হলদে গোলাপ

হলদে গোলাপ

বইয়ের নাম: হলদে গোলাপ
লেখক: স্বপ্নময় চক্রবর্তী
প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং

ছোটবেলায় দেখতাম, আমাদের পাড়ায় একটা ছেলেকে সবাই ‘লেডিস’ বলত। রাস্তায় বের হলেই চারদিক থেকে “লেডিস লেডিস” বলে প্যাঁক দিত। 

শুনেছি আমার ছেলের ক্লাসেও একটা ছেলে পড়ত, তাকেও সবাই ‘লেডিস’ বলত আর খেলাধুলা থেকে ব্রাত্য করে রাখত। একদিন সে নাকি বন্ধুদের গিয়ে বলেছিল, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি ‘লেডিস’, এবার তো তোরা আমাকে খেলতে নে!”

মেয়েসুলভ ছেলে বা ছেলেসুলভ মেয়ে অথবা অন্যকম কেউ, এদের কারও যন্ত্রণাই কোনোদিন অনুভব করিনি। কবেই বা ভেবেছি কোনও হিজড়ার কষ্টের কথা?

কলকাতা বইমেলা-২০২৩ এ ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ যে বইটার নামে চোখ আটকে গেল, সে বইখানার কথা আমি আগেও অনেকের কাছে শুনেছি। স্টলের বাইরে বড় বড় করে সব বইয়ের নাম লেখা ছিল। ছেলেকে বললাম, “আমার ঐ বইটা চাই।”

বইয়ের আকৃতি দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। এতো মোটা বই? ৫৯১ পাতা? এই উপন্যাস পড়ে শেষ করতে পারব তো? আসলে অনেকদিন উপন্যাস পড়ার অভ্যেস নেই।

বাড়ি এসে বইটা খুললাম আর একপাতা দুপাতা করে পড়তে শুরু করলাম। চোখ আটকে গেল। উঁহু, মনটা আটকে গেল। আমি জানি না, কোন জাদুবলে লেখক আমাকে এভাবে ধরে রাখলেন? আমি ডুবে গেলাম আর ডুবে গেলাম। শেষ না করে ছাড়তে পারলাম না।

বইয়ের নাম? হ্যাঁ, এখনও যদি না বলি তো অপরাধ হবে। সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা, আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত উপন্যাস, ‘হলদে গোলাপ’।

দে’জ পাবলিশিং-এর বই, অতএব বাঁধাই, পৃষ্ঠা, হরফ এসব নিয়ে কথা বলা বাতুলতা। সবটাই ভালো। দামটাও ভালো।

‘হলদে গোলাপ’ তৃতীয়  লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে লেখা একটি জ্বলন্ত দলিল, প্রচুর প্রচুর গবেষণার ফসল। এলজিবিটি (LGBT- লেসবিয়ন, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডার) দের উপর অসামান্য বই।

বইয়ের মুখবন্ধে সাহিত্যিক মহাশয় বলছেন –
“ছোটবেলা থেকেই তথাকথিত ‘মেয়েলি ছেলেদের’ অপমানিত হতে দেখেছি সমাজের নানা ক্ষেত্রে। ওদের কষ্ট পাওয়া উপলব্ধি করেছি। মানুষের লিঙ্গ পরিচয় লৈঙ্গিক আচরণের আলোছায়া বুঝতে চেষ্টা করেছি। ১৯৯৪/৯৫ থেকে এ বিষয়ে অল্প বিস্তর তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি, কিছু ক্ষেত্রে সমীক্ষাও। উপন্যাস লেখার কথা ভাবিনি। ২০১০ সাল নাগাদ কোনও এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে এ বিষয়ে সামান্য কিছু বাক্যালাপ হয়। বছরখানেক পরে অভাবনীয়ভাবেই ওঁর সম্পাদিত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই বিষয় নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার প্রস্তাব পাই।“

পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, উপন্যাস নয়, এ যেন এক দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। স্বপ্নময়বাবু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনিকেতের মাধ্যমে এই পরিক্রমা করালেন। প্রধান চরিত্র অনিকেত বেতারের একজন অনুষ্ঠান আয়োজক। পরিচিত শিল্পীদের নামও পেলাম উপন্যাসের শুরুতেই, যাঁরা এক সময় আকাশবাণীকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রসঙ্গত শ্রী স্বপ্নময় চক্রবর্তীও দীর্ঘদিন আকাশবাণীতে কর্মরত ছিলেন।

বলতে দ্বিধা নেই, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ বরাবরই মনে মনে পোষণ করতাম। ‘হলদে গোলাপ’ একের পর এক সেই অজানা জগতটাকে মেলে ধরল। তত্ত্ব এবং তথ্য নির্ভর একটি উপন‍্যাস। বছরের পর বছর ধরে লেখক গবেষণা করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে পড়ে থেকেছেন। ওদের কথাবার্তার ধরন, আচার, আচরণ, সবকিছু আয়ত্ত করেছেন। যার বিচ্ছুরণ ঘটেছে পাতায় পাতায়।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিকেত আমাদের হাত ধরে নিয়ে যায় – কখনও যদি হিজড়াদের ‘খোলে,’ মানে যেখানে হিজড়ারা থাকেন, তো কখনও রূপান্তরকামী শিক্ষিত মানুষদের মাঝে। একদিকে পুরুষের দেহটাকে নারীতে রুপান্তরিত করার আদিম অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, আরেকদিকে সর্বাধুনিক শল্য পদ্ধতি। যেখানে একজন চিকিৎসক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছুরি কাঁচির সাহায্যে নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তোলেন নিজের শিল্পকর্ম। সব জায়গাতেই মূল সুরটি  বড় করুণ। জন্মসূত্রে পুরুষ দেহধারী মানুষটি মনেপ্রাণে নারী। অপর একজন পুরুষকেই সে জীবনভর কামনা করে। ফলে শরীর আর মন কোনোদিন একসুরে বাজে না।পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই পুরুষদেরও ভোগ্য বানায়। ওরা সারাজীবন ধরে প্রার্থনা করে মা বহুচেরা দেবীর কাছে,”আমায় মেয়্যা করে দাও।” মোরগবাহনা এই দেবী হিজড়াদের আরাধ্যা।

আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে, যেখানে এখনও লুকিয়ে স্ত্রী-ভ্রূণ হত্যা করা হয়, সেখানে কারও পুত্রসন্তান যদি বয়ঃসন্ধির সময় থেকে বোঝাতে শুরু করে, সে শুধু আকৃতিগতভাবে পুরুষ, কিন্তু  মানসিকভাবে নারী, সেই বাবা মায়ের মনের অবস্থা কী হয়? অথচ এই অসংগতির জন্য দায়ী ক্রোমোজোমের অসামঞ্জস্য।দুটো পরিচ্ছদ ধরে লেখক এই জটিল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বুঝিয়েছেন xx আর xy এর বিভাজন বৈচিত্র্য।

জানতে পারি সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের কথা। সোমনাথ থেকে মানবী হয়ে ওঠার কথা। আনন্দবাজারকে দেওয়া মানবী বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের সাক্ষাৎকারটা পড়লে বোঝা যায়, কত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে।

এমন ছেলেসুলভ মেয়ের কথাও আছে, পড়তে পড়তে মনে হয়, আরে, এই ঘটনাটা তো জানি; খুব শোরগোল ফেলে দিয়েছিল একটা সময়। পরিস্থিতির প্রয়োজনে পাত্র পাত্রীর নামটুকু শুধু পাল্টে গেছে।

একটু আধটু ঘুরেও বেড়ালাম। কখনও ব্যাঙ্কক-পাটায়া আবার কখনও ঝাড়গ্রাম-চাইবাসা। দেখলাম মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডাদের নিজস্ব আচার।মহুয়ার গন্ধ নাকি গোবিন্দভোগ চালের মত। পায়েসের গন্ধে ম’ ম’ করা পরিবেশে বসে আদিবাসীদের মুখে শুনি ওদের লোককথা।

“ভাল কইর‍্যা বাজান গো দোতারা, সুন্দরী কমলা নাচে” – গানটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ক’জন জানি এই কমলা আসলে একটি কিশোর। অনেকসময় জমিদারের মনোরঞ্জনের জন্য,  কিশোরদের মেয়ে সাজিয়ে ব্যবহার করা হত। এমনই এক কিশোর কমলাসুন্দরী। সিলেটের উপাখ্যান।

ছত্রে ছত্রে অনুসন্ধানের বিন‍্যাস অথচ একবারও একঘেয়েমি আসে না। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা কেউ ব্রাত্য নয়, সমাজের উপর বাড়তি বোঝা নয়।

শেষ করব একজন রূপান্তরকামীর উদ্ধৃতি দিয়ে, “গোলাপের রং তো আমরা গোলাপিই বুঝি। পিংক। কিন্তু গোলাপ যদি সাদা কিংবা হলুদ হয়, তবে কি সেটা গোলাপ নয়? আমরাও পুরোপুরি মানুষ। মানুষের সমস্ত ধর্ম আমাদের মধ্যে আছে। আমাদের মধ্যে শিল্পীসত্ত্বা আছে। পরের জন্য দুঃখবোধ আছে। সমাজ সচেতনতা আছে, আবার পরশ্রীকাতরতাও আছে। শুধু ব্যক্তিগত যৌনতার ক্ষেত্রে আমরা আলাদা।”  

প্রচুর কবিতা ব্যবহার করেছেন লেখক, যার বেশিরভাগটাই রূপান্তরকামীদের লেখা। এরকমই একটা কবিতা পড়াতে ইচ্ছে করছে।

ঋণ

সব ঋণ শোধ করে দেব একদিন,
যা কিছু শুশ্রূষা পেয়েছ, তার
হিসেব রেখেছি রুমালের গিঁটে।

যা কিছু অপমান, সেটাও সঞ্চয়
শরীরে ব্লেডের দাগে হিসেব রেখেছি।

যত ঋণ আছে কাশে, কিংশুকে
হিসেব রেখেছি এই ছোট বুকে

বহে যাওয়া জল, কেশে যাওয়া বুড়ো
বাস
সবাইকে বলি আয়, আয়, আয়
ভালোবেসে সব ঋণ শোধ করা যায়।

এলজিবিটিদের জীবনসংগ্রাম, অস্তিত্বের লড়াই আর বঞ্চনার ইতিহাস, ওদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে দিল। একবার পড়ে মন ভরল না। আবার পড়ব। শুধুমাত্র গল্প হলে হয়ত এমন ইচ্ছে হত না। প্রথমবার শুধু গলাধঃকরণ করে গেছি, এবার আত্মীকরণ করতে হবে।

সুতপা বিশ্বাস ঘোষ মূলত ছোট গল্প লেখেন। কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখতে ভালবাসেন। অভিব‍্যক্তি নিউ জার্সি, শনিবারের আসর, সাহিত্য বিবর্তন, পাণ্ডুলিপি সহ বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত আকারে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *