রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিদেশযাত্রা: রাজনীতির প্রথম পাঠ

রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিদেশযাত্রা: রাজনীতির প্রথম পাঠ

রবীন্দ্রনাথের রাজনীতিচিন্তা ছিল গভীরভাবে প্রাতিস্বিক। দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের দৈনিক যাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল সংযোগ রবীন্দ্রনাথকে রাজনীতি ও সমাজবোধের যে-পাঠ দিয়েছিল, তার সঙ্গে মিল ছিল না রাজনীতির প্রচলিত কাঠামোর। একদিকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা এবং অন্যদিকে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ‘টোটালিটেরিয়ান’ ভাষ্যকে প্রত্যাখ্যান—এই দুই মেরুর সমন্বয় রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরকে করেছিল বিশিষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চিন্তার বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর রাজনীতিচিন্তার বিকাশের নানান স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বহু আলোচনা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশে তাঁর প্রথম বিদেশযাত্রার বিশিষ্ট ভূমিকার কথা স্মরণ করব।

ঠাকুর পরিবারে স্বাদেশিকতা ও দেশাত্মবোধের চেতনার প্রকৃত বপন হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়: “স্বদেশের প্রতি পিতৃদেবের যে একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা তাঁহার জীবনের সকলপ্রকার বিপ্লবের মধ্যেও অক্ষুণ্ণ ছিল, তাহাই আমাদের পরিবারস্থ সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছিল।” ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ‘হিন্দু মেলা’-র আয়োজন, ‘সঞ্জীবনী সভা’-র প্রতিষ্ঠা এবং নানান দেশীয় শিল্পোদ্যোগের পরিকল্পনা ঠাকুর পরিবারে অনুসৃত তীব্র স্বাদেশিকতারই বিবিধ প্রকাশ। তেরো বছর বয়েসি কিশোর রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলায় সর্বজনসমক্ষে তাঁর রচিত আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক কবিতা পাঠ করেছিলেন। ১৮৭৭ সালের পয়লা জানুয়ারি দিল্লিতে লর্ড লিটন আয়োজন করেছিলেন এক রাজকীয় ‘দরবার’-এর (যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনমানসে রানী ভিক্টোরিয়ার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা), আর ঠিক সেই সময়ই ভারতে বেশ কিছু প্রদেশে তীব্র খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। একদিকে রাজকীয় প্রাচুর্যের বিলাসবহুল প্রদর্শন এবং অন্যদিকে দেশের মানুষের দুর্দশার মধ্যে তীব্র এই ভারসাম্যহীনতাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সেই ‘রাজনৈতিক’ কবিতাটির মূল অভিমুখ। ‘হিন্দু মেলা’-র পাশাপাশি, কিশোর রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশের রাজনৈতিক শৃঙ্খলমোচন করার উদ্দেশ্যে ‘সঞ্জীবনী সভা’-র ‘গোপন’ কার্যকলাপ। রবীন্দ্রনাথের কিশোর মনে জাতীয়তাবোধের গভীর ও স্থায়ী প্রভাব ছিল মূলত পারিবারিক অর্জন।

গভীর জাতীয়তাবোধকে সঙ্গী করে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ জীবনে প্রথমবার ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। সেবারেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়ে ঔপনিবেশিক শাসকের অভিপ্রায় ও কর্মপদ্ধতি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে তাঁর কৈশোর জীবনের প্রান্তে ইংল্যান্ডে থাকার সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউস অফ কমন্‌স’-এ বিভিন্ন বিতর্ককে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বিলেতে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পাঠরত রবীন্দ্রনাথ

সে-দেশে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে (যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজে জানিয়েছেন ব্যারিস্টারি পাস করার লক্ষ্যেই তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল)। পশ্চিমবঙ্গ স্টেট আর্কাইভসে রক্ষিত ফাইল থেকে ১৮৭৮ সালের ১২ মার্চ রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি আবেদন পত্র খুঁজে পেয়েছেন জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল। সেখানে পত্রলেখক আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর বয়েসের সার্টিফিকেটের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করছেন। “As I intend to proceed to England for the purpose of competing at the Indian Civil Service Examination I beg to request the favor of your granting me a certificate of my age as required by the Rules.”

যাই হোক, প্রায় দিন কুড়ির যাত্রার পর প্যারিস হয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছলেন। এ-দেশে এসে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে-থাকা চূড়ান্ত সংবেদনশীল আর সৃষ্টিশীল রবির প্রাথমিক যে-অনুভূতি হল, সেটি গভীর নৈরাশ্যের। তিনি আশা করেছিলেন এই দেশের নারী-পুরুষ বুঝি টেনিসনের কবিতা, গ্ল্যাডস্টোনের বক্তৃতা, ম্যাক্মমুলারের বেদব্যাখ্যা, কার্লাইলের চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে “intellectual আমোদ”-এ ব্যস্ত। তার বদলে তিনি দেখলেন: এখানে “মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে, সংসার যেমন চলে থাকে তেমনি চলছে—কেবল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যা-কিছু কোলাহল শোনা যায়।” এই ‘রাজনৈতিক কোলাহল’-এর উষ্ণতার আঁচ মিলল সে-দেশের সংসদে।

১৮৮০-র দশকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চেহারা, যেমন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

ব্রিটিশ সংসদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনের সময়, ১৮৭৯ সালের ২৩ মে এবং ১২ জুন, রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। এই তারিখ দুটি উদ্ধার করেছেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেতজীবনের বিবরণ য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র-এ প্রাপ্ত পার্লামেন্টের বিতর্কের বিবরণের সঙ্গে সংসদের মিটিং-এর কার্যবিবরণকে মিলিয়ে প্রশান্তবাবু এই দিন দুটি নির্ধারণ করেছেন।

প্রশ্ন হল, পার্লামেন্টে কী নিয়ে আলোচনা চলছিল তখন?

প্রথম দিন পার্লামেন্টের প্রাসাদের বিরাটত্ব আর সেখানে নিত্যদিন ঘটে-চলা রাজনৈতিক বিতর্ক ও সাংসদদের আচরণের ‘নিম্নমান’-এর বৈপরীত্যে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ ঘটল। “পার্লামেন্টের অভ্রভেদী চূড়া, প্রকাণ্ড বাড়ি, হাঁ-করা ঘরগুলো দেখলে খুব তাক লেগে যায়; কিন্তু ভিতরে গেলে তেমন ভক্তি হয় না।” ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, ভারতীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করছেন ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেল [Mr. Frank O’Donnell, ১৮৪৮-১৯১৬] নামের একজন আইরিশ সাংসদ।

আইরিশ সাংসদ ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেল

সে-সময় ভারতে ভাইসরয় লর্ড লিটনের কাছে দুটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে দরবার করতে গিয়ে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্যরা অপমানিত হন। ফ্যাঙ্ক ও’ডনেলের প্রতিবাদ ছিল এই অবমাননার বিরুদ্ধে। যে-দুটি বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা লর্ড লিটনের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন তা হল: (১) আফগানযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়সহ ব্রিটিশ সরকারের কিছু অর্থনৈতিক নীতির পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব, ও (২) দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ-সম্পাদিত সোমপ্রকাশ পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসকের অবদমনমূলক নীতির বিরোধিতা। প্রথম প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকারের তদানীন্তন আফগান নীতি ও শুল্ক বিষয়ক কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা লিটনের কাছে আপত্তি তোলেন। দ্বিতীয় প্রস্তাবে তাঁদের প্রতিবাদ ছিল ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’-এর বিরুদ্ধে। ভাইসরয়ের কাছে এই দুটি বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে লর্ড লিটন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নেতা-সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন: “…and the Viceroy, in reply, made many injurious reflections on the personal character and status of the members of the deputation, even reminding those of them who were rich that they owed their wealth to the action of the Government.” ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই ঘটনার কথা তুলে ধরে লর্ড লিটনের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছিলেন আইরিশ সাংসদ ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেল। বক্তৃতায় তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবিত দুটি বিষয় নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা করেন। দ্বিতীয় বিষয়ের সূত্রে উঠে আসে সোমপ্রকাশ পত্রিকার কথা।

 

সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ১৮৭৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি পত্র প্রকাশিত হয়, যেখানে ব্রিটিশ সরকারের কিছু নীতির তীব্র সমালোচনা ছিল। ওই একই পত্রের একটি ইংরেজি অনুবাদ ডেকান স্টার (ইংরেজিতে প্রকাশিত ভারতীয় সংবাদপত্র) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বছর ১৮ মার্চে প্রকাশিত সরকারি নোটিসে সোমপ্রকাশ পত্রিকার মুদ্রক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে হাজার টাকার জরিমানা ধার্য হয়, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাটি সরকারি দমননীতির বাইরে থেকে যায়।

সোমপ্রকাশ পত্রিকা

আসলে ইংরেজিতে প্রকাশিত সংবাদপত্র এবং ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতি ব্রিটিশ শাসকের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গভীর বৈষম্য ছিল। ইংরেজি সংবাদপত্রের থেকে ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের নজরদারি আর অবদমনমূলক আচরণের তীব্রতা ছিল অনেকাংশেই বেশি, কারণ ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের পাঠক স্বভাবতই প্রচুর। দুটি ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতি শাসকের দৃষ্টিভঙ্গির এই তারতম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন আইরিশ সাংসদ ও’ডনেল। তাঁর মতে ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতি সরকারের দমনমূলক মনোভাবের পিছনে রয়েছে শাসকের হীনতা ও নির্লজ্জ দমননীতি (“pettiness, the absurdity, the mischievousness, the foolish, hysterical, petty tyranny of a Government”)। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, তীব্র আবেগে একজন আইরিশ সাংসদ লড়ছেন ভারতীয় সংবাদপত্রের কন্ঠরোধের বিরুদ্ধে, কিন্তু সেই আইরিশ সাংসদের বক্তব্যকে নাকচ করছেন এক ইংরেজ সাংসদ। অবশেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেলের প্রস্তাব পরাজিত হল ১৭৯ ভোটে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের প্রতি সংবেদনশীল এই আইরিশ সাংসদের অবমাননায় দুঃখিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। লর্ড লিটন ঠিক যেরকম অবমাননাকর আচরণ করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভ্যদের সঙ্গে, তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঠিক সেই একইরকম অসহিষ্ণু আচরণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিকাংশ ইংরেজ সদস্যদের কাছ থেকে ফিরে পেলেন ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেল। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র-এ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন: “আমরা যখন গেলেম তখন O’donnel বলে একজন Irish member ভারতবর্ষ সংক্রান্ত বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, Press Actএর বিরুদ্ধে ও অন্যান্য নানা বিষয় নিয়ে তিনি আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে Irish memberরা Houseএ অত্যন্ত অপ্রিয়—তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়ে গেল।”

আসলে সেই সময় ভারতের মতো আয়ারল্যান্ডও ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। আইরিশ সদস্যরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্থান পেলেও সম্মান পেতেন না; তাঁদের ভাগ্যে জুটত পরিহাস আর অপমান। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতের নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক সমব্যথা তাই আইরিশ সাংসদদের প্রতি।
দ্বিতীয় দিন, ১২ জুন, রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গিয়ে আবার ফ্র্যাঙ্ক ও’ডনেলের বক্তৃতা শুনলেন: আফ্রিকায় জুলু-যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর নৃশংস আচরণের বিরোধিতা করে সেদিন নিজের কঠোর বক্তব্য পেশ করেছিলেন সাংসদ। ওই দিন বিখ্যাত সাংসদ এবং তৎকালীন বিরোধী নেতা গ্ল্যাডস্টোনের ভাষণ শুনলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাষণও ছিল ভারতকেন্দ্রিক:

ভারতের প্রতি সংবেদনশীল ব্রিটিশ সাংসদ গ্ল্যাডস্টোন

সেদিনের সভায় গ্ল্যাডস্টোন পেশ করেছিলেন কলকাতা থেকে প্রেরিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একটি আবেদন যেখানে ব্রিটিশ সরকারের আফগাননীতি ও কর-সংক্রান্ত কিছু নীতির বিরোধিতা করা হয়েছিল। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র-এ ধরা আছে ভারত ও আয়ারল্যান্ডের প্রতি সংবেদনশীল সাংসদ গ্ল্যাডস্টোনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতার প্রকাশ: “গ্ল্যাড্‌স্টোনের কী-এক রকম দৃঢ় স্বরে বলবার ধরণ আছে, তাঁর প্রতি কথা মনের ভিতর গিয়ে যেন জোর করে বিশ্বাস জন্মিয়ে দেয়। একটা কথায় জোর দেবার সময় তিনি মুষ্টি বদ্ধ করে একেবারে নুয়ে নুয়ে পড়েন, যেন প্রত্যেক কথা তিনি একেবারে নিংড়ে নিংড়ে বের করছেন। আর সেই রকম প্রতি জোর-দেওয়া কথা দরজা ভেঙেচুরে যেন মনের ভিতর প্রবেশ করে।” গ্ল্যাডস্টোন কিন্তু আইরিশ নন, তিনি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে প্রকাশিত ভারতের প্রতি দরদ কৈশোর-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

জীবনের প্রথম ইংল্যান্ডবাস রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধকে যেমন গভীর করেছিল, তেমনই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইরিশ সাংসদদের নিয়ত অপমান তাঁর মনে আয়ারল্যান্ডের প্রতি এক সহানুভবের টান প্রতিষ্ঠা করেছিল। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র-এ বারে-বারেই মেলে সেই ইঙ্গিত। “হৌসে Irish memberদের ভারী যন্ত্রণা; এ বেচারিরা যখন বক্তৃতা করতে ওঠে তখন হাউসে যে অরাজকতা উপস্থিত হয় সে আর কী বলব! চার দিক থেকে ঘোরতর কোলাহল আরম্ভ হয়, অভদ্র মেম্বররা হাঁসের মত ‘ইয়া’ ‘ইয়া’ করে চেঁচাতে থাকে। বিদ্রূপাত্মক ‘hear’ ‘hear’ শব্দে বক্তার স্বর ডুবে যায়। এই রকম বাধা পেয়ে বক্তা আর আত্মসম্বরণ করতে পারেন না, খুব জ্বলে ওঠেন; আর তিনি যতই রাগ করতে থাকেন ততই হাস্যাস্পদ হন… আমার স্বভাবতই আইরিশ মেম্বরদের প্রতি টান…।” এই প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ: “…আয়ারল্যান্ডে হোমরুল-আন্দোলন শুরু হইয়াছে—ভারতের রাজনৈতিক নির্যাতিত অবস্থার সহিত আয়ারল্যান্ডের তুলনা করিয়া স্বভাবতই তাঁহার [রবীন্দ্রনাথের] সহানুভূতি আইরিশদের প্রতি ধাবিত হইয়াছিল।”

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে আয়ারল্যান্ডের প্রতি এই টান এবং সেখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি সহানুভব এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীকালে বিখ্যাত আইরিশ কবি ইয়েটস-এর (রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি-র প্রকাশে যাঁর সোৎসাহ ভূমিকা এবং সেই বইতে তাঁর লিখে-দেওয়া অনবদ্য ‘ভূমিকা’টির কথা আমরা সবাই জানি) সঙ্গে কবির বন্ধুত্ব, ভারতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ আর-এক আইরিশ মহীয়সী নারী সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে সৌহার্দ, ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের এই যোগ গভীরতর হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে আমরা ভুলব না রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস গোরা-র কথাও, যেখানে প্রধান চরিত্রটি ছিল আদতে আইরিশ। আসলে ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্গত দুই দেশ হিসেবে, ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের শরিক হয়ে উঠেছিল এই দুই দেশ। এক দেশের বিপ্লবীরা অন্য দেশের বিপ্লববাদী কার্যকলাপ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতেন। রবীন্দ্রনাথের এই আয়ারল্যান্ড-যোগের তাই গভীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল এবং সতেরো-আঠারো বছর বয়সে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়ে সেখানে আইরিশ সাংসদদের প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁর এই টান গভীরতর হয়েছিল। কবির রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশের পরবর্তী পর্যায়গুলির ধারাবাহিক বিকাশে এই পর্বটির গুরুত্বের কথা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত।

ব্যবহৃত গ্রন্থ:

  • প্রশান্তকুমার পাল। রবিজীবনী। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৮২, ১৯৮৪।
  • প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রজীবনী। প্রথম খণ্ড। কলকাতা: বিশ্বভারতী, ২০০৮।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র–রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। নবম খণ্ড। কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৮৯।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র। কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৬১।
  • ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ধারাবিবরণের উল্লেখে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ‘হানসার্ড’ (Hansard) ওয়েবসাইট-এর। ঠিকানা: https://hansard.parliament.uk/
জন্ম ১৯৮৬। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ, এম ফিল, পি এইচ ডি; গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত অধ্যাপক চিন্ময় গুহর তত্ত্বাবধানে। পেশায় একটি সরকার-পোষিত কলেজের অধ্যাপক। এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি জার্নাল, অনুষ্টপ ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত প্রবন্ধ-গ্রন্থ: যুগান্তরের চিঠি: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য (ধানসিড়ি, ২০১৫)। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু মৌলিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের লেখক ও একটি গ্রন্থের সহ-সম্পাদক। সম্পাদিত গ্রন্থ: বিগত যাপন: একটি পারিবারিক আখ্যান (ধানসিড়ি, ২০২১)। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বাংলা প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন (অপর: লেখা ও কথার সংকলন, অনুষ্টুপ, ২০২২)-এর প্রস্তুতি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে সত্যজিৎ রায়ের ঐতিহাসিক ছবিগুলি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়; ওই বিষয়ে একাধিক বক্তৃতা দিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে। অধ্যাপক ছন্দক সেনগুপ্তের সহযোগী হিসেবে সম্পাদনা করেছেন অনুষ্টুপ-প্রকাশিত অনুষ্টুপের সত্যজিৎ (২০২৩) গ্রন্থের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *