আমার চোখে আইল অফ স্কাই
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলগুলোতে গরমে লম্বা দু’মাসের ছুটি পাওয়া যায়। ২০১৯ সাল। আমার কন্যা তখন ক্লাস সেভেনে। মওকা বুঝে সপরিবারে গ্রেট ব্রিটেন অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। চিরকালই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যর জন্য বিখ্যাত ‘আইল অফ স্কাই’ আমাকে হাতছানি দিত, তাই সেটাই লক্ষ্যস্থল।
প্রথম গন্তব্য ছিল লিডস শহর, সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে থেকে গাড়ি করে স্কাই, প্রায় ন’ঘণ্টা লাগলো পৌঁছতে। স্কাই-এর কাছাকাছি পৌঁছে আমরা পেটে ভালোমন্দ দেবার তাগিদ অনুভব করলাম। স্কটল্যান্ডের জাতীয় পদ হ্যাগিস একরকম নরম মাংসের পুডিং, তার সঙ্গে আলুভাতে এবং শালগম যার স্থানীয় নাম Turnip থেকে ছোটো করে ‘neeps।’ পুরো ব্যাপারটার ওপর হুইস্কি সস ছড়ানো। সেই বস্তুগুলো যখন মুখের মধ্যে গলে গলে হৃদয়ে প্রবেশ করছিল তখন সে এক স্বর্গীয় আস্বাদন।
বিভিন্ন জায়গায় থামতে থামতে আমরা বিকেল বিকেল স্কাইয়ে গিয়ে পৌঁছলাম। স্কাই-এর জন-ঘনত্ব ৬.০৪ জন/কিমি স্কোয়ার এবং জনসংখ্যা ১০,০০৮, কাজেই পর্যটক ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা খুব একটা নজরে এল না। স্কাই দ্বীপটি পঞ্চাশ মাইল দীর্ঘ এবং এর রাজধানীর নাম পোর্ট্রি। এখানে দুটো বিখ্যাত গোষ্ঠী বা বংশের (clan) আধিপত্য ছিল এবং তাদের বেশ কিছু দুর্গ ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ স্কাই-এর মহিমা আরও বর্ধিত করেছে। এই দুই গোষ্ঠীর নাম ম্যাকডনাল্ড এবং ম্যাকলিওড। এদের দ্বন্দ্বের কথা স্কটল্যান্ডে সর্বজনবিদিত।
স্কটল্যান্ডের উত্তর পশ্চিম উপকূলের সঙ্গে স্কাই একটা মাত্র ব্রীজ দিয়ে যুক্ত – স্কাই ব্রীজ। ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল এই ব্রীজ ভেঙে গেলে দ্বীপটির সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তখন ফেরিই একমাত্র ভরসা হবে।
স্কাই একটি স্বর্গরাজ্য, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, হ্রদ, সমুদ্র, এবং মধ্যযুগীয় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে সাজানো এই দ্বীপটিকে মনে হয় যেন একটি পেইন্টিং। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে, বিভিন্ন হ্রদ পেরিয়ে, অনেক গ্রামের ভেতর দিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম মধ্যযুগীয় প্রাসাদের ধাঁচে তৈরী আমাদের পাঁচ রাত্রির আবাসস্থলে। সূর্যাস্ত তখন পশ্চিম আকাশে বেগুনি গোলাপি মেশানো আবির ঢালছে, ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়ছে, যদিও গ্রীষ্মকাল। শোনা যায় এখানে শীতকালের আকাশে aurora borealis দেখা যায়।
পূর্ব পরিকল্পনা মতো আমাদের বাড়ির চাবিটা মেল-বক্স থেকে সংগ্রহ করা হল। আশেপাশে জনমানব নেই, একটি চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া আছে আমরা যেন সর্বদা গেট বন্ধ রাখি, নইলে ভেড়া ঢুকে সব ঘাস ও গাছ খেয়ে নেবে। কী কান্ড!
বাড়িটি দোতলা এবং প্রশস্ত। ছবির মতো সব ব্যবস্থা। প্রতিটি ঘরই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সাজানো। দেয়ালগুলোতে স্থানীয় প্রকৃতির চিত্র এবং হস্তশিল্পের নমুনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমরা রান্নাঘরে প্রথমেই সব গুছিয়ে ফেললাম। সেখানে যাবতীয় বন্দোবস্ত রয়েছে, চাল, ডাল, তেল, নুন এমনকী টম্যাটো কেচাপও। আমরাও প্রচুর রসদ নিয়ে এসেছি, সেগুলো ফ্রিজে ভরে ফেললাম। প্রত্যেকটি ঘরে পর্যাপ্ত লেপ, চাদর, প্রতিটি বাথরুমে তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু সব কিছুর প্রায় এক সপ্তাহের মত যোগান মজুত। ওয়াশার, ড্রায়ার থাকায় আমাদের খুব সুবিধা হল নইলে এখানে রোদের যা অভাব কিছু কাচলে শুকোনো মুশকিল হতো।
রাতে প্রতিটি ঘরে হিটার চালিয়ে অল্প রেড ওয়াইন ও মাংস ভাত সহযোগে জমাটি নৈশভোজ সেরে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। স্বপ্নে লেকের দৈত্য, স্কটল্যান্ডের পরিরা এসে উঁকি দিয়ে গেলো।
সকাল হতেই ঝলমলে একটি দিন আমাদের সামনে উপস্থিত। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চায়ের জল বসাতে গিয়ে জানালায় উঁকি মেরে দেখি চারখানা ভেড়া কোনোভাবে গেট টপকে ঢুকে এসেছে এবং আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। হই হই করে মেয়েকে ডাকলাম, কী সুন্দর সাদা পশমে ঢাকা শরীর তাদের। দিনটা খুব সুন্দর করে শুরু হলো। এবার পালা অ্যাডভেঞ্চারের।
আমরা একটা বোট ভাড়া করে লেক ক’রুইস্ক (Loch Coruisk in Scottish Gaelic, CoireUisg, the “Cauldron of Waters”) দেখতে গেলাম। কপাল ভালো থাকায় যাবার পথে একটি বড়সড় সীল পরিবারকে হ্রদে পাথরের খন্ডের ওপর রোদ পোহাতে দেখলাম। তাদের দু’একটা বাচ্চাকে দেখে আমার কন্যা তো মহা খুশি! এই হ্রদটি আভ্যন্তরীণ স্বচ্ছ জলের হ্রদ, Black Cullin পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা।
এই জায়গাটির ইতিহাস না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তার আগে বলি ভূগোলের কথা, যেহেতু ভূগোল ছিল আমার বিষয়। স্কাই-এর প্রধান দুই পর্বতমালা হল ব্ল্যাক কালিন আর রেড কালিন। আমরা বেছে নিলাম ব্ল্যাক কালিন, এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ এবং জায়গায় জায়গায় প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচু। দীর্ঘতম শৃঙ্গ Sgurr Alasdair (৩২৫৪ ফুট) গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে উপদ্বীপের মাঝে। এই ব্ল্যাক কালিন শৈলশিরা তৈরি হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। হিমবাহ বাহিত বরফ গলে এর চারপাশে এই অপূর্ব লেকটি তৈরী হয়েছিল আর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লাভা প্রবাহিত হয়ে অপূর্ব উপদ্বীপের সৃষ্টি করেছে। ব্যাসল্ট পাথরের বিশালায়তন চাতাল যুগ যুগ ধরে আবহাওয়ার প্রভাবে অতি মসৃণ ভূমির রূপ নিয়েছে। বোটে করে সেই উপদ্বীপে পৌঁছে আমার কন্যা ওই ব্যাসল্ট ভূমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত হরিণীর মতো ছুটে বেড়ালো, আর আমরা হ্রদের (Loch Coruisk) ধারে বসে বসে কল্পনা করছিলাম একটু দূরের জ্বালামুখ থেকেই ফুটন্ত লাভা বেরিয়ে এসেছিল! বোটের চালক আমাদের নানা উপকথা শুনিয়ে চলল। ষোলো’শ শতাব্দীর কাছাকাছি পূর্বোল্লিখিত দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাট যুদ্ধ হয় এই উপদ্বীপেই, রক্তে লাল হয়ে যায় হ্রদের জল।
স্কটল্যান্ডের উত্তরতম প্রান্তে অবস্থিত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দ্বীপটিই হলো এই স্কাই। এই দ্বীপের নামকরণের পিছনে পুরোনো নর্স (ভাইকিং) শব্দ “Sky” (cloud) এবং “Ey” (island) এর অবদান রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। গোটা দ্বীপ জুড়ে প্রস্তর যুগ এবং লৌহ যুগের নমুনা পাওয়া যায়। বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে দেখা যায় এই দ্বীপের নথিবদ্ধ ইতিহাসে রয়েছে প্রায় ১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কতিপয় আইরিশ মানুষ এই দ্বীপটিতে খ্রিস্টধর্মের সূত্রপাত করেন। প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে দ্বীপটি ভাইকিংদের অধীনে চলে যায়। পরবর্তী বেশ কিছু শতক ধরে দ্বীপটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা “clan” দের দাপট ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দুই গোষ্ঠী ম্যাকলিয়ড ও ম্যাকডনাল্ডই বিজয়ী হয়ে থেকে যায়। আঠেরো শতকের শেষের দিকে এই দ্বীপটি পাকাপাকি ভাবে স্কটল্যান্ডের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দ্বীপ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এই দুই গোষ্ঠীর নানা কাহিনি স্কাই-এর বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়। গোটা স্কটল্যান্ড জুড়ে হ্রদের দৈত্য, পরি, আর দুই গোষ্ঠীর বিভিন্ন যুদ্ধের কথা প্রচলিত, আর ওখানে দু’রাত কাটানোর পর আমরাও সব কিছুকে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিলাম।
পরদিন সকালে আমরা গেলাম Neist Point-এ। এটি স্কটল্যান্ডের একটি বিখ্যাত লাইট হাউস, স্থানীয় নাম “Durinish।” স্কাই এর পশ্চিম প্রান্তে এই লাইট হাউসটি গ্লেনডেল শহরতলির একদম পাশেই অবস্থিত। খাড়া উঁচু পাহাড় থেকে ঢালু পাহাড়ি রাস্তা নেমে গেছে উপকূলের পাশে অবস্থিত একদা সক্রিয় নেইস্ট পয়েন্ট লাইট হাউস অবধি। ওই জায়গা থেকে অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখা যায়, তাই জায়গাটি ফটোগ্রাফারদের অত্যন্ত প্রিয়।
সব মিলিয়ে ২.২ কিমি মতন হাঁটা, সময় লাগে ৪৫ মিনিট। আমার মতো শম্বুক গতিতে চললে সেটা দাঁড়াবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এতটাই ঢালু রাস্তা যে ফিরে আসার সময়, যাকে বলে ‘জান কয়লা’ হয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
গাড়ি থেকেই নামতেই ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল আর সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া! পাহাড়ি দুর্গম রাস্তা, প্রচন্ড চড়াই উৎরাই, নামার সময়ে প্রত্যাবর্তনকারীরা সাবধান করলেন। বেশ ঝুঁকি নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম লাইট হাউসের উদ্দেশ্যে। এতদূর এসে না দেখে ফিরে যাব, তা কী হয়!
প্রচন্ড ঠান্ডা, বৃষ্টি – হাওয়া যেন উল্টে ফেলে দেবে। কিন্তু তার মধ্যেই চলল আমাদের অভিযান। সে এক অপূর্ব অনুভূতি। বিশাল প্রকৃতি, আর তার মাঝে ক্ষুদ্র আমি একাকার হয়ে মিশে গেলাম। তার মধ্যে চলল আমাদের ছবি-তোলা পর্ব। একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে একবুক তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, পেরেছি।
আবার ফেরার পালা, কিন্তু এখন ভয় কে জয় করে ফেলেছি, এবার শুধুই দু’চোখ ভরে উপভোগ করা।
“মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে …”
পরিতৃপ্ত মন নিয়ে ডেরায় ফিরে এলাম, ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে এসেছে। রাতে আমাদের অধিবেশনে ঠিক হলো সব কিছু তো এই কদিনের মধ্যে দেখা সম্ভব হবে না। কিন্তু আমার কন্যা খুব খুশি হবে এমন একটা জায়গা পরের দিনের জন্য বেছে নেওয়া হল – তার নাম, the Fairy Glen of Skye। সেটি আসলে পরিদের রাজ্য। সত্যি বলিতে কী, আমিও সেখানে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম।
এই ফেয়ারি গ্লেন অঞ্চলে গিয়ে দেখলাম সেই landscape বা ভূচিত্র অত্যন্ত অদ্ভুত। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছোট ছোট পাহাড় – যেন খেলনা পাহাড় কেউ সাজিয়ে রেখেছে। পুরু গালচের মতো ঘাস দিয়ে ঢাকা, চূড়াগুলো আইসক্রিম কোনের মত দেখতে। প্রচলিত উপকথা হল পরিরা এখানেই বাস করে। আমার কন্যা তো সঙ্গে সঙ্গে পরি খুঁজতে লেগে পড়ল। এক একটা পাহাড়ের গায়ের গর্ততে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করল যদি সেখান থেকে কোনো ভাবে “টিঙ্কার বেল” ফেয়ারি উড়ে উড়ে বেরিয়ে আসে! এরপর সে একেকটা পাহাড়ের ওপর নিমেষে উঠে, বসে বসে এক মনে দূরের চ্যাপ্টা মাথা পাহাড়, যা অনেকটা দুর্গের মতো দেখতে, সেই Castle Ewan-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। আহারে, মনে মনে কত কী না জানি কল্পনা করছে মেয়েটা!
এই দিকে একটু ঘোরা ফেরার পর আমরা গিয়ে বসলাম একটি পুকুরের ধারে, যেখানে নাকি সমস্ত পরিরা চান করতে আসে। আশপাশে জনমানব নেই বললেই চলে, কিছুক্ষণ পুকুরের দিকে মুখ করে বসে থেকে যেন শৈশবে ফিরে গেলাম…। এই বুঝি ঝোপের আড়ালে কোনো পরি তার পোশাক খুলে এসে জলে ঝাঁপ দিল; হয়তো কেউ আমাদের অজান্তে মাথার ওপরেই উড়ছে; এতই ক্ষুদ্র যে আমরা তাদের দেখতে না পেলেও তারা সবই দেখছে, শুনছে – এমনটা হতেও তো পারে! এক সময় আমাদের উঠতে হল সেই রূপকথার রাজ্য থেকে। বাড়ি গিয়ে জমিয়ে রান্নাবান্না করার প্ল্যান আছে।
বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাবে, আগে দুটো ভালো মন্দ পেটে দেওয়ার কথা ভাববে – আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। আমাদের ব্রেকফাস্ট হত রাজকীয়। কারোর জন্য বিশেষ অমলেট, কারোর আবার ওট আর দুধ অনেক ফল সহযোগে, এছাড়া টিনের বেকড্ বিনস্ ও সসেজও থাকত। দেদার খাও, সঙ্গে স্ট্রং কফি অথবা দার্জিলিং চা। আহা, বেরোতেই ইচ্ছে করতো না, মনে হত এই বাড়ির সামনের দালানে বসে সারাদিন প্রকৃতির অপূর্ব শোভা দেখেই কাটিয়ে দিই। কিন্তু হাতে আর দুটো মাত্র দিন – অতএব “চরৈবেতি”।
ঠিক হল প্রথমে The Quiraing-এ একটু হাঁটাহাঁটি করা হবে। এর অভূতপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফারদের দেশবিদেশ থেকে টেনে আনে। এই বিশাল ভূমি Trotternish ridge এর একটা অংশ এবং এই বৈচিত্র্যময় ভূচিত্র তৈরী হয়েছিল একটি ভূমি ধ্বসের ফলে। কী যে ভালো লাগল এখানে হেঁটে বেড়াতে! হঠাৎ সুউচ্চ সূচের মতো খাড়া চূড়া, আবার একটু এগোলেই বিশাল মালভূমি – পুরোটাই সবুজ ঘাসে ঘেরা। রোদ ঝলমলে এই দিনটির সুযোগ নিয়ে আমরাও মহানন্দে চরে বেড়ালাম এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।
এরপর ঠিক হল লাঞ্চের জন্য স্কাই-এর বিখ্যাত ফিশ এন্ড চিপস্ খেতে যাওয়া হবে। এতই বিখ্যাত এই খাবারটি যে সারি সারি রেস্টুরেন্ট থাকা সত্ত্বেও অর্ডার দেওয়ার পর প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। ও হ্যাঁ, অর্ডার দেওয়ার সময় কিন্তু ফিশ অ্যান্ড চিপস্ বললে হবে না. বলতে হবে “হ্যাডক অ্যান্ড সাপার।” এই সাপার বলা মানেই আলুভাজা চাই। কেচাপ বা মেয়োনিজ এর জন্যেও আলাদা পয়সা দিতে হয়েছিল।
অতক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন সদ্য সমুদ্র থেকে তোলা গরম গরম হ্যাডক মাছ ভাজাগুলো আমাদের প্লেটে এবং পেটে পড়ল তখন আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। আহা কী অপূর্ব তার স্বাদ, চোখ বুজে আয়েশ করে খেতে খেতে আমরা পরবর্তী গন্তব্য স্থির করে ফেললাম। এবার যাবো বিখ্যাত কিল্ট রক দেখতে।
এই কিল্ট রক-টি ট্রোটেনিশ (Trotternish) মালভূমির উত্তরপূর্ব দিকে সমুদ্র উপকূল থেকে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য, এই cliff বা খাড়া পাহাড়টি লম্বালম্বি ভাবে ব্যাসল্ট পাথর দিয়ে তৈরি এবং তার মাঝে মাঝে ডলোরাইট পাথর উঁকি দিয়ে একটা অপূর্ব প্যাটার্নের সৃষ্টি করেছে। এই প্যাটার্নটি এখানকার ব্যগপাইপারদের স্কার্ট-এর প্যাটার্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। প্রকৃতির থেকে বড় কারিগর আর কেউ হতে পারেনা। এই পাহাড়ের ওপর থেকে বইছে মিল্ট ফলস্ (Mealt Falls), যার উৎস কাছের মিল্ট হ্রদ। এই অপূর্ব ঝরনা, পাহাড়, ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে বাজনা বাজাচ্ছেন একজন ব্যাগ পাইপার যাঁর স্কার্টটি হুবহু ওই কিল্ট রকের মতোই। প্রচুর ঘোরাঘুরি করে, ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ডেরায় ফেরার কথা ভাবতে হল।
সেই রাতে আমরা ছড়িয়ে ফেলা সংসার আবার গুছিয়ে ফেলতে লাগলাম। বাড়িঘর পরিষ্কার করে, ভ্যাকুম করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পরদিন আমরা এখান থেকে গ্লাসগো স্টেশন-এ যাব, সেখান থেকে লন্ডন যাওয়ার ট্রেন ধরব, শুরু হবে আমাদের রানির দেশে অভিযান।
পরদিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রেকফাস্ট সেরে, স্কাইকে বিদায় জানিয়ে গ্লাসগোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের ফিরতি পথে শেষ যে দ্রষ্টব্যটি বাকি ছিল সেটির কথা বলতে গেলে বলা যায়, “Last but not the least!” সেটি হলো বিখ্যাত Loch Ness (লেক নেস)। আমার কন্যা ভীষণ উত্তেজিত, গল্পে পড়া বা সিনেমায় দেখা দৈত্য নেসি-কে কি একবার হলেও দেখা যাবে? একবারটি কি সে জল থেকে মুন্ডু তুলে আমাদের “হাই” বলবে?
এই হ্রদে ২৬৩ বিলিয়ন কিউবিক ফিট জল রয়েছে; ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সমস্ত হ্রদ, নদী ও জলাশয় একসঙ্গে করলে যে পরিমাণ জল ধরে এ তার থেকেও বেশি। ১৯৩৩ সালে প্রথম Inverness Courier কাগজে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশিত হয়। এক স্থানীয় দম্পতি এক বিশালাকার জন্তুকে জলের থেকে উঠে আসতে দেখেছেন। এর পরপরই আরও এক দম্পতি দাবি করেন তাঁরাও ওই দৈত্যকে চাক্ষুষ দেখেছেন। এই ভাবেই প্রচলিত হয় লেকের দৈত্য ‘নেসি’র গল্প। এখনও স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন নেসি ওই হ্রদের মধ্যেই বাস করে।
আমরা যদিও নেসির দেখা পেলাম না, তবুও স্কাই আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে দিয়েছে। এই ক’দিনে মন কেড়ে নেওয়া একটি ভূস্বর্গকে পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম রাজা রানির দেশে। আমাদের মনে পাকাপাকি ভাবে রয়ে গেলো পরি, দৈত্য, ঝরনা, পাহাড়, ও ভাইকিংদের লড়াই এর অসাধারণ কিছু গল্প।
4 Comments