সমরেশ মজুমদার - এক অক্ষয় স্মৃতির কোলাজ
সমরেশ মজুমদার নামটা তখনো আমার শোনা হয়নি, কিন্তু আপামর বাঙালির মনের অন্দরমহলে তিনি নিশ্চুপে প্রবেশ করেছিলেন। একজন মানুষ বাঙালির মনে জন্ম দিচ্ছেন এক নতুন যুগের।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন দোকানে গিয়ে আমরা বলি, “কাকু থামস আপ আছে?” কাকুও হাসিমুখে পরের প্রশ্ন করেন, “গোল্ডস্পট, থামস আপ আর লিমকা আছে, কোনটা চাই?” থামসআপ চাওয়া ছেলেটি বলে, “গোল্ড স্পট দাও।”
এ আবার কী কথা? এখুনি বলল যে থামস আপ? হুঁ হুঁ বাওয়া, সে যে বিস্ময়কর নব্বই দশক, আমাদের একান্ত আপন। বাইরে থেকে তাকে দেখলে একটু হাসি পাবে। কিন্তু আমার মতন যারা তার ভিতরে থাকার সুযোগ পেয়েছে, তাদের কাছে এই অদ্ভুত সময় এক আবেগ। আবেগের নাম নস্টালজিয়া, যখন তখন ফিরে দেখে খানিক হাসি, খানিক মন খারাপ।
তখন কোল্ডড্রিঙ্ক মানেই থামস আপ, চকলেট মানেই ক্যাডবেরি আর কাপড় কাচা সাবান মানেই সার্ফ। এমনকি মানুষের নামও পরিবর্তন হয়ে যেত। তেমন একটা ঘটনা বলি।
একটা বিয়েবাড়ি গেছি। বন্ধুর দাদার বিয়ে। সঙ্গে মা আর পাশের বাড়ির কাকিমা। মোটামুটি ফাঁকা বিয়েবাড়ি, পাড়ার মাঠেই প্যান্ডেল। অথচ এক জায়গায় খানিক জটলা। আমরা অবাক হয়ে জটলার কাছে গিয়ে কৌতূহল নিবারণ করব ভাবছি, এমন সময় বুল্টিদি এক ছুটে জটলা থেকে বেরিয়ে এসে মুখে এক বিঘত হাসি নিয়ে মাকে বলল, “কাকিমা কে এসেছে দেখেচ?”
মায়ের মুখে তখনো বিস্ময়, “কে রে?”
“আরে, গোরা।”
সেই প্রথম দেখেছিলাম স্মার্ট, ছ’ফুট ছাড়ানো মানুষটাকে। আপামর বাঙালির কাছে তিনি তখন গোরা, সব্যসাচী চক্রবর্তী নন। কেন এই গল্পটা বললাম? কারণ সব্যসাচী চক্রবর্তীর বাঙালির মনে জায়গা করার পিছনে যে “তেরো পার্বণ,” তার মাধ্যমে কিন্তু স্ক্রিপ্ট রাইটার সমরেশ মজুমদার জয় করে নিয়েছেন বাঙালি মন, অথচ অনেকে হয়তো তাঁর একটি লেখাও পড়েননি। এমনকি অনেকেই হয়তো জানতে চাননি, “তেরো পার্বণ“ ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট কার লেখা? তবু লেখকের পরিচয় তো তার লেখনীতেই। কাজেই তেরো পার্বণের জন্য, যখন বাঙালিকে প্রথম সার্থক ধারাবাহিকের স্বাদ দেওয়া পরিচালক জোছন দস্তিদারের নাম মুখে মুখে ঘোরে, সব্যসাচী চক্রবর্তী যখন গোরা হয়ে ওঠেন, অনুচ্চারণের মধ্যেও থেকে যান আরেকজন মানুষ, যার সঙ্গে আমার আসল মনের টান গড়ে উঠল উপরের ঘটনার অনেক পরে। এবার সেই গল্পটাই শোনাই।
আমার বাড়িতে যে খুব বিরাট কিছু বই পড়বার পরিবেশ ছিল, সে কথা বলা ঠিক হবে না। আমি অন্তত ছোটোবেলায় বাবা মাকে তেমন বইটই পড়ে সময় কাটাতে দেখিনি। বাবার পড়া বলতে আদ্যপান্ত খবরের কাগজ। মায়ের পড়া মানে আমার স্কুলের বই। কিন্তু এরই মধ্যে প্রতি মাসে আমার হাতে বাবা মা তুলে দিতেন ‘শুকতারা।’ যখন পড়তে শিখিনি, বাবা মা গল্প পড়ে শোনাতেন। অদ্ভুত না? হ্যাঁ, ওপরের দুটো কথার এমন অমিল আমার আজ, এই চল্লিশেও বড়ো অদ্ভুত লাগে। অথচ এটাই চরম বাস্তব। সেই আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যেস তৈরি হল। তারপর ‘শুকতারা,’ ‘আনন্দমেলা,’ আর সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই স্কুলের গণ্ডি পেরোলাম একদিন।
আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। তখনও আমরা মুকবইয়ের স্বাদ পাইনি, তাই বাড়ি ফেরবার আগে ক্যান্টিনের পড়ন্ত আড্ডায় বই যখন তখন উঁকি দেয়। কলকাতায় তখন ময়দানে ধুলোর খেলা, সঙ্গে বইমেলা। দু’জন বন্ধুর সঙ্গে শনিবারে কলেজে হাফ ছুটির পর বইমেলায় যাব ঠিক করলাম। বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বইমেলা যাওয়া। মনে তখন বসন্ত আগডুম বাগডুম খেলছে। জীবনে প্রেম না থাকলেও মনে সে বস্তুর অভাব যেমন নেই, তেমনি তাকে যতই জানি কৌতূহল মেটেনা।
ঠিক এমনি একটা সময়ে বইমেলায় চোখে পড়ল একখানা বই। “মনের মতো মন,” লেখক সমরেশ মজুমদার। পাতা উলটে দুটো নাম চোখে পড়ল, স্বপ্নাশিস আর আহির। কী সুন্দর নাম দুটো? বড্ড মন টানল। সেই হল আমার নিজের টিউশনের টাকায় কেনা প্রথম বই। অতএব পরের দিনটা কোথাও না গিয়ে একটু রাত জাগা আর বুঁদ হয়ে থাকা বইটার পাতায় পাতায়। কী যে মুগ্ধতা, সে কি আর বলে বোঝানো যায়?
শহরতলিতে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে স্বপ্নাশিষের বল উড়ে গিয়ে লাগল একটা মেয়ের মাথায়, নাম তার আহির। আর সেখানেই নানান ঘটনার ঘনঘটায় জোড় বাঁধল দুটো মিষ্টি মন। ঝরঝরে গদ্যে লেখা তরতরে উপন্যাস। কিন্তু শেষটায় মন খারাপে ভরা। বড্ড অভিমান হল লেখকের ওপর। কিন্তু যতক্ষণ না কেউ মনের গোপন ঘরে আপন হচ্ছে, ততক্ষণ কি অভিমান হয়? বুঝলাম, হঠাৎ আপন হয়ে ওঠা এই লেখককে জানতে হবে তার আরও লেখার মধ্যে দিয়ে।
এমত সময় আমার এক পড়ুয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তার সুবৃহৎ বইয়ের আলমারিতে চোখে পড়ল লাল রংয়ের মলাটের একটি বই। লেখক সমরেশ মজুমদার। জিজ্ঞাসা করলাম, “এই বইটা পড়েছিস?” সে বলল, “পড়ব না? এটা তো ওনার প্রথম উপন্যাস, ‘দৌড়।’ ট্রিলজি পড়ার পর একের পর এক ওঁর লেখা পড়েছি।”
একথা আমার সিলেবাসের বাইরে। সাহস করে আর জিজ্ঞাসা করলাম না, কোন ট্রিলজির কথা বলছে। বরং মানে মানে বন্ধুর কাছ থেকে বইখানা ধার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়ি ফিরে তাড়াহুড়ো করে নাকে মুখে ডিনার গুঁজে নিয়ে বসে পড়লাম বইখানা নিয়ে। কিন্তু কিছুদূর পড়েই থমকাতে হল। আমি বলে সদ্য বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, সেই আমাকেই বিশ্বাস করতে হবে যে একজন লোক দুমদাম বলে দিচ্ছে কোন ঘোড়া রেস জিতবে, আর সে কথা মিলে যাচ্ছে? না আর এগোতে পারলাম না। সে রাতে বরং ঘুমিয়ে পড়াই শ্রেয় মনে করলাম। কিন্তু এ বইয়ের কাছে যে আবার ফিরতে হবে, সে কথা তখনো ভাবিনি।
কলেজ লাইব্রেরিতে সিলেবাসের বই তুলতে গিয়ে প্রায়ই গল্পের বইয়ের আলমারির আশেপাশে ঘোরাফেরা করি। ততদিনে জেনে গিয়েছি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ট্রিলজির কথা। উত্তরাধিকার বইটা নিয়ে নিলাম। তারপর যে কি হল সে কথা বোঝানো কঠিন। হয়তো হারিয়ে গেলাম, হয়তো বা এ বই আমায় গ্রাস করল। স্বর্গছেঁড়া – নামটা পড়েই খানিকক্ষণ চুপটি করে বসে একখানা সবুজে মোড়া ভারি সুন্দর অদেখা চাবাগানের দেশের কথা ভেবে ফেলেছিলাম। আমার ভাবজীবনে কতবার যে সে পথে ঘুরে এসেছি তার ইয়ত্তা নেই। কত দৃশ্যকে চোখের সামনে দেখেছি, কত দৃশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে আছে আজ এত বছর পরেও, যে ভাবতে অবাক লাগে। ঐ যে, যে জায়গাটায় সরিৎশেখর একটা ট্রাকে চেপে চা বাগান ছেড়ে চলে আসছেন, মদেসিয়া কর্মচারীরা গাড়ির আনাচে কানাচে উঠে পড়ে আর্জি জানাচ্ছে না যাবার, আহা, কতগুলো কাগুজে কালো অক্ষর ছেড়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সে দৃশ্য। তারপর কখন যেন ঝাপ্সা হয়েও গেছিল – না সে দৃশ্য নয়, আমার চোখ।
আরও আছে। অনিমেষের বন্ধুর নামের সঙ্গে নিজের পরলোকগত স্বামীর মিল পাওয়া পিসিমার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকেও অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেই তখনই বুঝেছিলাম লেখকের হাতের গুণে অক্ষর কেমন ছবি তৈরি করে, অদেখা হয়ে ওঠে দৃশ্যমান, অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে বাস্তব, ছবিরা কাঁদায়, হাসায়, রাগায়, ভাবায় – সাহিত্যের জন্ম হয়।
অনিমেষের জীবন জুড়ে চলতে থাকে রাজনীতির পালাবদল। নতুন স্যারের আদর্শে রাজনীতিতে জড়াতে থাকে অনিমেষ। ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের সাহায্যে। আর ঠিক তখনি ঘটে এক অদ্ভুত পালাবদল। অনিমেষের অতি প্রিয় নতুন স্যারের অজানা এক রূপ প্রকট হয়ে ওঠে নতুন স্যারের সঙ্গে ত্রাণ সরবরাহের সময়। অবাক হয়ে অনিমেষ দেখে, নতুন স্যার তাঁর নিজের দলের এলাকা নয় বলে গাছে ঝুলতে থাকা মৃতপ্রায়, বন্যাদুর্গত মানুষদের খাবার না দিয়ে কেমনভাবে তাঁদের মৃত্যুর ছায়ায় ছেড়ে রেখে চলে যান।
অনিমেষ বড়ো হতে থাকে, সঙ্গে আমি। তারপর একদিন কলকাতা নামের একটা শহর অনিমেষকে গিলে ফেলে, অনিমেষ পৌঁছায় কালবেলায়, সঙ্গে আমিও। আমার কলেজ জীবন মিশে যায় অনিমেষের সঙ্গে। ক্লাসের মাঝে দুটো নীরব চোখ যখন অনিমেষের দিকে চেয়ে থাকে, আমিও মাধবীলতার প্রেমে পড়ি। আর এমনি করেই একদিন সমরেশ মজুমদার আমার ভাবজীবনের অকাল বার্ধক্য কাটিয়ে যৌবনে ফিরিয়ে আনেন। আবার দৌড় পড়লাম, অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস করলাম, ভালো লাগল, মুগ্ধ হলাম। জয়িতার দ্রিমিত হয়ে ওঠার গল্প শুনলাম, বুকের ভিতর আগুন জ্বালাল জয়িতা, সুদীপ, আনন্দ, কল্যাণ, দ্রিমিতের “গর্ভধারিণী” হবার সাক্ষী রইলাম। তারপর “সাতকাহন,” সে এক অনন্য অনুভূতি। দীপাবলিকে খুব কাছ থেকে দেখতাম প্রতি মুহূর্তে। নারীকে ভালবাসতে শিখলাম, দীপার প্রেমে পড়লাম।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘অর্ধেক জীবন’-এ লিখেছিলেন, মানুষের একটা ব্যক্তিজীবন থাকে, তেমনি থাকে ভাবজীবন। আমার মনে হয় দুটির কোনটিকেই অস্বীকার করা যায় না। লেখকের কলমে তাঁর ভাবজীবন বাস্তব জীবনকে ছাপিয়ে যায়, পাঠক লেখককে চিনতে শেখে তাঁর ভাবজীবনের আদলে। আর সেখানেই বোধহয় লেখকের সার্থকতা। আমি ঠিক এমন করে চিনতে শিখেছিলাম সমরেশ মজুমদারের ভাবজীবনকে। আমার কাছে সমরেশ মজুমদারের পরিচয় তাই অনিমেষ, দ্রিমিত, আহির, স্বপ্নাশিসদের মধ্যে দিয়ে। বছর তিনেক আগে বইমেলায় মানুষটার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম যখন নতুন কিছু লেখকের চতুর্দিকে ভিড়ের ছড়াছড়ি, সমরেশ মজুমদার তখন একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। হয়তো তখন তাঁর ভাবজগতে বিচরণ করছে আবার কোনও অনিমেষ, আবার কোনও দীপাবলি – কী দরকার তাদের গতিকে থামিয়ে দিয়ে? কিছুক্ষণ দূর থেকে তাঁকে দেখে আমার চেনা সমরেশ মজুমদারকে বুকে নিয়েই ফিরে এলাম।
4 Comments