কালচিনিতে তিন দশক
‘অভিজ্ঞতা’ শব্দটার অর্থ ব্যাপক। অভিজ্ঞতা সত্যি অর্জন করতে পেরেছি কিনা জানি না। যেটুকু অর্জন করেছি, তারই একটি অংশ আজ তুলে ধরছি।
ছোট থেকে বড়ো হয়েছি পশ্চিমবঙ্গের একটি মহকুমা শহরে। ছোটবয়স থেকেই আর পাঁচটা মেয়ের মত পড়াশুনা, গানবাজনা, খেলাধুলো করে বেড়ে উঠেছি। জীবনে কখনও কন্যাসন্তান বলে অবহেলিত হইনি। বাড়িতে বরাবর শুনেছি প্রত্যেক মেয়ের স্বনির্ভর হওয়া খুবই জরুরি। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম একবার, কিন্তু হয়নি। তবে এতে আশাহত হইনি। প্রেম জীবনে একবারই এসেছিল, তার সঙ্গেই বিয়ে। বিয়ের পরে বুঝলাম সেও নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তার কাছে এবং বাবা-মায়ের কাছে পাওয়া শিক্ষা থেকে একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার – মেয়ে মানে হাতা-খুন্তি-লিপস্টিক নয়, মেয়ে মানে ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা।
১৯৯২ সালে বিয়ের পর, স্বামীর কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স-এর কালচিনি ব্লক-এ এলাম। কালচিনি ছোট্ট একটা ব্লক। চারদিকে যেন সবুজ কার্পেট পাতা – শুধু চা বাগান আর চা বাগান। কী অপরূপ দৃশ্য। কতরকম গাছপালা! কোথাও গভীর জঙ্গল, কোথাও পাহাড়, কত যে নদী! অদ্ভুত সব নদী – জল নেই। আবার যখন জল হয়, কী ভয়ঙ্কর তার রূপ! বেশিরভাগ সময় পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই নদী ভরে যায়।
বিচিত্র এই ডুয়ার্স। একদিকে ভুটান, একদিকে আসাম আর নেপাল। বাংলাদেশও খুব একটা দূরে নয়। বিভিন্ন জনজাতির বাস ডুয়ার্স-এ। নেপালি, আদিবাসী, মেচ, রাভা, ডুকপা, টোটো – কত জনজাতি আর কত ভাষারই না সমাবেশ!
মানসিকতা ছিল একটা চাকরি করব – পেয়ে গেলাম। সংস্থার নাম ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েসান অফ ইন্ডিয়া (FPAI)। প্রসঙ্গত বলে রাখি, FPAI কালচিনি ব্লকে পঞ্চাশের দশক থেকে কাজ করছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এই সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও মহিলাদের যৌন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে এরা কাজ করে। একটি বিজ্ঞাপন দেখে, ব্রিটিশ ডাক্তার Dr. B.R. Bumbli এই বিষয়ের ওপর কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলে দীর্ঘদিন যোগাযোগের পর এখানে একটি শাখা খোলার অনুমতি পান। আজকে এটি FPAI-Kalchini Branch নামে পরিচিত।
প্রথমদিকে চা বাগানের মাঠে প্রচার চলত প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য বিষায়ক সিনেমা দেখিয়ে। দৈনন্দিন কাজের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট কর্মচারী ছিল না। সংস্থাটি সদস্যরাই চালাতেন। কার্যপরিবাহক সদস্যসংঘ গঠন করা হত বিভিন্ন চা বাগানের ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, ও ডাক্তারদের নিয়ে। ১৯৯০ সালে, FPAI তিনজন কর্মী নিয়োগ করল। তিনজনই পুরুষ কর্মচারী। সেই সময়ে এই সংস্থাটিকে একটি বিশেষ চা বাগান থেকে সরিয়ে কালচিনিতে নিয়ে আসা হল পঞ্চায়েত এলাকা, বনবস্তি, ও সব চা বাগানে কাজ করতে পারবে বলে। ধীরে ধীরে সংস্থাটির প্রভাব বাড়ল ঠিকই, কিন্তু মহিলাদের সহযোগিতা পাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠল। সমস্যা লাঘবের জন্যে ১৯৯৩ সালে সংস্থাটি তিনজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবক কর্মী নিয়োগ করল। এদের ভাতা ছিল মাথাপিছু মাত্র তিন’শ টাকা। এই তিনজনের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে দু’জন মহিলা কর্মী অন্য কাজে যোগ দিয়ে চলে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি। আমার আগ্রহ অজানাকে জানব।
কালচিনির জনসংখ্যা তিন লক্ষ তিরিশ হাজার। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি, ৪৮টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, তেরোটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তিনটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। যখন কাজে যোগ দিলাম পরিস্থিতি একেবারেই অজানা। কোনো এলাকা চিনি না, ভাষা বুঝি না – শুরু হল আমার পথ চলা। পথ চলতে গিয়ে অনেক হোঁচট খেয়েছি, কিন্তু থেমে যাইনি। ফিল্ড ওয়ার্ক দিয়ে কর্মজীবন শুরু হল। আমার দায়িত্ব হল ‘নিরাপদ মাতৃত্ব’ সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো।
এই অঞ্চলে পরিবহন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তার একটাই কারণ – এখানে জঙ্গলে হাতি আর বাইসন, আর চা বাগানে চিতাবাঘের বাস। রাতে এরা অবাধে চলাফেরা করে; এমনকি দিনেও জনবসতিতে চলে আসে। কিন্তু এই নিয়েই এখানকার জীবনযাত্রা – আমিও তাই করে চলেছি। কাজে যাওয়ার সময় কিছুটা পথ বাসে গিয়ে হাঁটি মাইলের পর মাইল। তারপর পৌঁছই গন্তব্যে।
ভাষা শিখতে গিয়ে পড়লাম আরেক বিপাকে। আদিবাসী, মেচ, রাভা – কোনো ভাষাই জানি না। আমি হিন্দিতে কথা বললে কেউ তার একবর্ণ বোঝে না। বুঝলাম এদের নিজেদের ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানা নেই। দিনের পর দিন ফিল্ড পরিদর্শণে গিয়ে নেপালি, আদিবাদী ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করতাম – সবাই হাসত। জানতাম ভুল বলছি, তবু না থেমে বলে যেতাম কথা। কখনও কখনও সেই সব ভাষা বাংলায় লিখে অনুশীলন করতাম। কেউ ভাষা না বুঝলে মানুষের সঙ্গে কাজ করব কী করে? দু’একটা উদাহরণ দিই।
‘মেয়েদের আঠারো বছর না হলে বিয়ে দেওয়া যাবে না’ – এই বাক্যটি রাভা ভাষায় বলব ‘সা মিচিক নি আঠারা বছর সায়চা রউন লাও মাঞ্চা না।’ আবার ‘আমি তোমার সঙ্গে যাব না’ – আদিবাসী জনজাতি ভাষায় বলব, ‘ম তর সঙ্গ নি যাবু।’ আবার, ‘তোমার বয়স কত বছর?’ নেপালি ভাষায় বলতে হবে ‘তপাইক-অ কতি বরসো ভইয়ো?’ কখনও ভুল, কখনও ঠিক বলতে বলতে ভাষাগুলো রপ্ত করে ফেললাম।
সুরক্ষিত মাতৃত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম সেই অঞ্চলের মেয়েরা কেমন করে থাকে। তাদের প্রতি সবার সবসময়ই কেমন যেন তাচ্ছিল্য; সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যের অবস্থা শোচনীয়। তখনকার প্রজনন স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কথা ভাবলে আজও আমি শিউরে উঠি। ঘরে ঘরে নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য, বাল্য বিবাহ, কমবয়সে গর্ভধারণ, বিপজ্জনক গর্ভপাত, পাচার, নেশা – কী নেই! আরম্ভ করলাম জনসংযোগ – ব্যক্তিগত, দলীয়, গণসভা ডেকে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস। এই ছিল স্বাস্থ্যশিবির। সেখানে আলোচনা হত মেয়েদের বিয়ের সঠিক বয়স, বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রজনন স্বাস্থ্য ও তার সুরক্ষা, প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিচর্যা, হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের উপকারিতা, শিশুদের টিকাকরণ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি, বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মূত্রনালি ও জননেন্দ্রিয়ে সংক্রমণ ও প্রতিকার, নিরাপদ গর্ভপাত, ইত্যাদি বিষয়ে।
কাজ করতে গিয়ে বহু বাড়ির পুরুষের কাছে অপমানিত হয়েছি, কারণ বেশির ভাগ পুরুষই মহিলাদের স্বাধীনতা বিরোধী। এই প্রতিরোধ সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে গেছি। প্রশিক্ষণ শিবিরে পুরুষদের অত্যাচারের সঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদ করতে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাদের স্বনির্ভরতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে সমবয়সি সঙ্গী-শিক্ষার (peer-education) ব্যবস্থা চলেছে। ‘Go for Health Club’-এ কিশোরকিশোরীদের আভ্যন্তরীণ খেলার (যেমন, লুডো, ক্যারম, তাস, টেবিল টেনিস, ইত্যাদি) সঙ্গে স্বাস্থ্য বিষায়ক শিক্ষা দেবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম ক্রমশ মানুষের মধ্যে ব্যাবহারিক পরিবর্তন আসতে লাগল।
মহিলাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কাজকে ভালো লাগার পাশাপাশি সুন্দরী ডুয়ার্সকে ভালোবেসে ফেললাম। নিঝুম এলাকা, চারদিকে চা পাতার মিষ্টি গন্ধ, সন্ধ্যার পরে একেবারে নিঃশব্দ। ভোরে ঘুম ভাঙে পাখির গানে। কোকিল এখানে পৌঁছে যায় বসন্তের অনেক আগেই। সন্ধে হতে না হতেই মাদলের তাল – ডু-ডুং, ডু-ডুং, সঙ্গে আদিবাসীদের নৃত্য। কী অপূর্ব তার তাল, লয়, ছন্দ। সঙ্গে চলে ঝিঁঝিঁ পোকার কীর্তন। প্রকৃতির সেরা সঙ্গীত আকাদেমি যেন এই ডুয়ার্স। আবার কখনও মাঝরাতে হই হই রবে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেছে। হাতি গ্রামে ঢুকেছে – তাই মশাল নিয়ে, কখনও বা বাজি ফাটিয়ে হাতির পাল তাড়ানো হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন আজও হয়নি, তবে ঘন জঙ্গলের সংখ্যা এখন কমে যাচ্ছে। হাতি, বাইসন, চিতা, সংখ্যায় বেড়ে খাবারের সন্ধানে জনবসতির মধ্যে চলে আসছে। এর শেষ কোথায় হবে কে জানে!
ফিরে আসি কাজের জগতে। মহিলাদের স্বাস্থ্যের বেহাল অবস্থা, বারবার গর্ভধারণ, অপুষ্টি, আর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যশিবির চলতে লাগল। সেখানে এবং কাউন্সেলিং কেন্দ্রে মেয়েদের মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহ রূপটি নজরে আসাতে আমরা তাদের প্রতিবাদের ভাষা শেখাতে আরম্ভ করলাম। সেই সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া আরম্ভ হল। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল স্বামীর অমত সত্বেও মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে এগিয়ে আসছেন। সমাজকে সক্রিয়ভাবে সহকর্মী করেই একটু একটু করে এই সফলতা পাওয়া গেল।
এখনও অনেক কাজ বাকি। কাজের খুঁটিনাটি প্রতিনিয়ত শিখে চলেছি। নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে কেউ এলে তাদের সঠিক পরামর্শ দেবার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যমের সহায়তা নিই। কখনও বই পড়ে, ডাক্তার গুণীজনের কাছে নিজে পরামর্শ নিয়ে, আবার কখনও কঠিন সমস্যায় সমব্যাথী হয়ে মানুষের সহযোগিতা করি। নিজে শিখতে গিয়ে বুঝেছি, মানুষকে ভালোবেসে ধৈর্য, সততা বজায় রেখে ভুলের স্বীকারোক্তি করলে মানুষ অন্যকে সহজে গ্রহণ করে।
প্রথমদিকের সেই সংগ্রাম আজ অতীত, তবে অবশ্যই স্মরণীয়। খুব আনন্দ হয় যখন দেখি বহু পুরুষ-মহিলা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে নিজেরাই আগ্রহী। বুঝি, এইখানেই রয়েছে বুনিয়াদী স্তরে কাজ করার সার্থকতা। আজ যতটুকু শিখেছি তা এই অচেনা জনজাতি, অচেনা জায়গা আমাকে শিখিয়েছে। আমি গর্বিত, আনন্দিত। দীর্ঘ সাতাশ বছর কাজ করেছি, কিন্তু এতটুকু ক্লান্ত হইনি। একেই বোধহয় বলে ‘আত্মসন্তুষ্টি।’
3 Comments