কথায় কথায় কণিকা

কথায় কথায় কণিকা

অনেক সঙ্গীতপ্রেমীদের মতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অঘোষিত দু’টি ঘরানা আছে। একটি শান্তিনিকেতনের, আর অন্যটি কলকাতার। আর এই দুই ঘরানার পথিকৃৎ এবং প্রতিভূ যে দুজন কিংবদন্তি গায়িকা, এই ২০২৪ দুজনেরই জন্মশতবার্ষিকী বছর।

এঁদের জীবন নিয়ে এমন কোন্ কথা আছে যা মানুষের অজানা? জীবনী, আত্মজীবনী, সাক্ষাৎকার, তথ্যচিত্র – এ সবই লেখা, বলা, করা, হয়ে গেছে। দু’জনের গান নিয়েও বিশ্লেষণ আর গবেষণার অন্ত নেই, আর এই ধরনের কাজ করার যোগ্যতা আর ধৃষ্টতাও অধমের নেই। তবুও এক একটি জীবন যখন মহাজীবনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন শতবর্ষ পরেও মানুষের কৌতূহলের অবসান হয় না। তেমনই কিছু ঔৎসুক্য থেকে এই রচনার সৃষ্টি। এঁদের দু’জনকেই এক আলেখ্যে ধরা অসম্ভব।

অমিতাভ চৌধুরী

 

তাই ঠিক করলাম, আজ একজনের বিষয়েই সীমিত থাকব। তিনি, যাঁর সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত অমিতাভ চৌধুরী লিখেছিলেন-

“রবির গানের মণিকার –
এমন মধুর ধ্বনি কার?
কণিকার, কণিকার”।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

পরম শ্রদ্ধেয়া কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদেরই কিছু নতুন-পুরোনো স্মৃতিচারণে কয়েকটি ঘটনা তাঁর ব্যক্তিত্ব, এবং বিশেষ করে রবিগানের সুর ও স্বরলিপি নিয়ে তাঁর মত শিল্পীকেও যে বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার বিবরণ আছে। তেমনই কয়েকটি উপাখ্যান এই নিবন্ধে সংযোজিত করলাম।

এমনিতে তিনি ছিলেন শান্ত, সৌম্য, ধৈর্যশীলা। কিন্তু তাঁর চরিত্রে, বিশেষত পরবর্তী পর্যায়ে সঙ্গীত ভবনের প্রশাসকের ভূমিকায়, একটা দৃঢ়তাও প্রকাশ পেতো। শিল্পীদ্বয় মনোজ মুরলী নায়ার ও মনীষা নায়ারের বাবা ছিলেন বিশ্বভারতীর কর্মচারী এবং নৃত্যনাট্য ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। সেই সূত্রে কণিকাকে তিনি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। মনোজ বলছেন, ‘বাবার কাছে শুনতাম, কোন কোন বিষয়ে মোহরদির অবস্থান হত অনেকটা ‘এটা আমার কথা, এবং এটাই শেষ কথা‘ এই ধরণের। একবার শ্যামা মঞ্চস্থ হবে, বাবা করবেন বজ্রসেন। মোহরদি সঙ্গীত পরিচালনা করছেন। আমরা বাবার সঙ্গে রিহার্সাল দেখতে যেতাম। একদিন সেখানে তুমুল বাগবিতন্ডা। কোনো একটি গানে নাচের মাস্টার বেঁকে বসলেন। বললেন, ‘এই লয়ে এ নাচ হয় না, লয় বদলাতে হবে।’ মোহরদিও অটল, গান ঐ লয়েই হবে। শেষ পর্যন্ত মাস্টারজীকেই হার মানতে হল।

শিল্পীদ্বয় মনোজ মুরলী নায়ার ও মনীষা নায়ার

এই কণিকাই আবার নাকি মঞ্চের অনুষ্ঠানের সময় ভীষণ নার্ভাস হতেন। প্রখ্যাত তালবাদ্য বিশারদ পণ্ডিত বিপ্লব মণ্ডল তাঁর স্মৃতিচারণায় বলছেন, ‘সেবার রবীন্দ্র সদনে শ্যামা হবে। গানে হেমন্তদা, মোহরদি, জর্জদা, চিন্ময়দা। হল উপচে পড়ছে দর্শকে। শো শুরু হতে চলেছে, হঠাৎ মোহরদি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ তো বিপ্লব, আমার হাতটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’’ কণিকার মন্ত্রশিষ্যা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও এ কথা সমর্থন করে বলছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ’৭১ সালে কলকাতা থেকে এক বিরাট শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকায় গিয়েছিলেন অনুষ্ঠান করতে। সে দলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বহু নামিদামি শিল্পীরা ছিলেন। অনেক কষ্টে টিকিট সংগ্রহ করে সেই অনুষ্ঠান আমি দেখতে গিয়েছিলাম। এত শিল্পী থাকায় কণিকা সেখানে গোটা চারেক গানই মাত্র গেয়েছিলেন। কিন্তু আমার ভীষণ আক্ষেপ হয়েছিল, তাঁর চেহারাটাই আমি দেখতে পেলাম না, কারণ গান গাইলেন সারাক্ষণ মুখের সামনে একটা খোলা খাতা ধরে। অনেক পরে জেনেছিলাম, এমনটা তিনি করতেন যাতে দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে চোখাচোখি না হতে পারে তার জন্যে।’

শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক সহজ মানুষদের মধ্যে বড় হওয়া কণিকার মনটিও ছিল সরল ও স্নেহময়। এই সরলতার মাসুলও তাঁকে কখনো কখনো দিতে হয়েছে। শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশিত উদীচী পত্রিকার কণিকা স্মরণ সংখ্যার অতিথি সম্পাদক অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার লিখেছেন, ‘একদিন বীরেনদা (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী শ্রী বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়) বললেন, “জানো উজ্জ্বল, আজ একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে মোহর। গয়না পালিশ করতে এসেছিল, তাকে সব গয়না দিয়ে মোহর গানের ক্লাসে চলে গিয়েছিল। ঘরে ফিরে দেখে, গয়না উধাও! চীনেবাদামের খোলা গয়নার বাক্সে!”’ 

প্রয়াত বরুণ সেনগুপ্ত তরুণ সাংবাদিক জীবনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য ছিলেন। শান্তিনিকেতনে গেলে তাঁর বাড়ীতে উঠতেন। তখন তিনি থাকতেন চীনা ভবনের পাশে একটি ছোট বাড়িতে। একবার পৌষ মেলায় গিয়েছিলেন আনন্দবাজারের গৌরকিশোর ঘোষ আর পরিমল চন্দ্রর সঙ্গে। এই দু’জন অবশ্য থাকছিলেন অন্যত্র। বরুণবাবু এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘একদিন রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ মোহরদির বাড়ীর বাইরে থেকে বরুণের নাম ধরে দুই সহযাত্রীর চিৎকার, ‘বরুণ, উঠে এসো, আমরা এসে গিয়েছি’। বিব্রত বরুণ ভাবছেন, কী করবেন। কিছু ভেবে ওঠার আগেই মোহরদির গলা পাওয়া গেলো, ‘বরুণকে ডাকাডাকি কেন? ও ঘুমোচ্ছে’।
ওঁরা বললেন, ও আমাদের সঙ্গে যাবে।
– কোথায়?
– আমরা যেখানে উঠেছি, সেখানে। 
– না। ও ছেলেমানুষ, ঘুমিয়ে আছে। ওকে ডাকাডাকি করবেন না। ও যাবে না। কাল সকালে আপনাদের সঙ্গে দেখা করবে।
এর পরও গৌরদা কিছু বলতে গেলে মোহরদি কড়াভাবে বললেন, ‘আমি বলছি ও যাবে না। আপনারা এবার যেতে পারেন।’
অগত্যা ওঁদের চলে যেতে হল। এই দু’জনের সঙ্গে বীরেনবাবু ও মোহরদির পরিচয় কিন্তু আরও বেশি দিনের। পরবর্তী সময়ে কণিকার বোনের সঙ্গে পরিমল চন্দ্রের বিয়েও হয়। সে রাতে কিন্তু মোহরদি অনুজ অতিথির বিশ্রাম ও নিরাপত্তাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পরের দিন জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাড়িয়ে দেব না? তুমি ছেলেমানুষ, ওরা তোমার ঘুম ভাঙাবে কেন?”

 মনোজ মুরলী নায়ার পারিবারিক পরিচিতির সূত্রে এবং শ্রীগোরা সর্বাধিকারীর কাছে গান শেখার উদ্দেশ্যে কখনো সখনো কণিকার ‘আনন্দধারা’ বাসভবনে যেতেন। একদিন সেখানে মনোজের গলায় পরে থাকা একটি মালা মোহরদির নজরে পড়ে। দেখে শুনে মোহরদি বললেন, ‘বাহ্, মালাটি তো বেশ!’ এ কথা মনোজ তাঁর মাকে গিয়ে বলেন। মোহরদির পছন্দ হয়েছে শুনে তাঁর মা কেরল থেকে ঐ রকমই একটি মালা করিয়ে আনালেন, এবং মনোজ সেটি তাঁর মোহরদিকে উপহার দেন। এর বহুদিন পরে, মোহরদি তখন কলকাতার হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি, মনোজ একদিন তাঁকে দেখতে গেছেন। তিনি মনোজকে বললেন, ‘জানো, তুমি সেই মালাটা আমাকে দিয়েছিলে? ওটা এরা এখানে পরতে দিচ্ছে না। আমি নিজের কাছে রেখে দিয়েছি।‘ অবাক মনোজ ভাবলেন, আত্মীয় নন, ছাত্র নন, কবেকার দেওয়া একটি সামান্য উপহারের কথা তিনি শুধু মনেই রাখেননি, সঙ্গে করে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। দুর্ভাগ্যবশত সে মালা আর মোহরদির পরা হয়নি। এই সাক্ষাতের তিন দিন পর তাঁর দেহাবসান ঘটে।

আর এক বার আর একজন রাতের অতিথি এসেছিলেন, তাঁর ‘আনন্দধারা’ বাড়িতে। এমনিতে তো উনি বহুবার এসেছেন, কিন্তু এবারের ঘটনাটি বেশ মজাদার। এই অতিথি আর কেউ নন। এই শতবার্ষিকীর অপর নায়িকা শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্র।

কণিকা ও সুচিত্রার মধ্যে বেশ একটু অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। পেশাদার জীবনে দুজনের তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে বেশ কিছু কাহিনি প্রচলিত। কিন্তু সে সবের মধ্যে না গিয়ে এ কথা অবিসংবাদিতভাবে বলা চলে যে একের সঙ্গীতের প্রতি অন্যের ছিল পারষ্পরিক অনাবিল শ্রদ্ধা। আর বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ের যে, একজন অন্যকে নিয়ে, যাকে বলে practical joke, করবার স্বাধীনতা অনায়াসে নিতে পারতেন। যেমন এই ঘটনাটি।

এটি বিবৃত করেছেন শ্রী গৌতম রায়, তাঁর ‘শতবর্ষে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়’ নিবন্ধে। তিনি সেদিন সেখানে উপস্থিত। সাতের, আটের দশকের শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যের পরেই যেন মাঝরাতের নিশুতি নেমে আসত। সেদিন তখন প্রায় রাত দশটা বাজছে। মোহরদির কাছে খবর এলো, সুচিত্রা আসছেন। ‘এত রাতে?’, বলে মুচকি হেসে তড়িঘড়ি শোবার ঘরে গিয়ে আগল দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

অবিলম্বেই সুচিত্রা বাড়ীতে ঢুকে মোহরের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। তিনিও খুলবেন না, সুচিত্রাও ছাড়বেন না। গলা ছেড়ে গান ধরলেন, কে দিলো আবার আঘাত দুয়ারে মম। শেষমেশ বেকায়দায় পড়ে মোহর বলে উঠলেন, ‘গোরা, সুচিত্রাকে বলো, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি’। উপস্থিত সকলের মধ্যে হাসির রোল উঠলো।

আসলে সুচিত্রা আসবেন বলে মোহর সারাদিনই অনেক তেড়জোড় করে রেখেছিলেন। দিনভর অপেক্ষা করিয়ে অত রাতে আসার জন্যে এ ছিল অভিমান প্রদর্শন। যা হোক, পরদিন সকালে আবার সুচিত্রা এলেন। মোহর বললেন, ‘আমি কিন্তু সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’। সুচিত্রা উত্তর দিলেন, ‘আমি তো জানি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই তুমি গোরাকে তোমার ঘুমিয়ে পড়ার খবরও আমাকে দিতে বলেছিলে।’ এবার দুই বন্ধুই সমস্বরে হেসে উঠলেন।

সুচিত্রা-কণিকার কথিত দ্বৈরথকে উসকে দিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখতে গিয়ে বরুণ সেনগুপ্ত কেমন তিরষ্কৃত হয়েছিলেন, তার বিবরণ তিনি লিখেছেন। ‘একদিন বীরেনদা, মোহরদির সঙ্গে খেতে বসেছি। বললাম, অমুকে বলছিলেন মোহরদির চেয়ে সুচিত্রাদি ওই গানটা অনেক ভালো গেয়েছেন। মোহরদি সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে যেতেন। আবার এমনও অনেক দিন হয়েছে আমি হঠাৎ বলেছি, শুনলাম সুচিত্রাদি সেদিন এমন বাজে গাইলেন আর বলার নয়। মোহরদি আমাকে রেগে ধমকে দিতেন: রবীন্দ্রসঙ্গীতের তুমি কি বোঝ হে! সুচিত্রার গানের সঙ্গে কারও গানের তুলনা হয়?’

কণিকা ও সুচিত্রা – রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুই প্রধান কর্ণধার
জর্জ বিশ্বাস – রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক উজ্জ্বল কাণ্ডারী

শুনলে অনেকে অবাক হবেন যে কলকাতার সমকালীন যে সব শিল্পীদের কণিকা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। শিল্পী জীবনের মধ্যগগনে তিনি তৎকালীন বিশ্বভারতী কর্তৃক একাধিক বার প্রত্যাখ্যাত হন। শান্তিনিকেতন শৈলীর অনেকেই তাঁর গানকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশুদ্ধতার বিরোধী বলে প্রচার করতেন। এই শান্তিনিকেতনে লালিত হয়েও এবং বিশ্বভারতী সঙ্গীত ভবনের আজীবন সদস্যা হওয়া সত্ত্বেও কণিকা কিন্তু তাঁর জর্জদাকে খুবই সম্মান করতেন। পরের দুটি বিবরণী থেকে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।

প্রথমটি মনোজ মুরলী নায়ারের জবানিতে। কৈশোর বয়সে তাঁর এক জন্মদিনে তাঁর বাবা মনোজকে নিয়ে গেলেন মোহরদির বাড়িতে তাঁর আশীর্বাদ নিতে। প্রণাম করার পর মোহরদি আলমারি থেকে দুটি ক্যাসেট বার করে মনোজকে উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি গান শোন ?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কার গান ভালো লাগে?’
উত্তরটা সহজ ছিল। ‘আপনার।’
মৃদু হেসে মোহরদি বললেন, ‘আমার গাওয়া কোন গান তোমার ভালো লেগেছে?’
– ‘তুমি রবে নীরবে’।
– ‘তুমি রবে নীরবে’ জর্জদার গলায় শুনেছো ?’
– ‘না।’
– ‘জর্জদার গান শুনো। তোমার ভালো লাগবে।’

মনোজ বলছেন, আসলে জর্জদা মানুষটি যে কে, বহুদিন তাঁর জানা ছিল না। তিনি ভাবতেন অ্যান্ড্রুজ বা এলমহার্স্টের মত শান্তিনিকেতনে আসা কোন সাহেব হবেন। বহু বছর পরে কলকাতায় এসেও এই একই নাম শুনতে শুনতে একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘আচ্ছা, মোহরদির মুখেও শুনেছি, এখানেও সবাই বলেন, এই জর্জদাটি কে?’
– ‘সে কি? জর্জদা কে তুমি সত্যিই জানো না?’
– ‘না, তাই তো জিজ্ঞেস করছি।’
– ‘দেবব্রত বিশ্বাস কে জানো?’
– ‘হ্যা, দেবব্রত বিশ্বাসকে জানবো না কেন?’
– ‘আরে, দেবব্রত বিশ্বাসই তো জর্জ বিশ্বাস।’

এখানে উল্লেখ্য, দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া যে গানটি কণিকা মনোজকে শুনতে বললেন সেই গানেই একটি শব্দান্তর করার জন্য অনেক বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু সে ভিন্ন কাহিনি।

দ্বিতীয় কাহিনিটি শোনা যাক এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্যের কথায়। শ্রীকান্তের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেটে যুগ্ম শিল্পী ছিলেন প্রবুদ্ধ রাহা। এই অ্যালবামের গানগুলির রেকর্ডিং হয়েছিল স্বয়ং মোহরদির তত্ত্বাবধানে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো একটি গান নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের আপত্তি থাকায় অ্যালবামের মুক্তি আটকে যায়। সমাধানের পথ খুঁজতে এই দুই শিল্পীকে শান্তিনিকেতনে যেতে হলো। শ্রীকান্ত বলছেন, ‘সে দিন মোহরদির ‘আনন্দধারা’য় দুজনে অপেক্ষা করছেন। মোহরদি তখন পাশের ঘরে কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় গোরা সর্বাধিকারী সেখানে এলেন। তিনি দুই নবীন শিল্পীর আগমনের কারণ জানতে চাইলে এঁরা জানালেন সমস্যার কথা। গোরাদা বললেন, ‘ও, ওই গানটা? ওটা তো জর্জদাও গেয়েছেন। কিন্তু – কী জানি, কেমন যেন গেয়েছেন।’ গোরাদার এই কথা মোহরদির কানে গিয়ে থাকবে। তিনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি জর্জদাকে নিয়ে কিছু বলছিলে?’
গোরাদা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বলতে গেলেন, ‘না, মানে ওই –‘ মোহরদি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শোন, জর্জদাকে নিয়ে এখানে কিন্তু কোন কথা হবে না।’

রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা তো ছিলেনই। গুরুদেবের কাছে প্রত্যক্ষভাবে যাঁরা গান শিখেছেন, তাঁর গানের স্বরলিপি করেছেন, যেমন ইন্দিরা দেবী, অনাদি দস্তিদার, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার ইত্যাদি সব গুণী ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে এসে, তাঁদের কাছে শিক্ষালাভ করে, কণিকার সঙ্গীতচর্চা সমৃদ্ধ হলেও, তাঁকে মূলত শৈলজারঞ্জনেরই যোগ্যতম ছাত্রী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার দুই স্তম্ভ ছিলেন শান্তিদেব ও শৈলজারঞ্জন। প্রায়শই এঁদের শিক্ষণ ও গায়নশৈলীর স্বতন্ত্র ধারার অনুগামীদের এক এক জনের গোষ্ঠীভুক্ত বলে পরিচিতি দেবার প্রবণতা ছিল। এই শ্রেণিভেদ পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত না হলেও একেবারে অস্বীকার করাও বোধ হয় যায় না।

বরুণ সেনগুপ্ত ছিলেন রাজনৈতিক সাংবাদিক। তাঁর পেশাদারী প্রবণতাই হয়তো ছিল প্ররোচিত করার। তিনি বলছেন, ‘শৈলজারঞ্জনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা মোহরদির মুখে বহুবার শুনেছেন। একবার তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখলেন, শান্তিদেব ঘোষ চেয়ারে বসে আছেন, আর তাঁর পায়ের কাছে মাটিতে মোহরদি। কিছুক্ষণ কথা বলার পর শান্তিদা চলে গেলেন। একটু হেসে বরুণ বীরেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বীরেনদা, মোহরদি কি গ্রুপ পাল্টেছেন নাকি?’ বীরেনদা কিছু বলার আগেই মোহরদির ধমক, ‘তুমি জানো শান্তিদাকে আমি কত শ্রদ্ধা করি? শান্তিদার কাছে কত গানই না শিখেছি! শান্তিদার মত মানুষ ক’জন আছে?’

কণিকার গাওয়া অনেক গানই যে স্বরলিপির অনুগামী ছিল না, তা অনস্বীকার্য। মনোজ মুরলী নায়ার বলছেন, ‘তাঁর এবং মনীষার যুগ্ম গায়নে যে দ্বিতীয় ক্যাসেট বেরিয়েছিল,তাতে মনীষার গাওয়া গানগুলি ছিল মুক্তছন্দের।’ মনীষা বলছেন, ‘শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলে থেকে তখন মোহরদি ছাড়া আর কারো গানই বিশেষ শুনতেন না, তাঁর গানগুলির prelude/interlude পর্যন্ত তাঁর মুখস্থ ছিল।’ তা ছাড়া তাঁর গানের শিক্ষিকা ছিলেন শ্রীমতি বুলবুল বসু, যিনি আবার মোহরদির প্রত্যক্ষ ছাত্রী। কাজেই মনীষার গাওয়া গানগুলি ছিল একেবারেই মোহরদির অনুসারী। রেকর্ডিং কোম্পানির কর্ণধার সুভাষ চৌধুরীর ব্যাপারটা পছন্দ ছিল না। তিনি গানের লিস্ট দেখেই নাকচ করে দেন। পরে অবশ্য কোম্পানির মালিকের অনুরোধে তিনি রাজী হন, একটি শর্তে। শর্তটি ছিল, মনীষা যা গেয়েছেন তার স্বরলিপি করে এনে দেখাতে হবে। এইবার মনোজ আর তাঁর এক বন্ধু মিলে মোহরদির গানগুলি চালিয়ে স্বরলিপি করতে বসে দেখলেন, অনেক গানই স্বরলিপির সঙ্গে একেবারেই মিলছে না। সে যাত্রা অবশ্য কোনক্রমে সুভাষবাবুর ছাড়পত্র পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কণিকাও যে বারংবার স্বরলিপির কাঠামো অতিক্রম করেছেন, সে কথা তাঁরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন।

আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান যাঁরা গাইতেন, স্বরলিপির থেকেও তাঁরা বেশী গুরুত্ব দিতেন তাঁদের সঙ্গীত শিক্ষক বা trainerরা যেভাবে শেখাতেন, তার ওপর। আর হবে নাই বা কেন, কারণ এই সব শিক্ষাগুরুরা হতেন কোন না কোন ভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সহযোগী বা সমসাময়িক পরিমণ্ডলে শিক্ষিত সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর গানের স্বরলিপির সঙ্গে অমিলের প্রসঙ্গে কণিকা নিজেও একবার বলেছিলেন, ‘কিন্তু আমি তো শৈলজাদার কাছে এই ভাবেই শিখেছি।’ 

’আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া এমন একটি গান যা বলা যায় এক কথায় যুগান্তকারী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও যে এক ধরনের cult status তৈরী করা যায় তার নিদর্শন। গানটি নিয়ে কিন্তু এক সময় কম বিতর্ক হয়নি। কারণ স্বরলিপি থেকে কণিকার গাওয়া অনেকই ভিন্ন। বিশুদ্ধতাবাদীরা তো বটেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিছু গোষ্ঠীবাদীরাও সে সময় বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন। অনেকে অবশ্য বলেন ‘তিনি যখন এ গান রেকর্ড করেন, তখন গানটির কোন প্রামাণ্য স্বরলিপিই ছিল না।’ কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। কণিকার কণ্ঠে এ গানের রেকর্ড প্রকাশ পায় ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে। তার তিন মাস আগে মে মাসে প্রকাশিত স্বরবিতান-৪৫এ ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীর পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধার করা একটি স্বরলিপি ছাপা হয়। তার আগে প্রকাশিত কোনো স্বরবিতানে এ গান ছিল না। অথচ বহু বছর আগে ১৮৯৭তে বীনাবাদিনী পত্রিকার এক সংখ্যায় স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-কৃত একটি স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। কেন তা স্বরবিতানে এতদিন স্থান পায়নি, তা জানা যায়নি।

কণিকার ‘আনন্দধারা’ অবশ্য এই দুই স্বরলিপি থেকেই ভিন্ন। এবং এমনই জনপ্রিয় এবং অনুসৃত হলো এ গান যে শেষমেশ স্বরবিতান-৬৪তে তাঁর গাওয়া versionটিরও একটি স্বরলিপি অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা ভি. বালসারার করা। এখানে লেখা হলো ‘গানটি প্রথম প্রচারিত হয় রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশিত সুরে।’ কিন্তু সুর তো করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলছেন, ‘রমেশচন্দ্র ছিলেন আসলে মোহরদির এই গানটির ট্রেনার।’ গানটি বিষ্ণুপুর ঘরানার একটি বিখ্যাত খেয়ালের থেকে ভাঙা সুরে মিশ্র মালকোষ রাগে রচিত। রমেশচন্দ্র নিজে ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সুপণ্ডিত। তাই ঐ ঘরানায় যেভাবে মালকোষ গাওয়া হয়, সেভাবেই গাওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করা হয় এবং সেভাবেই তিনি মোহরদিকে শেখান। গানটির প্রভূত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও যে বিতর্ক হয়েছিল তা সম্ভবত কণিকাকেও কিছুটা আহত করেছিল। মনে আছে, বহু বছর আগে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান, আর শ্রোতাদের থেকে বারবার অনুরোধ আসছে ‘আনন্দধারা’র। অনুষ্ঠান শেষের দিকে অনুরোধ সরব হয়ে উঠলো। কণিকা বললেন, ‘আনন্দধারা আমি ভুলে গেছি।’ এক যুবক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘দিদি, আপনিই তো গেয়েছেন।’ ‘আমিই গেয়েছি, আবার আমিই ভুলে গেছি,’ বলে অন্য একটি গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে চলে গেলেন।

শান্তিনিকেতনে প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা শেষ করার পরেও বন্যা বহুদিন কণিকার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে তাঁর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। সেই যোগাযোগের সুত্রে তাঁর গাওয়া অনেক গানের পশ্চাৎপটের আলোচনা মোহরদির মুখে বন্যা শুনেছিলেন। তেমনই দু-একটি গানের কথা তিনি শুনিয়েছেন যেখানে স্বরলিপির সঙ্গে প্রভেদ থাকায় মোহরদিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।

যে রেকর্ডে ‘আনন্দধারা’ বেরোয়, তার উল্টোপিঠের গান ছিল ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’। এই গানটি নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বলাবলি করতে লাগলেন, গানটির নোটেশন শৈলজাবাবুর করা, মোহরদি নিজে শৈলজাদার ছাত্রী। তা সত্ত্বেও তিনি স্বরলিপি বিচ্যুতি কেন করলেন?

ঘটনাটা ছিল এই রকম। তখন শান্তিনিকেতনে আকাশবাণীর একটি স্টুডিও হয়েছিল। প্রত্যেক মাসে বিশ্বভারতীর একটি প্রোগ্রাম সেখানে রেকর্ডিং হতো। একবার সেখানে মোহরদির গাওয়ার কথা। তাঁকে এই গানটি গাইতে দেওয়া হয়েছিল। মোহরদি শৈলজাদার কাছে গানটি ভালো করে শিখে রেকর্ডিং করতে গেছেন। সেই অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন শান্তিদা। তিনি কিন্তু মোহরদির নোটেশন দেখে ভীষণ রেগে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, ‘এই গান এই তালে হতেই পারে না।’ শৈলজাদা শিখিয়েছিলেন কাহারবা তালে, স্বরলিপিতেও তাই আছে। নরম স্বভাবের মোহরদি বললেন, ‘শৈলজাদা তো আমাকে এই রকমই শিখিয়েছেন।’ শান্তিদা আরও রেগে উঠে বললেন, ‘ও সব আমি জানি না। এ সারি গানের (নৌকা বাওয়ার গান) সুর। এখানে এ তাল চলবে না।’ অসহায় মোহরদি কোণে বসে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে একটু ঠাণ্ডা হয়ে শান্তিদা বললেন, ‘আমি শেখাচ্ছি, যদি দশ মিনিটে শিখে নিতে পারো তো গাইবে।’ এই বলে তিনি পুরো গান শেখালেন দাদরা তালে। ‘পাড়ি দেব’র পর ‘গো’ শব্দটিও যোগ করলেন, যা নোটেশনে নেই। এই ভাবেই রেকর্ড হয়ে আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত হলো। আর তার কদিনের মধ্যেই শান্তিদা গ্রামোফোন রেকর্ডেও মোহরদিকে দিয়ে এই গান রেকর্ড করিয়ে নিলেন।
এই প্রসঙ্গে কণিকা শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে কোন আলোচনা করেছিলেন কি না, বা এই রেকর্ড নিয়ে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া ছিল, তা অবশ্য জানা যায়নি। আরও উল্লেখযোগ্য, শান্তিদেব ঘোষের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্রীরূপে যাঁর পরিচিতি, সেই সুচিত্রা মিত্র এই গান রেকর্ড করেছিলেন কাহারবা তালে শৈলজারঞ্জনের স্বরলিপি অনুসরণ করে।

গুরু শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে কণিকা
রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিদেব ঘোষ
রথীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ

বন্যা মোহরদির মুখে শোনা আরেকটি গানের কথাও বলেছেন। সেবারও আকাশবাণীর জন্য মোহরদি গাইতে গিয়েছিলেন। তখন সারাদিনে তিন বার করে কোনো শিল্পীর অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। তাই অনেকগুলি গান তিনি গেয়েছিলেন। যেদিন সম্প্রচার হলো, তার পরদিন রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলেন। মাঝরাস্তায় ভুবনডাঙার মাঠের কাছে দেখলেন উল্টোদিক থেকে রথীন্দ্রনাথ সাইকেল চেপে আসছেন। মোহরদিকে দেখে তিনি সাইকেল থামিয়ে ইশারায় তাঁকে ডাকলেন। রিক্সা থেকে নামলে রথীবাবু বললেন, ‘অ্যাই মোহর, কাল রেডিওতে তোর গান শুনলাম।’

মোহরদি ভাবলেন তাঁর গাওয়ার প্রশংসা করতেই রথীবাবু তাঁকে ডাকলেন। তিনি কিন্তু বলে উঠলেন, ‘বাবামশাই গত হয়েছেন, ক’বছরই বা হয়েছে। এর মধ্যেই তোরা যা ইচ্ছে তাই করতে শুরু করেছিস, না?’
অপ্রস্তুত মোহরদি বললেন, ‘রথীদা, আপনি কোন গানের কথা বলছেন?’
– কেন, আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে? এই গানের ওই সুর, ওই তাল আছে?
– কিন্তু শৈলজাদা তো আমাকে ঐরকমই শেখালেন!
– শৈলজাবাবুও আজকাল যা খুশি তাই শেখাচ্ছেন, আর তোরাও যা ইচ্ছে তাই গাইছিস।

রথীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত। তাঁর মেজাজ অধিকাংশ সময়েই সপ্তমে চড়ে থাকত। তিনি আরো কিছু বাক্যশেল নিক্ষেপ করে চলে গেলেন।

মর্মাহত মোহরদি কাঁদতে কাঁদতে শৈলজারঞ্জনের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁকে বললেন, ‘আপনি আমাকে কি সব ভুলভাল শিখিয়েছেন? রথীদা মাঝরাস্তায় নামিয়ে যা নয় তাই শুনিয়ে গেলেন।’
বিস্মিত শৈলজা কী হয়েছে জানতে চাইলে মোহরদি পুরো ঘটনা শোনালেন। তখন শৈলজা তাঁকে বললেন, ‘তুই আয়, বোস। আমি তোকে বোঝাচ্ছি।’

শৈলজাদা সেদিন যা বুঝিয়েছিলেন, তা তিনি লিখেও গেছেন। ‘আজি ঝরো ঝরো’ রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন বর্ষামঙ্গলের জন্য। মূল গানটি করেছিলেন কাফি রাগের ওপর ষষ্ঠী তালে। মহড়ার সময় তিনি অনুভব করলেন গানটি নৃত্যশিল্পীরা উপভোগ করছে না, নাচে প্রাণ আসছে না। তখন তিনি তাল বদল করলেন কাহারবায়, লয়ও দ্রুত করলেন। শৈলজা বাধা দিলেও সুরও অনেকটা পাল্টালেন। সুর এবং লয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার জন্য কথাও বদলে ‘উদাসী’কে করলেন ‘উদভ্রান্ত’। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, নাচিয়েরা যেন উপভোগ করে প্রাণ আনতে পারে। এত কিছুর পরেও অন্তরা তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। তখন শৈলজারই পরামর্শে অন্তরা দু’বার গাওয়া স্থির হলো, একবার নীচু স্বর দিয়ে, দ্বিতীয়বার উঁচু স্বরে। অবশেষে গানের খোল-নলচে সম্পূর্ণ বদলে গেলো। ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়ে গেলো এই রূপান্তরটি। ষষ্ঠী তালের মূল গানটিকে কেউ মনে রাখল না, যা মোহরদিকে সেবার শিখিয়ে তিনি পাঠিয়েছিলেন।

বন্যা আরও একটি গানের কথা বলেছেন, ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বাণী।’ এই গানটিও মোহরদি যে ভাবে শিখিয়েছিলেন, এবং শান্তিনিকেতনে যা গাওয়া হয়, তার সঙ্গে স্বরলিপিতে প্রভেদ আছে। এর সুর নাকি শান্তিনিকেতনেই পাওয়া কোন একটি লাল খাতার মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়।

রেজওয়ানার নিজস্ব এক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করব। তিনি যখন মোহরদির কাছে ব্যক্তিগতভাবে শিখছিলেন, তখন অনেকদিন থেকেই তাঁকে অনুরোধ করতেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ গানটি শেখাতে। গানটি রেকর্ড করার তাঁর ইচ্ছে ছিল। কোনো না কোনো কারণে হয়ে ওঠেনি। একদিন বিকেলে মোহরদির বাড়িতে আবার আবদার করলেন গানটি শেখাতে। মোহরদি বললেন, ‘ঠিক আছে, স্বরবিতানটা নিয়ে এসো।’ বন্যা বলছেন, স্বরবিতান থেকে গানটি বার করে তাঁর হাতে দিলে, মোহরদি নীরবে অনেকক্ষণ ধরে স্বরলিপি দেখতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বরলিপি থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘দেখো, এখানে বলছে রূপক তাল। কিন্তু এই কি তালে গাওয়ার গান? আমি তোমাকে তাল ছাড়া শেখাব।’

তাল ছাড়াই শেখালেন, এবং বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে বন্যা গানটি রেকর্ড করলেন একটি ক্যাসেটের জন্য। কিন্তু আপত্তি এলো কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের থেকে। তাঁদের সংশয় ছিল, স্বরলিপির বাইরে গিয়ে গাইলে তখনকার বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন পাওয়া দুষ্কর হবে। তাই উপায়ন্তর নেই দেখে বন্যা গানটি আবার তাল সহযোগে গেয়ে রেকর্ড করলেন।
ক্যাসেট বেরোল। সেই ক্যাসেট নিয়ে বন্যা আবার শান্তিনিকেতন এলেন মোহরদিকে শোনাতে। সব শুনে মোহরদি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ কি আমি তোমাকে এমনি ভাবেই শিখিয়েছিলাম ?’
অপ্রস্তুত রেজওয়ানা তখন তাঁকে সব ঘটনা বললেন। মোহরদি সব শুনলেন, কিন্তু মুখে কিছুই প্রতিক্রিয়া দিলেন না। তবে মনে যে ব্যথা পেয়েছিলেন, তাঁর নীরবতাই তা বলে দিচ্ছিল।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের কপিরাইট শেষ হবার পর রেজওয়ানা আবার এই গান রেকর্ড করেছিলেন, এবার তাল ছাড়া। মোহরদি যেমন শিখিয়েছিলেন।

ওপরে আলোচিত কয়েকটি গানের লিংক্ এখানে দিলাম, যাতে পাঠক-শ্রোতাদের বুঝতে সুবিধে হয়।

  1. প্রথমে কণিকার গাওয়া ‘আনন্দধারা’ –
    https://youtu.be/WPECO5LLpZg?si=kB65YHDxhK5DM1n-
    কণিকার ঐ ‘আনন্দধারা’র প্রবাহ এমনই প্রবল যে অন্য কোন ভিন্ন উদাহরণ পাওয়া দুরুহ। অনেক খুঁজে দুটি পাওয়া গেলো। একটি ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আনন্দধারা’র হিন্দি রূপান্তর (তাঁর সম্ভবত একমাত্র হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীত)। তত্বাবধায়ক শান্তিদেব ঘোষ –https://youtu.be/vc0kWWDENo8?si=OXea_O5xFElq59qy  
  2.  দ্বিতীয়টি এই প্রজন্মের শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রর গাওয়া –
    https://youtu.be/6rdsFTYqE5Q?si=clDG1QxDUm2Brnq6
  3.  এর পর কণিকার কণ্ঠে ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’ –
    https://youtu.be/hrXNQxuvAWU?si=svIEV7CmB_r04SHY
    এবং সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’ –
    https://youtu.be/A4zmNdPq4Do?si=X_wb4MZZx38jkSRd
    কাহারবা তালে বা ২+২ ছন্দে জনপ্রিয় ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’র নিদর্শন তো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তবে দেবব্রত বিশ্বাস ও পদ্মিনী দাশগুপ্তের গাওয়া এটি এমন একটি সময়ের গান যখন ন্যূনতম যন্ত্রানুসঙ্গে, প্রধাণত শিল্পীদের শৈলী গানের ভাবকে অনায়াসে প্রকাশ করতে পারতো –
    https://youtu.be/Zyv4UgWmeuo?si=xOzUpuPvT3neuX5Y
    কিন্তু ষষ্ঠী তালে বাঁধা ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’র মূল গানটি খুঁজে পাওয়া, আদি স্বরলিপির ‘আনন্দধারা’ খুঁজে পাওয়ার মতই, দুঃসাধ্য। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া এই বিরল উদাহরণটি শুনলে শ্রোতারা অনুমান করতে পারবেন এর সঙ্গে নাচকে প্রাণবন্ত করা কত কঠিন –
    https://youtu.be/O5VC1MZ3IrE?si=vMqDhcOy4—XYfc  
  4.  পরিশেষে শোনা যাক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গাওয়া রূপক তালে ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ –
    https://youtu.be/1zbGBYTgI2A?si=AguPh-dVJiGBTcRJ
    এবং তাল ছাড়া সেই একই গান, যেমন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে শিখিয়েছিলেন –
    https://youtu.be/wdMtb5fZVfs?si=-pppUx323dx6Bnsk
জন্ম, শৈশব, প্রথম যৌবন কলকাতায়, তারপর দীর্ঘ কর্ম- ও অবসর জীবন বেঙ্গালুরুতে । আজীবন নাগরিক । এক অত্যাশ্চর্য্য, উদ্দীপনাময়, বিবর্তনকারী প্রজন্মের সাক্ষী ও হয়তো ভাগীদার । অবসরে সঙ্গীত, লেখা, পড়া ও আরও কিছু নান্দনিকতার সখ ও আগ্রহ ।

6 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • পার্থ আঢ্য , July 16, 2024 @ 2:47 pm

    দুর্দান্ত – আরো লেখ – সাথে একটা youtube channel খুলে লেখার সাথে তোর স্বরকে যুক্ত করলে আরও ভালো লাগবে।

  • সমীর ভৌমিক , July 16, 2024 @ 5:57 pm

    খুব সুন্দর এবং সাবলীল লেখা!
    নিবন্ধটা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারা গেল! এই ধরনের ছোট ছোট তথ্য জানতে পারলে, ওই সময়ের পরিস্থিতি এবং সমসাময়িক আরো অনেকের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারা যায়!
    এই প্রসঙ্গে আরো জানার অপেক্ষায় রইলাম!

  • Arun Bhattacharya , July 17, 2024 @ 11:03 am

    কিছু লেখা পড়ে শুধু ভালই লাগে না, তার সাথে যোগ হয় একরাশ তৃপ্তি। এটি তেমনই। তাই বারবার পড়ছি ও নিজেকে প্রতিবার সমৃদ্ধ করছি। ভাবতে ভাল লাগছে যে, নিরলস পরিশ্রম করে, এই সব মনি মানিক্য খুঁজে, ঘষে মেজে পালিশ করে, যে এটি আমাদের জন্য সাজিয়ে দিল, তার সাথে বসে একদা ক্লাস করেছি, একসাথে হস্টেলে কাটিয়েছি – সত্যিই গর্ব হচ্ছে।
    চারিদিকে সোশাল মিডিয়া যখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তখন সেইসব সস্তা সাবজেক্টগুলো অবহেলায় সরিয়ে, এত মনোরম তথ্য সমৃদ্ধ লেখা দিয়ে যে মনকে ভাসিয়ে দেওয়া যায় – My salute to you Aniruddha

  • PRALOY DATTA , July 20, 2024 @ 3:49 am

    খুব ভালো লিখেছিসশ, কাকু। কিন্তু হস্টেল 15এ তোর পাশের ঘরে দুবছর থাকা সত্ত্বেও – এসবের কিছুই আমার দেখতে পাই নি!

  • PRALOY DATTA , July 20, 2024 @ 4:14 am

    নাকি তখন “তথাকথিত” ওইটা খাবার ভয়ে কিছু প্রকাশ করতিস না!

  • PRALOY DATTA , July 20, 2024 @ 4:20 am

    খুব ভালো লিখেছিস, কাকু। হস্টেল 15এ পাশের ঘরে দু’বছর থাকা সত্ত্বেও এইসবের কিছুই তো দেখিনি। নাকি তখন “তথাকথিত” লজ্জায় এইসবের কিছু প্রকাশ করতিস না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *