নিঃসঙ্গ ঈশ্বর

নিঃসঙ্গ ঈশ্বর

বইয়ের নাম: নিঃসঙ্গ ঈশ্বর
লেখক: সমীরণ দাস
প্রকাশক: অভিযান পাবলিশার্স

“নিঃসঙ্গ ঈশ্বর” – বইটির নাম। শিরোনামেই শিহরণ! 

বইটির প্রচ্ছদ, গেটআপ, বাঁধুনি চমৎকার। একেবারে ব্লার্ব থেকে পড়া শুরু করলাম। ছলছল করে উঠল চোখ। এরপর ব্যাক-কভারে গেলাম। পড়ে ফেললাম।

প্রথম পাতাই সাংঘাতিক। বিদ্যাসাগর মহাসংকটে। উইলে ছেলের নাম রাখলে তার দুষ্কর্মকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। সেটা তাঁর চরিত্রবিরোধী কাজ হবে। আবার, ছেলেকে বাদ দিয়ে কাজটা করতেও পারছেন না। এই দোটানা অবস্থা এক অদ্ভুত অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে বিদ্যাসাগরের মধ্যে – যেন এক বিদ্যাসাগর অন্য আরেকজন বিদ্যাসাগরকে প্রশ্ন করছেন – কী হল, এমন দ্বিধাগ্রস্ত কেন তুমি? লেখক চমৎকার এঁকেছেন সেই মুহূর্তটি  তাঁর শক্তিশালী লেখনীতে।

মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না বিদ্যাসাগরের জীবন। কলেজ জীবন শেষ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ৪০ টাকা মাইনের চাকরিতে ঢুকলেন। কিছুদিন ছিলেন সেখানে, তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক পদ গ্রহণ এবং পরবর্তীকালে অধ্যক্ষের পদ, সেইসঙ্গে নিজের পড়াশুনা। কিন্তু তাঁর প্রাণের চাওয়া ছিল শিক্ষাসংস্কার এবং নারীশিক্ষার বিস্তার। দুর্বার সাহস, সাংঘাতিক কর্মক্ষমতার অধিকারী, অদম্য প্রাণশক্তির আধার এবং একশোভাগ সৎ মানুষ যখন এরকম একটা ব্রত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন, তখন বিভিন্ন নামি/অনামি ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সংঘাত যে অনিবার্য হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এরই সঙ্গে ছিল তাঁর অত্যন্ত সংবেদনশীল মন। ফলে দুঃখভোগ অনিবার্য।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপকের একটি পদ খালি হয়েছে। বিদ্যাসাগরের মনে হল, এই পদের জন্য উপযুক্ত মানুষ তাঁর বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতি। কিন্তু তারানাথ তখন কালনায়, কলকাতায় নেই, খবর পাঠাতে হবে, অথচ সময় বেশি নেই। কলকাতা থেকে কালনার দূরত্ব পঞ্চাশ মাইল। চিঠি পাঠালে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। লোক পাঠালেও সে কবে পৌঁছবে ঠিক নেই, বিদ্যাসাগর নিজেই চললেন পায়ে হেঁটে খবর দিতে বন্ধুকে। তারানাথ তো অবাক বিদ্যাসাগরকে দেখে (পৃষ্ঠাঃ ১৬)!

ভাবা যায়!

সেসময় বিদ্বজ্জন মহলে রাজা রাধাকান্ত দেব ছিলেন মহা পরাক্রমশালী। বিধবা-বিবাহ ব্যাপারটা প্রচলিত হওয়া উচিত, এই উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর শিক্ষিত উদারপন্থী রাধাকান্ত দেবের শরণাপন্ন হলেও বুঝলেন, তিনি বিদ্যাসাগরকে শেষমেষ সমর্থন করতে পারবেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মনের জোর, অদম্য প্রাণশক্তি এবং কর্মক্ষমতা যে কিরকম সাংঘাতিক ছিল, সেটা বোঝা গেল তাঁদের পারস্পরিক কথাবার্তার মাধ্যমে, যখন রাধাকান্ত সভামধ্যে বললেন,

“আপনার সঙ্গে আমি সহমত। কিন্তু… তাঁদের অমতে আমি কিছুই করতে পারি না।“

উত্তরে বিদ্যাসাগর জানালেন, “আপনি না পারলেও আমি পারব। বিধবা-বিবাহের প্রচলন এই দেশে করেই ছাড়ব“ (পৃষ্ঠাঃ ৫৮)।

বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরকে পরবর্তীকালে সাংঘাতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব তিনি আইনগত ভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন।

দুই মহান ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগর এবং মধুসূদনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অতি মধুর। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বিদ্যাসাগরকে উপহার দিতে এসেছেন মাইকেল। সাক্ষাৎ মুহূর্তে মধুসূদন প্রণাম করেন বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করলে মধুসূদনের চোখে জল এসে যায়… (পৃষ্ঠাঃ ১০৪)। 

সময় বিশেষে মধুসূদনকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু একসময় আবার কিছু টাকা চেয়ে মধুসূদন যখন চিঠি লিখেছিলেন বিদ্যাসাগরকে, তিনি লিখলেন –

“…আপনার ব্যাপারটা একেবারেই নৈরাশ্যজনক। আমি অথবা অন্য কেউ… যতই কঠোরভাবে চেষ্টা করি না কেন, আপনাকে রক্ষা করা যাবে না…” (পৃষ্ঠাঃ ১৪৭)।

সেই মধুসূদনের প্রতিও বিরূপভাব পোষণ করলেন একসময়।

বই সংরক্ষণের ব্যাপারে বিদ্যাসাগর যত্ন ছিল ষোলোআনা। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ছিল ১৬,০০০। বিস্ময়কর! বিদ্যাসাগর তাঁর বই, পত্র-পত্রিকা আলমারিতে গুছিয়ে রাখছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাগুলি সাজিয়ে রাখছেন। বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ‘বঙ্গদর্শন’-এ কলম ধরেছিলেন বঙ্কিম। তেমন একটি সংখ্যায় দীর্ঘ লেখার কিছু অংশ (পৃষ্ঠাঃ ১৯১ – ১৯৪) পড়তে গিয়ে বঙ্কিমের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। ভাবলে বিস্ময় লাগে আমাদের। এই তথ্য এই বইটি না পড়লে জানতেই পারতাম না।

মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের শ্যামবাজার শাখার প্রধান মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যিনি ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের ভক্ত, একদিন রামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। আড়াইপাতা (পৃষ্ঠাঃ ২০০ – ২০২) জুড়ে এই দুজনের কথোপকথন বড় আনন্দদায়ক। 

এক বিধবার জমি আত্মসাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, নিষ্কর্মা হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মদ্যপান, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা – এরকম নানা দুষ্কার্যের সঙ্গে যুক্ত তাঁর পুত্র নারায়ণ। এসবের জন্য বিদ্যাসাগর দায়ী করছেন তাঁর রাশভারী পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে,

“আপনার আদরের নাতি কয়েকজন কুলাঙ্গারের সঙ্গে মিলিতভাবে একজন বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।… আপনি নারায়ণের কোনো ত্রুটি দেখতে পান না। আদরে আদরে ও বাঁদর নয়, কুলাঙ্গার হয়ে গেছে, সেটা আপনি বুঝতে পারেননি“ (পৃষ্ঠাঃ ১২৬)। 

যে-কোনো রকম অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর ছিলেন রীতিমত খড়গহস্ত। তাঁর বাবাকেও তিনি ছাড়েননি। আক্ষেপ করে  জীবনের শেষ মুহূর্তে ছেলেকে বলেছিলেন,

“আমার ছেলে হয়ে তুই কী করে বিধবার সম্পত্তি…” (পৃষ্ঠাঃ ২২৫)? 

বাবার পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইলেন পুত্র নারায়ণ। বিদ্যাসাগরের শেষ অবস্থা তখন। উইল পরিবর্তন হল, সাক্ষীরাও হাজির, সই করতে বলা হল বিদ্যাসাগরকে। তারপর… শেষটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে।

বিদ্যাসাগর ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। তাই বুঝি কর্মাটাঁড়ে সাঁওতালদের মধ্যে কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ বেশ কিছু বছর। তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে বইটিতে। সংগ্রহে রাখার মতন বই।

 
৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *