‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার’

‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার’

জীবনের প্রান্ত বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে অতীতের আলো। যে আলোয় বুদ্বুদের মত সাঁতরে যায় মুহূর্ত অথবা মানুষ। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, কাউকে ছুঁতে পাই আর কাউকে পাই না। নানা রঙের অদৃশ‍্য সুতো ভেসে বেড়ায়। হাত দিয়ে ধরতে পারলেই স্মৃতির পথ খুলে যায়। নয়তো কেবলই ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে অসহ‍্য যন্ত্রণা হয়, কিচ্ছু মনে পড়ে না। নামটুকুও না। হারিয়ে যায় কত স্মৃতি। আজ লিখতে বসে চোখের সামনে আবার অসংখ‍্য সুতো দেখতে পাচ্ছি। একটা উজ্জ্বল সবজে সুতোতে হাত ছোঁয়াতেই বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমার গল্প শোনার বাতিকের ছোট্ট মুহূর্ত ভেসে উঠল।

সবার মুখে শুনেছি, সরস্বতী যতটাই কালো আমি নাকি ততটাই ফর্সা ছিলাম। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। গন্ধরাজ ফুলের গাছের ডালে দুটিতে পা ঝুলিয়ে বসতাম। বড়োরা বলত রাধাকৃষ্ণ। কিন্তু সত‍্যি বলতে কী, আমি যাকে চোখের সামনে দেখতাম তার মুখটাই নিজের বলে অনুভব করতাম। তাই শৈশবের অভিন্নহৃদয়, ইজের পরা সরস্বতীর মুখটাই আমার নিজস্ব ছিল। কৈশোরেও পেনফ্রেণ্ডকে নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলাম আমি কুচকুচে কালো, চাপা নাক, যার একটাতে গাঢ় হলদে পোঁটার চিরস্হায়ী আবাসের বন্দোবস্ত করা আছে। চুল লালচে জটা ধরা। বলাই বাহুল‍্য সেই বন্ধু আর কখনো চিঠি দেয়নি।

যাই হোক, ছোটবেলায় বৈকালিক আহারে দুধ-কলা-ভাত ধার্য করা ছিল। তবে সরস্বতীকেও দিতে হবে এবং লালকমল নীলকমলের গল্প বলতে হবে, এই ছিল আবদার। সরস্বতীর বাটি খালি হলেও আমার মন পূর্ণ হত না সহজে। ফলে খাওয়ার বদলে প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করতে থাকতাম মা’কে। ‘লালকমলের মাকে রাজা কষ্ট দিল কেন?’ ‘রাক্ষসী কোন জাদুতে সুন্দরী হল?’ ইত‍্যাদি। এদিকে বন্ধুর খাবার বাটি ফাঁকা হওয়ায় তাকে দু’বার আরো ভাত দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমার খাওয়া এগোয়নি। অগত‍্যা দুর্বাসা মুনি হুঙ্কার দিলেন এবং দুধভাতের বাটি মাথায় উপুড় করলেন। দু’দিকের বিনুনি ও লাল ফিতে তখন সাদা আঠালো চটচটে। বিপদ বুঝে পিঠটান দিয়েছে বন্ধু। ভ‍্যাঁ কান্নার উপায় নেই। দুর্বাসা রাগে কাঁপতে থাকে, ওই মাথা এখন যে তাকেই পরিস্কার করতে হবে! এ ঘটনা বহুবার ঘটেছে। সরস্বতী বড় হয়ে বলতো, তোর মাথায় দুধভাতের সার পড়েছে তাই পড়াশোনা করিস; আমি তো খেয়েছি তাই আর মাথায় কিছু যায় না। শুধু খিদে পায়।

মামাবাড়িতে থাকত ওরা দু’বোন। সুযোগ পেলেই খুব মারত ওদের মামারা। আমার মাথায় খুন চেপে যেত। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করতাম বাধ‍্য হয়ে মা ওদের বাড়ি গিয়ে ওর মামাদের বকে ঝকে মার থামতো। কতদিন মনে মনে ভেবেছি বড় হয়ে ওর মামাদের কারাগারে বন্দি করে রাখব। এখন কেমন আছে, কোথায় আছে সরস্বতী, কে জানে? নিজের নামকে কলঙ্কিত করে ফোর অবধিও পড়তে না পারা সরস্বতী কী সুন্দর হাসত মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁতে।

আরো এক সঙ্গিনী ছিল পুকুর পাড়ের গুগুলি টুকানোতে। নাম মনে করার বৃথা চেষ্টায় সুকুমার মুখখানির মলিনতা বিদ্রুপ করছে কিনা জানি না, তবে ঘাটের জলে লেখা আছে কত সুন্দর দিনলিপি। রাধাচূড়ার ফুল পুকুরময় ভেসে বেড়ায়। স্রোতের টানে বসন উড়িয়ে মত্ত যেন কোন চঞ্চল কিশোরী। স্থির হয়ে ভেসে থাকতাম সকলে মিলে। খুলে দিতাম চুল। সে বলতো, ‘মাছ এসে ঘুমিয়ে পড়বেনে তোর চুলির ভ‍্যেতরে।’ বোঝো কাণ্ড, মাছ আবার ঘুমায়? ‘বারে ঘুমায় না? ঘুমালি না স‍্যান পোয়াতি হয়, ডিম হয় প‍্যাটের ভিত্রে।’ আমি তখন রুই মাছকে বলি লেবিয়ো রোহিতা। মনোযোগ দিয়ে শিখি ধুতরা ফুলে গর্ভকেশর, পুংকেশর চক্র। মুখ টিপে পাণ্ডিত‍্য গোপন করি। এদিকে জলের ভেতরে থাকতে থাকতে হাত সিঁটে লেগে আসতো। হঠাৎ সে বলত, ‘গুগুলি তুলবি আমার হাঁসের জন‍্যি?’ পা দিয়ে জলের তলার মাটি ঘষে খরখর করলে ডুব দিয়ে খাবলা দিয়ে আনতাম মাটি। তার থেকে গুগুলি দিতাম ওর কোঁচড়ে। পরে অন‍্য এক বন্ধুর মুখে শুনেছি, ‘হাঁস না ছাই, ওরা গুগুলি সিদ্ধ দিয়ে ভাত খায়। ইস্ মাগো নিঘিন্নি!’

ভেজা শরীর জুড়ে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তো। ঠাকুমার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে শরীর গুঁজে দিয়ে ঐ গুগুলি সেদ্ধ খাওয়া জীবনের গল্প শুনতে চাইতাম। ওরা দুলে। এককালে আমাদের সাথে ওদের ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল না। পরে আমার ঠাকুমাই এসব বন্ধ করেন। ওরা আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোতে আসত, উঠোনে বসে ভোগ খেত। ওদের এক জ্ঞাতিকে বাঘে থাবা মেরেছিল। মুখের বাঁদিকে মাংস ছিল না। দাঁত গুলো বেরিয়ে থাকত প্রায় কান অবধি। ওঁকে দেখে খুব ভয় পেতাম। মনে হত রাক্ষস। একদিন বলেছিলাম ঠাকুমাকে। ‘অমন করে বলে না। উনি তো পরিস্থিতির শিকার। মায়া করবে, ঘৃণা না।’ আর কখনো ভয় লাগেনি ওঁকে। কেবল ভেবেছি এঁদের জীবন ভীষণ কষ্টের। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘ ধরেছিল। ঠাকুর কেন মানুষকে কষ্ট দেয়? এই উত্তর আজো পাইনি।

ঠাকুমা গল্প বলত সেই সময়ের। যখন লোক বসতি ছিল না। জঙ্গল বাঘ সব নাকি ছিল আমাদের এলাকায়। আর ছিল স্কন্ধকাটা। রাত গভীর হলে স্কন্ধকাটার ধোঁয়া গন্ধে পাড়ার দম বন্ধ হয়ে আসতো। তার চোখ ছিল পেটের উপর মাথা নেই। দু’হাতে তালি বাজাতে বাজাতে পথ পেরোতো। ওই হাতের মাঝে পড়লেই সব শেষ। ভয়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরতাম। অথচ রাত বাড়লে চুপিচুপি শিউলি তলার দিকের জানলা ফাঁক করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখ ডুবিয়ে খুঁজতাম স্কন্ধকাটাকে। বড্ড হতাশ করেছিল সে। কোনদিন দেখা দেয়নি। একবার কালীপুজোর দিন আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম পাড়া জুড়ে। পাড়ার শেষ দিকে ঘোড়াওলা বাড়ি ছিল। মানে ঐ বাড়িতে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছিল। যে গাড়িতে ইঁট বহন করা হত। আমার বোন সেই বাড়িতে লুকোতে গিয়ে ছায়া সরে যেতে দেখে। খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল আমার রোগা ছোট বোনটাকে নিয়ে। মনে মনে দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি কেন দেখলাম না কিছু? সেই দুঃখ আজো রয়ে গেছে।

কিছু সুতোয় টান দিতে না চাইলেও জড়িয়েই যায় গলায়। ফাঁসে নিঃশ্বাস আটকে আসে। ছটফট করে একটা কান্না। আবার কোনো সুতোয় বাঁধা থাকে আনন্দঝরণা। আজকের আমি ফ‍্যালফ‍্যাল করে চেয়ে থাকি অতীতের মায়াজালে। কৃষ্ণচূড়ায় রঙ লাগে রঙিন হয় মন। দৈবাৎ বন্ধু হয় যে জন সেও কালের গ্রাসে ঝরে পড়ে টুপটাপ।

ইউক‍্যালিপটাসের জঙ্গলে তিন কিশোরী হাওয়ায় উড়িয়েছিল সদ‍্য বিকশিত প্রেমের উপাখ‍্যান। কাজল, টিপ, দুই বিনুনিদের স্বপ্ন ছিল একটা দুর্দান্ত প্রেমের উপাখ্যান লেখার। রাজপুত্র না হোক কোটালপুত্র, মন্ত্রীপুত্রদের আনাগোনা নেহাত কম ছিল না। ব‍্যাঙ্গালোরে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা তিন মেয়ের একটি ছিলাম আমি, বাকি দুই জয়া আর নীতু। ওরা গাড়োয়ালি। আমাদের ভাষা আলাদা হলেও মন মিশেছিল সহজেই। এয়ারফোর্স ক‍্যাম্পাসের রোমান্টিক পরিবেশে মালাই আইসক্রিম খেতে খেতে তিনটিতে ভেসে যেতাম রাজপ্রসাদের অন্দর মহলে। মহীশূর বেড়াতে গিয়ে টিপু সুলতানের প‍্যালেস দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলাম। আমাদের প্রভাবিত করার জন‍্য কিছু সক্রিয় মানুষ ছিল বইকি তবে সে গল্প অন‍্যদিন।

এই তিনকন‍্যার কথা বলি। তারা সব দেখে বুঝে ভেসে ডুবে হাবুডুবু খেয়েও স্থির। কেউ মনের কথা বিন্দুমাত্র প্রকাশ করেনি কারো কাছে। কেবল তিনজনে জানত তিনজনের মনের কথা। ইচ্ছের কথা, ভয়ের কথা, কান্নার কথা। তিনজনে প্রতি রাতে প্রায় কারো না কারো বাড়িতে (তিনজনের যে কোন একজনের) একজোট হয়ে ডিনার করে ঘুমাতো একসাথে। নামেই ঘুমাতো আসলে রাত জেগে স্বপ্নের জাল বুনতো বকবক করত। সদ‍্য বন্ধুত্ব হওয়া তিনটিতে প্রতিজ্ঞা করেছিল সারাজীবন যোগাযোগ রাখবে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। স্বয়ং আমিও সব স্মৃতির ঘর বন্ধ করে দুয়ার এঁটেছি। মাঝেমাঝে যখন খুব একা লাগে, চোখের সামনে রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়, সব ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। দু’হাত বাড়িয়ে দিই শূন্যতায়। ভরে যায় মুঠি। স্মৃতির কাছে গুটিসুটি দিয়ে ঘন হয়ে বসি। একে একে আমার চারপাশে আসে সবাই। গল্প জুড়ে দিই। একেকটা গল্প থেকে জন্ম নেয় আরো কত শত গল্প। কেউ ব‍্যর্থ, কেউ সফল। তবে সবাই একান্ত আমার। ওই যে আরো একটা রঙিন সুতো আমার খুব কাছে। শুধু ধরার অপেক্ষা।

কল‍্যানী শহরে বেড়ে ওঠা। নিয়মিত নাটক করেন। পেশায় শিক্ষিকা। অল্প বিস্তর লেখালেখির শখ। বেড়াতে ভালোবাসেন। আর ভালো লাগে প্রকৃতির কাছে থাকতে ।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Payel Chatterjee , July 28, 2021 @ 7:10 am

    বড় মায়াময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *