অমৃত কুম্ভের সন্ধানে

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে

বইয়ের নাম: করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে
লেখক: নবনীতা দেব সেন
প্রকাশক: করুণা প্রকাশনী

একবার হলো কী, নবনীতা দেবসেন গেছেন তিরুপতিতে। কনফারেন্সে বক্তব্য রাখার পরে কথায় কথায় উঠে এল কুম্ভমেলার প্রসঙ্গ। ব্যাস, আর আটকায় কে? তিনি কি যে সে মেয়ে! টিকিটের ব্যবস্থা করে রওনা দিলেন অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। না আছে উপযুক্ত শীতবস্ত্র – না কোন সঙ্গীসাথি। পথে বেরিয়ে অত ভয় পেলে কি চলে! কী আশ্চর্য, একজন বয়স্ক মানুষ জুটে গেলেন রাস্তায়। নাম – শার্দুল সিং। খুব unimpressive চেহারা যদিও। পরে অবশ্য চমকে দেওয়ার মতো খাঁটি বিলিতি ইংরেজিতে কথা কয়ে শুধু নবনীতা দেবসেনকে কেন, পাঠককেও চমকে দেন সেই  শার্দুল সিং। যাই হোক, অনেকটা পথ একসঙ্গে এসে কুম্ভমেলায় প্রবেশের পরে অবধারিত ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কারণ নবনীতাদির আস্তানার তো কিছুই ঠিক নেই!

তাই ভারী একটি বিয়েবাড়ি-মার্কা শাড়ি পরে এদিকে সেদিকে হাতড়ে হাতড়ে বেড়ান। নাহ্, ভুলই হল কি এইভাবে এসে? হঠাৎ ঐ খোলা আকাশের নীচে ভিড়ে ঠাসা মেলায় একদল বাঙালি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অজান্তে কখন পরিচয় গড়ে ওঠে। খিদে তেষ্টায় কাতর নবনীতা দেবসেনের পেটে পড়ে পুরি, কচুরি গরম গরম তরকারি। এরপরও লোকে বলবে – ঈশ্বর নেই! ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়েই তো এসেছে এই মানুষগুলো।

তবে সবাই এবং সবই কি আর মধুমাখা? মেলায় এসে মানিয়ে নিতে না পারা, স্বার্থপর কিছু মানুষের সন্ধান মিলে যায় ঐ ছাউনিতেই। অযাচিত কৌতূহলী মাসিমার দলও আছেন, যাঁরা কথায় কথায় নবনীতা দেবসেনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চেষ্টা করেন তাঁর স্বামীর খবর জানতে চেয়ে। কীভাবে সেসব বাউন্সার সামলালেন তিনি, তার অম্লমধুর বর্ণনা রয়েছে তাঁর অনবদ্য ভ্রমণকাহিনি  – ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে ‘ গ্রন্থে। 

আবার ফিরে যাই কুম্ভমেলার আসরে। মাটিতে শুয়ে একটা পাশ কখন ঠান্ডা জল পড়ে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে – তা সত্বেও নবনীতাদি’র মনের উত্তাপের কাছে ওসব বাধা কিছুই না। তিনি একহাতে ঐ ভারী শাড়ি-শাল-সোয়েটার সামলে চটি হাতে নিয়ে অঞ্জলির মন্ত্র পড়তে পারেন দিব্যি! চটিজুতো ভেসে যাচ্ছে দেখে খপ করে সেটিকে পাকড়াও করেন – মুখে তখন পিতৃতর্পণের সংস্কৃত শ্লোকের মহিমা। এইভাবে হাসতে হাসতে আর হাসাতে হাসাতে তিনি কুম্ভস্নান সেরে বাড়ি ফেরেন।বাড়িতে অবশ্যই তাঁর জন্য চিন্তায় অস্থির মা অপেক্ষা করছেন। ব্যাস, শুরু হয়ে যায় বকাবকি। এর মধ্যে অবশ্য টুক করে মা’র কাছে মেয়ে আবদার করে বসেছেন যে কাশীতে বাড়ি বানালে ভালো হয় না? এরপর মা সত্যিই নবনীতা দেবসেনের মা হয়ে ওঠেন এবং একটি অসাধারণ কথা বলেন – ঐ গঙ্গাকে কি আর তার পাড়ে বসে খোঁজা যায়! গঙ্গার স্রোত বইয়ে দিতে হবে মনের মধ্যে – জীবনের পথে পথে।

ঠিকই, মন্দাকিনীর এই জলধারা হৃদয়ে বহন করতে পেরেছিলেন বলেই নবনীতা দেবসেন লিখতে পেরেছেন এমন একটি অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনি – ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে,’ যে কাহিনি ঘরে বসে থাকা মানুষকেও কুম্ভস্নান করিয়ে আনতে পারে। এমনই তাঁর কলমের জোর, এমনই তাঁর মায়ামমতার বন্ধন। হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যাই করুণাময়ের কৃপায় করুণা সাগরে – কুম্ভমেলার আসরে – অমৃত কুম্ভের সন্ধানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *