আন্তর্জাল

আন্তর্জাল

মানুষ যে কত কিছুর জন্য মরণপণ লড়াই করে তার ইয়ত্তা নেই। এই যেমন তিনটি বেসিক নিডস্ ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’ তো আছেই ।
ইয়ে মানে ‘ভাত’ ছেড়ে রুটির কথা বললুম বলে দোষ নিবেন না যেন অধমের। আমাদের সবার গুরু অমিতা (এটি প্রচলিত কথ্যরূপ) বচ্চন সাহেবের সিনেমার নামটা ইউজ করতে খুব মন চাইল কিনা!
মরণপণ লড়াই এর আরও হাজার একটা গ্রাউন্ড আছে। এই যেমন কৈশোরে ও যৌবনে কেরিয়ার গঠনের জন্য মরণপণ লড়াই। তারপর পরিপূর্ণ বয়সে একটি নিশ্চিন্ত সরকারী চাকুরি প্রাপ্তির জন্য মরণপণ লড়াই। ,দৌড়ের মাঠে ট্রফি হাতে ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়াবার বাসনার তরে মরণপণ লড়াই। কঠিন রোগ থেকে মুক্তি, দেনামুক্তি, হরেক রকমের নেশামুক্তি, থেকে ছুটকারের জন্য মরণপণ লড়াই। অফিস টাইমে ভিড় বাসে কোন্ সিট ফাঁকা হবে তা অনুসন্ধান পূর্বক সেই সিট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ার জন্য মরণপণ লড়াই। সন্ধ্যাকালীন শিয়ালদা নর্থ এবং সাউথের ডাউন ট্রেনে বডি সেঁধানোর এবং ভিড়ের চাপে বডিকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার থেকে বাঁচাতে দুই সিটের মধ্যের অঞ্চলটাতে সূচ হয়ে ঢুকে পড়ে টিকে থাকার জন্য মরণপণ লড়াই!
এবং কোনও একটি বিশেষ প্রকার মনুষ্য-প্রজাতিদেরকেও বিষম মরণপণ লড়াই লড়তে হয় পেটের কথা চেপে রাখার জন্য। আর মহাভারত না বাড়িয়ে এবার আসল গপ্পে আসা যাক বন্ধুগণ।
এ সবই আর পাঁচজনের মতো বিপুলেরও জানা। তবে ইদানীং কালে তার সাথে একটি নতুন মরণপণ লড়াইয়ের ক্ষেত্র বর্তমানে যুক্ত হয়েছে তার অভিধানে। এ মরণপণ লড়াই শুধু তার বা তার পরিবারের নয়, এ লড়াই তাদের সমগ্র অঞ্চলের মানুষের লড়াই।
দক্ষিণ বঙ্গের বাসিন্দা বিপুল বসু। আমফান ঝড়ে বেশ কিছু দিন ইলেকট্রিসিটি ছিল না বিপুলদের মতোই অনেক অঞ্চলেই। যা দিন দুনিয়ায় নেই বা কোনও দিনও পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশাটুকু নেই। তা নিয়ে হাহুতাশ বা মরণপণ লড়াই করা বেকার। যা বর্তমানে নেই কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যা পাওয়া যাবে তার জন্য হাপুস নয়নে আশা আর দোয়া করতে হয়।

কিন্তু যেটা আছে অথচ নেই, কিংবা অতি দুব্বল ভাবে আছে, কিংবা এই আছে এই নেই, এমনই যার হাল তার জন্য মাথা নষ্ট করা ছাড়া আর কি উপায়! পাঁচ দিনের মাথায় ইলেকট্রিসিটি এসেছিল। কিন্তু মোবাইল নেটওয়ার্ক তৎসহ ইন্টারনেটের হাল বর্ণনা করতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ওই গানটাই যথাযথ, ‘এই আছি এই নেই আমি যেন পাখি, মেলি পাখনা, সীমানার সীমা ছেড়ে যাই দূর প্রান্তে, নীড় একা পড়ে থাকে থাক না।’
একতলায় ফোনকল এবং নেট চলে না। ওনলি অফলাইন গেমস্। বিপুলের মেয়ে টুকির পোয়াবারো। ফোনকল রিসিভ করা গেলেও ফোনের ওধারে ধান বললে এধারে কান শোনা যায়।এপারে তালা বললে ওপারে কালা শোনে অপর জন! সবই অস্পষ্ট কাঁপা কাঁপা স্বরে। কি জ্বালা!
সেদিন বিপুলের কাকাশ্বশুর ঝড়ের পরবর্তী কুশল সংবাদ জানতে ফোন করেছেন। বিপুলের স্ত্রী পম্পার বাবা ছোট বেলায় গত হলে পম্পা তার এই কাকার কাছেই মানুষ হয়েছে। কাকাশ্বশুরের ভাইঝি মানে, বিপুলের বউ পম্পা তখন দোতলায় স্নানের শেষে আয়নার সামনে। কাকার সাথে বেশ কথাবার্তা চলছিল তার। শ্বশুরমশাই শেষে জামাইকে চাইলেন ফোনে। সামনেই জামাই ষষ্ঠী যতই চলুক লকডাউন, ফোনে অন্ততঃ নেমন্তন্নটা সারতে তো হবে। পম্পা বলে, “কাকু, তোমার জামাই নীচে একতলায়। রান্নাঘরে। মাটন কষাছে। দাঁড়াও তোমার জামাই এর কাছে পাঠাচ্ছি ফোনটা।” বিপুলের মেয়ে টুকি তার দাদুর সাথে বকবক করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামে। তারপর বিপুলের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে, ‘দাদুর ফোন’ বলেই এক দৌড় লাগায়। খুন্তি হাতে গলদঘর্ম বিপুল বাম হাতে ফোন নিয়ে কানে চেপে বলে, “হ্যালো, কে কাকু?”
ওদিকে বিপুল পরাক্রান্ত এক্স মিলিটারি ম্যান ত্রিদিব রঞ্জন সাঁপুই, মানে বিপুলের কাকাশ্বশুর শোনেন, ফোনের ওপারে তাঁর জামাই বাবাজীবন। অস্পষ্ট সেই স্বর যেন বলে চলেছে, ‘কেলো রে টাকু?’
গলার স্বর এক পর্দা চড়িয়ে সাঁপুই মশাই বলেন,”কী বলছটা কী বিপুল?”
এদিকে অতি দুর্বল নেটওয়ার্কের জ্বালায় বিপুলের কিছুই কর্ণগোচর হয় না। সে কানে ফোন চেপে একবার সামনের বারান্দার দিকে ছোটে একবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা করে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যায়। অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। আর ক্রমাগত বলেই চলে, “হ্যালো কাকু ? হ্যালো কাকু ?হ্যালো কাকু?”
যদিও ততক্ষণে মনহুস কলটা গেছে কেটে। আর ওদিকে দোর্দণ্ড প্রতাপ সাঁপুই মশাই বিষম রাগে ফুলতে থাকেন। তাঁর বিশাল কালো রঙের বপু কাঁপতে থাকে রাগে ! আর মাথা জোড়া টাক ওঠে ঘেমে।
ব্যাপারটা পম্পা ম্যানেজ করেছিল তার কাকুকে সব খুলে বলে। কিন্তু এরপরে বিপুল এবং তার কাকাশ্বশুরের মুখোমুখি হলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে ভাবলেই বিপুল চুপসে যায়। লকডাউন তো আর চিরটাকাল চলবে না।
দোতলায় ফোন কল সাবলীল। কিন্তু নেট বেটা পঙ্গু। টুকি একদিন দুপুরে বায়না ধরে রসগোল্লার। করোনার ভয়ে এখন বাইরের রেডিমেড খাবার সব বন্ধ। পম্পা ইউটিউবে রসগোল্লা তৈরির ভিডিও চালাতে যায়। মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে তখন শুধুই বাফারিং।
টুকি পেছন থেকে উঁকি মেরে বলে, “ওমা এতো শুধু জিলিপির প্যাঁচের মতো ঘুরছে গো। জিলিপি তৈরির রেসিপি না কি? ওক্কে মম, তুমি তবে জিলিপিটাই বানিও না হয়।”

আর দোতলার ছাদে ফোনকল এবং ইন্টারনেট কখনো রোদের মতন ধাঁ চকচকে আবার মাঝেমাঝে গোরুর গাড়ির হেডলাইট। ওই রোদ বৃষ্টির খেলার মতন মিষ্টি লুকোচুরি! আমফানের জন্য কদিন স্কুলের অনলাইন ক্লাস বন্ধ ছিল টুকিদের। এটাই যা নিশ্চিন্তি!
এরমধ্যে একদিন সকালে বিপুলের ফোনে মেসেজ ঢোকে , আগামীকাল থেকে পুনরায় টুকিদের স্কুলের অনলাইন ক্লাস শুরু হবে। সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো। বিপুল পম্পাকে বলে , “নিশ্চিন্তে আর থাকা গেল না গো! আর কটা দিন পর থেকে শুরু করলেই পারত এরা।”
সাজসাজ রব পড়ে গেল বসু পরিবারে। স্বল্প পরিসরের চিলেকোঠা। আর সেখানে যত পড়তি ঝড়তি বাড়তি জিনিসের ডাঁই। শুরু হয়ে গেল বিপুল পম্পার মিলিত ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’। টেবিল চেয়ার পাতার মত জায়গা বের করতেই হবে এই চিলে কোঠায় যে করেই হোক। এই জুনের দুপুর রোদে ছাদে বসে আমসি হয়ে তো আর ক্লাস করা যায় না।
অনলাইন ক্লাসের শুভ মহরত ক্ষণ প্রায় উপস্থিত। পৌনে দশটায় সমগ্র বসু পরিবার মনে মনে ইষ্ট নাম জপে চিলে কোঠায় হাজির। টেবিল চেয়ারে ফিট হয়ে যায় টুকি সোনা। টেবিলের পায়ার কাছে মেঝেতে বসে পড়ে বিপুল আর পম্পা।
যেই ঘড়িতে পাক্কা সকাল দশটা। বিপুলের অ্যানড্রয়েড ফোনে শুরু হয়ে গেল টুকির অনলাইন ক্লাস। বিপুল মনে মনে বলে ওঠে , ‘জয়গুরু। এত পরিশ্রমের ফসল কি আর জলে যাবে! শেষ রক্ষা কোরো হে প্রভু! শেষ রক্ষাটুকু কোরো!’
নেট আজ সুপার ফাস্ট। আর ঠিক সেই সময় পম্পার মোবাইলে এফ বি ওয়ালে ফুটে উঠল বেশ কয়েকদিনের ভাইরাল একখানি পোস্ট। সুউচ্চ গাছের মগডালের মাচায় চড়ে ফোন হাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক শিক্ষকের অনলাইন শিক্ষা দানের প্রাণপণ লড়াইয়ের স্থির চিত্র!

জন্ম হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত ডায়মন্ড হারবারে। গণিতে লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ থেকে স্নাতক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের একটি সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির নেশা। লেখালেখির পেছনে মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কবিতা লেখা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ভূতের, হাসির এবং রহস্য গল্পই লেখা বেশি হয়ে থাকে। বেশ কিছু গল্প বিভিন্ন পূজাবার্ষিকী, গল্প সংকলন এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং আরো কিছু প্রকাশের অপেক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *