শিশুসাহিত্যিক জসীমউদ্দীন
তখন বিশ শতকের গোড়ার দিক। স্বদেশীর প্রচার চলেছে জোরকদমে। এক যুবক গ্রামে গ্রামে ঘুরে পল্লীর অগ্রজদের মুখে শোনা গল্পের পর গল্প ফোনোগ্রাফের মোম রেকর্ড-এ লিপিবদ্ধ করছেন। গোটা ময়মনসিংহ চষে বেড়িয়ে এই কাজ করে ১৯০৬ সালে কলকাতা এসে তিনি এই সংগ্রহের নমুনা দেখালেন বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-র লেখক দীনেশচন্দ্র সেনকে। দীনেশবাবু তো নমুনা দেখেই আপ্লুত — তাঁর উদ্যোগেই ‘ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স’ থেকে লোকগল্পগুলি নীল কাপড়ে মোড়া, সোনালি বর্ডার দেওয়া বই আকারে প্রকাশিত হল। সেই বইয়ের পাণ্ডুলিপি যেই পৌঁছল রবীন্দ্রনাথের হাতে, তিনি প্রথম এডিশনেই সংগ্রাহক-সম্পাদকের প্রচেষ্টার প্রবল প্রশংসা করে একটি ভূমিকা জুড়ে দিলেন। তৈরি হল দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি — স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম রূপক, ও আগত প্রজন্মের কাছে বাংলা শিশুসাহিত্যের এক আদর্শ দৃষ্টান্ত।
এই গল্পটা অনেকেরই জানা। তবে তিরিশের দশকে ঠাকুরমার ঝুলি/ঠানদিদির থলের মতোই শিশুসাহিত্য হিসেবে লোককথা — এই ধরনের আরেকটা বইও বেরোতে পারত। দক্ষিণারঞ্জন-এর মতই আরেক যুবক, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র জসীমউদ্দীন, দীনেশ চন্দ্র সেনের কাছে তাঁর লোকগানের পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হন। দীনেশ সেন তখন চার খন্ডের ময়মনসিংহ গীতিকা সম্পাদনার বিশাল কাজে মশগুল। যুবকের কাজে উৎসাহিত হয়ে তক্ষুনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গবেষণা গ্রান্ট জোগাড় করে দিয়ে আরও গান সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিয়ে দিলেন। এর কয়েক বছরের মধ্যেই দীনেশ চন্দ্র সেনের সমর্থন ও সহায়তায় জসীমউদ্দীন ‘পল্লী কবি’ খেতাব লাভ করেন। তবে সেই দীনেশ সেন-এর সঙ্গে প্রথম দেখার দিন জসীমউদ্দীন তাঁর কাছে আরেকটি প্রস্তাব এনেছিলেন। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লোকমুখে শোনা গল্প তিনি ছোটোদের জন্য গল্পকারে লিখে প্রকাশ করতে চান। তিরিশের দশকে সন্দেশ পত্রিকার হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্য বেশ কিছু পথ অতিক্রম করেছে। রূপকথা, বিশেষত স্বদেশী রূপকথার বাজার নেই। অতএব…
জসীমউদ্দীন আজও পল্লী কবি হিসেবেই প্রখ্যাত। নকশী কাঁথার মাঠ, রাখালী, সোজন বাদিয়ার ঘাট, ইত্যাদি রচনার ওপর ভিত্তি করেই তাঁর খ্যাতি। এক বিশেষ বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর উদ্যমে তাঁর এই খেতাব লাভ। জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, যেদিন তিনি দীনেশ সেন-এর সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে যান, সেদিন তাঁকে বলা হয়েছিল যে বাংলায় অনেক কবি লেখক মজুত আছেন।[i] কিন্তু একজন গ্রামের ছেলে হিসেবে তিনি যেভাবে গ্রামবাংলার গান সংগ্রহ করতে পারেন, সেই কাজ অন্যের দ্বারা হবে না। দীনেশ সেন খুব স্পষ্টভাবে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নিজের লেখার কদর তিনি করবেন না, অন্ততঃ বাংলা লোকগানের বিপুল গবেষণা চলাকালীন তো না-ই।
একজন মানুষকে একভাবে চেনার পর তাঁর অন্যরকম পরিচিতি দেওয়া কঠিন। “কবর” কবিতার স্রষ্টা জসীমউদ্দীনকে সেই স্কুল থেকেই আমি চিনতাম। অনেক বছর পর শিশুসাহিত্য নিয়ে এমফিল করতে গিয়ে শিশুসাহিত্যিক জসীমউদ্দীন এর সঙ্গে আলাপ হল। দীনেশ সেন প্রকাশ না করলেও জসীমউদ্দীনের উপকথার সংগ্রহ পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, বাংলা অ্যাকাডেমির প্রচারের জন্যে শিশু-কিশোর সাহিত্যিক হিসেবেও ওপার বাঙলায় তাঁর খ্যাতি হয়। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।
জসীমউদ্দীনের শিশুসাহিত্যের সূচনা হয় ১৯৩৮ সালে, হাসু-কে দিয়ে।
হাসু একটি ছোট্ট মেয়ে
এদের মত — তাদের মত,
হেথায় সেথায় ছড়িয়ে আছে
খোকা খুকু যেমনি শত।
নয় সে চাঁদের চাঁদকুমারী
তারার মালা গলায় পরে,
চালায় না সে চাঁদের তরী
সারাটা রাত গগন ভরে।
রূপকথাতে ঠাঁই নাই তার,
রূপে আলো রাজার কনে,
গাছরা দোলায় ফুলের হাসি
ভাব করিয়ে তাহার সনে।
কাঁদলে পরে মুক্ত ঝরে,
হাসলে ঝরে মানিকগুলো;
চলতে পায়ের আলতাতে যায়
রঙিন হয় পায়ের ধুলো।
পাতালপুরীর আঁধার ঘরে
ঘুমিয়ে হাসে আর যে মেয়ে,
গড়িয়ে পড়ে চাঁদরা তাহার
হাতের পায়ের পরশ চেয়ে।
মাথার পরে কাল অজগর
পট ফণাতে মানিক জ্বেলে,
নিতুই তারে বাতাস করে
কখন দুলে কখন হেলে;
এদের সাথে হাসুর সাথে
তুলনা তো হয়ই না ভাই,
তারে লয়ে জাকজমোকের
এমন কোনো গল্প নাই…
শিশুসাহিত্যে, বিশেষ করে রূপকথাধর্মী শিশুসাহিত্যে অনেক সময় দেখা যায় ছোট মেয়েদের রাজকন্যার সাথে তুলনা করা হচ্ছে, এবং ছেলেদের রাজকুমার। কিন্তু হাসু সংকলনের কবিতায় জসীমউদ্দীন এই ধারণা ধূলিসাৎ করলেন। তার কাছে হাসু হলো সর্বজনীন শৈশব, সমস্ত সাধারণ বাচ্চা মেয়ের প্রতীক। পাতালপুরী, কাল অজগর, চোখের জলে মুক্তো, ইত্যাদি, যা সব রূপকথাধর্মী সাহিত্যের বিশেষ মোটিফ, তা হাসুর শৈশবের চেয়ে আলাদাI তার জীবন অতি সাধারণ, কল্পনাজগতের অলীক স্বপ্নে মোড়া নয়। কবিতা যেন খুব সন্তর্পনে শিশু পাঠককে তার জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছে।
প্রথমটা এমন কবিতা পড়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এরকম সুবক্ত কল্পনা ও বাস্তবের তফাৎ দেখিয়ে নিছক শিশুসাহিত্যে কবি কী বোঝাতে চাইছেন? আরেকটু পড়াশোনা করে কিছু উত্তর মিলল। শান্তিনিকেতন-এ থাকাকালীন জসীমউদ্দীন লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যান, ও তখনই তাঁর সঙ্গে আসল হাসুর আলাপ হয়। হাসু আর কেউই নয়, প্রভাতকুমারের ভাইঝি। তখন থেকে শুরু হয় কবি ও বালিকার মধ্যে পত্র নিবেদন। বহু বছর চলে এই আদান প্রদান। এই ছোট্ট মেয়েটিকে খুশি রাখতে কবির দিন কেটে যায়। তারপর হঠাৎ একদিন হাসু বড় হয়ে ওঠে। এমনি এক লেখকদের আড্ডার সন্ধ্যায় হাসু আর তার পুরনো বন্ধুর কাছে ঘেঁষতে চায় না।[ii] হাসু সংকলনটি এই ঘটনার ঠিক পরপরই বের হয়। কোনো একটি অব্যক্ত ব্যাথায় বোধয় কবি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, তাই তাঁর কল্পনায় হাসুর শৈশব খুব বাস্তব, রূপকথায় মোড়া নয়। পরে অবশ্য নিজের মেয়ে বেগম হাসনাকেও আদর করে হাসু ডাকেন, ও সূর্য দীঘল বাড়ী উপন্যাসে হাসু নামে একটি চরিত্রের সন্ধান মেলে।[iii] এইভাবে সত্যি সত্যি হাসু হয়ে ওঠে বিভিন্ন কাল্পনিক ও আসল শিশুর প্রতিনিধি ও চিরশৈশবের প্রতীক —
তবু তারই ভালো লাগে
চাঁদের দেশের চাঁদের মেয়ে —
শঙ্খমালা, চন্দ্রাবতী,
যখের কনে, সবার চেয়ে।
কারণ সে যে ওদের মত,
তাদের মত, সবার মত,
হেথায় সেথায় খোকা খুকু
হাসে খেলে যেমনি শত।
অনেক তাহার পুতুল আছে,
খেলনা আছে, দোলনা আছে,
যেমনি আছে আমার কাছে,
তোমার কাছে, সবার কাছে,
তাই তাহারে আদর করে
সব শিশুরে আদর করি,
শুনিয়ে তারে রূপকথা যে
সকল শিশুর পরাণ ভরি।
হেথায় সেথায় সকম খানে
আছে যারা হাসুর মত,
ছড়িয়ে দিলাম তাদের তোরে
আমার বাধা শোলোক যত।[iv]
হাসু বইয়ের প্রসঙ্গে থেকে জসীমউদ্দীন-এর শিশুপ্রীতির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। আতোয়ার রহমান এ বিষয় আরও বিস্তারিত লিখেছেন —
ঢাকায় কলকাতায় কেবল এক একটি শিশুর সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে তার যে কতো অচেনা পরিবারের সাথে পরিচয় এবং তাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়েছিল, তার হিসেব দেওয়া ভার। এই শিশুদের অনেককে নিয়েই তিনি কবিতা লিখেছেন। অনেকের অটোগ্রাফের খাতায়ও তিনি ছোট ছোট কবিতা লিখে দিয়েছেন।[v]
তাঁর লোকগানের ও গ্রাম্য ছড়ার গবেষণার কাজও অবশেষে ছোটোদের সঙ্গে ভাব পাতানোর ছুতোয় ব্যবহৃত হয়েছে। “আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর,” “পালের নাও,” ইত্যাদি কবিতা সব লোক ছড়ার পরিবর্তিত রূপ। তবে সেখানেও বাস্তবকে উপেক্ষা করে কখনো কল্পনার জগতের আশ্রয় নেননি কবি।
শৈশব যে নির্মল, বিশুদ্ধ কোনো সময়কাল নয়, তাতেও যে কঠোর বাস্তবের প্রভাব পড়ে, এ কথা তিনি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন এক পয়সার বাঁশি গ্রন্থে। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় তিনি দুঃখ, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, কখনো গোপন করেননি। “কবি ও চাষার মেয়ে” কবিতায় যেমন ছোট্ট মেয়ে খুকুমণি কবির মিথ্যে প্রতিশ্রুতিকে হেয় করে বলে-
সাত তালি এই কাপড়খানা তাও গিয়েছে আজকে ছিঁড়ে
পায়েতে নাই একটু তেনা, শীত কাপিছে অঙ্গ ঘিরে।
ওগো তোমার পায়ে পড়ি চারটি আনা দিবে কি ধার?
সারাটা দিন পায়নি খেতে পেটটি জ্বলে জ্বালায় ক্ষুধার।
ছদন শেখের কন্যা আমি, অনাহারে বাপ মরেছে,
জনমদুখী মা জননী, সেই তাহারি সঙ্গে গেছে।
এক পয়সার বাঁশি গ্রন্থের প্রধান চরিত্র খোসমানী ও আসমানী। খোসমানী সমৃদ্ধশিল বাড়ির মেয়ে, আসমানী দুস্থ বাড়ির কন্যা। বিভিন্ন কবিতায় খোসমানীদের কাছে তিনি আসমানীদের সাহায্য করার জন্যে আবেদন জানিয়েছেন। পরে আসমানীর কবিভাই বলে কিশোরপাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি পত্র সংকলন তাঁর মরণোত্তর কালে প্রকাশিত হয় — তাতে আসমানীর পুষ্টিহীন শরীর, চিরদারিদ্র্য ও পার্টিশন কালের নিপীড়িত ও নির্মম গ্রামবাংলার সাক্ষী, ও কবি তাঁর অসহায় সঙ্গী। আসমানীকে নিয়ে লেখা পুরনো কবিতা ও এই পত্রসংকলন বোধহয় শিশুকিশোর পাঠকের মধ্যে কিছু সমাজসচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা, তবে জসীমউদ্দীনের বাকি লেখা ও জীবনী পড়লে মনে হয় ব্যাপারটা অনেক বেশি অন্তর্নিহিত ব্যথার বহিঃপ্রকাশ।
তখন চল্লিশের দশক। বিপুল রাজনৈতিক টালমাটাল। “পাক বাংলা”-র পরিকল্পনা চলছে। জসীমউদ্দীন শের-এ-বাংলা ফজলুল হক-এর সমর্থক ছিলেন। পরে অবশ্য পাক বাংলার প্রকল্প সফল হয়নি, জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের রাজনীতিতে বাঙালি মুসলিমের বিপ্লব সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বিভাজন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রাদেশিক ধারণা ও পরিকল্পনা যেভাবে রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় পার্টিশন এ রূপান্তরিত হল, সে গল্প অনেক বড়। জসীমউদ্দীন এর স্মৃতিকথা থেকে এইটুকু বোঝা যায় যে বিভাজনের প্রথম দিকের কিছু পরিকল্পনা খানিক সমর্থন করলেও পরে পার্টিশন-এর বিপুল হত্যাকাণ্ড ও রক্তাক্ত দাঙ্গা হাঙ্গামা তাঁকে সাংঘাতিক আঘাত করে। পঞ্চাশের দশকে লেখা মাটির কান্না কাব্যগ্রন্থে এক অন্য রকমের গ্রামবাংলার ছবি পাওয়া যায় — তখনও তিনি পল্লীকবি কিন্তু সেই পল্লীর রূপ বিভৎস, নিষ্ঠুর, প্রবল যন্ত্রনাদায়ক। আসমানী কে নিয়ে লেখাগুলো এই সময় ঘিরে।
আর সেই লোককথা উপকথার বইয়ের কী হল? যার পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রথমবার তিনি দীনেশ সেন-এর কাছে এসেছিলেন? বাঙালির হাসির গল্প প্রথম খন্ড বেরোতে বেরোতে ১৯৬০ সাল হয়ে গেল। দ্বিতীয় খন্ড বের হল আরও কয়েক বছর পর – ১৯৬৪ সালে। এর মধ্যে কিছু গল্প লাল বিহারী দে, উপেন্দ্রকিশোর, ও দক্ষিণারঞ্জন পাঠকদের কাছে অতি চেনা — যেমন “পান্তা বুড়ি,” “টুনটুনির গল্প,” “জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা,” “নাকের বদলে নরুণ,” “শেয়ালের পাঠশালা,” ইত্যাদি। কিছু গল্প রূপকথা-কেন্দ্রিক, কিছুটা ঠাকুরমার ঝুলির আদলে লেখা। কিন্তু অধিকাংশ গল্পের মধ্যেই আমি পেলাম জসীমউদ্দীনের কঠোর বাস্তবচিত্র তুলে ধরার প্রবৃত্তি ও সমাজসচেতনতা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা। একটা গল্প উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করলাম।
কাক আর চড়ুইতে একদিন শর্ত হল যে যে তাড়াতাড়ি ধান খেয়ে বা লঙ্কা খেয়ে শেষ করতে পারবে, সে অপরের বুক খুঁড়ে খাবে। কাক কপ কপ করে সবার আগে খাওয়া শেষ করে ফেলল। চড়াই তো শর্ত ফেলতে পারে না। কিন্তু সে শুধু অনুরোধ করল যে কাক যেন ঠোঁট ধুয়ে আসে। তারপর কাক গঙ্গায় গেল, গঙ্গা বলল ঘটি নিয়ে আসতে, তখন সে কুমারের কাছে গেল, কুমোর বললো মাটি আনতে, কাক গেল মোষের কাছে শিং চাইতে যাতে সে মাটি খুঁড়তে পারে, সেখান থেকে কুকুরের কাছে যাতে সে মোষকে ভয় দেখায়, সেখান থেকে গরুর কাছে কুকুরের জন্যে দুধ আনতে, সেখান থেকে মাঠে গরুর জন্যে ঘাস আনতে, সেখান থেকে কুমারের কাছে কাস্তে আনতে, সেখান থেকে গৃহস্তের কাছে আগুন চাইতে যাতে কুমার কাস্তে গড়তে পারে। গৃহস্থ আগুন দিতে রাজি হল কিন্তু বোকা কাক বলল তার ডানায় আগুন দিতে, কারণ তার কাছে হাঁড়ি নেই। সেই আগুনে সে পুড়ে মারা গেল আর ছোট্ট চড়াইও প্রাণে বেঁচে গেল।
গল্পটা নিশ্চই খুব চেনা। উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বইয়ে গল্পটা “চড়াই ও কাকের কথা” বলে রয়েছে। কিন্তু লোককথা সাধারণত অবাস্তব কল্পনা হয় না, তার মধ্যে রূপকের সাহায্যে কোনো না কোনো অন্তর্নিহিত সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সত্য থাকে। লোককথা গবেষক Antti Arne ও Stith Thompson বিশ্বের অন্যতম সেরা লোককথার একটি বিপুল তালিকা নির্ণয় করেছিলেন — তাতে দেখা যায় যে প্রত্যেক উপকথা কোনো সামাজিক নীতি বা ধর্মীয় নৈতিকতা শেখানোর জন্যে বলা হয়।[vi] একই ধাঁচের অনেক লোককথা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাদের চরিত্র, বলার ধরন, প্রসঙ্গ সব আলাদা হলেও গঠন এক, ফলে নৈতিক বার্তাটুকু সমান। সেই তত্ত্ব যদি ভাসাভাসা ভাবেও আমরা মেনে নিই, তাহলে এমন অদ্ভুত শর্তের প্রস্তাব চড়াই দিলই বা কেন, আর কাকই বা মিছিমিছি চড়াই এর বুক খাওয়ার জন্যে এত ঘোরাঘুরি করে শেষে প্রাণই বা হারাল কেন? এ কিসের রূপক?
উত্তরটা আমি পেলাম জসীমউদ্দীন-এর সংস্করণে। পুরো গল্পটাই এক, শুধু শুরুর দিকটা আলাদা —
কাককে কেউ ভালোবাসে না। তার গায়ের রং কালো। কথার সুরও কর্কশ। তাই বলে কি কাককে অবহেলা করতে হবে? সকলেই কি সুন্দর? সকলের স্বর কি মিষ্টি? যেখানে আবর্জনার মধ্যে দু একটি খাবার জিনিস পড়িয়া থাকে, কাক তা খুটিয়া খায়; ইঁদুর, আরশোলা, ব্যাঙ মরিয়া গেলে কাক তা কুড়িয়ে খায়।… কাকের ভারী ইচ্ছে করে আর সব পাখিদের সঙ্গে সে খুব ভাব করে। তাদের সঙ্গে মিশতে পারলে সে জাতে উঠতে পারে। কিন্তু কে তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে? কি করে সে নিজের অচ্ছুৎ নাম ঘোচাবে, কি করে সে দলে উঠবে?[vii]
এরপর কাক চড়ুইয়ের কাছে গিয়ে তার দলে যোগ দিতে চায়, চড়ুইও তাকে হেয় করে দূরে সরাতে চায়। তখন কাক বলে সে তো গরীব, টাকা পয়সা নেই, অন্য পাখিদের মত রং বেরংয়ের পোশাক পায় কোথায়। এ কথা শুনে চড়ুই আরো বিরক্ত হয়ে যায় ও বলে সে যদি ঠোঁট ধুয়ে আসে, তবেই চড়ুই-দলে যোগ দিতে পারবে।
এর পরের গল্প উপেন্দ্রকিশোরের সংস্করণের সঙ্গে হুবহু এক।
ছোটবেলার এই গল্পটা কাজের সূত্রে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে আমি লোককথার সংগ্রহ ও সম্পাদনা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম। উপেন্দ্রকিশোর এই গঠনেই গল্পটা পেয়েছিলেন না প্রথমদিকের অংশটা নিজে জুড়েছিলেন, তা জানি না। জসীমউদ্দীন-এর ক্ষেত্রেও কী উদ্দেশ্য ছিল, তার হদিস এখনো পাইনি। তবে বইয়ের ভূমিকায় ছোট করে লিখে গেছেন — “‘অচ্ছুৎ’ গল্পটি তোমাদের মনে কিছুটা আনন্দ এনে দেবে, কিন্তু এর পেছনে জাতে ওঠার জন্যে কাকের যে কান্না জমা হয়েছে, তা যেন তোমরা জানতে পার।” জসীমউদ্দীন এর গল্পগুলি পড়ার পর ঠাকুরমার ঝুলি বা টুনটুনির বই আবার করে পড়েছি। তখন অনেক কিছুই বেশ অন্যরকম লেগেছে।
জসীমউদ্দীন-এর অনেক লেখাই এখনো অপ্রকাশিত। কবির লেখা ও জীবন সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি, তাঁকে জানতে চেষ্টা করেছি, ততই অবাক হয়েছি। এখনো তাঁকে নিয়ে অনেক কাজ বাকি আছে। তবে পল্লী কবি খেতাব দিয়ে তাঁর সমস্ত লেখকসত্তা ও পরিচিতিকে বাক্সবন্ধি করতে আমি একদম নারাজ।
———-
[i] জসীমউদ্দিন. “যাদের দেখেছি”. জসীমউদ্দীন স্মৃতিকথা সমগ্র (কলকাতা: দেজ প্রকাশনী), পৃঃ ২৫০.
[ii] জসীমউদ্দীন. “যাদের দেখেছি”. জসীমউদ্দীন স্মৃতিকথা সমগ্র (কলকাতা: দেজ প্রকাশনী), পৃঃ ২৮৫.
[iii] আবু ইসহাক. “অম্লান স্মৃতি”. জসীমউদ্দীন জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ. ঢাকা: বাংলা একাডেমি (২০০৪), পৃঃ ৩১-৩৭.
[iv] জসীমউদ্দীন. জসীমউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ কবিতা. কলকাতা: দেজ (২০০০), পৃঃ ১০১.
[v] আতোয়ার রহমান. “জসীমউদ্দীন: ছোটদের লেখক”. জসীমউদ্দীন জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ. ঢাকা: বাংলা একাডেমি (২০০৪), পৃঃ ১৪৪.
[vi] https://www.duchas.ie/en/aath
[vii] জসীমউদ্দীন. “অচ্ছুৎ”. বাঙালির হাসির গল্প. ঢাকা: পলাশ প্রকাশনী (১৯৬০), পৃঃ ১৩৯.
- ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ উইকিপেডিয়া; ও www.jasimuddin.org
1 Comment