শতবর্ষে রমাপদ চৌধুরী একটি সংগ্রহযোগ্য আত্মকথা

শতবর্ষে রমাপদ চৌধুরী - একটি সংগ্রহযোগ্য আত্মকথা

একজন লেখকের অন্তরঙ্গ আত্মকথায় এমন অনেককিছু উঠে আসে যা সেই লেখককে চিনতে, বুঝতে; এমনকী অনুভব করতেও সাহায্য করে থাকে। লেখক তাঁর সাহিত্যকর্মে একটু আড়ালে থাকেন, ঘটনা ঘটায় তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা। কাহিনি নানা বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলে পরিণতির দিকে। কিন্তু আত্মকথায় প্রধান চরিত্র একজনই, তিনি লেখক। তার চারপাশে থাকে রক্তমাংসের আরও অনেকে। এদের সবাইকে নিয়েই লেখকের যাত্রাপথ। আমরা জানতে পারি লেখক মানুষটি কী ভাবে ভাঙতে ভাঙতে গড়ে উঠেছেন। কী ভাবে তৈরি হচ্ছে তাঁর অন্তর্জগৎ; জানা যায় দর্শন, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে তাঁর কিছু ধারণার কথা। তাঁর স্বপ্নের জগত্টাই বা কেমন ছিল সেই ইঙ্গিতও মিলতে পারে! লেখকজীবনের পথ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুগম নয়। নানারকম আঘাত আসে নানা দিক থেকে, একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হন লেখক। তাঁর আত্মবিশ্বাসে কখনও চিড় ধরে, কখনও বা তা আরও মজবুত হয়ে তাকে তাঁর স্বক্ষেত্র চিনতে সাহায্য করে । সৃষ্টির জগতে কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। লেখক তাঁর নিজের পথ নিজেই নির্মাণ করে থাকেন। পরিবেশ, চারপাশের মানুষজন, তাঁর পড়াশোনা তাঁকে তাঁর পথ চিনতে সাহায্য করে থাকে। একজন লেখকের অন্তরঙ্গ আত্মকথায় অজ্ঞাতপূর্ব নানা দিক উঠে আসে। রমাপদ চৌধুরীর অনবদ্য আত্মকথা ‘ফেলে আসা জীবন’ জীবন পড়ার পরে এসব কথাই টুকরো- টুকরো ভাবে ভিড় করেছিল মনের মধ্যে।

 

দীর্ঘায়ু ছিলেন রমাপদ চৌধুরী, বেঁচেছিলেন ছিয়ানব্বুই বছর বয়স পর্যন্ত। শেষ বয়সে বার্ধক্যের অসুখবিসুখ কাবু করে ফেলেছিল বেশ খানিকটা, কিন্তু স্মৃতিশক্তি ছিল অটুট। ওঁর মৃত্যুর মাসদুয়েক আগেও ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছে আমার। মাঝেমধ্যেই হত। একটা জিনিস অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম–ওঁর কণ্ঠস্বরে প্রথমদিকে বয়সোচিত মৃদু কাঁপুনি থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়ে উঠত। রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় অর্ধ শতকের, শেষের দিকে অবশ্য বছর পনেরো-কুড়ি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু টেলিফোনে কথা হত নিয়মিত।
ওঁর যখন মৃত্যু হয়, আমি তখন আমেরিকায়। মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম ফেসবুকের পাতায়। কলকাতায় থাকলে নিশ্চয়ই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যেতাম। বিচলিত হয়ে ফেসবুকের পাতাতেই নানা কথায় তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলাম। এমন নির্লোভ, উদারচেতা মানুষ আমি আমার জীবনে খুব বেশি দেখিনি।

 

পুরনোদিনের কথা বলতে ভালোবাসতেন রমাপদবাবু। কতদিন বলেছি—একটা আত্মজীবনী লিখুন না–। উত্তরে হাসতে হাসতে একটিই কথা বলতেন—দেখি। এই আত্মকথাটি ওঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল মাসিক কৃত্তিবাসে, পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় প্রতিভাস প্রকাশন সংস্থা থেকে।
আত্মকথাটি লিখতে শুরু করেছিলেন অনেকদিন আগে থেকেই। তবে একটানা লেখেননি—লিখতেন এবং ফেলে রাখতেন। তারপর ওই জীবনস্মৃতি লেখায় দীর্ঘ একটি ছেদ পড়ে যায়। শেষে বিস্মৃত হয়েছিলেন লেখাটির কথাই। কী ভাবে লেখাটি উদ্ধার হয়েছিল, সে-কথা এই বইটির সম্পাদক সিদ্ধার্থ সিংহ বইয়ের ভূমিকায় জানিয়েছেন।

কিছুকাল আগে রমাপদ চৌধুরীর আত্মকথার একটি অংশ ‘হারানো খাতা’ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়, পরে বার হয়েছে গ্রন্থাকারেও। সেই লেখাটিও আমি পড়েছি। ‘হারানো খাতা’ সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল, তবে সেটির উদ্ধার ও প্রকাশ লেখকের জীবদ্দশাতেই। প্রথম জীবনের অনেক কথাই আছে ওই বইটিতে, যা নেই তার হয়তো অনেকখানিই পাওয়া যাবে ‘ফেলে আসা জীবন’-এ। এই আত্মকথায় তাঁর বংশপরিচয় আছে, বাবা-মা, নিকটজনের কথা আছে; সূচনার এই আয়োজন-পর্ব দেখে বোঝা যায়, বেশ বড় আকারেই জীবনস্মৃতিটি লিখতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কোনও কারণে মাঝপথে সেটি থেমে যায়। শুধু থেমে যাওয়াই নয়, লেখাটির কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন বেমালুম। নাটকীয় ভাবে এটির উদ্ধার হয় তাঁর জীবনের শেষ পর্বে, এবং ছাপার হরফে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনাবসানের পরে।

আত্মকথা কোনও অবস্থাতেই জীবনচরিত নয়, এবং এটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার অবকাশও নেই। জীবনস্মৃতিতে কোথাও বা জীবনের বড় দু-তিনটি পর্ব ধরা পড়ে, কোথাও একটি বা দুটি। এই আত্মকথাটির সময়কাল লেখকের শৈশব-কৈশোর থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত। আত্মকথায় জীবনের কালানুক্রমিক সব ঘটনা লেখক তুলে ধরেন না। আগের কথা পরে আসে, আবার কখনও পরের কথা আগে। এই খণ্ডিত স্মৃতিচারণই বুঝি আত্মকথার সুষমা।
রমাপদ চৌধুরীর লেখক-জীবনে শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের মস্ত বড় একটি ভূমিকা আছে। তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে খড়্গপুরে। এই রেলশহরটি পরবর্তীকালে তাঁর লেখকজীবনে অনেক তথ্য সরবরাহ করেছে। খড়্গপুর সম্পর্কে অদ্ভুত এক মমতা ছিল লেখকের। লিখেছেন, ‘ওই ছোট্ট শহরে বাস করেও আমি একটুকরো খুদে ভারতবর্ষে বাস করতাম। … ওই ক্ষুদ্র শহর আমাকে উদার করে দিয়েছিল, আমাকে ভারতবাসী করে দিতে চাইত।’
খড়্গপুরে রেল-কোম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন লেখকের বাবা। ভারতে তখন অনেকগুলি রেলওয়ে ছিল। তার সবগুলি একালের মতো সরকারি সম্পত্তি ছিল না। বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে (বি এন আর) ছিল একটি ইংরেজ কোম্পানি। তাদের বোর্ড অব ডিরেকটরস ছিল লন্ডনে। শুধু জেনারেল ম্যানেজারই নয়, বড় বড় সব পদগুলিতেই ছিল খাস ইংরেজ, এমনকী ছোট অফিসারের পদগুলিতেও। তার নীচের ধাপে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। উঁচু পদে ভারতবাসীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। চাকরির স্তরভেদে ছিল বিভিন্ন ধরনের কোয়ার্টার্স, বাংলো। লেখকের বাবার বাংলো ছিল সাহেবপাড়ায়। মস্ত বাংলো, মস্ত বাগান। এই বাংলোজীবন লেখকের সাহিত্যকর্মে দেখা গিয়েছে কয়েকবার।

বালক বয়সের প্রিয় শহরটি সম্পর্কে লেখক লিখেছেন, ‘লক্ষাধিক মানুষের শহরটির সৌন্দর্য তো ছিলই। পিচঢালা মসৃণ প্রশস্ত রাস্তা, তার দুপাশে বৃহত্‌-বৃহত্‌ বৃক্ষরাজি, সারা পথকে প্রখর গ্রীষ্মেও ছায়া সুনিবিড় করে রাখত। ওই ছায়ায় ছায়ায় হাঁটা বা সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার যে কী আরাম এখনও মনে পড়ে। মনে পড়ে এ-জন্যেই যে শহরটি গ্রীষ্মে যেমন ছিল প্রচণ্ড গরম, শীতে তেমনই ঠাণ্ডা। কলকাতার গরম তার কাছে শিশু। ছায়াঘন এই রাস্তার দুধারে ছিল বিশাল বিশাল বাগানওয়ালা বাংলোর সারি। বড়-বড় অফিসারদের বাংলোর, অর্থাত্‌ বাগানের একপ্রান্তে কয়েকটি কুঠুরি, বাংলোর পিয়ন-মালি-ধোপা ইত্যাদির জন্যে, যাদের মাইনে জোগাত রেল কোম্পানি। বেতনভোগী মালি ছিল বলেই বাগানগুলিও ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকত। সব ঋতুতেই। অর্থাৎ এমন ভাবে গাছগুলি সাজানো হত যে, সব সময়েই কিছু না কিছু ফুলের বাহার দেখা যেত। অতীব সুন্দর একটি গির্জা ছিল। শান্ত সমাহিত সিমেট্রিও। শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিত অগণিত শ্বেতকায় রমণী ও কিশোরীরা। এদের অনেকেই ছিল নির্ভেজাল ইংরেজ। কিন্তু তাদের তুলনায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পুরুষ ও নারীরা আমাদের চোখে বেশি সুন্দর মনে হত তাদের সুগঠিত দেহ ও সুন্দরতর মুখশ্রীর জন্য।’
শৈশব ও কৈশোরের রেলশহর, সেখানকার মানুষজন, স্কুল, সহপাঠী, গ্রন্থাগার লেখকের ওপর প্রগাঢ় ছাপ ফেলেছিল, যার ছায়া পড়েছে তাঁর পরবর্তীকালের সাহিত্যকর্মে। বরাবরই খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করে পড়তে এলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, বাসিন্দা হলেন হিন্দু হস্টেলের। রেলশহরের লাজুক কিশোরটির মনের সবক’টি জানলা খুলে গিয়েছিল বৃহত্ এই শিক্ষাপ্রাঙ্গণে এসে। সহপাঠী সব কৃতী ছাত্র এবং প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকেরা তাঁর জীবনে এমন একটি পরিবর্তন এনে দিয়েছিল যার ছাপ পড়েছিল তাঁর পরবর্তী জীবনে। সাহিত্যানুরাগী কয়েকজন বন্ধুকেও পেয়েছিলেন, সাহিত্যজগতে তার পা রাখার ঘটনাটিও চমকপ্রদ। সঙ্গে ছিল প্রবল পাঠতৃষ্ণা। বাংলা বইপত্র তো ছিলই, আর ছিল পেঙ্গুইন ও পেলিক্যানের বিশ্বজোড়া ভাণ্ডার। কলেজস্ট্রিটে তখন নতুন ও পুরনো বিস্তর ভালো ভালো বইপত্তর পাওয়া যেত।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন রমাপদ চৌধুরী, কিন্তু আগ্রহ ছিল শিল্পসাহিত্যের নানা শাখায়। ইতিহাসও ছিল তাঁর একটি প্রিয় বিষয়। আত্মকথায় সাহিত্যচিন্তার পাশাপাশি সেই ইতিহাসও উঠে এসেছে নানা জায়গায়। কেমন ছিল তখন দেশের সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট—সে-সবেরও কিছু খণ্ডচিত্র ধরা পড়েছে বইটিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চলেছিল তাঁর ছাত্রজীবন, কলেজ-পড়ুয়া তখন তিনি। যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার নানা কথাও প্রসঙ্গক্রমে এসে গেছে তাঁর আত্মকথায়। কিন্তু এখানে তিনি কোনও দলিলচিত্র রচনার দিকে যাননি। শৈশব, কৈশোর, যৌবনের বর্ণময় ছবিই প্রাধান্য পেয়েছে ; আর সব কিছুর আড়াল থেকে যা বিচ্ছুরিত হয়েছে তা তাঁর সাহিত্যচিন্তা।
শস্তাগন্ডার বাজার ছিল তখন। কেমন শস্তা তার কিছু পরিচয় তুলে ধরা যেতে পারে লেখকের আত্মকথা থেকে। লেখক লিখেছেন, ‘মাছ-মাংস ছ’আনা থেকে আট আনা সের। এক পাউন্ড চায়ের দাম মাত্র আট আনা। একটি কোডাক বক্স ক্যামেরা কিনেছিলাম, মনে আছে, মাত্র তিন টাকায়। সোনার ভরি ছিল তখন পঁয়ত্রিশ টাকা।’
এই বইয়েরই অন্যত্র হিন্দু হস্টেলের থাকা-খাওয়ার খরচের কথা শুনিয়েছেন। আজকের বিচারে সে এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। হিন্দু হস্টেলের একক কক্ষের ঘরভাড়া ছিল দশ টাকা। “সারা মাসের দু-বেলা খাওয়ার মেসিং চার্জ কোনো এক অলিখিত আইনে বারো টাকার ঊর্ধ্বে যাওয়া নিষিদ্ধ। সেরা চামরমণি চাল তখন টাকায় এগারো সের, দুধ টাকায় আট সের, এক পাউন্ড লিপটন চায়ের প্যাকেট আট আনা, ডিম দু-পয়সা, একটি ফারপোর ছোটো মিল্ক ব্রেড দু-পয়সা। তত্সত্ত্বেও কেউ কল্পনা করতে পারতেন না মাসিক বারো টাকার বিনিময়ে কী আহার্য জুটত। দৈনন্দিন ডালভাতের সঙ্গে দু-বেলাই থাকত বেশ বড় এক পিস মাছ, দু-রকমের ব্যঞ্জন, একটি ভাজাভুজি এবং কোনোদিন উপরি পাওনা মেটের তরকারি। কিন্তু এসব তুচ্ছ, আসল খাওয়া সপ্তাহে দু-দিন, রবিবার ও বুধবার। রবিবার ফিস্ট বুধবারে সেমি-ফিস্ট। সেমির বিবরণ শুনলে একালের লোকের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। দেরাদুন রাইসের পোলাও এবং যথেচ্ছ পরিমাণে মাংস। ভেটকির ফ্রাই, রুইমাছের মুড়ো দেওয়া ডাল, দই, মিষ্টি। রবিবারের ফিস্টে এ ছাড়াও গলদা চিংড়ির মালাইকারি, কখনো গঙ্গার ইলিশের ভাপা এবং ভাজা। দই,মিষ্টি ছাড়াও রাবড়ি কখনো কখনো। মাত্র আট আনা গেস্ট চার্জ দিলে সেই ফিস্টে একজন বন্ধুকেও খাওয়ানো যেত।”

কিন্তু লেখক জানিয়েছেন, জিনিসপত্রের দাম শস্তা আর অঢেল বিদেশি জিনিস পাওয়া গেলেই সেটি ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে যায় না, বরং সেটি ছিল আদতে ‘তাম্রযুগ’। লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে সেটি তামারই যুগ। তামার পয়সা, তামার আধলা অর্থাৎ আধপয়সা, এমনকি তীর্থস্থানে পাইপয়সাও চলত। তিন পাই মানে এক পয়সা, সেই পাইপয়সা ভিক্ষে পেলেও অনেকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
লেখকের কাছ থেকেই জানা যায়, ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে কেরানির চাকরিতে মাসিক বেতন ছিল তিরিশ টাকা। এই চাকরির জন্যেও বছরের পর বছর অনার্স গ্রাজুয়েটকেও উমেদারি করতে হত। সেকালে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ছিল নামমাত্র, কিন্তু চাকরি ছিল তার চেয়েও কম। লেখকের মাতামহ উনিশ শতকের গ্রাজুয়েট, কিন্তু রেলের স্কুলের হেডমাস্টার হতে পেরেছিলেন ‘পরম ভাগ্যবান’ বলেই। লেখকের বাবা ১৯১৯ সালের এম এস সি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন, তাঁর চাকরি পাওয়াও সহজ হয়নি। লেখক নিজেও ছিলেন আগাগোড়া কৃতী ছাত্র, ইংরেজির এম এ, কিন্ত চাকরি পাওয়ার জন্যে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে।
আসলে, ভারতে ব্রিটিশরাজের শেষের কয়েক দশকে স্বাধীনতা-আন্দোলনের জোয়ার লেগেছিল গোটা দেশে। ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মানুষদের সাধারণত বড় চাকরিতে বহাল করতেন না। মাঝারি চাকরির সংখ্যাও ছিল কম। কিছু চাকরি হত রেলওয়েতে, কাস্টমসে, সামান্য কিছু সওদাগরি অফিস ইত্যাদিতে।

লেখক হওয়ার কথা লেখকের মুখেই শোনা যাক। ‘ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পরই আমার তিন মাস লম্বা ছুটি। সেই প্রথম একটা স্বপ্নরাজ্য আবিষ্কার করলাম, যা আমাকে লেখক করে তুলল। সারা ভারত ঘুরেছি। …তখন এই স্বর্গদ্বীপ আমার মন জয় করে নিল রাতারাতি।’ জায়গাটি রাঁচির কাছে। আগে নাম ছিল লাপরা, পরে নাম বদলে হয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ । চতুর্দিক ঘন অরণ্য, মাঝে মাঝেই টিলা কিংবা পাহাড়। আড়ালে আড়ালে ছোট মুন্ডা বা ওঁরাও বস্তি। আদিবাসীদের বাইরে যারা এখানে থাকে, তারা সব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অপরূপ এই পরিবেশে জন্ম হল লেখক মানুষটির। লেখকের হাতে এক-এক করে উঠে এলো বেশ কয়েকটি গল্প। কিছুকাল পরেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত ‘দরবারী’। রচিত হয়েছিল আন্ডা হল্টের গল্প ‘ভারতবর্ষ’।
আত্মকথার বিভিন্ন জায়গায় লেখক মানুষটির বিচ্ছিন্ন পরিচয় ধরা আছে। ঘটনাকালের পরম্পরা সব সময় মানা হয়নি। আগের কথা কখনো পরে এসেছে, পরের কথা আগে। ঘটনাক্রমের নানা কথা শুরু হয়েছে লেখকের শৈশবে, শেষ হয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরে।

অপরূপ এই আত্মকথা লেখার কাজ এক সময় থামিয়ে দিয়েছিলেন রমাপদ চৌধুরী। তারপর লেখাটি তাঁর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। শেষবয়সে আকস্মিক ভাবে আবিষ্কৃত হয় অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। সে-কাহিনি চমকপ্রদ, বইটির সম্পাদক সিদ্ধার্থ সিংহ ভূমিকায় তা জানিয়েছেন। আত্মকথার প্রকাশ লেখকের মৃত্যুর পরে। স্বাভাবিক কারণে বইটির নাম, বিভিন্ন পরিচ্ছেদের নামকরণ ও সাজিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব ছিল সম্পাদক ও প্রকাশকের ওপর। সে দায়িত্ব তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র এই বইটির বাড়তি সম্পদ। বইটি অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য

চিত্রগুলি সবই অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

গ্রন্থ –  ফেলে আসা জীবন

লেখক – রমাপদ চৌধুরী

প্রকাশক – প্রতিভাস

মুদ্রিত মূল্য – 

সম্পাদকীয় সংযোজন –  

লেখক শেখর বসুর প্রথম উপন্যাসের পিছনেও রমাপদ চৌধুরীর অবদান ছিল। সে কথা লেখক ‘অবসর’ পত্রিকাতে আগের একটি লেখাতে জানিয়েছিলেন। আগ্রহী পাঠকের জন্য রইল সেই লেখার লিঙ্ক – 

https://abasar.net/abasarold/abasar/PujoShekharBasu.htm

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *