সুজন দাশগুপ্ত
১৮ই জানুয়ারি, ২০২৩। একজন কাছের মানুষ চলে গেলেন আজ। ‘একেনবাবু’র স্রষ্টা, লেখক সুজন দাশগুপ্ত। সারাদিন ধরে ভাবছি, চারদিকে তো এত মানুষের ভিড়, সুজনদার মতো এমন চমৎকার এবং সৃজনশীল মানুষের যাবার এত তাড়া কেন? ওঁর চলে যাবার খবরটা শুনে থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। আর মন খারাপ হলে আমি লিখতে বসে যাই। আমার এই nerdy অভ্যাসের কথায় অনেকেই হয়তো মুখ টিপে হাসবেন। তবে আমি তো আর ওদের জন্য লিখছি না। লিখছি নিজের লেখার তাগিদেই। লিখছি সুজনদার কথা মনে করে।
সুজনদার সঙ্গে প্রথম কবে আলাপ হয়েছিলো, আজ আর তা মনে নেই।
AT&T থেকে কম বয়েসে retire করে উনি ফুল টাইম লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন। বাংলায় লেখা। আমাকে বলতেন “ছেলেবেলা থেকেই আমার বাংলা ভাষাতে লেখার শখ।” প্রথম দিকে ধাঁধার বই লিখে হাতেখড়ি। অঙ্ক, লজিক, পাজল, টেকনোলজি নিয়েই লিখতেন। পরে মোবাইল টেকনোলজি নিয়ে এক আধ জায়গায় লিখেছেন, বলতেন “যদিও সেই লেখাগুলো এখন নিজেই বুঝতে পারব কিনা সন্দেহ আছে!” বছর কয়েক আগে আনন্দ পাবলিশার্স ওঁর অঙ্ক আর লজিক-পাজল নিয়ে লেখা বইগুলোর একটা সঙ্কলন বার করেছিল।
২০০০ সালে অগ্রজ-প্রতিম প্রয়াত সুমিত রায়ের সঙ্গে ‘অবসর’ বলে একটি তথ্য আর বিনোদনের ওয়েব পত্রিকা শুরু করেছিলেন। তাতে নানা ধরনের লেখা বেরত। অবশ্য গল্প-কবিতা সেখানে ছাপা হত না, ছাপা হত শুধু প্রবন্ধ। পছন্দসই লেখা না মিললে মাঝে মধ্যে বাধ্য হয়ে সুমিতবাবুকে আর স্বয়ং ওঁকেই লিখতে হত।
সুজনদা খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন গোয়েন্দা একেনবাবুকে সৃষ্টি করে। একেনবাবুর প্রথম উপন্যাস আনন্দমেলা’য় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, প্রথম বই ১৯৯৪ সালে। প্রকাশক ছিল সুপ্রীম পাবলিশার্স। ২০১০ সালে থেকে প্রায় প্রতি বছরই একটা করে একেনবাবুর বই প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথমদিকে একেনবাবুর বই তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। সুজনদার কথায়, “এইবার কলকাতায় এসে বুঝলাম ওয়েব সিরিজ ও সিনেমার কল্যাণে একেনবাবুর কিছুটা পরিচিতি হয়েছে, বই আর ক’জন পড়ে! দিন দুই আগে একেনবাবুকে নিয়ে ‘হইচই টিভি’ আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সের শুরুতেই বললাম, ‘একেনবাবুর বই প্রথম দিকে মাত্র তিনজন পড়ত, তাই অবাকই হয়েছিলাম একেনবাবুকে নিয়ে কেউ ওয়েব সিরিজ করার কথা ভাবছে শুনে!’” যাই হোক, the rest is history।
এবার বলি, সুজনদার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হোল কীভাবে। ওঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা জানেন ওঁর কৌতুকপ্রিয়তা আর রসবোধের কথা। অনায়াসে পার্টির মধ্যমণি হয়ে বসতেন অফুরন্ত গল্পের সম্ভার নিয়ে। সুজনদার হাস্য-কৌতুকের একটা নিদর্শন না দিলে ওঁকে পুরোপুরি জানা হয় না। নীচের গল্পটা আমার সম্প্রতি শোনা।
বিয়ের পর সদ্য অ্যান আর্বরে এসেছে ইন্দ্রাণী। স্বামী অমিতাভর সঙ্গে প্রথাগত ভাবেই বিয়ে হয়েছে ওর। এসে অবধি হোম সিকনেস যায়নি। এর মধ্যে একদিন শমীতাদি-সুজনদার বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ এসে গেল। দাশগুপ্ত পরিবার অনায়াসেই নবদম্পতিকে আপন করে নিলেন। খাওয়া দাওয়ার পাঠ শেষে শুরু হোল গল্প-গুজবের পালা। নববধূ হলেও ইন্দ্রাণী বেশ সপ্রতিভ। মিটি-মিটি হেসে সুজনদা বললেন “আচ্ছা ইন্দ্রাণী, মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে তো এখানকার কথা সবই হয়। অমিতাভর কথা কী বলো তুমি?” একটু অপ্রস্তুত, ইন্দ্রাণী বলল “কী আর বলবো, সুজনদা?” উনি বললেন, “তুমি কি মাকে বলেছ, ‘ও বড় দুষ্টু?’”
হাসি-গল্পর মধ্যে হলেও সুজনদার serious, সৃজনশীল দিকটার সাক্ষাৎ সবসময় মিলত ওঁর কথাবার্তাতে। একদিন আমাকে বললেন, “অবসরের জন্য তুমি একটা popular level-এ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখ।” সুজনদা জানতেন আমি মাঝেসাঝে ইংরাজিতে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ-টবন্ধ লিখি। একটা বই লেখারও চেষ্টাতে আছি। কিন্তু social media-র কল্যাণে “বই আর ক’জন পড়ে” আজকাল? তার উপর আবার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ! জনপ্রিয় একটা ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশ করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া আর কী। আবার ভাবলাম এই সুযোগে যদি একটু publicity হয়!
বললাম “চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক শব্দের প্রতিভাষা নিয়ে সমস্যা। আর মুস্কিল যে বহুদিনের অনভ্যাসে বাংলা বানান ভুল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।” উনি বললেন “দ্বিতীয় সমস্যাটার সমাধান তো আমারই হাতে। এডিট আমি করবো। প্রথমটাও কোন সমস্যা নয়। প্রতিভাষা খুঁজে না পেলে তুমি ইংরাজি শব্দগুলো বাংলাতেই লিখবে।”
ইংরাজিতে একটা প্রবন্ধ আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিলো। ভাবলাম ওটাই বাংলাতে অনুবাদ করে ফেলি। অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে কাজটা যে সোজা নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সুজনদার সহায়তায় কাজটা শেষপর্যন্ত সম্পন্ন হল। ওঁর উপদেশ যে সেদিন কী কাজে লেগেছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ফলাফলটা যে আমাকে সুখী করেছিল তা বলতে পারি না। প্রবন্ধটা প্রকাশ হবার পর পৌষালী পড়ে বলল, “এমন খটোমটো লেখা আগে পড়িনি কখনো।”
সুজনদাকে সেটা জানাতে উনি বললেন “শোন!” কথার প্রথমে এই “শোন” বলার অভ্যাসটা ওঁর একটা বৈশিষ্ট্য। এখনো যেন কানে কানে বেঁধে আছে কথাটা আর ওঁর সৌম্য চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। “Popular level এ লিখতে হলে পাঠককে সব nuance-এর হদিশ না দিলেও চলে। অনেক সময় analogy বা উপমা দিয়ে সুন্দর ভাবে কাজ সারা যায়। পাঠকের interest ধরে রাখাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া চাই।”
এখানে সুজনদার ভাষার উপরে দখলের কথা অল্প করে না বললেই নয়। আগেই বলে নিই, আমাদের মধ্যে অনেকেই সুলেখক এটা মানতেই হয়। ফেসবুকে অনেক বন্ধুর লেখা পড়ে ভাল লেগেছে। আবার বিরক্তিকর পোস্ট-এরও অভাব নেই, বিশেষ করে যখন জীবনের সহজ চিন্তাগুলো অকারণে লম্বা নৈতিকতাবাদী rant-এর আকার ধারণ করে। আমার কাছে ভাল লেখার মাপকাঠি হল, যে লেখা ফিরে পড়তে ইচ্ছা করে, সেটা। সুজনদার লেখার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পুরোমাত্রায় ছিল। আর ওঁর নতুন লেখা দেখলেই পড়তে ইচ্ছা করতো তো বটেই। আমার বিচারে ছোট প্রবন্ধ বা অনু-গল্প লেখায় উনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সে লেখা দেখলে স্টাইল অনুকরণের ইচ্ছা রোধ করা কঠিন।
যাই হোক, এরপর ওঁর প্রবল উৎসাহ সত্ত্বেও বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে দ্বিতীয় প্রবন্ধটা লেখা হয়নি।
কয়েক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল। অবসর-এর ওয়েব সাইট থেকে হ্যাকার-দের আক্রমণের ফলে সংরক্ষণ করা বহু মিডিয়া ফাইল অদৃশ্য হল। সুজনদা বললেন “দেখ তো কিছু করা যায় কিনা?” অনুসন্ধানের পর বোঝা গেল সাইটের শিথিল নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে হ্যাকাররা এই ন্যক্কারজনক কাজটা করেছে। সাময়িক ভাবে চালু করা গেলেও গুরুত্বপূর্ণ upgrade ছাড়া সাইটটাকে সম্পূর্ণভাবে বিপদমুক্ত করা যাবে না। সুজনদা তখন একেনবাবু নিয়ে ব্যস্ত। বললেন “ব্যাকআপ তো করে রেখেছি, এখন এভাবেই চলুক, পরে দেখা যাবে।” কারণ ইতিমধ্যে উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে অবসরের পাক্ষিক প্রকাশনা বন্ধ করে তিন-মাসে একবার প্রকাশ করলেই চলবে।
বছর খানেক এভাবেই চলার পর সুজনদা অবসরের দায়িত্ব তুলে দিলেন একটা সংস্থার উপর। ওঁর involvement পরোক্ষ ভাবে রইল। একেনবাবু তখন মধ্য গগনে, একার পক্ষে কি সব দিক সামলানো সম্ভব? কয়েক মাস আগে উনি আমাকে টেলিফোন করে বললেন “তুমি এবার একটা nuclear fusion নিয়ে প্রবন্ধ লেখ। অবসরের জন্য।” বললাম, “আমার লেখাও যা, না লেখাও তা। পড়ে কি কেউ? পড়লেও বুঝবে কি?” উনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন একজনের কথা, বোধহয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অবসরের যোগাযোগ পেজে মন্তব্য রেখেছিল যে অমন লেখারও (আমার আগের প্রবন্ধ) প্রয়োজন আছে। আর বললেন, “তুমি ভাবছ কেউ পড়ছে না। অবাক হবে, অনেকে পড়বে। যাদের দরকার তারা তো বটেই।”
সুজনদা বেঁচে থাকলে হয়তো সত্যিই লিখতাম, কারণ উনি পেছনে লেগে থাকতেন। আজ উনি নেই। লেখার তাগিদটা যেন আরও বেশি করে অনুভব করছি। অলক্ষ্যে ওঁরই প্রেরণা, সন্দেহ নেই।
এই প্রবন্ধের সমস্ত তথ্যই সুজনদার ফেসবুক পেইজ থেকে সংকলন করেছি। নীচে, ফেসবুক থেকে নেওয়া, ওঁর একটা মনোগ্রাহী লেখা হুবহু তুলে দিলাম। হাল্কা চালে লেখা হলেও messageটা উপেক্ষা করার মতো নয়।
———-
সুজনদার ফেসবুকের লেখার অংশবিশেষ –
ফেসবুকে অনেক বন্ধুর লেখা পড়তে বেশ কষ্ট হয়, কারণ যে-সব শব্দ তাঁরা ব্যবহার করেন সেগুলোর অর্থ ঠিক বুঝি না, কতবার আর অভিধান দেখা যায়! নিশ্চয় ভালো লেখেন তাঁরা, কঠিন কঠিন শব্দগুলো সাজানোর কায়দা দেখেই সেটা বুঝি। আমার মতো পাঠককে স্রেফ জব্দ করার জন্য শব্দগুলো ব্যবহার করছেন না – সেটাও জানি। ধরে নিচ্ছি ফেসবুকের বেশির ভাগ পাঠকের ভাষাজ্ঞান আমার থেকে বেশি। আমি তো বাংলায় বরাবরই টায়ে-টুয়ে পাশ করেছি।
এই কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল অগ্রজপ্রতিম প্রয়াত সুমিত রায়ের কথা। সুমিতদা ছিল বাংলায় কৃতি ছাত্র। ২০০০ সালে আমরা দুজন মিলে শুরু করেছিলাম তথ্য আর বিনোদনের ওয়েবসাইট, ‘অবসর’। গল্প-কবিতা সেখানে ছাপা হত না, ছাপা হত শুধু প্রবন্ধ। পছন্দসই লেখা না পেলে মাঝে মধ্যে বাধ্য হয়ে সুমিতদা আর আমাকে অবসর-এ লিখতে হত।
সুমিত দার লেখার হাত ছিল দুর্দান্ত, বিশেষ করে শ্লেষে ভরা হালকা মজাদার লেখা। আবার সেই একই কলম থেকে বেরোত কঠিন কঠিন শব্দে ভরা গুরুগম্ভীর আলোচনা। পাঠকরা বেশির ভাগই আমাদের পরিচিত। তারা শুধু হালকা লেখাগুলোই পড়ত, অন্যগুলো নয়। আমাকে বলত, “একটু সহজ করে লিখতে বল না সুমিতদাকে, পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই।”
সুমিতদাকে সেটা জানাতে গেলেই ধমক খেতাম, “পন্টকদের জন্য আমাকে সহজ করে লিখতে হবে!”
“‘পন্টক’ আবার কী শব্দ?”
“তার আগে বল, ‘কন্টক’ কী?”
“কাঁটা।”
“তাহলে?”
“বুঝলাম, পাঁটাদের জন্য তুমি স্টাইল বদলাবে না। কিন্তু লাভটা কী হচ্ছে? তোমার লেখা তো সবাই পড়ছে না!”
এরকম কথাবার্তা বেশ কয়েকবার হবার পর, একদিন সুমিতদা সমস্যাটা মনে হয় বুঝল, “এ তো আচ্ছা ঝামেলা। কী করি বল তো?”
“এক কাজ কর, লেখা থেকে ‘অভিসন্দর্ভ,’ ‘সনিষ্ঠ,’ ‘প্রেয়ত্ব,’ ‘চেষ্টিত,’- এইসব শব্দগুলো বাদ দাও।”
“‘চেষ্টিত’ বাদ দেব কেন?”
“সব সময়ে লেখ, ‘চেষ্টিত হতে হবে।’ ওটা আবার কী ধরণের কথা, চেষ্টা করতে হবে বললেই তো হয়!”
“না হয় না, তাহলে চেষ্টার সেই জোরটা থাকে না।”
“তাহলে আর কী, ‘চেষ্টিত হওয়া’ই চালিয়ে যাও।”
পরের বার দেখলাম শুধু ‘চেষ্টা’ই লিখেছে!
আমাকে বলল, “তোর জ্বালায় আমার লেখার ভার আর ধার – দুটোই নষ্ট হয়ে গেল।”