বোকা এবং কয়েকজন
[সম্পাদকীয় সংযোজনঃ তরুণ লেখক শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকস্মিক প্রয়াণে আমরা, ‘অবসর’ পত্রিকার সভ্যরা মর্মাহত। তিনি ছিলেন আমাদের চিরসুহৃদ। অবসরের এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছিল ১৫ই জানুয়ারি, ২০১৭। সেই বিশেষ সংখ্যার অতিথি সম্পাদক ছিলেন ঈশানী রায়চৌধুরী। তাঁর অনুরোধে শীর্ষ এই লেখাটি পেশ করে ছিলেন। তাঁর অবর্তমানে সেই লেখাই আমাদের সঙ্গী হয়ে রইল।]
আলোচনার বিষয় বোকাবাক্সের গোয়েন্দারা। সিনেমা নয়, টিভির। যাঁদের অনেকেই বইয়ের পাতা থেকে সোজা এসে পড়েছেন ছোট পর্দায়। আর কিছু গোয়েন্দার জন্ম, কর্ম, সব টিভিতেই। ছোট পর্দা, কিন্তু কাজটা নেহাত ছোট নয়। মাত্র আধ ঘণ্টার স্লট। বিজ্ঞাপনের সময় বাদ দিলে বরাদ্দ ২২ মিনিট। এইটুকু সময়ের মধ্যে আস্ত একটা গোয়েন্দা গল্প বলে ফেলা রহস্যভেদের থেকেও শক্ত। ধারাবাহিক কায়দায় প্রত্যেক এপিসোডে একটু একটু করে গল্পটা অবশ্য বলা যায়। সে তো খিচুড়ি রেঁধে ফ্রিজে রেখেও খাওয়া যায় অনেকদিন ধরে!
কাজেই চেষ্টা থাকে ওই ২২ মিনিটেই বাজিমাত করার। কিন্তু টিভি–তে প্রযোজক–পরিচালকদের হাত–পা বাঁধা। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কোনো গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করলে, তিনি বোকাবাক্সে আঁটবেন না। সাড়ে ছ’ফুট উচ্চতা, ব্যায়াম করা বলিষ্ঠ শরীর, কারাটে–কুংফু–জুজুৎসু–বক্সিং এবং ইঁদুর ধরা, বাঘ মারায় সমান দড়, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী সব্যসাচী বন্দুকবাজ — এসব ছাইপাঁশ গালগপ্পে লাভ নেই, কারণ ছোট পর্দায় তার এফেক্টই পাওয়া যাবে না। একই কারণে কাহিনি বিন্যাসেও পরিমিতি বোধ রাখতে হবে, সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে বাজেট। গাড়ির পিছু ধাওয়া করার ধুন্দুমার দৃশ্য, বা তার এরিয়াল শট অনর্থক! চেজিং সিকোয়েন্সই বাদ দিলে হয়, নেহাত দরকারে ক্লোজ শটে ব্যস্ত পায়ের দৌড়োদৌড়ি দেখাতে পারলেই যথেষ্ট। গোয়েন্দার এক হাতে উদ্যত পিস্তল আর অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরিয়ে, তাকে পাঁচতলা থেকে পাইপ বেয়ে নামানোটাও আহাম্মকি। বরং তার চরিত্রটা এমনভাবে তৈরি করা হোক, যেটা গড়পড়তা লোকের মতো নয়, অন্য ধারার। সেটা অদ্ভুত, কিংবা বেয়াড়াও হতে পারে!
সেভাবেই সামনে এসেছিল ‘করমচাঁদ।’ গোয়েন্দা সম্পর্কে ধারণাটাই আমূল বদলে দিয়েছিল পঙ্কজ পরাশরের সেই টিভি সিরিজের গোয়েন্দা। সেটা ’৮০র দশক, দূরদর্শনের মৌরসিপাট্টা। রোজ সন্ধে ছ’টায় রবিশঙ্করের ঝ্যাং চ্যাং চ্যাং সুরে তিনটে সাদা গোল্লা ঘুরতে ঘুরতে দূরদর্শনের লোগোয় গিয়ে স্থির হয়, যার তলায় হিন্দিতে লেখা থাকে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম।’ তার কয়েক বছর আগেই স্বনামধন্য রাজ কাপুর উদার–বক্ষ জিনাত আমনকে নিয়ে সমনামী ছবিটি বানিয়ে বিপুল ছিছিক্কার এবং বিপুলতর হাততালি কুড়িয়ে ফেলেছেন। তা সত্ত্বেও দূরদর্শন নির্বিকার এবং অকুতোভয়। যাহা সত্য এবং সুন্দর, তাহাই কেবল টিভি–তে দেখানো হয়। তবু রাতজাগা বেড়ালদের জন্য কখনো–সখনো শিকে ছিঁড়ত। দেখার সুযোগ হতো জেরেমি ব্রেট অভিনীত শার্লক হোমসের বিবিসি টিভি সিরিজ, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ বাজারে আসার আগে পর্যন্ত যাঁর হোমসই ছিল সেরা। মাঝে মধ্যে এরকুল পোয়ারো, মিস মার্পল। তেনাদের দেখে দেখে গোয়েন্দারা ঠিক কেমন হন, বইতে এবং টিভি–তে, তার একটা আন্দাজ হয়েই গেছে। উৎকেন্দ্রিক অথচ ক্ষুরধারবুদ্ধি শার্লক, নিখুঁত স্যুট এবং মোম–মাজা গোঁফের ডগা নিখুঁততর কোণে ওপরে উঠে থাকা, চটজলদি রসবোধে টইটম্বুর এরকুল, অথবা নকশাদার কার্পেট ব্যাগ, বাহারে টুপি–ছাতা সমেত মিস মার্পল। এমন সময় সব চিন্তা–ভাবনা গুলিয়ে দিতে চলে এলেন ‘করমচাঁদ।’
সিরিয়ালের শুরুতে বিলকুল অন্যধারার শীর্ষসঙ্গীত, নাকি তার দোসর মারকাটারি মন্তাজ, কোনটায় প্রথম টোপ গিলেছিলাম খেয়াল নেই, কিন্তু করমচাঁদ হিসেবে পঙ্কজ কাপুর একেবারে গেঁথে গেলেন টাকরায়। প্রতি এপিসোডে যে রহস্যভেদের বিরাট কোনো মারপ্যাঁচ দেখা যেত, তা আদৌ নয়। অপরাধের ডিটেকশন, বা ডিডাকশনের ধার ধারত না ২২ মিনিটের এপিসোড, তবু মজিয়ে রাখত আগাগোড়া। করমচাঁদ রাতবিরেতেও কালো রোদচশমা পরে থাকেন। সিগারেট, চুরুট, বা পাইপ নয়, কচকচ করে গাজর খান। আর পলিটিকাল কারেক্টনেস এবং জেন্ডার ইকুয়ালিটির ধুদ্ধুড়ি নেড়ে দিয়ে নিজের মহিলা সহকারী কিটি–কে ধমকে, দাবড়ে চুপ করিয়ে রাখেন। প্রতি এপিসোডের শেষে কিটি ভক্তি, আহ্লাদ আর নেকুপনায় গলে গিয়ে বলে, ‘স্যর, ইয়ু আর আ জিনিয়াস!’ আর করমচাঁদ হাত দিয়ে মাছি ওড়ানোর ঢঙে বলেন, ‘শাট আপ কিটি!’
করমচাঁদের বিচিত্র হাবভাব সেই প্রথম বুঝিয়েছিল, টিভি–র গোয়েন্দারা চিরাচরিত রহস্যভেদীদের থেকে একটু অন্যরকমও হতে পারেন। তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় না। অনেক পরে বোধোদয় হয়েছিল, নিজের হোমওয়ার্কটাই ঠিক ছিল না। গোয়েন্দারা অসাধারণত একটু খাপছাড়াই হন। নেহাত যদি বাঙালির পরিপাটি ফেলুদা, বা সাংসারিক ব্যোমকেশ বক্সি, কিংবা শ্রী জটায়ুর প্রখর রুদ্র না হন। কনান ডয়েলের ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ গল্পে প্রথম শোনা গেল শার্লক হোমসের কথা। ডক্টর ওয়াটসন তাঁর নতুন বন্ধুর ভাল–মন্দের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন এভাবেঃ সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান — শূন্য! দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান — শূন্য! এর পর অবশ্য সাফাই গাওয়ার মতো ওয়াটসন বলেছেন, কিন্তু বেহালাটা ভাল বাজায়। আর ‘সেনসেশনাল লিটারেচর’ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। ‘সেনসেশনাল’ মানে কি পর্নোগ্রাফি? খোলসা করেননি বন্ধু ওয়াটসন। ক্রমে ক্রমে আরও জানা গেছে হোমসের কোকেন আসক্তি ও আরও নানা বেয়াড়া গুণের কথা। কাজেই উন্মার্গতার যদি কোনও মাপকাঠি হয়, তার চূড়ান্ত সূচক ছিলেন শার্লক হোমস। যে ধরনের লোককে কিছুতেই ভদ্র সমাজের মানানসই করে তোলা যায় না। এবং টিভি সিরিজের শার্লককে জেরেমি ব্রেট যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আধুনিক সময়ে তারই ভাব সম্প্রসারণ ঘটালেন কাম্বারব্যাচ। দু’ক্ষেত্রেই আসলে ওই অতিমানবিক এক্সেন্ট্রিসিটিরই উদযাপন হল মহা সমারোহে। বইয়ে যেটুকু অধরা ছিল, সেটাও চমৎকার রেঁধেবেড়ে পরিবেশন করল বোকাবাক্স।
এরকম আরও একজন আছেন অদ্ভুতরস জাগানিয়া টিভি গোয়েন্দা। এড্রিয়ান মঙ্ক। তিনি অবশ্য শার্লক হোমসের মতো জগদ্বিখ্যাত কেউ নন, কিন্তু একই রকম বেয়াড়া ধারার। অবশ্য মঙ্কের সমস্যা অনেকটাই ব্যক্তিগত।
যেমন তিনি ও.সি.ডি.–তে ভোগেন। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার। খুনের তদন্তে গিয়ে হয়ত দেখতে পেলেন, সার দিয়ে সাজানো জুতোর কোনও একটি পাটি একটু বেঁকে আছে। মঙ্ক সব ছেড়ে আগে গিয়ে সেইটা সোজা করে দেবেন। সম্ভাব্য খুনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হয়ত দেখলেন খাওয়ার টেবিলে রাখা নুন এবং মরিচের পাত্র দুটো এক লাইনে নেই, মঙ্কের মধ্যে অদম্য ইচ্ছে হবে ভুলটা আগে শুধরে দেওয়ার। গল্প বোনার কৌশলে অবশ্য এই বাতিকই শেষ পর্যন্ত রহস্যভেদের সূত্র, অপরাধীকে গেঁথে ফেলার অব্যর্থ তির হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সানফ্রান্সিসকো পুলিসের বরখাস্ত হোমিসাইড ডিটেকটিভ এড্রিয়ান মঙ্ক একজন হাস্যকর চরিত্র হয়ে আমোদ জোগান বিস্তর। নানা বিচিত্র বাতিক আছে মঙ্কের। যেমন কারও সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হলেই রোগ সংক্রামিত হওয়ার ভয়। যে কারণে মঙ্কের সহকারী মহিলা হাত মোছার টিশ্যুর কৌটো সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কারো সঙ্গে হাত মেলানোর পর মঙ্ক তার সামনেই টিশ্যু দিয়ে ঘষে ঘষে হাত মুছে ফেলেন!
তবে অন্যরকম গোয়েন্দা মানেই যে মজাদার, তা সবসময় নয়। যেমন আই টিভি–র সিরিজ ‘আ টাচ অফ ফ্রস্ট’এর ডিটেকটিভ জ্যাক ফ্রস্ট।
খেঁকুরে, বদমেজাজি একটা লোক, যে হামেশা ওপরওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসে থাকে! ফলে ফ্রস্টের শত্রু বাইরে এবং ঘরেও। এহেন কুঁদুলে গোয়েন্দাও কিন্তু প্রতিটা কেসে সফল হয়। ফ্রস্টের চরিত্রে তুমুল, তুখোড় অভিনয় করতেন ডেভিড জেসন। এতটাই ভাল, যে দর্শকদের বিচারে সারা বিশ্বের, সর্বকালের সবসেরা গোয়েন্দা নির্বাচিত হয়েছিল জ্যাক ফ্রস্ট। এই যে গোয়েন্দারাও আদতে ‘ভাল লোক,’ বা ‘আদর্শ চরিত্র’ নাও হতে পারেন সবসময়, এই ভাবনাটাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল বিবিসি–র আরেক টিভি সিরিজ ‘লুথার’।
ইদ্রিস আলবা অভিনীত চিফ ইন্সপেক্টর জন লুথার এমন কাজপাগল, অপরাধের রহস্যভেদে এত বেশি মনযোগী, যে অপরাধীর অন্ধকার মনস্তত্বের সঙ্গে সে নিজেও জড়িয়ে যায় বারবার। লুথারের স্রষ্টা নিল ক্রস পরে বলেছিলেন, লুথার চরিত্রটা গড়া শার্লক হোমসের আদলে, কিন্তু আরও গভীর, আরও জটিল আর অন্ধকার। তবে তার কাহিনির বিন্যাস ছিল সত্তরের দশকের আরেক বিখ্যাত মার্কিনি টিভি সিরিজ ‘কলাম্বো’র কায়দায়, যেখানে গোড়াতেই দেখিয়ে দেওয়া হয় অপরাধী কে! টিভি সিরিয়ালের তথ্যপঞ্জী বলছে, আমেরিকার বাইরেও ৪৪ টা দেশের টিভি–তে দেখানো হয়েছে কলাম্বো, কিন্তু ভারতে সম্ভবত কখনও হয়নি। দেখালে মন্দ হতো না। কলাম্বোর একটি এপিসোড পরিচালনা করেছিলেন খোদ স্টিভেন স্পিলবার্গ!
বাংলা টেলিভিশন সেই তুলনায় নেহাতই দুগ্ধপোষ্য। তার গোয়েন্দারা চেনা ছক ছেড়ে বেরোবার সাহস পাননি। অথচ রসদ যে ছিল না, তা নয়। চিরন্তন বাবু বাঙালি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সি, বা সপ্রতিভ প্রদোষ সি মিটার–কে বাদ দিলেও প্রেমেন মিত্তিরের পরাশর বর্মা ছিলেন, অথবা সৈয়দ মুজতবা সিরাজের কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কিন্তু কেন কে জানে, প্রযোজক–পরিচালকরা কখনও নজর দেননি। ব্যাপারটা কিন্তু, যাকে বলে, হাইলি সাস্পিশাস্!
—–
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত