দিনের পরে যায় দিন
দেশবিভাগের বহু আগে, আমার ঠাকুর্দা কলকাতার বুকে খোদ ভবানীপুর এলাকায় বেশ খানিকটা জমির মাঝে একখানা দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। বড় রাস্তা থেকে গেটের ভিতরে ঢুকে বাড়ি পর্যন্ত আসতে নাকি সুপুরি গাছের সারি দেওয়া ইটের পথ ছিল। আমরা বড় হয়ে উঠতে উঠতে সেই পথের পাশে মাত্তর গোটাকয়েক গাছই অবশিষ্ট ছিল।
ওই বাড়িতেই আমাদের বাপ জ্যাঠারা বড় হয়ে, পড়াশুনা শেষ করে যে যার মতো চাকরি বাকরি জুটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেও, তাঁদের ছেলেপুলের দল অর্থাৎ আমরা, ইশকুলের পাট চুকোনো মাত্তরই এক এক করে কলকাতায় এসে ওই বাড়িতে থেকেই কলেজে পড়াশুনা করতাম। ওটাই ছিলো আমাদের পরিবারের অলিখিত নিয়ম, কারণ আমাদের ঠাকুর্দা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মারা যাবার পর ঠাকুমা কিছু রক্তের সম্পর্কবিহীন অথচ স্বজনপ্রতিম মানুষজনদের নিয়ে,ওই বাড়িতেই থাকতেন। পরিজনহীনতার একাকীত্ববোধে যাতে তাঁকে কখনও কষ্ট পেতে না হয়, সেইজন্যই ওই ব্যবস্থা।
ঠাকুমা পরিবারের মাথা হলেও সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে যিনি ছিলেন, তাঁকে সবাই ডাকত বামুনদিদি নামে। আবালবৃদ্ধবনিতা, সকলের ইউনিভার্সাল বামুনদিদি।
গৌরবর্ণা, কোঁকড়া চুলে ঘেরা দুর্গা প্রতিমার মত অপূর্ব মুখশ্রীযুক্তা মহিলাটির মুখের দিকে চাইলে এক নজরেই বোঝা যেত তিনি সম্ভ্রান্তবংশীয়া। পরিস্থিতি তাঁকে আমাদের বাড়িতে এনে ফেলেছিল, আমাদের মতো কতগুলো অপোগন্ডের ভার নিতে।
যতদূর জানতাম, বালবিধবা মহিলাটি পূর্ববঙ্গে বসবাস করতেন, ছোট ছোট ভাইদের সংসারের মাথা হয়ে। দেশবিভাগের পরেও সেদেশেই থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। তারপর কেন জানা নেই, এদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। এরপরে কীভাবে, কেমন করে আমাদের দ্বিতীয় ঠাকুমা হয়ে আমাদের এই বাড়িতে এসে থিতু হন, সেই ইতিহাস আমাদের জানা ছিল না, জানার আগ্রহও বোধ করিনি কোনও দিন। শুধু এখন এই বয়সে এসে বুঝি তাঁর অভিভাবকত্বের শ্যেন দৃষ্টিতে, নিজেদের অজান্তেই জীবনের অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে গেছি। মানুষ কতটা হয়েছি জানিনে, কিন্তু একেবারেই অমানুষ হয়ে যেতে পারিনি।
এই সূত্র ধরে একখানা গল্প বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার ছোটপিসির ফর্সা টুকটুকে মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশনের পর যখন বাঁধাধরা উচ্চশিক্ষায় বিতৃষ্ণ হয়ে অতঃপর কী করা যায় – এই চিন্তায় মগ্ন, তখনই বামুনদিদি পাশের পাড়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারের চার্টার্ড একাউন্টেন্ট পাত্রটির সঙ্গে একখানা সম্বন্ধ অবলীলায় সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
রোজ দুপুরে স্নান সেরে বাড়ির পাশের মন্দিরে, শিবলিঙ্গের মাথায় জলঢালা ছিল তাঁর নৈমিত্তিক কর্ম। পাত্রের মায়ের সঙ্গে সেখানেই,বামুনদিদির দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ পরিচয়। এই জীবনে নিজের জন্য যে আশীর্বাদের প্রয়োজন তাঁর মোটেও ছিল না, সেই আশীর্বাদটুকু আঁচলে বেঁধে, তিনি আমাদের বোনটির জন্য সংগ্রহ করে এনেছিলেন। অচিরেই শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়,এবং তারা আজও পুত্রকন্যাসহ সুখে ঘরকন্না করছে।
এঁরা নিজের লোক নয়তো আবার কী!
পরবর্তী কালে পায়ের তলার মাটি একটু শক্ত হতেই বামুনদিদির নিজের ভাইরা দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি ফিরে যাননি। ভাইরা অবশ্য মাঝে মধ্যেই বড় বড় মিষ্টির বাক্স হাতে দেখা করতে আসতেন। আমরাও ভাগ পেতাম।
এই পরিবারে আরও একটা অলিখিত নিয়ম চালু ছিল। সব মেয়েদের জন্যে বাড়ির কাছাকাছি হাঁটাপথের সীমানায় মর্নিং কলেজেই ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এই ব্যপারে অন্য কোনও মতামত গ্রাহ্য করা হত না। নিত্যদিন ট্রাম-বাস ঠেঙিয়ে, অভিভাবকদের উদ্বেগের পারা চড়িয়ে, একই সিলেবাসের পড়া পড়তে যাবার যৌক্তিকতা তাঁরা বুঝে উঠতে পারতেন না, বিশেষ করে যে বাড়িতে কিনা দেরি হলে খোঁজখবর করবার জন্য শক্তসমর্থ পুরুষ মানুষ থাকে না!
এর আরও অনেক বছর পরেও আমার জ্যাঠামশায়ের নাতনি, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ভর্তির ছাড়পত্র পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের ওই চিরাচরিত কলেজেই ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছিল! কারণ যে কলেজ থেকে তার পিসিরা, পিসিরও পিসিরা পাশটাশ করে আরও নানা উচ্চশিক্ষার ধাপ অবলীলাক্রমে পার হয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে, সেই কলেজে পড়ার ঐতিহ্য ভঙ্গ করার কোনও যৌক্তিকতা তাঁরা খুঁজে পাননি। এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল, কারণ কলেজটি নেহাত মন্দ কিছু নয়, আজও মোটামুটি নামকরা, কিন্তু আমাদের ভাইঝিটির কপালে একখানা অতিরিক্ত বিড়ম্বনা জুটেছিল।
জ্যাঠামশাই ততদিনে অবসর নিয়ে এই বাড়িতেই ফিরে এসেছিলেন। ফলে একটু বৃষ্টি পড়লেই ছুটির সময় ছাতা নিয়ে কলেজ গেটে হাজির হয়ে যেতেন। কে না জানে স্নেহ অতি বিষম বস্তু! একটু পরেই ছেলেদের সেকশন শুরু হত। তারা ততক্ষণে কলেজ গেটে হাজির, বাকিটা সহজেই অনুমেয়!
আবার আমাদের সেই নানারঙের দিনগুলিতে ফেরা যাক।
কলেজ শুরু হতো সকাল ছ’টায়। সেইসময় ভোরবেলায় নিয়মিত রাস্তা ধোওয়া হত। সজোরে ফটাশ্ করে একখানা শব্দে ঘুম ভাঙতো প্রতিদিন। হাইড্রেন্টের মুখ খোলার শব্দ। সেই যে মুখে পাইপ লাগিয়ে, তীব্র জলধারায় রাস্তা ধোওয়ার কাজ শুরু হত, ওটাই ছিল আমাদের অ্যালার্ম। আমরা প্রতিদিন সেই ধোওয়া রাস্তা দিয়ে কলেজে যেতাম।
ভবানীপুর এলাকায় তখন লাইন দিয়ে নামকরা সব সিনেমা হল রমরমিয়ে চলে। তিনটে, ছ’টা এবং ন’টা ছিল শো- টাইম। শুক্রবারে সেইসব হলে তখনকার নামজাদা নায়ক নায়িকাদের মারকাটারি সিনেমা মুক্তি পেত। মুক্তির দিন হলের সামনের গেটগুলি ফুলপাতার মালায় সেজে উঠত।
আমরাও মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যেতাম বৈকি, তবে বাড়িতে জানিয়ে, এবং একমাত্র তিনটের শোতে। ফেরার পথে রাস্তার গরমগরম আলুর চপের গপ্পোখানা অবশ্য গোপনই থাকত।
আমাদের ছোটপিসির ছেলে তখন রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়ে। হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। সেই কারণে ছোটপিসিকে মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসতে হত। আর পিসি এলেই আমাদের পোয়াবারো। একখানা করে সিনেমা আর ভরপেট তেলেভাজা বাঁধা। আমি যদিও ভাইটির চাইতে বয়সে অল্প কয়েকমাসেরই বড়, কিন্তু কী জানি কোন জটিল হিসেবে আমি তখন কলেজের ফার্স্টইয়ারে পৌঁছে গেছি। ফলে আমি বড়দের গ্রুপে। ভাইটি মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করলেও হস্টেলবাসী, অতএব ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ হবার সুযোগ মেলেনি।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প না বললেই নয়।
একবার পুজোর ছুটির সময় ছেলেকে হস্টেল থেকে কলেক্ট করে এনেছেন পিসি। পরদিন নিজের জায়গায় ফেরা, তার আগে রুটিন মাফিক সিনেমা। এবার ভাইটিও দলে সামিল। সদলবলে সিনেমা দেখে বের হয়ে বেচারি ভালোমানুষ ভাইটি, ধোপদুরস্ত নায়কের লোভনীয় বিবাহ প্রস্তাব হেলায় অগ্রাহ্য করে নায়িকা কেন যে নির্জন সৈকতের সিক্ত বালুচরে ফেলে যাওয়া বাউন্ডুলে উদাসীন নায়কের পদাঙ্ক অনুসরণ করল – তার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ায়, পিসি তার হাতে গোটা চারেক ধবধবে সাদা সন্দেশ ধরিয়ে দিয়ে আমাদের ভরপেট গরম গরম চিংড়ির চপ খাইয়েছিল!
নিজের মায়ের করা সেই অপমান সে এই বৃদ্ধবয়সে এসেও ভোলেনি। পারিবারিক জমায়েতে ঘরময় হাসির হাওয়া বইয়ে আজও তার সেই উথলে ওঠা দুঃখের কিসসা সে নিজেই সবিস্তারে বর্ণনা করে!
এইসব পারিবারিক নানারঙের দিনযাপনের মাঝে আমার চেতনা, আত্মসম্ভ্রম,আর মূল্যবোধ গড়ে উঠছিল। নেপথ্যে নিজের অজান্তেই আরও একটা উপাদান কাজ করে চলত, সেটি হলো গল্পের বই।
কোনও একটি বিশেষ বই চিহ্নিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু সেই নির্দিষ্ট দিনগুলিতে যে বইটি আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল, সেটি হল আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা।
‘সুবর্ণলতা’ তখন মাসিক বসুমতীতে কিস্তিতে প্রকাশ পায়। আমাদের বাড়িতে সেটি আসে না। বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিতে হয়। তাদের বাড়ির প্রতিটি সদস্য – ধোপা, নাপিত, মায় পোষা কুকুরটিরও শোঁকা হয়ে গেলে সেখানা হাতে পেতাম। উফফ্, সে যে কী আনন্দ! পাঠকমহলে রীতিমতো সাড়া ফেলেছিলো সেই লেখা। কবেকার পুরনো দিনের ঘরকন্নার ছবি, তবু নাকি কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে সুবর্ণলতার ছায়া খুঁজে পেতেন!
এক বিয়েবাড়িতে আশাপূর্ণা দেবীর সাক্ষাত পেয়ে সে কথা জানাতেই তিনি নাকি বলেছিলেন, “সে কী? সমাজ, তবে বদলাচ্ছে না বলতে চাও!”
আজ জীবনের এই অপরাহ্ণবেলায় এসে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি খুব বদল হয়েছে! বিশ্বব্যাপী
অগ্রগতির জয়ধ্বজার আড়ালেও ছোঁয়াছুঁয়ি, মাদুলি, তিথি অনুযায়ী কুষ্মাণ্ডভক্ষণ – দাপটেই বিরাজ করে! আজও কেন নাবালিকার বিয়ে রুখতে পুলিশকে ছুটতে হয়!
এখন আমার আস্তানা বাইপাসের ধারে একটি আবাসনে। বারান্দায় বসে এইসব আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে হারিয়ে যাই।
পুরনো কাজের মানুষটি দেশে যাবার সময় একজনকে দিয়ে গেছে,তার আবার হাত এবং মুখ দুইই সমানতালে চলে। বিকেলে কাজের শেষে এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় আমার কাছটিতে এসে বসে। দুটো সংসারের সুখ দুঃখের কথা কয়ে হালকা হয়। দুটি মেয়ে। তাদের ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বাপের সবরকম বিরোধিতা সত্ত্বেও মেয়েদের ভাগ্য গড়ে দিতে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে।
কথার তোড়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। হঠাৎ শুনি বলছে, “আশেপুন্না দিদা আমায় পই পই করে বলে গেচে মেয়ে দুটোকে যেন নিজের পায়ে দাঁড় করাই। আমিও কথা দিয়েচি জান দিয়ে লড়ে যাব।”
স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে, “কী বললে! কে বলেছেন?”
“ওই যে গো, আশেপুন্না দিদা, বই নিকতো, বই নিকেই তো কত নাম ডাক। পেরাইজ পেল। কাগজে ছবি বেরুল।”
অবাক বিস্ময়ে বলি, “তাঁকে তুমি পেলে কোথায়?”
“কেন, আমি তো তাঁর বাড়িতেই কাজ করতুম গো। ওই তো সিনেমা হলের উল্টো দিকের দোতলা বাড়িটা। বাসনমাজুনি বলে একটুও হতচ্ছেদ্দা করেননি কোনওদিন, উল্টে রোজ কাজকম্মের শেষে বসিয়ে কত সুখদুঃখের কথা কইতেন…”
আরও কতো কিছু বলে যায় সে।
হতবাক হয়ে বসে থাকি। এত কাছে থাকতেন! শুধু আমিই তাঁর হদিশ পাইনি! অনেক কষ্টে মুখে কথা জোগায়। বলি, “তোমার মেয়েদের পড়াশুনার জন্য টাকার দরকার হলে বোলো, আমি আছি। তুমি শুধু এখুনি ওদের পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিও না!”
তীব্র স্বরে সে বলে ওঠে, “না গো, কিচুতেই না। ঐ যে পাড়ার মোড়ে নাইবেরিটা(লাইব্রেরি) তোয়ের হয়েচে না, সেকেনেও ক’জন মাস্টার মশাই আমাদের মতো গরীবদের ছেলেমেয়েকে বিনা পয়সায় টিউশানি পড়ায় গো। ওই জন্যই তো আমার বড় মেয়েটা এবার এত ভালো রেজালট করে কেলাশ টেনে উটেচে।”
সন্ধে হয়ে আসে। স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবি, এই তো, সমাজ তো সত্যিই বদলাচ্ছে!
মাঝে মাঝে স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ে দেখি, তাতে হিরে জহরত মণিমুক্তোর সম্ভার নেহাৎ মন্দ জমেনি। তারই আলোয় বাকি জীবনের পথটা ঠিক চলা যাবে।