক্রমশঃ ঘনতর হয়ে জটাবদ্ধ হয় তার মুক্ত কেশ, বাসুকির প্রসারিত সহস্র কালো ফণার মতো মেঘের দল সম্মিলিত হয়ে আয়োজন করে আনন্দ আসরের। কী হবে, কী হবে, সংশয়ে থরথর কাঁপে অপেক্ষমান বিটপীর দল, স্তব্ধ অপেক্ষায় থাকে জগতের প্রাণিকুল। আকাশ মথিত হয় মেঘের গর্জনে, পৃথিবী দলিত হয় বাতাসের তাণ্ডবে। কিশোর বয়সি অহমিকারা নিষেধ অমান্য করার আনন্দে ছোটে বাগানে, কোঁচড়ভরে তুলে আনা আধকাঁচা, আধপাকা, অথবা কাঁচামিঠে আম, জাম, কামরাঙার অম্লমধুর স্বাদে জারিত হয় তাদের কৈশোরের তারুণ্য। অকস্মাৎ কালো মেঘ নিজেকে উন্মুক্ত করে জটার শেকল থেকে। টুপুর টাপুর ফোঁটা থেকে ঝর ঝর বাদল ধারায় স্নাত হয় মাথা ঢাকার অক্ষম চেষ্টায় গাছের তলায় দাঁড়ানো বেখায়ালি কৈশোর। দিন পেরোয়, বছর কাটে, জীবন এগিয়ে চলে আগামী বৈশাখের পথে, জন্ম হয় রোমান্টিসিজমের, কখনো তা দিশাহারা, থমকে থাকে ভাবিকালের নস্টালজিক মুহূর্ত হয়ে, কখনো তা পল্লবিত, মুকুলিত হয় আগামীর লক্ষ্যে। আজ যখন সেই কিশোরীর চুলে রুপোর তার, দৃষ্টিতে ধূসরতা তখন তার মোহমুদ্গরতার ধরোহর সে তুলে দিয়ে যেতে চায় আগামী তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। বলে, রেখে দাও তোমাদের অত্যাধুনিক চলভাষ, মুক্তি দাও নিজেকে অন্তর্জালের কারাগার থেকে। দূরদর্শনের রঙিন পর্দায় নয়, চোখ খুলে তাকিয়ে দেখো দিগন্তে খেলা করা রঙিন বর্ণচ্ছটা মেঘের মাথায় লক্ষ মাণিক জ্বালিয়েছে। আজকের বৈশাখী দ্বিপ্রহর তোমাদের স্পর্শ ছাড়া বড় মলিন, বড় ভারাক্রান্ত চল্লিশোর্ধ ডিগ্রির উত্তাপে। ঠান্ডা ঘরের আরাম, শীতল কৃত্রিম রঙিন পানীয়, চলভাষের চলচ্ছবি, উচ্চ ডেসিবেল-এর সংগীত আজ অক্ষম তার শ্রান্তি অপনোদন করতে। এসো, সমবেত হয়ে আজ আবাহন করি বৈশাখী বিকেলকে, অয়ি মোর চিরসখি, নিজের চিরন্তনী রূপে দেখা দাও, উত্তাপে দাও হৃদয়ের উষ্ণতা, বাতাসের স্পর্শে আস্বাদ দাও মুক্তির আনন্দের, কালবৈশাখীর ঝরঝর অকাল বরিষণে ঝরে পড়ুক তোমার স্নেহধারার স্পর্শ। হে মহাজীবন, আমাদের উত্তর প্রজন্ম সিক্ত হোক, স্নাত হোক, প্রাণরসে উজ্জীবিত হোক তোমার উচ্ছল অথচ পরম কারুণিক স্নেহ স্পর্শে, সজল হোক সবুজ হোক, প্রাণময়, প্রফুল্লিত হয়ে উঠুক ধরিত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *