‘ফুল যদি ভালোবাস…’
কোমো ভ্রমণের বাসনার বীজটি এসেছিল একটি গারডেনিং ম্যাগাজিনের পাতা থেকে। জানুয়ারি মাস। এ সময়ে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় বরফ না পড়লেও বাগানে বিশেষ কিছু করা যায় না। হিম যা পড়ে রাতে তাতে গাছের মাথায় ঘোমটা পরিয়ে রাখতে হয়। এমন সময়ে কেবল স্বপ্ন দেখা – বাগানের প্ল্যানিং, রঙিন দিনের একটু উষ্ণতার জন্য অপেক্ষা।
ক্যাটালগ কোম্পানিগুলো বনমালীদের মনের এ দুর্বলতার সুযোগ নিতে ছাড়ে না। চমৎকার রঙিন ছবি দিয়ে উসকে দেয় স্বপ্ন দেখার খেয়াল। এমনই এক বইতে একটি ছবি দেখি। হ্রদের ছবি – চারদিকে পাহাড় ঘেরা। ছোটোবেলায় দেখা নৈনিতালের মত। কিন্তু ঠিক তাও নয়। এখানে বাড়িগুলো আলাদা, ফুলগুলো আলাদা। বিদেশি গাছ আর ফুলের সাজে কত রকম রঙ। লেকটির নাম কোমো। ছবির ওপর ক্যাপশান – ‘ফুল যদি ভালবাস, একবার এস’ – কোন ট্র্যাভেল কোম্পানির বিজ্ঞাপন, আর কী?
সেই ইচ্ছার বীজ একদিন মুখ তুলে চাইল। ২০০৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বাবাকে হারিয়েছি। মনমরা মেজাজ। এমন সময়ে এপ্রিল মাসের শেষে সুযোগ এল ইতালি যাবার।
“কোমো!” আমি লাফিয়ে উঠি! রোম না, ভেনিস না, শুধু কোমো। মনের কোনে ড্যাফোডিল, টিউলিপ, নীলমনি লতা ঘেরা সেই জলাশয়ের ছবিটি ঝিলিক দিয়ে গেল।
মিলান থেকে ট্রেন বদল করে আমরা কোমো স্টেশনে নামলাম। ছোটো স্টেশন, ওই তো জল দেখা যাচ্ছে। শুনলাম হোটেলটি জলাশয়ের গা বরাবর। হোটেলের মালিক, মারিয়ো, টেলিফোনে জানাল, “হেঁটেই আসা যায়, তবে চেনার সুবিধার জন্য আই সাজেস্ত এ ট্যাক্সি।”
ইটালিয়ান ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে সসম্মানে একটি বাও করে ট্যাক্সির পিছনের দরজাটি খুলে ধরল, “সিনোরা!”
অমিত, আমার স্বামী, পাশে বসতে গেলে সে মাথা নাড়ে সজোরে, “ন সিনর, সোলো লেই।” (মানে ইংরেজিতে – Just she)। দৌড়ে গিয়ে সে সামনের দরজাটি খুলে আবার একটি নাটকীয় বাও। গলায় একটি মিহি সুর ভাঁজতে ভাঁজতে দু’মিনিটের মধ্যেই আমাদের হোটেলের সামনে পৌঁছে দিল।
এই হোটেলটি আমাদের ভ্রমণ তালিকায় সবচেয়ে সস্তার আস্তানা। একটি ইয়ুথ হোস্টেল বিশেষ। ঘরটি ছোটো। বিছানা বলতে দুটি বাঙ্ক বেড, ট্রেনের মত। বাথরুম বাইরে। কিন্তু “এ রুম উইথ এ ভিউ।” আলতো হাসে মারিয়ো, চাবি খুলতে খুলতে ঘাড় ঘুরিয়ে, ছোট্ট একটি উইঙ্ক।
সত্যি, এক চিলতে জালনার ফ্রেমে ধরা যে ছবিটি, তার তুলনা নেই। তখন রাত প্রায় আটটা। একটু আগে সূর্যদেব অস্ত গেছেন। কিন্তু তা বোঝার উপায় নেই। নেই কোনো রঙের খেলা। ধূসর ধূপছায়ায় ঢাকা সব। কুয়াশার পর্দায় আবছা জাপানি জলছবি যেন। এ আবার আরেক রূপ। কিন্তু এ ছবি আমি ভাবিনি।
হাত মুখ ধুয়ে নিতে মেয়েদের বাথরুমে ঢুকে দেখি, মহিলারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন উদোম গায়ে। এই মরেছে! আমার কিংকর্তব্য আনাড়ি মুখ দেখে এক বিদেশিনী মুচকি হেসে আমাকে দেখিয়ে দিলেন একটি পর্দা ঘেরা আব্রু। সাওয়ার কার্টেনটি সজোরে টেনে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
হস্টেলটির অদূরে একটি খাবার স্টল চোখে পড়ল। রেস্তোরাঁগুলো ঝাঁপি বন্ধ করতে ব্যস্ত। স্ন্যাক বারে দেখি, আমাদের কাটলেটের মত একটা জিনিস সবাই খুব কিনছে। আমরাও তুলে নিলাম তাই। বিদেশি নাম শোনা মাত্র ভুলে গেলাম। খাবারের স্বাদ অনেকটা আমাদের মাংসের চপের মত, ভাত আর কিমার মণ্ড – তাতে প্রচুর টম্যাটো সস মাখা। অরিগানো আর ইতালিয়ান তুলসী পাতার গন্ধে ম ম। এই খেয়েই বেশ পেট ভরে গেল; বিখ্যাত ইতালিয়ান পেস্ট্রির শেল্ফ আজ ফাঁকা।
পরদিন সকালে মারিয়োকে জিজ্ঞাসা করি, “একদিন মাত্র থাকার মেয়াদ, কী দেখা যায় বল তো?” অনেকগুলি ব্রোসিয়োর খুলে মেলে ধরল সে আমাদের সামনে। অনেকগুলি আইডিয়া।
“নৌকো করে লেকের চারপাশ ঘুরে বেড়াতে পার। দুটো অপূর্ব চার্চ আছে। ব্যাসিলিকা অব স্যানফেদেল, আর বিখ্যাত কোমো ক্যাথিড্রাল। এছাড়া ভোল্টা মিউজিয়াম, আর টাউন সেন্টার বেলাজ্জিও… সেখানে তো নিশ্চয় যাবে। আর ভালো কথা, ভিলা মেলজ্জি – মিস কোরো না কোনো মতেই।”
জানতে পেলাম কোমো নাকি বিখ্যাত সিল্ক শিল্পের জন্য। অনেক অনেক দিন আগে মিলানের ডিউকের মাথায় একটা দারুণ আইডিয়া আসে। এই লেকের ধার বরাবর লাগিয়ে দেন অনেক অনেক মালবেরী গাছ, যেখানে সিল্ক পোকাগুলো বেড়ে উঠতে থাকে। তারপর তা দিয়ে এমন যত্নের সঙ্গে যা তৈরি করল এরা তা হল পৃথিবীর সেরা। ১৯৭০ এর দশকে এদের উৎপাদন আর চাহিদা চিন জাপানের সিল্ককে হার মানিয়ে দিয়েছিল। এই সঙ্গে কোমো শহরে অনেক লোকও এল কাজের খোঁজে। দারুণ রমরমা অবস্থা। এ সব কথার ইতিহাস আছে তাদের মিউজিয়ামে। আজ যদিও ট্যুরিজম শিল্পটাই কোমোর বিশেষ আকর্ষণ।
সিল্ক মিউজিয়মে যাই না যাই, একটা কোমো সিলকের স্কার্ফ তো নিতেই হয় সুভেনির হিসেবে। আমার মাথাটা তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম করতে লাগল। এদিকে সময় এত কম! অবশেষে বলি, “আমি শুধু জলের ধারে যেতে চাই। জলের মধ্যেও না। মাটি আমার মা। আমি এখানে শুধু ফুল দেখতে চাই।”
মারিয়ো কি বুঝল কে জানে, কারণ বাঙলা ওর বোঝার কথা নয়, কিন্তু কলবল করে বলে উঠল, “ফ্লাওয়ারস, নো, নট টুডে।” টবের ড্যাফোডিল টিউলিপগুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “দেখছ না, রোদ না উঠলে কেউ মুখ তুলবে না। এইতো দু’সপ্তাহের মধ্যে দেখবে চারদিক রঙে ভরে যাবে। রায়ট অব রুজ।”
শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশেরও মুখ ভার। হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্টুরেন্টের কাছে এসে পড়েছি। এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে দুড়দাড় করে ঢুকল। টিপিকাল টিনেজার। তাপ্পিমারা ব্লু জিন্স, এই শীতেও স্প্যাগেটি স্ট্র্যাপ ক্যামিসোল, মুখে বাবলগাম। শুধু বুলি অন্য ভাষার। আমি ওদের রুচিতে ভরসা রাখি। এদের খাবার নিশ্চয় ভাল হবে।
হঠাৎ দেখি বেশ রোদ উঠেছে। লেকটি যে এখন কী সুন্দর লাগছে দেখতে – জলের ওপর রোদ্দুর যেন রূপোলি শাড়ির আঁচলে ঢেউয়ের ঝিলিক তুলেছে। একটি দুটি নৌকো ভাসছে পাল তুলে। অল্প দূরে নীলচে পাহাড়ের পাড় আর তার কোল ঘিরে ঘন সবুজ গাছের সারি। খুব কাছে একটি বাদামি পথ, কাঁকড় বিছানো, এঁকে বেঁকে লেকটি ঘিরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
আমার ইচ্ছে হল এই পথ ধরে হাঁটি। এমন দিনে ঘরের ভিতরে থাকতে মন চায়না। সাদা এপ্রন পরা একটি লোক সুপ্রভাত জানায় – “বন জুরনো সিনোরা।” সে আমাদের রেস্তোরাঁর ভিতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। বলি, “আউট সাইড?” বাইরে একটি গোল টেবিলে চেয়ার টেনে বসি। ওপরের ছাতাগুলি বন্ধ। এখন বাইরে কেউ বসেনা। কিন্তু লোকটি গালে আঙুল ঠেকিয়ে কী ভাবল, “আল রে।”
নাটকীয় ভঙ্গীতে দুটি হাত খেলিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল, যেন আমায় বসতে মানা করছে। একটি সাদা সাটিনের কভার এনে দ্রুত টেবিলটিতে পরিয়ে দিল। দুপাশে মাথা নেড়ে শিস দিতে দিতে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এল একটা দামাস্কের দামী রঙিন চাদর নিয়ে। সাদা সাটিনের ওপর পেতে দুহাত দিয়ে মসৃণ করে দিল। আমি বসতে যাচ্ছিলাম।
“আস পে তারে, আস পে তারে।” ধীরে বলল। যা বুঝলাম তা ওর হাতের ভঙ্গীতে। ইতালিয়ানরা আঙুল দিয়ে কথা বলে, হাত দিয়ে কথা বলে। বুঝলাম, সে আমাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলছে। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন পর্যবেক্ষণ করল, আবার কী আনতে গেল। কাঁচের ফুলদানিতে দুটি টুকটুকে লাল গোলাপ ফুল ঠিক টেবিলের মাঝখানে রেখে দু’হাত উল্টে, নিজের বুকের কাছে এনে আমায় ডাকল। চেয়ারটি যেন সিংহাসন এমন একটা ভাব তার হাতের ভাষায়।
“এক্কো, সিনরা।” ম্যাজিশিয়ানের মত একটি বাও। এবার সে খুশি। আর আমার ইতালিয়ান চরিত্রের প্রথম পাঠ শেখা হল। এরা সুন্দরের পূজারী জাত, দান্তে, মিকালেঞ্জেলো, ভিভালদি, এদের বুনিয়াদ গড়ে গেছেন।
আগের দিন রাতের পেস্ট্রি না খাবার দুঃখ আজ সকালের অপূর্ব চকোলেট ক্রয়াসঁ আর কান্নোলিতে মিলিয়ে গেল। ‘কান্নোলি’ ব্যাপারটা নতুন। খেতে অনেকটা আমাদের ক্রিম রোলের মত। ওপরে চিনি মাখা। আমরা যে ছোট্ট কাপে বেজায় তেতো কাপুচিনোতে খুশি নই, চাই এক মগ কফি, তাইতে ও মুচকি হাসে, কিন্তু মগ ভরিয়ে দিল উপচীয়মান সদ্য উথলে ওঠা দুধের ফেনায়।
সেই বাদামি নুড়ির পথ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি তা হ্রদটিকে ঘিরে এগিয়ে গিয়েছে। কোথাও পাথুরে দেওয়ালে নীলমণি লতার গুল্ম, কোথাও রডোডেনড্রনগুচ্ছের আবীর। কে বলে টিউলিপরা সব মুখ গুঁজে থাকবে? ঐ তো এক রাশ ফুটে আছে পথের ধারে, পাথরের ফাঁক দিয়ে মুখ তুলে। একটা শালিক গোছের পাখি আমার সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে আবার ফিরে তাকায় আমি আসছি কিনা দেখতে। একজন বয়স্ক মহিলা পাশ কাটিয়ে যাবার সময়ে এক ঝিলিক হেসে বলে গেলেন, “মইনা।”
আরে তাইতো! এতো আমার দেশের পাখি – ময়না।
ময়নাটি আমাকে ঝাঁক ঝাঁক হলদে ড্যাফোডিলের বুনো জংগল পেরিয়ে নিয়ে এল যেখানে, তার ওপরে দেখি লেখা – Monumento Alla Resistenzo Europa. (A place to not forget the past of Europe.)। অমিত অল্প দূরে দাঁড়িয়ে গেট খুলছে। ও আগেই আমাকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটা একটি সেমিটারি বিশেষ। বুনোফুলে ঢাকা এপিটাফ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের শরীর মাটির তলায়। তাদের শেষ কথা লিপিবদ্ধ পাথরের ফলকগুলির গায়ে। পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তারই দু’একটি নমুনা দিই:
“That a people may live, it is necessary that some must die (জাতিকে বাঁচাতে কাউকে তো প্রাণ দিতেই হয়।)”
Christina Utrik Hansen —a student shot on 23.1.1944.
দু পা এগিয়ে —
“I see myself as a leaf falling from a tree to become part of the soil below, the quality of the soil depends on that of the leaves. I am now speaking of the youth of France, in whom I place all my hope.” (Jacques Decour. Writer. Shot on 30.5.1942)
একটু আগে ‘ফুল নেই কেন, কুযাশা কেবল’ বলে ঠোঁট ফুলিয়েছিলাম। এখন সে কথা ভেবে মরমে মরে গেলাম। বুনো ‘ফরগেট মি নট’ ফুল মাথা ঝুঁকে কুর্নিশ করতে লাগল। হায়াসিনথ ফুলের সুবাস তির তির কাঁপতে লাগল হাওয়ায়। যারা আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছে ঝরা পাতার মত, নবাগত প্রজন্মের জন্য, এক স্বাধীন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেছিল যারা, নিজের প্রাণ বাজি রেখে, তাদের জন্য ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিচ্ছে এ বসন্তকাল।
1 Comment