প্রাচ্যের ফরাসি সুগন্ধি – কেরল

প্রাচ্যের ফরাসি সুগন্ধি – কেরল

আমি ভ্রমণ করতে ভালবাসি, কিন্তু ভ্রমণের কল্পনা করতে আমার আরও ভালো লাগে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

রবিঠাকুর উবাচ। আমাদের মতন ভ্রমণপিপাসুদের বেদবাক্য হয়ে থাকবে চিরকাল। বছরে যদি দু’বার ঘুরতে যাওয়া হয়, বাকি সময় কাটে ভ্রমণ কল্পনায়। সেই সময়ের কথা বলছি যখন বিদেশ ভ্রমণ শুধুমাত্র কল্পনায় বাস্তবায়িত হত। সদ্য চাকরি পাওয়া দু’জন নববিবাহিত মানুষ তাই চেষ্টা করত দেশের সবটুকু নিংড়ে নেবে তাদের ইচ্ছে-ডানায় ভর করে। সেই সময়ের কথা যখন বিছানার ওপর ভারতবর্ষের ম্যাপ ফেলে হুমড়ি খেয়ে দেখা হত রুট-প্ল্যান। অফিসের কম্পিউটারের একটা ট্যাবে সবসময় খোলা থাকত ট্র্যাভেল গাইড।

২০১০ – মাত্র এগারো বছর আগের কথা। মার্চের শেষের দিকে ‘যেথায় খুশি যাইতে পারি’ জুতোয় ভর করে বেরিয়ে পড়েছিলাম স্বপ্নিল এক স্থানের উদ্দেশে। এক রাজ্য যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, এই ত্রয়ীর সমন্বয় ঘটে একই ছুটিতে। বহু চর্চিত, ভ্রমণকারীদের পুণ্যস্থান, পোস্টকার্ড ছবির মতন, ভারতবর্ষের একেবারে নিচের দিকে অবস্থিত এই মায়াবি রূপকথার নাম কেরল। গডস্ ওন কান্ট্রি। আমি স্বর্গ দেখিনি, আমি কেরল দেখেছি।

কেরল পুরোটা ঘুরতে লেগে যাবে প্রায় কুড়িদিন। কেরানিবৃত্তির বোঝাটা সঙ্গে না থাকলে বানজারা জীবনটা ভালো হত। কিন্তু তা যখন নয়, আমাদের অতি কষ্টে বেছে নিতে হয়েছিল কয়েকটি স্থান। স্থির হল দশদিন যাবে বিধাতার নিজের দেশের স্বাদ পাওয়ার জন্য।

প্রচলিত মত অনুযায়ী কেরল নামটি ‘কের’ (মালয়ালম ভাষায় অর্থ নারকেল গাছ) এবং ‘আলম’ (দেশ বা ভূমি) শব্দ দুটির সমন্বয়ে সৃষ্ট। অর্থাৎ নারকেল বৃক্ষের দেশ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মৌর্য সম্রাট অশোকের তৃতীয় শতকের শিলালিপিতে স্থানীয় শাসককে কেরলপুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে প্রথম মানেটি বেশি হৃদয়গ্রাহী। কল্পনার ফানুসে তখন নৈসর্গিক চিত্রপট, সারি দেওয়া নারকেল গাছ, হাউসবোট, আর মেঘ-রোদ্দুর কেনার ইচ্ছে।

প্রথম দিন: বলে রাখা ভালো, আমাদের ভ্রমণকাহিনি অনেকটাই গুগল-বৃত্তের বাইরে। তাই এমন অনেক টুকটাক জায়গার হদিশ মিলবে যেখানে প্রকৃতির কোলে ভাবনাহীন চুপ করে বসে থাকা যায়। কলকাতা থেকে কোচি পৌঁছতে বিমানে লাগে তিনঘন্টা। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কন্যাকুমারী। কন্যাকুমারীর অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারে না অনেকেই। কারণটি ক্রমশ প্রকাশ্য।

কোচি থেকে গাড়িতে প্রায় সাড়ে ছ’ঘন্টা লাগল কন্যাকুমারী পৌঁছতে। প্রসঙ্গত, কেরল ভ্রমণে নিজের গাড়ি থাকলে অনেকাংশেই সুবিধা, কারণ প্রত্যেকটি জায়গার মধ্যে দূরত্ব বেশ অনেক। গাড়ি যখন ছুটে চলেছে ভারতের মূল ভূখণ্ডের শেষ প্রান্তে, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা নারকেল গাছ ঘেরা জায়গা। মনে হল গোল হয়ে নারকেল গাছের পরিবেষ্টনের ঠিক মাঝে স্বচ্ছ নীল জলে ফুটে আছে ক’টা পদ্ম। তার সামনে অনেকগুলো নৌকো পরপর দাঁড় করানো আছে। ঠিক ছবির মতন জায়গাটার কাছে যেতেই দেখলাম একটা নদীর মতন বিস্তারিত জলপথ। যার শেষ দৃশ্যমান নয়।

মাঝি এসে বলল, “সমুদ্রে যাবেন নাকি?” ওই প্রথম চাক্ষুষ করলাম কেরলের অন্যতম বিশেষত্ব – ব্যাকওয়াটার। জায়গাটার নাম পুভার দ্বীপপুঞ্জ। দুটো ডাব নিয়ে চড়ে বসলাম নৌকোয়। মিঠেকড়া রোদে স্নান করে আমরা এগিয়ে চলেছি গাছের মধ্যে দিয়ে, হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে গাছে এসে বসল সাদা বক। কোথাও আবার অচেনা সরগম শুনিয়ে গেল কোনো পাখি। প্রজাপতি এসে বসল হাতের ঠিক পাশে। এ কোন পৃথিবী যেখানে কিছুক্ষণের জন্য আদিম সভ্যতায় হারিয়ে গেলাম দুজনে! সম্বিত ফিরতেই যেখানে ব্যাকওয়াটার শেষে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হল, ভিজে বালি ছুঁলো পায়ের পাতা, সেখানেই শুনতে পেলাম ঢেউয়ের গর্জন। এমনও হয়? ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বালুকারাশির ওপর। ছোট সমুদ্রতটে তখন শুধুই আমরা আর সমুদ্রের হাতছানি। ফিরে এলাম একই ভাবে। প্রথম দর্শনেই বুঝলাম আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই ভেকেশন।

কন্যাকুমারী দেখার দুটো কারণ ছিল আমাদের। এক, এখানে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, আর ভারত মহাসাগরের মহামিলনে নীল জলরাশির এক রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ আছে। দুই, এখানে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম চিন্তাবিদ স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত ‘বিবেকানন্দ রক।’

বাঙালির স্মৃতিধন্য নীল জলরাশিতে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না। সেখানে পৌঁছলাম দুপুর তিনটে নাগাদ। হোটেলের ঘর থেকেই প্রথম দেখতে পেলাম তাকে। পরেরদিনই গন্তব্য অন্যত্র। অতএব খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একঘন্টা পর। হোটেল থেকে কন্যাকুমারীর শেষ বিন্দুতে যেতে সময় লাগল প্রায় ১০ মিনিট। অনেকটা পথ পেরিয়ে, ঘুরে ঘুরে যেতে হয় সেখানে। তখন বিকেল গড়িয়ে পড়ছে কন্যাকুমারীর নীল জলে। শেষ বিকেলের মায়াময় আলো গায়ে মেখে কন্যাকুমারীর শেষ বিন্দুতে, বিশাল বিশাল পাথরে ঘিরে রাখা প্রাচীরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি। এখানেই, এই মহাসমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মধ্যে অনন্তকাল ধরে দুটি দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিস্ময়কর পাথরখণ্ডের একটিতে বসে একদিন ধ্যান করেছিলেন বিবেকানন্দ নামে এক বাঙালি! আমাকে ছুঁয়ে গেল নোনা বাতাস।

হোটেলে ফিরে আসার পরেও অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে দেখেছিলাম তাকে। কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চিরকাল। সন্ধ্যা নেমে আসে উত্তাল নীল জলরাশির বুকে। সৃষ্টি হয় মহাসমুদ্রের মহামিলন, কয়েক মানুষের চেয়েও উঁচু উঁচু ঢেউয়ের আছড়ে পড়া, সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মূর্তি, ঘরে ফেরে মহাসাগরের মাঝে ঢেউয়ের দোলায় ভেসে চলা রঙিন বোট, মাছ ধরার ট্রলার, কমে আসে শত মানুষের ভিড়, একা দাঁড়িয়ে থাকে বিবেকানন্দ রক।

দ্বিতীয় দিন: গাড়ি চলেছে কোভালমের উদ্দেশে। কেরলে সরকারী ভাষা মালয়ালম হলেও যে রাজ্যের স্বাক্ষরতা ৯৩.৯%, সেখানে ইংরেজিতে অনায়াসে কথা বলে সবাই। হিন্দি সড়গড় না হলেও ইংরেজিতে সাহায্যের হাত বাড়াবে এখানে সবাই। আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম হোটেলে। একেবারে লাইটহাউস বিচের গা ঘেঁষেই আমাদের হোটেল। হোটেলের প্রাইভেট সুইমিং পুলের কোণ থেকেই সিঁড়ি নেমে গেছে বালির মধ্যে। ঠিক সামনেই ভিজিংজ্যাম লাইটহাউস। লাইটহাউসের ওপরে উঠতেই বাতাস এসে দূর করে দিল সমস্ত ক্লান্তি। সমুদ্র আর আকাশ মেশে যেখানে, সেখানেই লাল আভা ছড়ায় পশ্চিমের সূর্য। পড়ন্ত বিকেলে বসে রইলাম বিচ-স্যাকে।

কোভালম বীচ সবসময়ই খুব জনবহুল। প্রধান টুরিস্ট আকর্ষণ হওয়ার ফলে এখানে সমুদ্রতটের পাশেই সাজানো রঙ্গিন পসরা। তবে যা সবচেয়ে লোভনীয় তা হলো একের পর এক খাওয়ার দোকান। খাওয়ার দোকানগুলো বেশিরভাগই রাস্তার ওপরে। লোভনীয় সব রেসিপি। কেরলের বিশেষত্ব ফিস ফ্রাই – জিভে জল আনা তার স্বাদ।

কোভালম সুন্দর কিন্তু বড্ড একঘেয়ে। তাই গোটা একদিনই যথেস্ট কোভালমের জন্য। স্কুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়া যায় এদিক সেদিক। দিন এখানে ফুরোয় ধীরগতিতে। সমুদ্রকে স্বাক্ষী রেখে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে ভাসিয়ে দিলাম নিজেদের। লাইটহাউসের আলোয় কোথাও একটা জাহাজ নোঙর ফেললো। রাত বাড়াল সমুদ্রসফেন।

তৃতীয় দিন: সকাল দশটাতেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বহু প্রতীক্ষিত আলেপ্পি পৌঁছনোর আগে হল্ট নিয়েছিলাম কালাথিল লেক রিসর্টে। অনেকেই জানেন না কালাথিল রিসর্ট সম্বন্ধে। নতুন করে ভালোবাসায় ফেলে এই রিসর্ট। দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবন থেকে একটু আরাম পেতে, কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত ক্লান্তি, দৌড়ঝাঁপ, সমস্ত কিছু ভুলে যেতে একদিন থাকলাম। এখানে বিশেষ কিছু করার নেই। সারাদিন ভেসে বেড়ানো যায় ডিঙ্গি নৌকোয়, রঙ্গিন মাছেদের সঙ্গে গা ভিজিয়ে বসে থাকা যায় সুইমিং পুলে। পুলটির বিশেষত্ব, এটি একেবারেই ব্যাকওয়াটার সংলগ্ন। ঠান্ডা পানীয়ে গলা ভিজিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিমজ্জিত করা যায় নিজেকে। শুধুমাত্র বিলাসিতা নয়, নিজেকে মনে হবে কেরল অধিবাসীদের একজন। আয়ুর্বেদ, প্রাকৃতিক স্পা, এবং বডি ম্যাসাজ সবকিছুই অর্গানিক। অনেক রকম ভেষজ তেল পাওয়া যায় এখানে। ক্লান্তি দূর করতে হোক বা ব্যাথা নিবারণ, বেশ কার্যকরী এই তেলের ব্যবহার। একটা বই নিয়ে বসে থাকা যায় সারাদিন। সময় এখানে স্থির। কোনো কোনো সময় ঘড়িরও অবসর লাগে।

চতুর্থ দিন: “ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন্ দূরে, ঘাটে বাঁধা তবে কেতকী পাতার তরী!” এরকমই মনে হয়েছিল প্রথম দর্শনে। ছবির পাতা থেকে বেরিয়ে আলেপ্পি তখন শিল্পীর নিপুন তুলিতে আঁকা এক জলছবি। আলাপুঝা বা আলেপ্পিকে অনেকেই বলে প্রাচ্যের ভেনিস। আমি তা বলতে নারাজ। আলেপ্পি সুন্দর তার নিজস্ব সত্তায়। হাউসবোটে কাটানো দু’রাত আজও তুলনাহীন।

পৌঁছনোর পরই মেঘ করে আসে হঠাৎ। হাউসবোট তখন ব্যকওয়াটারের মাঝখানে। নারকেল গাছের সারির মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি নামে জোরে। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম দুজনেই। এমন দুরন্ত সুন্দর আর কি কিছু হয়! চারদিকে দমকা হাওয়া আর বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন সমস্ত যান্ত্রিক ক্লান্তি। দেখভাল করার ছেলেটা পাশ থেকে বলল, ”সুইমিং?” মনে হল এটাই তো চাইছিলাম।

সেই প্রথমবার সাঁতার না জানার আক্ষেপ হয়েছিল যখন আমার পাশের মানুষটা ঝাঁপ দিল জলে। সেই অনুভূতি ব্যাখ্যাহীন। ছেলেবেলার মতন বৃষ্টিতে ভিজে সাঁতার কাটার আনন্দ দেখেছিলাম তার চোখে। কেমন যেন একটা অতীতের স্বাদের সঙ্গে মিশে গেল নোনা বাতাসের ঝাপটা। খালের মাঝ দিয়ে তীর ঘেঁষে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে প্রিমিয়াম হাউসবোট। কোল ঘেঁষা সারি সারি নারকেল গাছ দেখে মনে হয় যেন পাশ্চাত্যের কোনো দেশ। বিভিন্ন পাখি দেখতে দেখতে আর বাতাসের সুরে নারকেল গাছের আন্দোলন উপভোগ করার ফাঁকে সময় কেটে যায় ধীর লয়ে। হাউসবোটে ট্র্যাডিশনাল কেরালার সব ধরনের স্পাইসি খাবার সার্ভ করা হয়। বিশেষতঃ বাহারি আইটেমের পকোড়ার সঙ্গে ফিসফ্রাইয়ের যুগলবন্দি আলাদা আমেজ এনে দেয়। রাত নেমে আসে হাউসবোটে। এক অন্যরকম ভালোলাগায় বসে থাকি দু’জনেই। অন্ধকারে ভেসে আসছে জলের শব্দ।

পঞ্চম দিন: হাউসবোটের স্যাটিন পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে লাগে দু’চোখের পাতায়। নিরালায়, নিজের মনের সঙ্গোপনে, এক অদ্ভুত রোমান্টিকতায় সকাল হয় ব্যাকওয়াটারের বুকে। নেই কোনো কোলাহল। দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট ছোট্ট গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নীল, স্বচ্ছ জল। জলে গ্রামগুলোর নান্দনিক প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে।

আলেপ্পির একপাশে আরব সাগর, অন্যদিকে কেরালার বৃহত্তম লেক ভেম্বানাদ। হাউসবোটে জেনে নিলাম জলপথের ধারে নানা বাগানে আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে লবঙ্গ, ভ্যানিলা, এবং কয়েক ধরনের কফি। জানলাম ভারতবর্ষের মশলার রাজধানী হিসেবে খ্যাত কেরালা। অতীতকাল থেকেই বিদেশিরা কোনো না কোনো রূপে এই রাজ্যে তাঁদের পদচিহ্ন রেখে গেছে, তা সে স্থাপত্যকীর্তি, রন্ধনশিল্প, বা সাহিত্য, যে ক্ষেত্রই হোক না। বর্তমানে আলাপুঝা নৌচালন প্রতিযোগিতা, ব্যাকওয়াটার ভ্রমণ, সমুদ্র সৈকত, সামুদ্রিক পণ্যসামগ্রী, এবং ছোবড়া শিল্পের জন্য বিখ্যাত। দুটো দিন হারিয়ে গেলাম কেরালার ইতিহাসে। ছবির মতন কেটে গেল আরেকটা রাত। এই কি তবে শেষ হল সুন্দরের সংজ্ঞার খোঁজ?

ষষ্ঠ দিন: সমুদ্র, ব্যাকওয়াটার, নৌকাভ্রমণ, শেষে এবার কেরালার অন্যতম আকর্ষণ হস্তিবিহার। আলেপ্পি বিচে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছলো এলিফেন্ট ক্যাম্প থেক্কাডিতে। একরাতের জন্য থাকা থেক্কাডিতে। পরেরদিন ভোরে যেতে হবে পেরিয়ার ন্যাশনাল পার্ক। কেরলে বহু জনপ্রিয় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি রয়েছে – অপূর্ব সুন্দর উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বাসস্থান। কেরলে পশ্চিমঘাট বা সহ্যাদ্রি পর্বতমালার দীর্ঘ, বিস্তীর্ণ জঙ্গল বন্যপ্রাণীদের নীড়। এখানে চোদ্দটি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি এবং দুটি টাইগার রিসার্ভ রয়েছে। এলিফেন্ট ক্যাম্পে হাতির পিঠে দুলকি চালে নিজেদের বেশ জিম করবেট মনে হল। একটা জায়গায় আমাদের বলা হল নেমে পড়ে জামাকাপড় বদলে আসতে। সে এক মজার জিনিস। হাতি শুঁড় দিয়ে জল তুলে স্নান করিয়ে দেবে। বেশ কাটল কিছুক্ষণ নির্বাক ভালোবাসায়। পরেরদিন অনেক ভোরে ওঠা। অতএব নরম বিছানায়, হাউসবোটের স্মৃতিচারণে, ঘুমপরি এসে বসল অল্পক্ষণেই।

সপ্তম দিন: সহ্যাদ্রি পর্বতের ৯০০-২১০০ মিটার উচ্চতায়, তামিলনাড়ু সীমান্তে, কেরলের থেক্কাডি জেলায় অবস্থিত পেরিয়ার ন্যাশনাল পার্ক। পেরিয়ার লেককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৭৭৭ বর্গকিমি আয়তনের এই অরণ্যের কোর এরিয়া ৩৫০ বর্গকিমি। নীলাকাশের নিচে স্বচ্ছ, হ্রদের জল, দু’দিকেই ঘন বুনট কালচে সবুজ বন, শোলা লতাগুল্ম ঘিরে দাড়িয়ে রয়েছে পাহাড়শ্রেণী। প্রায় ১৪০ প্রকার অর্কিড রয়েছে পেরিয়ারে। গ্রীষ্মে দলে দলে হাতিরা আসে লেকের ধারে, কখনও সাঁতার কাটে লেকের জলে। আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চলল জলপথে। খুবই মনোহর চারপাশের দৃশ্য। দেখি মাছের আশায় ফাঁদ পেতে বসে আছে ভোঁদড়। চিত্রবিচিত্র পেরিয়ার কচ্ছপের দেখা মেলে জলে স্থলে। সকাল সন্ধ্যায় লেকে জলপান করতে আসে সম্বর, বাঘ, বাইসন, বুনো মহিষ, চিতা, বন্যশুয়োরের দল। আমরা দেখতে পাই বুনোহাতির পাল। কোনো শব্দ করি না কেউ। সে এক রোমখাড়া করা দৃশ্য। পালেপালে হাতি জল খেতে এসছে ভোরে আর গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে নীলগিরির লেঙ্গুর। প্রজাপতি, ধনেশ, ভীমরাজ, পাপিয়া, সারস, মাছরাঙা, আর কাঠঠোকরা ছাড়াও নানান চেনা অচেনা পাখি বাসা বেঁধেছে পেরিয়ারের জলে জঙ্গলে। ওই প্রথম দেখি ফ্লাইং স্কুইরেল বা উড়ন্ত কাঠবেড়ালি।

ফিরে এলাম হোটেলে। বেশ চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর লাগছিল নিজেদের। কিন্তু স্নান করেই বেরিয়ে পড়া শেষ গন্তব্যে। যখন আলেপ্পিতে মনে হয়েছিল এই তাহলে সুন্দরের পীঠস্থান ঠিক তখনই মেঘবালিকা তুলিতে এঁকে দিয়ে গেল মুন্নার। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি এসে থামল মুন্নারে। কেরালার মাঝে সৌন্দর্যের আরেকটি মুক্তো হল মুন্নার শহর। মুন্নারকে বলা হয় কেরালার কাশ্মীর। মুধিরাপুজা, নাল্লাথানি, এবং কুন্দালি – এই তিন নদীর স্রোত একসঙ্গে মিলিত হয়েছে মুন্নারের ঠিক মাঝখানে। সম্ভবত এই জন্যেই মুন্নারের আবহাওয়া ও প্রকৃতি এত ভিন্ন ও নির্মল।

কেরালার অধিবাসীরা প্রধানত খ্রীষ্টান। ভারতে এসে ফরাসিরা তাদের প্রথম বাসস্থান গড়ে তুলেছিল মুন্নার শহরে। সেই অস্তিত্বেরই প্রমাণ পাওয়া যায় এখানকার বিভিন্ন স্থাপত্যগুলোয়। নান্দনিক ফরাসি স্থাপত্যের দেখা মেলে শহরটিতে। এমনই এক বাড়ির খোঁজ পেয়ে, আমরা কোনো হোটেল বুক করিনি। ইউরোপিয়ান চ্যাপেলের আদলে, পাহাড়ের ভেতরে, একটা পুরনো বাড়িতে ছিলাম। কোনো এক উকিলের বাড়ি যা ভাড়া দেওয়া হয় একমাত্র স্পেশাল পারমিশনে। চা বাগান, পাইন গাছের মধ্যে, পাহাড়ি গন্ধে পুরো বাড়িটা তখন আমাদের। কাঠের বাড়ি, বারান্দা, ঘষা কাচের জানলা, ঝাড়বাতি, সাদা পর্দা, পিয়ানো – আর কেমন অদ্ভুত ভাবে একটা পাহাড় স্পর্শ করছে বারান্দার রেলিংটাকে। আসার আগেই কেয়ারটেকারকে বলে রাখা ছিল খাওয়ার মেনু। কারণ একেবারেই জনবসতির বাইরে বাড়িটির অবস্থান। এখানে কল্পনারা বাস্তবায়িত হয় মোমবাতির আলোয়। কেয়ারটেকার থাকে বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে। কাঠের আরামকেদারায় বসে চোখ বন্ধ করতেই মনে হল ম্যকবেথ, হ্যামলেট, কিং লিয়ার, টুয়েলফ্থ নাইট, টাইমন অফ এথেন্স, একের পর এক সব চরিত্র যেন প্রাণ পাচ্ছে এখানে। রাত বাড়ছে বারান্দার পাহাড়টায়। সে এক ভয়ংকর সুন্দর অনুভূতি। তাকে স্পর্শ করা যায় না, দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আত্মিক যোগাযোগ ঘটে এখানে মুন্নারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সঙ্গে।

অষ্টম দিন: মিডসামার নাইটস ড্রিম ভাঙে শব্দহীন ভালোলাগায়। চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে বসি কিছুক্ষণ। সময় এখানে স্থির। ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় হিমেল স্পর্শ। মার্চের শেষে আবহাওয়া এখানে ভীষণ মনোরম। স্নান সেরে রওনা দিই মাত্তুপেট্টি ড্যামের উদ্দেশ্যে। লাইফজ্যাকেট পরে বিদেশি সিনেমার কায়দায় স্পিড বোটে চড়ে বসি দুজনে। পাহাড়ঘেরা মেঘলা দিনে হু হু ছুটছে স্পিডবোট। জেমস বন্ড সিনেমার মতন শরীরে রুদ্ধগতিতে চলছে অ্যাড্রেনালিনের হুড়োহুড়ি। হাওয়ার সাথে চুলোচুলি করে জলের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে স্পিডবোট। পাহাড়ের কাছে এসে কিছুক্ষণ নিমজ্জিত থাকি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। বিশাল ভারতের অগণিত সৌন্দর্যের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ হল কেরালার মুন্নার। কুয়াশামাখা পর্বতসারি, রুপালি অর্জুন অরণ্য আর অপার সবুজ বাগানের ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের মুন্নারকে এক চিলতে স্বর্গ বলাটা মোটেও ভুল হবেনা। এখানকার অসাধারণ ভিন্ন মাত্রার নিসর্গ যে কাউকে নিয়ে যাবে বিমুগ্ধতার জগতে। প্রকৃতি এখানে বড্ড বেশি মোহময়। পাহাড়ের পর পাহাড় মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আকাশের গায়ে।

চারপাশটা অপার সবুজে ঢাকা৷ স্পিডবোট নামিয়ে দিয়ে যায় আমাদের। তীব্র ভালোলাগার পর আবার আমাদের ফিরে আসা পাহাড়ি চুপকথায়। পথে যেতে যেতে দু’পাশে বিরামহীন সবুজে ঢাকা চায়ের বাগান। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এই চা বাগান যেন সবুজের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। চা গাছের মধ্যে সোজা মাথা তুলে আকাশের সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছে সারি সারি পাইন গাছ। সবুজে সবুজে মাখামাখির শহর হল এই মুন্নার।

দিগন্তজোড়া এই সবুজের নিসর্গে আরও বেশি চমক লাগিয়েছে ছোট ছোট নদী, জলপ্রপাত, আর পুরনো আমলের বাংলো। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে ফিরে এলাম ভিনটেজ সভ্যতায়। হাতছানি দিচ্ছে কল্পনারা। দেখি এক ধরনের অদ্ভুত সুন্দর বিরল বেগুনি রঙা ফুল ফুটেছে বাড়িটার চারপাশে। কেয়ারটেকার জানাল ফুলটার নাম নিলাকুরাঞ্জি। এই ফুল নাকি ১২ বছর পর পর ফোটে। আর ক’দিন পর নাকি পুরো অঞ্চলের পাহাড় ঢেকে যাবে বেগুনি চাদরে। সেই দৃশ্য এখানে স্বর্গীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। রূপকথারা ধরা দেয় মুন্নারে।

নবম দিন: আজ মন ভালো নেই। সরিয়ে দিতে হবে রূপকথা। আবার সেই রোজের টানাপোড়েন। কিন্তু আজ এতো বছর পরেও মুন্নার আর আমার বারান্দার পাহাড়টা হাতছানি দিয়ে ডাকে বারবার। দেখা হবে আবার।
নেমে আসার সময়ে ঘুরে গেলাম চা বাগান। বিশ্ব বিখ্যাত টাটা চা-এর উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং রপ্তানি হয় এই মুন্নার থেকেই। আর তাই চায়ের এই স্বর্গে পর্যটকরা চা বাগানের নিসর্গের সঙ্গে দেখতে পান চা প্রক্রিয়াকরণের নানান কিছু। টাটা মিউজিয়ামে দেখা যায় কীভাবে চা গাছ থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত করা হয়। প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর একটি ফ্রি ট্যুর দেওয়া হয় এখানে। সেখানেই চা সংক্রান্ত সবকিছু স্বচক্ষে দেখতে পারেন পর্যটকেরা।

গাড়ি ছেড়ে দিয়ে গেল এর্নাকুলাম। শহুরে ইতিবৃত্তে তখনও রেশ ছড়িয়ে রেখেছে হাউসবোট, মুন্নার, আর কেরলের সরল সৌন্দর্য। বসে রইলাম সেদিনটা মেরিন ড্রাইভে। অদ্য শেষ রজনী।

দশম দিন: আমরা ফিরে আসি বারবার। কল্পনায় ঘুরে আসি সারা বিশ্ব। ছবির থেকে তুলে ধরি বাস্তব। বানজারা মন ঘরে ফেরে আবার এক নতুন জায়গার খোঁজে। কোচি থেকে কলকাতা পৌঁছতে বিমানে লাগল তিন ঘন্টা। কেরল, তুমি রোমান্টিক, ভিনটেজ, নৈসর্গিক।

আমরা যারা একটু সময় পেলেই পায়ের বেড়ি ছিঁড়ে বার বার ছুটে যাই নতুন সৌন্দর্যের খোঁজে, তার রূপসুধা আকণ্ঠ পান করে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ি, আমাদের প্রকৃতি প্রেমের এই নেশার ঘোর কাটে না কখনও। ছুটিয়ে মারে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। দেশ ছেড়েছি অনেকবছর। ব্যাকপ্যাকে ভরে নিয়েছি বিশ্বের অলিগলি – তবুও কেরলের বিকল্প পাইনি আজও। পর্দানশিন মেঘপাহাড়ের স্তর সরিয়ে এখনও প্রজাপতি খেলে বেড়ায় বিধাতার আপন দেশে। কল্পনার রামধনুতে কানেকানে ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনিয়ে যায় নীল সমুদ্র। মোমবাতির আলোয় আবার কেউ ব্যাকওয়াটারে ফিরে পায় রোমান্টিসিজম। আবারও নিঃশ্বাস নিতে শেখায়, নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় কেরল।

নিউজার্সি নিবাসী। ব্লগার, বাচিকশিল্পী, এবং লেখিকা। ষোল বছর বয়সে প্রথম রচনা প্রকাশ পায় “দ্য টেলিগ্রাফ”-এর পাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরেই ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ চাকরিসূত্রে হাতেখড়ি। সানন্দা, আনন্দবাজার, প্রতিদিন, দি ওয়ালে, ফিচার লেখা ছাড়াও নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন দেশ-বিদেশের ই-ম্যাগাজিনে গল্প, ধারাবাহিক, অণুগল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, নাটক, লিখে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *