সৌম্য সেনশর্মা – যার আমি ‘সহপাঠী’ হতে পারলাম না

সৌম্য সেনশর্মা – যার আমি ‘সহপাঠী’ হতে পারলাম না

নাঃ! একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে যদি সহপাঠী হওয়া যায়, তাহলে সৌম্য কোনদিনই আমার সহপাঠী ছিল না। কিন্তু আমরা সমকালীন, দুজনেই একই বছরে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি। তবে কিছুদিন আগে একেবারে ধ্রুপদী অর্থে সহপাঠী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছিল। কিন্তু তার অকালপ্রয়াণে তাও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। সে কথা যথাস্থানে বলছি।

১৯৭৭ সালে বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া বিশাল রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার ছাত্রজীবনেরও এক বড় পরিবর্তন হয়। আজন্ম মফস্বলের স্কুলের পঠনপাঠন ছেড়ে কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলাম। তখনই প্রথম সৌম্য সেনশর্মার নাম শুনেছিলাম। ১১-১২ ক্লাসে আমরা যেমন বাইরের স্কুল থেকে এসে ভর্তি হয়েছিলাম তেমনই সেই স্কুলের বেশ কিছু উজ্জ্বল ছাত্র মাধ্যমিকের পর অন্য স্কুলে পাড়ি দিয়েছিল। সৌম্য ছিল তাদের একজন।

দু’বছর পরে আবার একই সঙ্গে ১৯৭৯ সালে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এলাম। কিন্তু ভিন্ন শাখায়, আমার ইলেকট্রনিক্স, সৌম্যর ইলেকট্রিক্যাল। সেই সময় মাঝে মাঝে দেখা হত, আড্ডাও হত। কলেজ ছাড়ার পরও যখন কলকাতা গিয়ে যাদবপুরে গেছি, দেখা হয়েছে – কিন্তু সে পরিচয় খুব বেশি গভীরে যায় নি।

বেশ কিছু বছর আগের কথা। ২০১৬ সাল! ততদিনে আমি ‘অবসর’ সম্পাদক সুজন দাশগুপ্তের বেশ কাছের মানুষ হয়ে উঠেছি। বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত। দু-একটি ধারাবাহিক লেখারও সুযোগ হয়েছে – এদের মধ্যে একটি ছিল ‘যাঁদের আমি ছাত্র’। সেখানে আমার ছাত্রজীবনের শিক্ষকদের কথা সবিস্তারে লিখেছিলাম।

এক শনিবার দুপুরে অফিস থেকে ফিরে দিবানিদ্রার তোড়জোড় করছি। হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর ও কণ্ঠস্বর। আমার অবসর পত্রিকার লেখা নিয়ে প্রশংসা! সেই লেখার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিতে পারার কথা এবং পরিশেষে আমার প্রশ্নের উত্তরে শ্রী সুজন দাশগুপ্তর কাছ থেকে আমার নম্বর পাওয়ার কথা। হঠাৎ হো হো করে হাসি –‘আরে আমি সৌম্য সেনশর্মা বলছি।’ তারপর আবার বেশ আলাপ শুরু হল। সৌম্য জানাল যে সে ও তার স্কুলজীবন নিয়ে লিখতে চায়। আমিও খুব উৎসাহী হলাম। লেখার প্রথম পর্ব পেয়ে দারুণ লাগল। সুজনদার সঙ্গেও কথা এবং মেল চালাচালি হল।

তারিখটা দেখছি – ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬!
সৌম্য লিখেছিল,

শ্রদ্ধেয় সুজনবাবু
সাগ্নিকের গল্পটার শেষ অংশটা ভুলবশতঃ ছাপা হয়নি। সেই অংশটা পাঠালাম। ‘অবসর’ দেখলাম। ভাল লাগলো। আরো ভাল ও আকর্ষণীয় করার অবকাশ আছে।
‘অবসর’-এর অঙ্গনে ঢুকে এক বড় প্রাপ্তি হল অনেক দিনের বন্ধু ও সতীর্থ ভাস্করের লেখা, এবং তার পরের যোগাযোগ। এজন্য ‘অবসর’কে ধন্যবাদ।
নমস্কারান্তে ইতি
সৌম্য সেনশর্মা

একই দিনে উত্তরে সুজনদা লিখেছিলেন,
সৌম্যবাবু,
এটা শেষে যোগ করে দিচ্ছি।
ভাস্কর আপনার বন্ধু জেনে ভালো লাগছে। ‘অবসর’-কে কী করে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় – সে বিষয়ে আপনার চিন্তাভাবনা জানতে পারলে খুবই ভালো হয়। আমি ভাস্করকে অনুরোধ করছি এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে।

সুজনদা আমাকে লিখেছেন,
“ভাস্কর,
সৌম্যবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বাংলা মিস্ট্রি ওয়েবসাইটের সূত্রে। উনি একটি ছাত্রের লেখা ইউনিকোড-এ করে দিয়েছেন। অবসর-কে আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে মনে হয় ওঁর কিছু চিন্তা ভাবনা আছে। তুমি একটু কথা বলে দেখবে… ঠিক কি ভাবছেন?”

আর ঐ লেখার প্রসঙ্গে সুজনদা জানিয়েছিলেন,

ভাস্কর,
সুখবর। আমাকে শ্রদ্ধেয় বলে সম্বোধন করলেও, আমি তো অশ্রদ্ধা করতে পারি না! কথা বল…ভালো হবে। পাঠভবন নিয়ে লেখাটা নিশ্চয় লেখা দেওয়া যায়… তোমারটা শেষ হোক… অন্যান্য বিভাগেও টেনে আনো।
ভালো থেকো।

আসলে ‘অশ্রদ্ধা’র ব্যাপারটা মজার। আমি সুজনদাকে জানিয়েছিলাম, ‘সৌম্য আমার সহপাঠী। তুমি ওকে বাবু বলছ কেন?’ সে কথারই এই উত্তর।

ফোনে সুজনদার সঙ্গে তারপর আলোচনাও হয়। প্রথম লেখাটা pdf format এ ছিল। সৌম্য সেটাকে বলেছিল ইউনিকোডে করে দেবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সৌম্য সেই লেখাটা নিয়ে আর এগোতে পারল না। আমার সঙ্গেও আবার তেমন যোগাযোগ রইল না – ব্যস্ততার কারণে অনেকের সঙ্গেই যা হয়। সেই লেখাটির প্রথম পর্ব এবারে প্রকাশ করলাম – পড়লে সকলেই বুঝতে পারবেন কেমন সুন্দর লেখার হাত ছিল এবং কত পরিশ্রম করে লেখাটি তৈরি করছিল। সেই লেখাটির লিংক –

শ্রদ্ধেয় অনুপমদা্র (অনুপম বসু) প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা, এই লেখাটিকে ইউনিকোডে রূপান্তরিত করে দেওয়ার জন্য।

তবে এই ব্যাপারে, অর্থাৎ সৌম্যকে অবসরে যুক্ত না করতে পারার ব্যাপারে, আমার নিজেরও হয়তো দোষ থাকবে। সুজনদা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিতেন ‘অবসর’ পত্রিকার জন্য নতুন লেখক খুঁজে বার করতে। করেওছি বেশ কিছু। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সৌম্যকে আর সেই তালিকাভুক্ত করতে পারিনি।

সম্প্রতি কলকাতায় এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে গিয়ে দেখা হল। সৌম্য নিজেই এসে আলাপ করল – আমি চিনতে পারিনি। আসলে দীর্ঘকালের অদর্শন। সোস্যাল মিডিয়াতেও তেমন যোগাযোগ ছিলনা। এসে হৈ হৈ করে অন্যান্যদের সঙ্গে আমার আলাপ করাল, ‘অবসর’ পত্রিকার খোঁজ নিল। আমিও জানালাম, এখন আমি সম্পাদক এবং ভালো লেখকের খোঁজে আছি। সৌম্য কথা দিয়েছিল। ওকে আমার একটি লেখা পড়াতে আমার ইদানীং ইতিহাসে উৎসাহ দেখে সৌম্য খুব আনন্দিত হল।

লেখাটি ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলারের নাৎসি বিদ্বেষ সংক্রান্ত। সৌম্য জানাল যে ও হচ্ছে ২য় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখার খুবই অনুরাগী পাঠক। শুধু পড়েই ক্ষান্ত নয়, সৌম্য ও তার এক বন্ধু কিছু বছর আগে ইউরোপ ঘুরতে গিয়েছিল ২য় মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত বিশেষ স্থানগুলি দর্শন করার জন্য।
আমি তো খুবই খুশি হলাম। যাক! অবসর পত্রিকাতে ইতিহাস নিয়ে লেখার একজন লোক পাওয়া যাবে। আমি এটাও জানালাম যে আমি একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছি। সৌম্য বলল – ‘ইস! ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ভুল হয়ে গেল রে! ইতিহাস নিয়ে পড়লেই ভাল হত!’ আমি বললাম যে এবার ভুল শোধরানোর সুযোগ রয়েছে আমাদের সামনে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার তার মাতৃবিয়োগ হওয়াতে মন খুব উতলা ছিল। সম্ভবত সেজন্য আর সে এই ব্যাপারে বেশি এগোতে পারল না। আর আমি না জানলেও শারীরিক ভাবে সৌম্য হয়তো রীতিমতো অসুস্থ ছিল। এটা আমি পরে জেনেছি। এদিকে তারপরেই ‘অবসর’ পরিবারেও নেমে এল মহা দুর্যোগ! সুজনদা হঠাৎ করেই চলে গেলেন। সৌম্যর কথা আর ওঁকে জানানোই হল না।

এই বছর বইমেলাতে যখন আমাদের কপিলদেব সংক্রান্ত বইটি প্রকাশের কথা হয়, সৌম্য খুবই আগ্রহ দেখিয়েছিল। ওর বাড়ির ঠিকানাও আমাকে দিয়েছিল, যাতে আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি। আমার সহ লেখক কলরব রায়ও ওর পরিচিত। এছাড়া ও বলেছিল যে চেষ্টা করবে বইমেলাতে আসার। তারপর জানালো যে আর আসতে পারছে না। কিন্তু ওর শারীরিক অবস্থার কথা আমি এত বিস্তারিত জানতাম না।

হঠাৎ করে সকালে খবরটা পেয়ে বেশ বিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। একজন এমন বন্ধু, যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে আমি খুবই উপকৃত হতাম খুব আকস্মিক পাশ থেকে খসে পড়ে গেল।
সৌম্যর বন্ধুরা অনেকেই জানিয়েছেন ওর বিভিন্ন কাজের কথা। আমি অল্প পরিসরে এটুকু জানিয়েই বন্ধুকৃত্য সারলাম। তবে এই অভাবটা আমাকে বেশ পীড়া দেবে।

ভালো থাকিস সৌম্য! তোর সঙ্গে একসঙ্গে ইতিহাস পড়ার সুযোগ হল না – এটার আপসোস রয়ে গেল রে!

জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, অন্যদেশ, পরবাস ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। সম্প্রতি নিজের একটি ব্লগ চালু করেছেন – www.bhaskarbose.com

Related Articles

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • শেখর বসু , April 18, 2024 @ 12:45 pm

    লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল…।

  • শেখর বসু , April 18, 2024 @ 12:57 pm

    লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল…

    • BHASKAR BOSE , April 19, 2024 @ 3:05 pm

      অনেক ধন্যবাদ শেখরবাবু!

  • অভিসার – Abasar , April 19, 2024 @ 12:39 pm

    […] এই সম্পর্কে বিশদে জানা যাবে যে লেখাটিতে তা হলঃ https://abasar.net/soumya-sensharma/ […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *