রবীন্দ্র নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীত- সবই কি সুপ্রযুক্ত?

রবীন্দ্র নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীত- সবই কি সুপ্রযুক্ত?

(১)

১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত “মুক্তি” ছায়াছবিটি। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ঘটনাটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, কেননা বিভিন্ন দিক দিয়ে এই ছবিটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন যুগের দিশারী। এর মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ছবিটিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার। চরিত্রের বিভিন্ন সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বর্ণ ভাণ্ডার ব্যবহার করবার ব্যাপারে প্রমথেশ বড়ুয়া ও তাঁর ‘মুক্তি’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পথিকৃৎ হয়ে থাকবে। “আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে”, “তার বিদায় বেলার মালাখানি”, “আমি কান পেতে রই” – এই তিনখানি মৌলিক রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সেই সঙ্গে পঙ্কজ কুমার মল্লিক সুরারোপিত রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ খেয়া’ কবিতাটি (দিনের শেষে ঘুমের দেশে) – এই চারটি গানের ব্যবহার বাঙালীর স্মৃতিতে আজও অম্লান।

প্রমথেশ বড়ুয়া (এবং সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক) প্রথম থেকেই বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের একটা উঁচু মান নির্ধারণ করে দেন। তাঁদের দেখানো পথ ধরেই দেবকী বসু, নীতিন বসু, বিমল রায় দের মতো তৎকালীন প্রতিভাবান তরুণ পরিচালকেরাও তাঁদের ছবিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগের পরম্পরা শুরু করেন যা অদ্যাবধি বহমান। বিগত নয় দশক ধরে অসংখ্য পরিচালক অসংখ্য চলচ্চিত্রে বিভিন্ন পরিবেশে চরিত্রদের বহুমুখী অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করে চলেছেন। এর মধ্যে সত্যজিৎ-ঋত্বিকের মতো অতি-প্রতিভাধর পরিচালকেরা যেমন আছেন, যাঁদের হাতে মূল বাণিজ্যিক ধারার বাইরে প্রকৃত শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগ চলচ্চিত্র – ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, তেমনি আছেন মূল বাণিজ্যিক ধারাতেও তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, বিজয় বসু, অজয় কর প্রমুখদের মতো বেশ কিছু শক্তিমান পরিচালক যাঁরা তাঁদের চলচ্চিত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সার্থক ও মর্মস্পশী ব্যবহার করেছেন। অবশ্য এঁদের পাশাপাশি প্রচুর সাধারণ মানের ছবিও তৈরী হয়েছে যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার সম্পূর্ণই আলংকারিক – বিশেষ কোন চিন্তাভাবনার প্রতিফলন-রহিত৷

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপক ব্যবহারের নিদর্শন হিসেবে সমতুল্য যে সৃজন ক্ষেত্রটিকে চিহ্নিত করা চলে সেটি কালানুক্রমিক বিচারে এক প্রজন্ম আগের এবং এই সৃজন ক্ষেত্রটি আর কিছুই নয় – রবীন্দ্রনাটক। এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজনীয় যে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর গান যেহেতু ‘রবিবাবুর গান’ এর গণ্ডি অতিক্রম করে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হয়ে উঠতে পারেনি, তাই তাঁর সমকালে অন্যান্য বাংলা নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার আদৌ প্রচলিত ছিল না- আর পরবর্তীকালের পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক আধুনিক বাংলা নাটকে গানের ব্যবহারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক হওয়ায় সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সহ মূল ধারার গানের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়৷ ফলে বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ ব্যাপক হলেও বাংলা নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ সীমিত থেকে যায় কেবল রবীন্দ্র নাটকেই।

গল্প -কবিতা-উপন্যাস-গান রচনার সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথ নাটক রচনাও শুরু করেন তাঁর কৈশোরেই৷ উনিশ বছর বয়সে রচনা করেন তাঁর প্রথম নাটক ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ আর তাঁর জীবনের শেষ নাটক ‘মুক্তির উপায়’- প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পূর্বে। রবীন্দ্রনাথের নাটক রচনার সূচনা গীতিনাট্যের মাধ্যমে৷ এর পর ক্রমশঃ গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কাব্যনাট্য ও গদ্যনাট্য – এই চতুর্মুখী ধারায় তাঁর নাট্য-সৃষ্টি বিকাশ লাভ করে। সব ধরনের শ্রেণীবিভাগ মিলিয়ে তাঁর মোট নাটকের সংখ্যা পঞ্চাশের কিছু বেশি। এর মধ্যে গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের প্রয়োগ সম্বন্ধে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন কেননা এদের ক্ষেত্রে গানই নাটকের প্রকাশ মাধ্যম। এর বাইরে বাবতীয় গদ্য নাটকেই রবীন্দ্রনাথ নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেছেন স্বরচিত গান। হ্যাঁ, ‘ব্যবহার করেছেন’ এই শব্দবন্ধই এক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত কেননা নাটকে ব্যবহৃত গানগুলির রচয়িতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হলেও এই গানগুলির মধ্যে খুব কম সংখ্যক গানই আছে যেগুলি নাটকে ব্যবহারের জন্যই রচিত (অর্থাৎ যেমনটি প্রত্যক্ষ করা যেত গিরিশ ঘোষের নাটকে) অধিকাং‌শ গানই তাঁর পূর্বরচিত গানের ভাণ্ডার থেকে নাটকের প্রয়োজন অনুযায়ী আহরিত৷ অর্থাৎ পরবর্তী যুগের চিত্র পরিচালকদের মতোই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ব্যবহার’ করেছেন।

বর্তমান নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় এটাই, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে তার নিজের গানের প্রয়োগ- কিংবা আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে তার প্রয়োগ- কুশলতা। রবীন্দ্রনাথ নিজে যখন তাঁর নাটকে স্বরচিত গান ব্যবহার করেছেন তখন নিজের গান বলেই কি সে প্রয়োগ সদাসর্বদা হয়েছে প্রশ্নাতীত? নাকি পরবর্তী যুগের বহুতর বাণিজ্যিক ছবির মতোই রবীন্দ্রনাথকেও অনেক ক্ষেত্রে নাটকে গান রাখতে হয়েছে নিছক অলংকরণের জন্য? অথবা, যখন সম্পূর্ণ শৈল্পিক প্রয়োজনেই নাট্যকার ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত তখনও কি সর্বদাই সেই প্রয়োগ হয়ে উঠেছে সমান ব্যঞ্জনাময়? উত্তর অনুসন্ধান করা যাক রবীন্দ্রনাট্য ভাণ্ডারে৷দে

(২)

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে একদিকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার বিষয়বস্তু আর অন্যদিকে শেক্সপিয়রের নাটকের আঙ্গিক- এই উভয় শিল্পরূপের অনুসারী রূপে সূচনা হয় বাংলা নাটকের। মূলতঃ পৌরাণিক ভক্তিরস কিংবা ঐতিহাসিক দেশপ্রেম- এই ছিল মোটামুটি তৎকালীন নাটকের বিষয়বস্তু। বলাই বাহুল্য, নাটকে গানের ব্যবহারও ছিল বিষয়বস্তুরই অনুসারী – অর্থাৎ প্রধানতঃ মনোরঞ্জন মূলক৷ এছাড়া যাত্রাপালার ‘বিবেকের গান’ এর অনুসরণে পরিস্থিতি অনুযায়ী মোটা দাগের আবেগ প্রকাশ করবার জন্যও গানের ব্যবহার হত। ‘বাংলা নাটকের শেক্সপীয়র’ খ্যাত গিরিশ ঘোষই প্রথম নাটকে গানের প্রয়োগে কিছুটা চিন্তাভাবনার প্রতিফলনের দৃষ্টান্ত রাখেন। নাটক রচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন কবি প্রতিভারও অধিকারী এবং নিজের নাটকের গানের রচয়িতা৷ নাটকের পাত্রপাত্রীর হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গানের ব্যবহারের প্রচেষ্টার তিনিই জনক। তাঁর রচিত ‘বুদ্ধ চরিত’ নাটকে নায়ক গৌতম বুদ্ধের মুখে আধ্যাত্মিক অস্থিরতার প্রকাশ-স্বরূপ “জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই” গানটি কেবলমাত্র সমকালে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবেরই নয়, আধুনিক শ্রোতাদের পর্যন্ত আবিষ্ট করে রাখে।

গিরিশ ঘোষের উত্তরসূরী হিসেবে বাংলা রঙ্গমঞ্চে যখন দ্বিজেন্দ্রলাল ক্ষীরোদপ্রসাদ প্রমুখের রাজত্ব বক্ষ্যমাণ তখন এঁদেরই সমান্তরালে, কিন্তু প্রায় নিঃশব্দে এবং দর্শক সাধারণের আগোচরে আবির্ভাব নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের৷ সমসাময়িক নাটক আর রবীন্দ্রনাথের নাটকের মূল পার্থক্য ছিল রবীন্দ্রনাটকের অন্তর্মুখিতায়। প্রচলিত নাট্য-কাহিনির প্রতিতুলনায রবীন্দ্রনাটকে ‘ঘটনার ঘনঘটা’, অর্থাৎ Actions এর স্থান অতি নগণ্য। চরিত্রদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত যা কিছু সবই আদর্শগত বা জীবন-বোধ সঞ্জাত এবং মূলতঃ মনোজাগতিক। রবীন্দ্র নাটক তাই প্রধানতঃ অন্তর্মুখী। বাহ্যিক ঘটনাবলীর স্থান সেখানে প্রধানতঃ পটভূমি রচনার – যে পটভূমিকায় নাটকের চরিত্রগুলির মনোজগতের বিশ্লেষণ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বই নাটকের উপজীব্য।

বলাই বাহুল্য, এই ধরণের তথাকথিত ‘ধীরগতি’ এবং ‘ঘটনাবিরল’ নাটকসমূহের সাধারণ দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা থাকার কথা নয় – ছিলও না। রবীন্দ্র-নাটক তাই কোন দিনই ব্যবসা-সফল নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর নাটকের এই গুণগত স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং সেই কারণেই নিজের নাটকের বাণিজ্যিক প্রচারের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়মিত অভিনীত হত বিশেষভাবে শিক্ষিত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের দ্বারা শুধু শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে, কখনো-সখনো কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে সূক্ষ্ম রচির, পরিশীলিত দর্শকমণ্ডলীর সামনে অথবা কালে ভদ্রে কলকাতায় পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে বাণিজ্যিক ভাবে৷ প্রসঙ্গতঃ বলা চলে, এ-হেন বৈশিষ্ট্যের জন্যই পরবর্তী যুগের রবীন্দ্র সমালোচকরা মোটামুটি একমত যে রবীন্দ্র- নাটকসমূহ সাহিত্য মূল্যে যতখানি উজ্বল নাট্যমূল্যে সম্ভবতঃ ততখানি নয়৷ সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি নিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে যতখানি আলোচনা হয় নাট্য ক্ষেত্রে তার একাংশও হয় না – মঞ্চায়ন ও অভিনয় তো আরো বিরল৷ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাম্প্রতিক কালে ভারতের অগ্রণী নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাড রবীন্দ্রনাথের নাটকের এই ‘নাট্যমূল্য’ সম্বন্ধে কিছু তির্যক ও নেতিবাচক মন্তব্য করে এই বিতর্ককে পুন:প্ররোচিত করেছেন এবং সেই সঙ্গে বহু রবীন্দ্র প্রেমীর বিরাগভাজন হয়েছেন।

সমকালীন নাটকের তুলনায় এই বিশিষ্টতার কারণে রবীন্দ্র- নাটকে গানের প্রয়োগও অবশ্যম্ভাবীরূপে ভিন্ন মাত্রার৷ নিছক মনোরঞ্জনের স্তর থেকে উর্দ্ধে উঠে তাঁর নাটকে গানের প্রয়োজন হয় কাহিনির অন্তঃপুরে এবং চরিত্রদের মনোজগতে প্রবেশ করার। গানের দিক থেকে এই প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা সমকালে একজনেরই ছিল- তিনি গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে তাই তাঁর নাটকে প্রয়োগের জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছিল গীতিকবি রবীন্দ্রনাথেরই গানের স্বর্ণ ভাণ্ডারে যা নাটকে গানের প্রয়োগকে এক ভিন্ন মাত্রায় উপনীত করে৷

(৩)

বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের নিরিখে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়- গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কাব্যনাট্য, ঋতুনাট্য, ইতিহাস ভিত্তিক নাটক, রূপক, সামাজিক, প্রহসন। এদের মধ্যে গানের ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম তিনটি পর্যায়কে আলোচনায় অন্তর্ভূক্তির কোন প্রয়োজন নেই। কেননা গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য সম্পূর্ণই সঙ্গীত নির্ভর- গানই সেখানে সংলাপের প্রকাশ মাধ্যম। তাই পৃথকভাবে গানের প্রয়োগের প্রশ্ন গীতি বা নৃত্যনাট্যে অবান্তর। কাব্যনাট্যে অধিকাংশ সংলাপ পদ্য ছন্দে- অর্থাৎ প্রধান পাত্রপাত্রীর যাবতীয় সংলাপই পদ্যে রচিত কেবল কিছু পার্শ্বচরিত্রের সংলাপ গদ্যে। এই ধরনের নাটকেও তাই গানের কোন ভূমিকা নেই। বাকী নাটকের মধ্যে ঋতুনাট্য শ্রেণীতে দুটি ধারা বর্তমান৷ এক ধরনের নাটক সম্পূর্ণতঃই ঋতুবন্দনা ধরনের, যেমন “বসন্ত”, “নবীন”, “শ্রাবণ গাথা” বা “শেষ বর্ষণ”৷ কবি ও রবীন্দ্র গবেষক শঙ্খ ঘোষ এই ধরণের নাট্যকল্পগুলিকে বর্ণনা করেছেন “পালানাট্য” রূপে৷ গদ্য সংলাপের সঙ্গে ব্যবহৃত গানগুলি অবধারিতভাবেই রবীন্দ্রনাথের ঐ বিশেষ ঋতুপর্যায় থেকেই গৃহীত৷ উদ্দেশ্য একই ঋতুর বিভিন্ন মেজাজ বা moods কে উপস্থাপিত করা। এই ধরণের পালানাট্যও তাই আমাদের আলোচনা- ক্ষেত্রের বর্হির্ভূত৷ অন্যদিকে “শারদোৎসব” বা “ফাল্গুনী”র মতো নাটকগুলিতে দেখা যায় ঋতুপ্রকৃতির ভূমিকা শুধু পটভূমিকা রচনার৷ শরৎ বা বসন্ত ঋতুতে আকাশ, বাতাস, মাঠ, নদী, বৃক্ষলতাময় বহিঃপ্রকৃতি কিভাবে নাটকের চরিত্রাবলীর মানসিকতা বা চিন্তাধারার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে তাই এইসব নাটকের উপজীব্য।এই ধরণের নাটকে গানের ভূমিকা তাই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর বাইরে আধুনিক গদ্য সংলাপে রচিত রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় ঐতিহাসিক, রূপক, সামাজিক ও প্রহসন নাটকগুলির প্রতিটিতেই নাট্যকার স্বরচিত গানের ব্যবহার করেছেন যা আমাদের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত৷ প্রয়োগ- প্রাসঙ্গিকতা বিচার প্রতিটি নাটকের প্রতিটি গান ধরে ধরে করা হয়নি। বরং যে সমস্ত গানের প্রয়োগে পাওয়া যার নাট্যকারের গভীরতর চিন্তনের প্রকাশ- সেগুলিকেই আলোচনায় দৃষ্টিগোচর করবার প্রচেষ্টা হয়েছে।

(৪)

রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে কাব্যনাট্য গুলি বাদ দিলে যে তালিকাটি থাকে তা হল (প্রকাশের কালানুক্রমে) “মুকুট”,”প্রায়শ্চিত্ত”,”নটীরপূজা”,”চণ্ডালিকা,”পরিত্রাণ”। এরমধ্যে “মুকুট” নাটকটিতে কোন গানের ব্যবহার নেই৷ বাকি নাটকগুলিতে গানের ব্যবহার পর্যালোচনা করা যেতে পারে৷

“প্রায়শ্চিত্ত” ও “পরিত্রাণ”- উভয়েই রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সে রচিত উপন্যাস “বৌঠাকুরাণীর হাট” এর পরিণত বয়সের নাট্যরূপ। প্রথমে রচিত হয় “প্রায়শ্চিত্ত”- রবীন্দ্রনাথের আটচল্লিশ বছর বয়সে৷ এর কুড়ি বছর পর রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি পুনরায় পরিমার্জনা করেন এবং পুনর্লিখিত নাটকটি “পরিত্রাণ” নামে অভিনীত ও প্রকাশিত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্যকে রবীন্দ্রনাথ কৈশোরকাল থেকেই অত্যাচারী শাসকের প্রতিরূপ হিসেবে কল্পনা করে এসেছেন। পরিণত বয়সে উপনীত হয়েও সেই বদ্ধ সংস্কার তাঁর যায়নি৷ “প্রায়শ্চিত্ত” আর “পরিত্রাণ”- উভয় নাটকেই প্রতাপাদিত্য উপস্থিত স্বৈরাচারী শাসক রূপে৷ কিন্তু “পরিত্রাণ” নাটকে – যা রবীন্দ্রনাথের অধিকতর পরিণত বয়সের রচনা- প্রতাপাদিত্যের অত্যাচারী ও প্রজাশোষক রূপটি আরো ব্যাপকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। মনে হয় ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে “পূর্ণ স্বরাজ” দাবীর পর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি রচনা করেন। ধনঞ্জয় বৈরাগী উভয় নাটকেই উপস্থিত অত্যাচারিত প্রজাদের মুখপাত্র হিসেবে। শুধু প্রজাসাধারণই নয়- দর্পিত প্রতাপাদিত্যের স্বেচ্ছাচার ও আত্মম্ভরিতার শিকার তার নিকটাত্মীয়রা, অর্থাৎ পুত্র-কন্যা উদয়াদিত্য-বিভা কিংবা খুল্লতাত বসন্ত রায়- এদের সবার সঙ্গেই ধনঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠতা। এদের সবার মনের কথাই রূপ পেয়েছে তার গানে। “প্রায়শ্চিত্ত”/”পরিত্রাণ” এর অধিকাংশ গানই রয়েছে ধনঞ্জয় বৈরাগীর মুখে। এইসব গানের মধ্যে প্রত্যাশিত ভাবেই রয়েছে করেকটি অতিপরিচিত স্বদেশগীতি- “রইল বলে রাখবে কারে” কিংবা “তোর শিকল আমায় বিকল করবে না।” বেশ কয়েকটি গান যেগুলি বাহ্যতঃ স্বদেশ প্রেমের গান না হলেও সেখানে আঘাত সহ্য করবার কিংবা বাঁধনের অসারতার কথা বলা হয়েছে, যেমন “আমাকে যে বাঁধবে ধরে”, ” আরো প্রভু আরো আরো”- এই সব গানগুলির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কখনো অত্যাচারী রাজার মুখের ওপর প্রতিবাদ-স্বরূপ আবার কখনো প্রজাদের উজ্জীবনের উদ্দেশ্যে ধনঞ্জয়ের বক্তব্য সংলাপের পরিবর্তে সুরের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে বলা চলে। অতিরিক্ত কোন ব্যঞ্জনা বা চরিত্রের মনের কোন না- বলা গভীর ভাব এসব গান ব্যক্ত করে না। কিন্তু বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ বলে “ওস্তাদের মার শেষ রাতে।” রবীন্দ্রনাথও এই দুটি নাটকে গানের শ্রেষ্ঠ প্রয়োগ দুটি সংরক্ষিত রেখেছিলেন নাটকের পরিসমাপ্তির জন্য। প্রথম গানটি “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ” – আসক্তিহীন, ঘরছাড়া বৈরাগীর সম্পূর্ণ জীবন দর্শন যেন ধৃত গানটির মধ্যে৷ বিভার “বৈরাগীঠাকুর, তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবে?” প্রশ্নের উত্তরে ধনঞ্জয়ের সংলাপ, “কোথায় যাব সে কথা আমার মনেই থাকে না। ঐ রাস্তাই আমার মজিয়েছে। এই মাটি দেখলে আমাকে মাটি করে দেয়”, এরসঙ্গে এই গান পাঠক/দর্শকদের বাধ্য করায় বহুল পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতটিকে এক নতুন চোখে দেখতে৷ এরপর একেবারে সমাপ্তিতে ধনঞ্জয়ের মুখে “আমি ফিরবো না রে ফিরবো না আর” – প্রয়োগ-ব্যঞ্জনায় অব্যর্থ৷ ধনঞ্জয়ের কণ্ঠের গানই যেন সমাপ্তিতে একই সঙ্গে তিন ঘরছাড়া- ধনঞ্জয়, উদয়াদিত্য আর বিভা- তিনজনেরই অন্তরের মর্মকথা হয়ে ফুটে ওঠে। একজন পথের টানে ঘরছাড়া, একজন স্বৈরাচারী পিতার রাজপ্রাসাদের বিলাস-বৈভবের বাঁধন ত্যাগ করে ঘরছাড়া আর অন্যজন ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের বন্ধন ছিন্ন করে ঘরছাড়া। কাহিনির শেষে এই তিন ঘরছাড়ার নতুন পথে যাত্রার ইঙ্গিতের ব্যঞ্জনাবাহী গানটির মাধ্যমে নাটকের যবনিকাপতন৷

“পরিত্রাণ” নাটকে ধনঞ্জয়ের গানগুলি ছাডাও আরো বহু গান ছিল- বসন্তরায়ের কন্ঠে, রামচন্দ্রের নটীদের কণ্ঠে। এর মধ্যে নটীদের গানগুলি নিয়ে বলার কিছুই নেই। প্রতিটি গানই বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় কিন্তু ব্যবহারের মধ্যে নিছক দর্শকের মনোরঞ্জন কিংবা নাটকের দৈর্ঘ্যবিস্তার ছাড়া অন্য কোন তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বসন্তরায়ের কণ্ঠের গানগুলি প্রয়োগে তেমন ব্যঞ্জনাময় না হলেও বসন্ত রায়ের চরিত্রের সরল, ছেলেমানুষীর দিকটি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে৷ বিশেষ করে নাতনি বিভার সামনে এসে গাওয়া “আজ তোমারে দেখতে এলেম” গানটি দর্শক মনে এক ধরণের চিত্তস্নিগ্ধকর আবেশ আনে৷

“নটীর পূজা” নাটকটি খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মগধ রাজ্যে রাজা অজাতশত্রু আর গৌতম বুদ্ধের সময়কালে সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মের দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে রচনা৷ ১৯০০ সালে রচিত “কথা” কাব্যগ্রন্থের “পূজারিণী” কবিতার ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সে দেওয়া নাট্যরূপ৷ বিষয়বস্তুর ভাবগাম্ভীর্য এবং গুরুত্বের কারণে এই নাটকে নিছক মনোরঞ্জন বা হালকা অনুভৃতি প্রকাশের প্রয়োজনে কোন গান প্রয়োগের অবকাশ নাট্যকার রাখেন নি। গানগুলি সবই শ্রীমতীর মুখে এবং প্রায় প্রতিটি গানই শ্রীমতীর আধ্যাত্মিক দর্শন বা মানসিকতার প্রকাশে ভাস্বর। তবে এর মধ্যে প্রয়োগ ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তিনটি গান- নিশীথে কি কয়ে গেল মনে”, “আর রেখো না আঁধারে আমার” আর অবশ্যই নাটকের চূড়ান্ত পরিণতিতে “আমায় ক্ষম হে ক্ষম।”

নাটক বা চলচ্চিত্রে গানের প্রয়োগ সবচেযে তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে তখনই, যখন গানের মধ্য দিয়ে এমন কিছু ব্যক্ত হয়, যা এযাবৎ বলা হয়নি, কাহিনির আসন্ন গতিপথের কিছু ঈঙ্গিত কিংবা সংশ্লিষ্ট চরিত্রের এমন কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ করা সংলাপের মাধ্যমে যার সম্যক প্রকাশ আদৌ সম্ভব নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে পূর্বোক্ত তিনটি গানই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ৷ নাটকের শুরুতে ভীক্ষু উপালির আগমন এবং শ্রীমতীকে জানিয়ে দেওয়া যে,”তোমার সেই দিন এসেছে, আমি জানিয়ে গেলুম৷ তুমি ভাগ্যবতী৷” শুরতেই নাট্যকার এই দৃশ্যের মাধ্যমে যে নাট্য-কৌতুহল তৈরি করেন তাই যেন গভীরতর ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয় শ্রীমতীর গানে। নাটকের শেষের অব্যশ্যম্ভাবী ভবিতব্যের জন্য শ্রীমতী যেমন কোন অনির্দেশ্যের প্রেরণায় ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে- দর্শক ও তেমনি ইঙ্গিত পায় কোন এক বিশেষ পরিণতির৷

“আর রেখোনা আঁধারে আমায়”- শ্রীমতীর এই গানটির পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে বৌদ্ধ দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা৷ আসন্ন বিপদের ভয়ে ভীত মালতীর উক্তি, “বিপদের ভয় না। কিছুই যে বুঝতে পারছিনা, অন্ধকার ঠেকছে, তাই ভয়” এর উত্তরে “আপনাকে এই বাইরে দেখিস নে। আজ যাঁর অক্ষয় জন্ম, তার মধ্যে আপনাকে দেখ- তোর ভয় ঘুচে যাবে” এই আশ্বাস বাণীর সঙ্গেই শ্রীমতী গেয়ে ওঠে “আর রেখোনা আঁধারে আমায় দেখতে দাও”৷ শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব এই গানখানিকে চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ “দুঃখের গান” হিসেবে। এই গানে “চিরজীবন শূন্য খোঁজা”র উল্লেখে তিনি পেয়েছিলেন “মর্মঘাতী হতাশা”র বহিঃপ্রকাশ। আমাদের মনে হয় আইয়ুব যদি গানটিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার না করে “নটীর পূজা” নাটকে প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতায় এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে বিচার করতেন তবে তাঁর সিদ্ধান্ত হয়তো ভিন্নতর হত। মহাযানবাদী মাধ্যমিক বৌদ্ধদর্শনের আলোকে বিচার করলে এই গানে যে সদর্থক মনোভাব ও প্রাণময়তা পাওয়া যায় তা গানের শুরুতে মালতীকে দেওয়া শ্রীমতীর আশ্বাসবাণীকেই সমর্থন করে।

যে “শূন্য খোঁজা” নিয়ে আইয়ুবের সংশয় বৌদ্ধ দর্শনে সেই “শূন্যবাদ” কিন্তু আদৌ কোনো অনিশ্চয়তা বা তথাকথিত “শূন্যতা” বোধক নয়৷ মাধ্যমিক বৌদ্ধদর্শনের মতে “শূন্য” অর্থ “বর্ণনাতীত”৷ পরম সত্ত্বা বা পরম ব্রহ্ম বর্ণনাতীত- এ হিন্দু দর্শনেরও মূল কথা৷ বেদান্তেরও মতে ঈশ্বর “অবাঙমানসগোচর”- বাক্য ও মনের অতীত। সদ্, অসদ্, সদসদ্ এবং সদসদ্ ভিন্ন- এই চারটি সম্ভাবনার কোনটিতেই পরম সত্ত্বাকে ধরা যায় না, তাই তিনি “শূন্য” (চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত শূন্যমেব)। অর্থাৎ বৌদ্ধ দর্শনের সংজ্ঞা অনুযায়ী “শূন্য” পরম সত্ত্বারই দ্যোতক- ভক্ত ও সাধকের চিরন্তন সাধনার লক্ষ্যস্থল।

এই ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে গানটিকে হতাশা ব্যঞ্জক মনে হবার কোন কারণ নেই। বরং ‘আপন বলে ভুলানো’ কালোছায়ার স্বপ্নভার থেকে মুক্ত হবার একমাত্র পথ যে পূর্বে বর্ণিত “শূন্য খোঁজা,” একথাই গানের মধ্যে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রীমতীও তো মালতীকে সেই আশ্বাসই দেয়- “তার মধ্যে আপনাকে দেখ- তোর ভয় ঘুচে যাবে।”

“নটীর পূজা”য় সবচেয়ে নাটকীয় প্রয়োগ সন্দেহাতীতভাবেই এর শেষ গানটি – শ্রীমতীর মুখে “আমার ক্ষমো হে ক্ষমো।” অবশ্যম্ভাবী অত্যাসন্ন আত্মাহূতির ভূমিকা হিসেবে নৃত্যগীত, ভক্তি আর শ্রীমতীর হৃদয়ের আর্তির পরম একাত্মতা সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে এই গানটিতে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে ‘নটীর পূজা” চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এমনকি স্বয়ং অভিনয়ও করেন।

ঘটনার কালানুযায়ী “চণ্ডালিকা”ও “নটীর পূজার”ই প্রায় সমসাময়িক – অর্থাৎ পঞ্চম বা ষষ্ঠ খৃষ্টপূর্বাব্দ। কাহিনির উৎসও এক- অর্থাৎ প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য। তবে “নটীর পূজা”র অধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে এই নাটকের প্রধান উপজীব্য প্রেম৷ নিজের প্রেমের অনুভূতির পথ বেয়ে নায়িকা প্রকৃতির পূর্ণতার পথে যাত্রার কাহিনি চণ্ডালিকা। বিষয়ের মহত্ব ও গাম্ভীর্য প্রতিফলিত হয়েছে প্রকৃতির মুখের প্রতিটি গানের নির্বাচনেও৷ “ফুল বলে ধন্য আমি” কিংবা “আমি তোমারই মাটির কন্যা”- “চণ্ডালিকা”র বিষয়বস্তুর সঙ্গে দারুণভাবে একাত্ম এবং চণ্ডাল-কন্যা প্রকৃতির অন্তরের নিবেদন হিসেবে চিরস্মরণীর হয়ে আছে। অন্যান্য গানের মধ্যে “চক্ষে আমার তৃষ্ণা” গানটির প্রয়োগ যথেষ্ট কাব্যময়৷ বাঞ্ছিত পুরুষের বিরহযন্ত্রণায় কাতর প্রকৃতির অন্তরের মিলন তৃষ্ণা বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিনে পৃথিবীর তৃষ্ণাকাতরতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। “হদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু” গানটির প্রয়োগও বেশ চমকপ্রদ। প্রকৃতির সংলাপ “আসুক সে চলে। আগুনের পথ মাড়িয়ে মাড়িয়ে। আমি মনের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি সামনে প্রলয়ের রাত্রি, মিলনের ঝড়, ভাঙনের আনন্দ”- তার পরেই এই গান। বর্ষার পরিচিত এই গানটিও পূর্বতন গানটির মতোই নায়িকার অন্তরের ভাবকে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে – গানটিতে আনে নতুন তাৎপর্য৷ নাটকের অন্যান্য গানগুলির মধ্যে প্রকৃতির মুখে “ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে” কিংবা “ডাকব না, ডাকব না”, কিংবা “আমি তারেই জানি” প্রকৃতির মনের ভাব গানের মধ্য দিয়ে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করে- যদিও এ গানগুলিতে অতিরিক্ত প্রয়োগ ব্যঞ্জনা তেমন নেই৷ তবু তারই মধ্যে “ডাকব না ডাকব না” গানটির প্রয়োগ আবেগঘন ও হৃদয়স্পর্শী৷ নাটকের শেষে “পথের শেষ কোথায়” গানটির প্রয়োগ যথেষ্ট তর্কসাপেক্ষ৷ এই গভীর দার্শনিক উপলব্ধির গানটিকে শুধুমাত্র প্রকৃতির হৃদয়ের অনুতপ্ত বিক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করতে গেলে এই গানের ব্যঞ্জনাকে বহুল পরিমাণে সংক্ষিপ্ত করে নিতে হয়। ‘চণ্ডালিকা’ নাটকে এই গানটির প্রয়োগের মূল্যায়নে আবু সয়ীদ আইয়ুবের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে আমরা শতভাগ একমত। সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথ নিজেও পরবর্তীকালে গানটির প্রয়োগ- সার্থকতা সম্বন্ধে সন্দিহান হন। এবং নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা থেকে গানটি বিযুক্ত হয়।

(৫)

পূর্বে উল্লেখিত পালানাট্যগুলি বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নির্ভর ঋতুনাট্যের তালিকায় আসবে “ফাল্গুনী”, “শারদোৎসব” ও “ঋণশোধ৷” এর মধ্যে “ফাল্গুনী” নাটকে গানের পরিমাণ এতই বেশি যে ব্যবহারিক প্রয়োজনে একে আমরা গীতিনাট্যরূপেই অভিহিত করতে পারি। এই বিপুল সংখ্যক গানের মধ্যে সংলাপ রূপে ব্যবহৃত গান আর গভীরতর ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত গানের পৃথকীকরণ দুঃসাধ্য কাজ, তাই এই নাটকটি বর্তমান আলোচনার বাইরে রাখাই সঙ্গত৷

‘ঋণশোধ'(১৯২১) রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব (১৯০০)’ নাটকেরই পরিমার্জিত ও পুনর্লিখিত রূপ৷ শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের জন্য শারদোৎসব উপলক্ষে রচিত নাটকটির মূল বক্তব্য- ঋণ শোধ। ক্ষুদ্র বৈষয়িক ঋণ থেকে শুরু করে শরতের অমল মহিমার প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির কাছে মানুষের যে চিরন্তন সৌন্দর্যের ঋণ সেই সব ঋণশোধই এই নাটকের চরিত্রগুলির চালিকাশক্তি। শরতের মাঠ, ঘাট, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, ঝরে পড়া শিউলি ফুলের রাশি এই নাটকের পটভূমি রচনা করে। তাই শরৎ পর্যাযের বেশ কিছু পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত এই নাটকে পরিবেশ রচনার সহায়তা করে। কিন্তু এর বাইরে মূল বক্তব্যকে উপস্থাপিত করতে যে গানগুলির প্রয়োগ হয়েছে সেগুলিই আলোচনার যোগ্য। কবি শেখরের মুখে ব্যবহৃত এই গানগুলির মধ্যে “দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া” গানটিকে এই নাটকের বিভব-গীতি বলা যেতে পারে। অন্য গানগুলির মধ্যে “কেন যে মন ভোলে”, ” আমারে ডাক দিল কে” আর “আমি তারেই খুঁজে বেড়াই”- প্রতিটি গানই নাটকের মূল বক্তব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং উপযুক্ত স্থানে প্রযুক্ত।

(৬)

রূপকনাট্য বা তত্ত্বনাট্য (প্রমথনাথ বিশীর সংজ্ঞা অনুযায়ী) গুলির মধ্যে যে নাটকগুলি গানের প্রয়োগের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য সেগুলি হল ‘অচলায়তন’, ‘রাজা’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘তপতী’৷ ‘তাসের দেশ’ নাটকটিকে রূপক নাট্য শ্রেণীভুক্ত করলেও এর আগে ‘ফাল্গুনী’ নাটকটি সম্বন্ধে যে আলোচনা করা হয়েছে তা ‘তাসের দেশ’ সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। এই নাটকেও বহুক্ষেত্রে গানই সংলাপ রূপ ব্যবহৃত হয়েছে। সেই অর্থে এটিও প্রকারান্তরে গীতিনাট্যই বলা চলে (বস্তুতঃ সেই ষাটের দশকে গুণী শিল্পীদের কন্ঠদানে সমৃদ্ধ HMV র রেকর্ডটি প্রকাশিত হবার পর থেকে অনেকেই ‘তাসের দেশ’কে শ্যামা-চিত্রাঙ্গদা- চণ্ডালিকার পাশাপাশি গীতিনাট্য হিসেবেই গণ্য করেন)।

‘অচলায়তন’ নাটকটি সূচিতই হয় পঞ্চকের মুখের গান দিয়ে- “তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে”। এই গানটি যেন শুরুতেই সম্পূর্ণ নাটকটির সুর বেঁধে দেওয়া গান। নাটকটির বক্তব্যই তো কোন সুদূর থেকে অশ্রুত কার আহ্বানে অচলায়তনের অসারত্ব উপলব্ধি করা এবং শেষ পর্যন্ত অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে ফেলা। কিন্তু শুরুতেই সে ডাক একমাত্র পঞ্চক ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না। পরে অবশ্য আচার্যদেবও পান। অচলায়তনের বন্দীশালার মধ্যে পঞ্চকের “দূরে কোথার দূরে দূরে” গানটিও পঞ্চককে বুঝতে সাহায্য করে। তবে নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে পঞ্চকের মুখে “সকল জনম ধরে ও মোর দরদীয়া” গানটি কিন্তু খুব সুপ্রযুক্ত বলা চলে না। গানটিতে ঈশ্বর প্রেমের যে একান্ত ব্যক্তিগত ও অন্তর্মুখী প্রকাশ আছে সেই ব্যঞ্জনা নাটকের ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। একই কথা প্রযোজ্য দর্ভকদের মাদলের সঙ্গত ও নৃত্য সহকারে “উতল ধারা বাদল ঝরে” গানটির মাধ্যমে ঈশ্বরের আবাহনের ক্ষেত্রেও৷ এই রোমান্টিক গানটি, কবি রবীন্দ্রনাথ যেটিকে যথার্থ ভাবেই প্রেমের গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং আমরাও যাকে মনে প্রাণে প্রেমের গান হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসি, সেটিকে ঈশ্বর প্রেমের গান হিসেবে প্রয়োগ করা চলে না এমন নয়- আমরা জানি, রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রেম ও পূজার সীমারেখা বহু ক্ষেত্রেই অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং বহু গানই উভয় ক্ষেত্রে সুন্দরভাবে প্রযোজ্য৷ কিন্তু সেই প্রয়োগ তো একান্ত ব্যক্তিগত হৃদয়ানুভূতির স্তরে। মাদল বাজিয়ে সমবেত নৃত্যের সঙ্গে গানটির প্রয়োগে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের চিন্তার নূতনত্ব প্রকাশ পায় ঠিকই, কিন্তু গানটি সার্থকতা পায় না। অবশ্য মূল গানটির সঙ্গে দুটি অতিরিক্ত স্তবক জুড়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ গানটিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চেযেছেন- কিন্তু সেই শেষ দুটি স্তবক বাকি গানটির সঙ্গে কতটা একাত্ম হয়ে উঠতে পেরেছে তা তর্কযোগ্য৷

তবে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় প্রযুক্ত হয়েছে বালক দলের মুখে “আলো আমার আলো” গানটি। আলোর উল্লেখ রবীন্দ্রনাথের বহু গানেই পাওয়া যায়- “আলোয় আলোকময় করে হে”, “আলো যে যায় রে দেখা” কিংবা “আলোকের এই ঝর্ণাধারায়” কিন্তু এই সব গানেই আলোর উল্লেখ প্রতীকী – জ্ঞান বা বোধির প্রতীক হিসেবে। কিন্তু এই গানটিতে আলো যেন বালক দলের খেলার সামগ্রী- উপভোগের বস্তু! আলোর স্রোতে সেখানে পাল তোলে প্রজাপতিরা, মেতে ওঠে মল্লিকা-মালতীরা, পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়ে শুধু হাসি আর পুলকের রাশি। নাটকে আছে একটি নিষিদ্ধ জানলা খুলে বাইরের দৃশ্য দেখে ফেলার ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ একটি বালককে অন্ধকার কক্ষে বন্দী করে বাধ্য করা হয় ‘মহাতামস ব্রত’ পালন করতে। সেই অন্যায় ব্রতের পটভূমিকায় বাকী বালকদলের কণ্ঠে এই গানটি অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময়৷
‘অচলায়তন’ রচনার ছ’বছর পর রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বালকদের দ্বারা “সহজে অভিনয়যোগ্য করিবার অভিপ্রায়ে” এই নাটকটির একটি “লঘুতর”, কিশোরপযোগী সংস্করণ রচনা করেন – নামকরণ করেন ‘গুরু’। এই নাটকটির সমাপ্তিতে ব্যবহৃত হয়েছে “ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়” গানটি। অন্তর্নিহিত ভাবের অপূর্ব মেলবন্ধনের কারণে গানটির প্রয়োগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য- গানটির রচনাকাল ১৩২১- অর্থাৎ ‘অচলায়তন’ রচনার তিন বছর পর। ফলস্বরূপ- এই অসাধারণ প্রয়োগ দৃষ্টান্তের সাক্ষী রইল শুধু কিশোর- উপযোগী সংস্করণটিই- অধিক প্ৰচলিত মূল নাটকটি বঞ্চিত রইল একটি সঙ্গীতময়, ব্যঞ্জনাবাহী পরিসমাপ্তি থেকে।

‘মুক্তধারা’ নাটকটির কাহিনি ভিন্ন হলেও বক্তব্যের দিক দিয়ে অনেকাংশেই ‘পরিত্রাণ’ নাটকের সঙ্গে তুলনীয়। সেই স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী রাজা এবং শোষিত প্রজাকুল, সেই রাজার স্বেচ্ছাচারীত্বের শিকার তার নিকটাত্মীয়- সবই এক। এমন কি গায়ক চরিত্রটিও দুটি নাটকেই সাধারণ- ধনঞ্জয় বৈরাগী৷ তার মুখের গানগুলিও অনেকগুলিই উভয় নাটকে সাধারণ৷ ধনঞ্জয়ের মুখে কয়েকটি অতিরিক্ত গান এই নাটকে পাওয়া যায় বটে, যেমন “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব” কিংবা “ভুলে যাই থেকে থেকে” – ব্যবহারের দিক থেকে গানগুলি কিন্তু একই ধরনের বক্তব্যবাহী এবং তাই নতুন কোন মাত্রা যোগ করেনা। পাঠক বা দর্শকের মনে হয, গানগুলি অনায়াসে পরিত্রাণ নাটকেও ব্যবহার হতে পারত! বরং সমবেত কণ্ঠে যন্ত্র ও যন্ত্ররাজ বিভূতির বন্দনা কল্পে ব্যবহৃত “নমো যন্ত্র নমো যন্ত্র” গানটি প্রাসঙ্গিকতা ও শব্দচয়নের জন্য আকর্ষণীয৷

‘রাজা’ নাটক বাইরের দেখা আর অন্তরের দেখার মধ্যে দ্বন্দ্বের নাটক। বাইরের দেখা বলতে মানুষের বহিরঙ্গ রূপ শুধু নয়, তাকে বহির্জগতের পটভূমিকায়, সর্বসাধারণের মধ্যে দেখাও এই নাটকের উপজীব্য। রাণী সুদর্শনা রাজাকে এই ‘সবার মধ্যে’ দেখতে চেয়েছিল। এই দেখার অসম্পূর্ণতা এবং এর বিপরীতে অন্তরের মধ্যে নিজের প্রাণের মানুষকে দেখার প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন স্বয়ং রাজা এবং সেই সঙ্গে রাণীর সহচরী তথা রাজার অনুগত দাসী সুরঙ্গমা৷ রাজা কিংবা সুরঙ্গমার গানগুলিও তাই এই অন্তর-বাহিরের দ্বন্দের কথাই নানাভাবে ব্যক্ত করে। “বাহিরে ভুল হানবে যখন” কিংবা “কোথা বাইরে দূরে যায়রে উড়ে” গানগুলি এই ভাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং প্রয়োগ- তাৎপর্যে উজ্বল৷ রাজার মুখে “আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না” গানটিও তাৎপর্যবাহী৷ এই অন্তর-বাহিরের দ্বন্দের সমান্তরালে আছে প্রকৃত ‘রাজা’র তাৎপর্য অনুসন্ধান। ‘রাজা’র বিভ্রম সৃষ্টিকারী কৈতবদের উপস্থিতির সমান্তরালে ঠাকুরদাদা নিয়ত ব্যাখ্যা করে চলেন প্রকৃত রাজার লক্ষণ৷ এখানেও সেই ভিতর-বাহিরের দ্বন্দ। প্রকৃত রাজা এই সব প্রতারকদের মতো প্রকাশ্যে রথের চাকায় ধুলি উড়িয়ে জয়ধ্বজা উর্দ্ধে তুলে আসেন না। তাঁর স্থান সবার অন্তরে। “আমরা সবাই রাজা,” “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,” “বসন্ত কি শুধুই ফোটা ফুলের মেলা,” “তোরা যে যা বলিস ভাই”- ঠাকুরদাদা আর তার দলবলের মুখে এই গানগুলিও নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ এর পাশাপাশি বসন্তোৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বেশ কিছু বসন্ত পর্যায়ের পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত- যেগুলির ভূমিকা শুধু উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।

রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক চর্চিত নাটক সম্ভবতঃ ‘রক্তকরবী’৷ মুক্তধারায় যার অনুক্রম মাত্র ঘটেছিল সেই যন্ত্র সভ্যতা ও কৃষিজীবী সভ্যতার চিরন্তন দ্বন্দ্ব এই নাটকের বিষয়বস্তু৷ আধুনিক নাট্যশিল্পী, সমালোচক, পাঠক- সবার কাছেই তাই এই নাটক অন্যান্য রবীন্দ্র নাটকের তুলনায় অধিক প্রিয়। রূপকধর্মী এই নাটকটিতে প্রতিটি চরিত্রই যেন প্রতীকী৷ রাজা- যান্ত্রিকতা ও যন্ত্রসভ্যতার প্রতিভূ৷ নন্দিনী যেন যক্ষপুরীতে মুক্ত আলো, হাওয়া, প্রাণোচ্ছলতার প্রতীক। বিশু চিরন্তন কবি ও ব্যর্থ প্রেমিক সত্তার প্রতীক। রক্তকরবীতে গানের সংখ্যা রবীন্দ্রনাথের এযাবৎ লিখিত অন্যান্য নাটকের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু প্রয়োগ ব্যঞ্জনার বিচারে অনেক ওপরে। গানের প্রয়োগের দিক থেকে এই নাটকে যেন আমরা অনেক পরিণত ও চিন্তাশীল রবীন্দ্রনাথকে পাই। অন্যান্য নাটকে গানের প্রয়োগের সঙ্গে এই নাটকের গানের মূল পার্থক্য এখানেই যে অন্যান্য নাটকে যেখানে বহু ক্ষেত্রেই গানের ব্যবহার হয়েছে সংলাপের সম্প্রসারক বা পরিপূরক হিসেবে, সেখানে এই নাটকের অধিকাংশ গানই নায়কের না-বলা কথার প্রতিরূপ – যে কথা মুখের ভাষায় সাধারণ সংলাপে ব্যক্ত করা যায়না, গানই যার একমাত্র নির্বিকল্প প্রকাশ মাধ্যম৷ গানগুলি সবই বিশুর মুখে৷ কেবল একটি মাত্র গান(ভালোবাসি, ভালোবাসি) নন্দিনীর। রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্যতম কিছু প্রেমের গান এই নাটকে প্রযুক্ত হয়েছে বিশু পাগলের মনের গভীরতম ভাবের প্রকাশ হিসেবে। নন্দিনীর উক্তি “পাগল ভাই, এই বদ্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে৷ বাকী আর সব বোজা” র উত্তরে বিশু বলে “সেই আকাশটা আছে বলেই তোমাকে গান শোনাতে পারি” আর তারপরেই গেয়ে ওঠে,”তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ”। গানের “দুখ জাগানিয়া” বিশেষণটিও বিশু ব্যাখ্যা করে- “তুমি আমার সমুদ্রের অগমপারের দূতী৷ যেদিন এলে যক্ষপুরীতে, আমার হৃদয়ে লোনা জলের হাওয়ায় এসে ধাক্কা দিলে”। প্রয়োগের এই গীতিময়তাই এই নাটকে গানের ব্যবহারে স্বতন্ত্রতা এনেছে। বিশুর অন্য গানগুলোর মধ্যে “তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে”- চন্দ্রা ও ফাগুলালকে দেওয়া মদ্যপানের কাব্যিক ব্যাখ্যা হিসেবে অসাধারণ৷ চন্দ্রার কাছে নন্দিনীকে নিয়ে তার ভাবাবেগ সে প্রকাশ করে “মোর স্বপনতরীর কে তুই নেয়ে”৷ মুখের কথায় যে আবেগের প্রকাশ অবাস্তব।

তবে বিশুর মুখে সবচেয়ে অমোঘ, ব্যঞ্জনাময় এবং প্রাসঙ্গিকতায় অদ্বিতীয় গানটি আমরা শুনি, যখন নন্দিনী বিশুকে রঞ্জনের কথা, তার তোলপাড় করা খেলার কথা বলতে বলতে শেষে বলে, “একদিন তুমিও ও তো তার (সেই খেলার) মধ্যে ছিলে, কিন্তু কি মনে করে বাজী খেলার ভীড় থেকে একলা বেরিয়ে গেলে ….. তারপর কতকাল খোঁজ পাইনি। কোথায তুমি গেলে বল তো?” এর জবাবে, কোন রকম সংলাপ ছাড়া বিশু গেয়ে ওঠে “ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে”৷ রবীন্দ্রনাট্যে ব্যবহৃত যাবতীয় গানের মধ্যে প্রয়োগ ব্যঞ্জনায় নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ গান তো বটেই, সাহস করে বলতে পারি অদ্যাবধি যাবতীয় চলচ্চিত্র- নাটকে যেখানে যত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছে প্রয়োগ ব্যঞ্জনায় তাদের কোনটিই এই গানের ধারে কাছে আসতে পারেনি। কোথায হারিয়ে গিয়েছিল বিশু? কোথার হারিয়ে যায় কবি ও ব্যর্থ প্রেমিকরা? হারজিতের যে সাহসী, ভয়ংকর খেলায় রঞ্জন জয় করে নিয়েছিল নন্দিনীকে, সেই খেলা তো বিশুর জন্য নয়। কারণ কবি ও প্রেমিকরা কখনও সফল মানুষদের দলে পড়ে না। সফল পথিকরা ঘাটের কিনারাতে ভীড় করে, তারপর জীবনের পসরা নিয়ে যে যার মতো পেরিয়ে যায় অন্যঘাটে। কবি পড়ে থাকে একলা৷ দিশাহারা রাতে তার তরী চেনা কূল থেকে বাঁধন খুলে নিয়তির হাওয়ার টানে ভেসে যায় কোন অচেনার ধারে৷ কবিতা আর প্রেমই তাকে কোনদিন স্থিত হতে দেয় না। তাই চিরকাল হারিয়ে যাওয়াই তার নিয়তি।

‘তপতী’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনে রচিত কাব্যনাটক ‘রাজা ও রাণী’ র পরিণত বয়সের সম্পূর্ণ পরিমার্জিত ও পুনর্লিখিত গদ্য নাট্যরূপ – যা রাজনৈতিক বক্তব্যে আরো দৃঢ় ও পরিণত। পরিণতি-র মত তপতী-ও ১৯২৯ এ লাহোর ঘোষণার পর স্বাধীনতা আন্দোলনের জ্বলন্ত সময়ের প্রেরণার ফসল। নাটক শুরু হয় “সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ” গানটি দিয়ে। শান্তিদেব ঘোষের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, লাহোর জেলে অনশনে স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন দাসের মৃত্যুতে সদ্য রচিত এই গানটি নাট্যকার অভিনয়ের পূর্বে বক্তব্যের সাযুজ্যের কারণে নাটকের সূচনায় জুড়ে দেন।

তপতী-ও এমন একটি নাটক যেখানে হতাশভাবে আমরা বেশ কিছু গভীর রোমান্টিক গানের অ-যথাযথ প্রয়োগজনিত অপমৃত্যু প্রত্যক্ষ করি৷ বিপাশার মুখে “মন যে বলে চিনি চিনি” এবং “দিনের পরে দিন যে গেল”- দুটি গভীর অনুভবের রোমান্টিক প্রেমের গানেরই প্রয়োগ অত্যন্ত অগভীর বলে মনে হয়। প্রথম গানটির প্রয়োগে একদিকে যেমন গানটির অনুভূতির গভীরতা ব্যর্থ হয অন্যদিকে নরেশ-বিপাশার যে গুরুগম্ভীর সংলাপের অংশ হিসেবে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে সেই বিষয় গাম্ভীর্যও অনেকাংশে লঘু হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় গানটি প্রেমের বিরহানুভূতির এক আশ্চর্য ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ৷ কিন্তু নাটকে জনপ্রিয়, ভাবী দেশনায়কের উদ্দেশ্যে যখন গানটি নিবেদিত হয় তখন গানটি এবং গানটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য- উভয়েই সমানভাবে ব্যর্থ হয়৷ “পায়ের ধ্বনি গণি গণি রাতের তারা জাগে / উত্তরীয়ের হাওয়া এসে ফুলের বনে লাগে / ফাগুন বেলার বুকের মাঝে / পথ চাওয়া সুর কেঁদে বাজে / প্রাণের কথা ভাষা হারায় চোখের জলে ঝরে” এর মতো বিরহ-বিধুর, অসামান্য রোমান্টিক পংক্তি গুলি কিভাবে কোন দেশনেতার প্রতি নিবেদিত হতে পারে এই প্রশ্ন কি আদৌ নাট্যকারের মনে জাগেনি? নাকি শুধু প্রথম লাইন দুটির মায়ায় পড়েই তিনি গানটি এখানে অকাতরে ব্যবহার করলেন? গানটির মধ্য দিয়ে বলতে চাওয়া একই বক্তব্য নিয়েই তো অব্যবহিত পরেই বিপাশার মুখে আমরা শুনি “তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ কর”- বক্তব্যের বিচারে যার যথার্থতা নিঃসন্দেহ। দেখে শুনে সেই পুরনো প্রশ্নই আবার ঘুরে ফিরে আসে – নাট্যকার এবং গীতি কবি সত্যিই কি দুজনে একই ব্যক্তি? কে জানে!

 

(৭)

রবীন্দ্রনাথের প্রহসন ও সামাজিক নাটকগুলিতে বিষয়বস্তুগত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত মোটামুটি সব নাটকেরই এক- তা হল সমকালীন মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ৷ এই দুই ধরনের নাটকেই তাই পাত্রপাত্রীদের প্রায় একই ধরণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায়। এছাড়া সমকালীনতাও এই নাটকগুলিকে এক ধরণের স্বভাবগত বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এই দুই গোত্রের সব নাটকই রবীন্দ্রনাথের পরিণত বা অতি পরিণত বয়সের রচনা হওয়ায় সংলাপের ভাষায় তীক্ষ্ণতা ও বুদ্ধির দীপ্তির প্রকাশেও সব নাটকে এক ধরনের সাযুজ্য দৃষ্টিগোচর হয়।

গানের ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই পর্যায়ের আলোচ্য নাটকগুলি হল ‘গৃহপ্রবেশ,, ‘চিরকুমার সভা,’ ‘শোধবোধ,’ ‘বাঁশরি,’ ‘শেষরক্ষা৷’ এগুলি ছাডা অন্য যে দু-একটি সামাজিক নাটক বাকি থাকে সেগুলিতে গানের ব্যবহার নেই অথবা থাকলেও নগণ্য৷ এই তালিকায় ‘চিরকুমার সভা’ আর ‘শেষরক্ষা’ হল প্রহসন- বাকীগুলি সামাজিক নাটক।

প্রহসনের মূল কথা হাস্যরস। কিন্তু রবীন্দ্র প্রহসনের বৈশিষ্ট্য হল সেই হাস্যরসের বুদ্ধিদীপ্ততা। হাস্যরস বলতে সেই যুগে(এমনকি এযুগেও) ‘হাসি’র সঙ্গে যে একাত্মতা কল্পনা করা হয় রবীন্দ্রনাথের হাস্যরস তার থেকে শতহস্ত দূরে। কোন ভাঁড়ামি নয়, স্থুল হাস্যোদ্রেককারী মুদ্রাদোষের প্রয়োগ নেই, বাহ্যিক বা আরোপিত রসিকতার মাধ্যমেও দর্শক বা পাঠককে হাসানোর প্রচেষ্টা নেই। নাটকের সরসতা সম্পূর্ণভাবে নিহিত কাহিনির ঘটনাবলীর মধ্যে৷ এর সঙ্গে রয়েছে শানিত ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ – হাস্যরসের উৎস রয়েছে সেখানেও৷ অর্থাৎ সব মিলিয়ে রাবীন্দ্রিক প্রহসনের যে হাস্যরস তা শিক্ষিত ও পরিশীলিত সাহিত্য পাঠক বা দর্শকের উপভোগ্য – আপামর জনসধারণের জন্য আদৌ নয়।

রবীন্দ্র-প্রহসনের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্য এই ধরণের নাটকে গানের ব্যবহারও ঠিক প্রচলিত অর্থে প্রহসন ধর্মী নয়৷ তাঁর প্রহসন গুলিতেও তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখি আমাদের পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই প্রয়োগ- যার বেশির ভাগই প্রেম পর্যায়ের গান। “চিরকুমার সভা” নাটকে অক্ষয়ের মুখে কিছু গান পাই যেগুলি আকারে ক্ষুদ্রকায়, দু চার পংক্তির বেশি নয়, কাহিনির দাবী অনুযায়ী অক্ষয়ের তাৎক্ষণিক রচনা এবং সুরের চলনে ঠুংরী, টপ্পা ধরণের বৈঠকী আমেজ। ঠাট্টার মেজাজে গাওয়া এই সরস গানগুলি পরিস্থিতি অনুযায়ী সুপ্রযুক্ত হওয়ায় নাটকের মেজাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে৷ বস্তুতঃ, কাহিনিতে অক্ষয়ের মতোই স্বয়ং নাট্যকারও এই গানগুলি তাঁর পূর্বে রচিত গীতিভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করার পরিবর্তে নাটকের প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবেই রচনা করেছেন। তাই পরিস্থিতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা এই গানগুলি পাঠক বা দর্শককে আজও আনন্দ দান করে। “স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে”, “কতকাল রবে”, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কি”, “পাছে চেয়ে বসে আমার মন”- সারা নাটক জুড়ে ছড়িয়ে আছে এমন বেশ কিছু টুকরো-গান। অক্ষয়ের মুখে দুটি পূর্ণদৈর্ঘের প্রচলিত রবীন্দ্রসঙ্গীতও ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে “মন মন্দির সুন্দরী”- স্ত্রীর মান ভাঙানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এবং “না না গো না কোরো না ভাবনা”- শ্যালিকার সঙ্গে রহস্যালাপে৷ দুটি গানই প্রার্থিত সরসতা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে৷ তবে এই নাটকে নীরবালার মুখের কয়েকটি গান শুধুমাত্রই দর্শক মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত৷ “যেতে দাও গেল যারা” কিংবা “জ্বলেনি আলো অন্ধকারে”র মতো গভীর অনুভবের গানগুলির পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগের কোন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষতঃ “জ্বলেনি আলো অন্ধকারে”র মতো একটি চাপা-বিষাদঘন প্রেমের গানের ব্যবহার তো সম্পূর্ণই অপচয় বলা যেতে পারে৷ “কে যাবি পারে” গানটি অবশ্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং পরিস্হিতির প্রতি সুবিচার করেছে বলা চলে। নীরবালার গানের পাশাপাশি নাট্যকার শ্রীশের মনের ভাব ব্যক্ত করবার জন্য দুটি পরিচিত গানকে কবিতা- রূপে ব্যবহার করেছেন। “নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া” এবং “ওরে সাবধানী পথিক” – দুটি গানই সংশ্লিষ্ট চরিত্রের হৃদয়ানুভূতি ব্যক্ত কল্পে সুপ্রযুক্ত বলা চলে৷

‘চিরকুমার সভা’র মতোই ‘শেষরক্ষা’ও বিবাহঘটিত সমস্যা এবং তার নিরসন নিয়ে রচিত প্রহসন৷ এই নাটকেও হালকা মেজাজে কতগুলি পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী “ওরে যায়না কি জানা” গানটির প্রয়োগ উপভোগ্য৷ অন্যান্য গানগুলি “যাবার বেলা শেষ কথাটি” কিংবা “কাছে যবে ছিল” খুব অর্থপূর্ণ প্রয়োগ না হলেও অপপ্রয়োগের দোষে দোষী করা যাবে না। তবে পরিসমাপ্তিতে “ওগো তোমরা সবাই ভালো” অবশ্যই মধুরেণ সমাপয়েৎ হিসেবে আনন্দদায়ক৷

সামাজিক নাটকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে তথাকথিত ‘ধীরগতি’র নাটক সম্ভবতঃ ‘গৃহপ্রবেশ’ আর সেই কারণেই এই নাটকে গানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ৷ রোগশয্যায় শায়িত মৃত্যুপথযাত্রী যতীন আর তার বোন হিমি নাটকের প্রধান পাত্র-পাত্রী৷ যতীনের স্বপ্ন-কল্পনাময় জগতই নাটকের উপজীব্য, আর এই জগৎ মূর্ত হয়ে উঠেছে হিমির গানে গানে। যতীনের অনুরোধে হিমির একের পর এক গেয়ে চলা গানে ব্যক্ত হয় যতীনেরই মনের কথা। “খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি”, “বাজো রে বাঁশরি বাজো,” “যদি হল যাবার ক্ষণ,” “অগ্নিশিখা এস এস,” “যৌবন সরসীনীরে,” “আমার মন চেয়ে রয়” – প্রতিটি গানেই মূর্ত হয়েছে যতীনের স্বপ্নজগৎ – যে জগতে কখনো সে একা, কখনো তার সঙ্গিনী তার নববিবাহিতা পত্নী- বাস্তবে যে নারী স্বামীর প্রতি প্রেমহীন এবং কঠিন অসুখে যতীনকে অবলীলায় পরিত্যাগ করে পিত্রালয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চলে যায়। যতীনের বিভিন্ন সময়ের ভাবনার জগৎকে গানগুলির মাধ্যমে সার্থক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ গানের প্রয়োগের দিক থেকে এই নাটকটি অন্যান্য রবীন্দ্রনাট্যের তুলনায় অভিনব এই কারণেই যে এখানে যেহেতু বাহ্যিকভাবে গল্পের কোনো গতি নেই – কাহিনির যা কিছু গতি তা শুধু যতীনের স্বপ্নের পথ বেয়েই, তাই গল্প এখানে বাহিত হয় প্রধানতঃ গানগুলির স্রোত:পথেই৷ যতীনের মুখে একটি মাত্র গান “মন যখন জাগলি নারে” – গল্পের শেষে তার স্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিতবাহী গানটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ৷ নাটকের শেষে হিমির মুখে “জীবন মরণের সীমানা ছাডাযে” গানটি পাঠক ও দর্শককে বাধ্য করে আসন্ন শোকের সামনে শ্রদ্ধায় নত হতে৷

‘শোধবোধ’ নাটকটিতে গানের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তবু প্রয়োগের দিক থেকে গানগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকের তিনটি গানই নায়িকা নলিনীর মুখে৷ এর মধ্যে প্রথম গানটির প্রযোগ যথেষ্ট ব্যঞ্জনাময় – “সে আমার গোপন কথা”। বিশাল ধনী মিঃ নন্দী তার পাণিপ্রার্থী, কিন্তু নলিনী মনে মনে ভালোবাসে কর্মহীন, সাধারণ ঘরের ছেলে সতীশকে৷ বিলাস – বৈভবের মধ্যে মানুষ হয়েও তার রুচি, তার স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎ ভিন্ন ধরণের৷ নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সে মিঃ নন্দীর নয়, সতীশেরই পথ চেয়ে থাকে৷ তার রুচি ও স্বপ্নের এই ভিন্নতার ঈঙ্গিত নাট্যকার নাটকের গোড়াতেই দিয়ে দেন যখন নলিনী বন্ধুর উদ্দেশে গেয়ে ওঠে “…. প্রাণ আমার বাঁশি শোনে নীল গগনে / গান হয়ে যায় নিজের মনে যাহাই বকি”৷ বাকী দুটি গান “বেদনায ভরে গিয়েছে পেয়ালা” এবং “উজাড় করে লও হে আমার সকল সম্বল” সতীশের অনুরোধে নলিনী গেয়ে শোনায়৷ গানদুটিও তাই নলিনী গাইলেও সতীশেরই মনের কথা বলে। অর্থাৎ গৃহপ্রবেশ নাটকে নাট্যকার গানের প্রয়োগে যে নাট্য কৌশল অবলম্বন করেছেন এখানেও সেই একই পথ অবলম্বিত হয়েছে। সতীশের মানসিকতা গান দুটিতে সুন্দরভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।

‘বাঁশরি’ রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রচনা এবং একান্ত ভাবেই মনোবৈজ্ঞানিক৷ ক্ষিতীশ- বাঁশরি- সোমশংকর- সুষমা ও সন্ন্যাসী পুরন্দর- এই পাঁচটি চরিত্রের জটিল প্রেম-সম্পর্ক, মানসিক টানা-পোড়েন এবং তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এই নাটকের উপজীব্য। নাটকে স্বল্প কয়েকটি গান ব্যবহার হয়েছে কিন্তু গল্পের গতিপথ বা চরিত্রদের মানসিকতা নিরূপণে তাদের বিশেষ ভূমিকা নেই। নাটকের শেষে সুষমা চরিত্রের ট্র্যাজেডিই পাঠক বা দর্শকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। সুষমা মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল পুরন্দর সন্ন্যাসীকে৷ কিন্তু পুরন্দর তাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে সোমশংকরের হাতে সমর্পণ করে চলে যান। সুষমার এই ট্র্যাজেডি মূর্ত হয়েছে “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়” গানটিতে৷ অন্য গানগুলির মধ্যে সোমশংকরের মুখে “ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা” পাঠক / দর্শক মনে তেমন কোন সাড়া জাগায় না কারণ পুরন্দর সন্ন্যাসী ঠিক কি ধরণের আদর্শের বন্ধনে সুষমা ও সোমশংকরকে বাঁধতে চেয়েছেন তা নাটকে আদৌ পরিষ্কার হয় না। একই কারণে তেমন তাৎপর্য পায়না সমাপ্তিতে “পিনাকেতে লাগে টঙ্কার” গানটিও।

 

(৮)

ওপরের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হিসেবে বলা যেতে পারে- প্রয়োগ-তাৎপর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্র-নাটকে গানের ব্যবহারকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে-

১) সংলাপাতীত ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ ব্যবহার
২) সংলাপের অঙ্গ বা সম্প্রসারক হিসেবে ব্যবহার
৩) পরিস্থিতির সঙ্গে আংশিক বা ঈষৎ সম্পর্কিত কিন্তু কাহিনির সামগ্রিক গতির পরিপ্রেক্ষিতে দর্শকের কাছে উপভোগ্য ব্যবহার
(প্রহসনের অধিকাংশ গানের ব্যবহার এই শ্রেণীর)
৪) গভীর অনুভূতি বা জীবন বোধ সম্পন্ন গানের পরিস্থিতি অনুসারে অতি-সরলীকৃত তাৎপর্যে ব্যবহার এবং
৫) জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তাৎপর্যহীন, নিছক মনোরঞ্জক ব্যবহার।

বলাই বাহুল্য- রবীন্দ্র নাটকে গানের প্রয়োগ নিয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আদৌ এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়- নাট্যকারকে বলপূর্বক পরীক্ষার্থীর আসনে অবনমিত করে তাঁর একেকটি নাটকের ‘উত্তরপত্র’ ধরে ধরে নম্বর প্রদানের ধৃষ্টতার তো প্রশ্নই ওঠে না। নাটকের সামগ্রিক সাফল্যমণ্ডন যে কোনো নাট্যকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য- রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন। গানকেও তিনি সেই বৃহত্তর লক্ষ্যেই ব্যবহার করেছেন। আমাদের প্ৰচলিত ধারণা যে রবীন্দ্রনাথ নাট্যকার হিসেবে ছিলেন নিরঙ্কুশ ও আপোষহীন- জনপ্রমোদের দায়ভারহীন। সাধারণ দর্শক তাই তাঁর নাটককে গ্রহণ করেনি। কিন্তু বস্তুতঃ দর্শকের মনোরঞ্জনের চিন্তাও যে তাঁকে ভাবিত করত গগনেন্দ্রনাথকে ‘ফাল্গুনী’ নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে লেখা চিঠিতে তার আভাস পাওয়া যায়- “চেষ্টা করছি আমাদের শিশু গাইয়ের দল বাড়িয়ে তুলতে…চোখ এবং কান দুয়েরই একেবারে পেট ভরিয়ে তুলতে হবে…বুঝিয়ে দেওয়ার চেয়ে মজিয়ে দেওয়াটাই দরকার…।” এই “চোখ এবং কান দুয়েরই পেট ভরিয়ে তোলা” এবং “মজিয়ে দেওয়ার” ভাবনা থেকেই তো বহু নাটকে এসেছে গানের পর গান- যা সন্দেহাতীত ভাবেই এক সচেতন প্রয়াসের ফসল। ওপরের আলোচনার উদ্দেশ্যও তাই তাঁর নাটকে গানের ব্যবহারের ত্রুটি অনুসন্ধান নয়- বরং ব্যবহারের পূর্বোল্লিখিত বিস্তৃত বর্ণালীটির প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণের একটি প্রয়াস মাত্র। এই সঙ্গে একথাও উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আসন্ন সম্মুখ সময়ের জনপ্রিয়তম হতে চলা শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রে তাঁর নিজের গান ব্যবহারের একটি পথনির্দেশিকা রেখে যেতে পেরেছেন যা প্রমথেশ বড়ুযা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের পরিচালকেরা পর্যন্ত বিগত নয় দশক ধরে অনুসরণ করে চলেছেন।

তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকার:

১। রবীন্দ্র রচনাবলী – পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত – ৫ম ও ৬ঠ খন্ড।

২। পান্থজনের সখা – আবু সয়ীদ আইয়ুব- দে’জ পাবলিশিং।

৩। কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক – শঙ্খ ঘোষ – রত্নাবলী।

৪। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা- শান্তিদেব ঘোষ- আনন্দ পাবলিশার্স।

৫। রবীন্দ্র সঙ্গীতের নানাদিক- বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়- মিত্রালয়।

৬। রবীন্দ্র নাট্য প্রবাহ- প্রমথ নাথ বিশী- মিত্রালয়।

৭। বাংলা নাটকের ইতিহাস-অজিতকুমার ঘোষ- জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাব

জন্ম, চেতনার উন্মীলন, শৈশব, কৈশোর, ও যৌবনের অতিবাহন - সব কিছু কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮তে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলে (Electrical Engineering) স্নাতক। বর্তমানে কর্মসূত্রে গুরগাঁও, হরিয়ানা নিবাসী। পেশাগত জীবনের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন বলতে স্ত্রী ও এক কন্যা সহ পারিবারিক দিনযাপন আর গান-কবিতা-সাহিত্য সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক নিজস্ব সময় যাপন। অবসর সময়ে সামান্য লেখালেখি - কিছু কবিতা এবং কিছু প্রবন্ধ। প্রবন্ধের প্রিয় বিষয় বাংলা গান এবং গীতিকবিতা। কবিতা ও প্রবন্ধের প্রকাশ মূলতঃ বিভাব, প্রমা, মিলেমিশে, একুশ শতকের মতো ছোটো পত্রিকা আর সানন্দার মতো বাণিজ্যিক পত্রিকায়।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Pavel Akhtar , October 29, 2022 @ 3:59 am

    খুব ভাল লেখা । রবীন্দ্র-নাটকের গভীর অধ্যয়ন ও খনন থেকে সুলিখিত প্ৰবন্ধ । প্রাক-শঙ্খ ঘোষ পর্বের প্রখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘পথের শেষ কোথায়’ প্রভৃতি উচ্চাঙ্গের মননশীল গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর ভাষ্যেরও পর্যালোচনা করেছেন লেখক দক্ষতার সঙ্গে । প্রসঙ্গত জানাই, শঙ্খ ঘোষের ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ বইটি উল্লেখযোগ্য । রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রেক্ষিতে দেখলে প্ৰবন্ধটিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চুলচেরা বিশ্লেষণ যথাযথ । যদিও নাট্যবহির্ভূত প্রেক্ষিত থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীরতা, অন্তর্লীন আবেদন ও গীতিমূল্য যে মূল বিচার্য তা অনস্বীকার্য । এমন একটি প্ৰবন্ধ পড়তে পেরে আমি আনন্দিত । ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *