রানির অসুখ
এক যে ছিল রানি। যেমন তেমন রানি নয় একেবারে মহারানি। পশ্চিম থেকে পূর্বে এতবড় সাম্রাজ্য তাঁর যে সেখানে কখনো সূর্যাস্ত হয় না। তাঁর ভক্ত, স্তাবক, অনুরাগীতে জগৎ পরিপূর্ণ। তাঁর বিশ্বজয়ী সেনার দল দেশ বিদেশ থেকে এনে দিয়েছে বসার জন্য ময়ূর সিংহাসন, তো মুকুটের জন্য কোহিনুর হীরা। এই অবধি পড়েই আমার পাঠকদল হৈ হৈ করে বলবেন, “আরে দাঁড়া, দাঁড়া! আর বলতে হবে না। বুঝে গেছি ইনি মহারানি ভিক্টোরিয়া!”
ঠিক বুঝেছেন। ইনিই ব্রিটিশ ভারতের সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া। মহারানির রাজত্বে সুশাসন, দুঃশাসন আপনার মতে যাই চলুক না কেন, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর একটি চরম অভিশাপ ছিল। যে অভিশাপ তাঁকে স্পর্শ না করলেও কেড়েছে তাঁর শিশুপুত্রের জীবন। শুধু তাই নয় তাঁর থেকে শুরু করে এই অভিশাপ ছড়িয়েছে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি রাজ পরিবারে। এমনকি রাশিয়ার জার পরিবার, পারস্য রাজপরিবার অবধি।
এই অবধি পড়ে পাঠক এবার কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কী সেই অভিশাপ? কে দিলেন? কেনই বা দিলেন? কী অপরাধে এই শাস্তি?
না, কেউ দেননি। কোনও তথাকথিত অপরাধ বা অন্যায়ের সাজাও এই অভিশাপ নয়। নেহাতই প্রকৃতির খেয়াল। যার পরিণতি রক্তপাতে মৃত্যু।
আঁতকে উঠছেন? হ্যাঁ! এই ভয়াবহ রোগটির নাম হিমোফিলিয়া। এক্ষেত্রে রুগির দেহের কোনও স্থানে (বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ) কোনও ক্ষত সৃষ্টি হলে আর পাঁচজন স্বাভাবিক ব্যক্তির মতো রক্ত জমাট বাঁধে না। ক্রমাগত রক্তপাত হতে হতে রুগি অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
আসুন পাঠক, এই তন্ত্রমন্ত্র, ভূত, পিশাচ, আধিদৈবিক, কুসংস্কার জাগরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞানচর্চা করি। দেহের কোনও জায়গা কেটে গেলে বা ছড়ে গেলে সেখান থেকে রক্তপাত হতে থাকে। খুব গভীরভাবে না কাটলে অর্থাৎ শিরা অবধি ক্ষত না পৌঁছলে ধীরে ধীরে রক্ত নিজেই জমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। দেহের এটা নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এই বিশেষ রোগটির ক্ষেত্রে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকেজো হয়ে যাওয়ায় ক্ষতস্থান থেকে ক্রমাগত রক্তপাত ঘটতেই থাকে এবং রুগি রক্তহীন হয়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে।
এখানে দুটি প্রশ্ন আসে।
প্রথমটি রক্ত জমাট বাঁধে কী করে?
আর দ্বিতীয়টি কেন এই রোগের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধে না?
সুধী পাঠক, চলুন একে একে এই দুটি প্রশ্নের জবাব খোঁজা যাক।
রক্ত জমাট বাঁধার জন্য তেরোটি পদার্থ বা ফ্যাক্টর দরকার। এগুলি যথাক্রমে, ফাইব্রিনোজেন, প্রোথ্রম্বিন, টিস্যু থ্রম্বোপ্লাস্টিন, ক্যালসিয়াম আয়ন, ল্যাবাইল, অ্যাক্সিলারিন, প্রোকনভার্টিন, অ্যান্টিহিমোফিলিক ফ্যাক্টর, ক্রিস্টমাস ফ্যাক্টর, স্টুয়ার্ট ফ্যাক্টর, PTA, হেজম্যান ফ্যাক্টর, হেকি লোরেন্ড ফ্যাক্টর।
এই অবধি পড়ে পাঠকের হেঁচকি উঠতে থাকলে আমি নাচার। গোটা দশেক বাংলা সিরিয়ালের গোটা পঞ্চাশেক অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম, ঠিকুজি কুষ্ঠি মুখস্থ রাখতে পারবেন, আর বিজ্ঞান একটু কপচালেই দৌড় লাগাবেন – অ্যাইসা ক্যায়সে চলেগা! আচ্ছা আপনাকে একটু সাহায্য করি। আপনি এক, দুই, তিন, চার, আট আর নয় নম্বরের ফ্যাক্টর কটি একটু মনে রাখবেন।
ডেঙ্গুর কল্যাণে আপনি আমি প্লেটলেট নামক রক্তকণিকাটিকে বেশ চিনেছি। এই প্লেটলেটস্ বা অণুচক্রিকা হল রক্ততঞ্চন নাটকের প্রধান চরিত্র। কেটে যাওয়া জায়গা দিয়ে রক্ত পড়ার সময় খসখসে রক্তনালীর দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে অণুচক্রিকাগুলো ভেঙে যায় আর বেরিয়ে আসে থ্রম্বোপ্লাস্টিন (3নং ফ্যাক্টর)। এটি রক্তরস বা প্লাজমায় (এই নামটিও করোনার কল্যাণে শিখেছেন) থাকা একটি প্রোটিন প্রোথ্রম্বিনকে (ফ্যাক্টর নম্বর 2) থ্রম্বিনে পরিণত করে। এই থ্রম্বিন রক্তে থাকা আর একটা প্রোটিন ফাইব্রিনোজেনকে (ফ্যাক্টর 1) জালের মতো প্রোটিন ফাইব্রিনে পরিত করে। এই জাল ক্ষতস্থানে বসে রক্তপাত বন্ধ করে।
এইবার আপনি ভাবছেন হচ্ছিল রানির অসুখের কথা, এ বসে বকছে রক্তজমাট বাঁধার গল্প। সাধে বলে স্বভাব না যায় ম’লে! চটবেন না। এটুকু আমি না কপচালে বাকিটা আপনাকে বুঝবেন না। রক্ত জমাট বাঁধার পদ্ধতিটা অনেকটা সিঁড়ির মতো। বাকি ফ্যাক্টরগুলো এই সিঁড়ির ধাপ। কোনও একটা ধাপ না থাকলে আপনি পরের ধাপে যেতে পারবেন না। রানির অসুখের ক্ষেত্রে নয় নম্বর ফ্যাক্টরটি বা ধাপটি না থাকায় সিঁড়ি বেয়ে আর এগোনো যায় না। ফলে রক্ত জমাট বাঁধে না। একে হিমোফিলিয়া B বলে। আট নম্বর ফ্যাক্টরটি না থাকলেও একই ঘটনা ঘটে। একে হিমোফিলিয়া A বলে।
এখন প্রশ্ন হোলো রানি তো দিব্যি সুস্থ সবল ছিলেন। তাহলে অসুখ বলা হচ্ছে কেন? আসল ঝামেলাটা এখানেই। যতই রানি হোন তিনি যে নারী। তাই তার লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম দুটিই ইংরেজি X অক্ষরের। ফলে দুটির মধ্যে একটিতে যদি ওই নয় নম্বর ফ্যাক্টর তৈরির জিনটি না থাকে তবে তার নিজের জীবনে প্রভাব পড়ে না। আর একটি X ক্রোমোজোম যেটি সুস্থ সেটি রোগগ্রস্ত জিনটিকে প্রকাশ পেতে দেয় না। সমস্যা পুরুষের ক্ষেত্রে। সমাজ জীবনে যতই রাজত্ব করুক জীববিজ্ঞানের জগতে তাদের পুরুষত্বের জন্য দায়ী দুটি ক্রোমোজোমের (XY) একটি (Yটি) দুর্বল প্রকৃতির। সে বিশেষ জিন বহন করে না। ফলে X ক্রোমোজোমে থাকা জিনটিই প্রকাশ পায়। সেটি যদি রোগগ্রস্ত জিন বহন করে তবে সেটিই প্রকাশ পাবে। তাকে থামাবার কেউ নেই।
তাই মায়ের রোগগ্রস্ত জিনটি মায়ের দেহে প্রকাশ না পেয়ে তার পুত্রের দেহে প্রকাশ পায়। পিতার রোগগ্রস্ত জিনটি কন্যার দেহে সঞ্চারিত হলেও যদি মাতা পূর্ণ সুস্থ হন তবে সেটি প্রকাশ পায় না। মাতার একটি জিন যদি রোগগ্রস্ত হয় এবং পিতা যদি রোগগ্রস্ত হন তবেই পঞ্চাশ শতাংশ সম্ভাবনা কন্যার রোগগ্রস্ত হবার। নতুবা সে একটি রোগগ্রস্ত জিন নিয়ে নীরবে রোগ বহন করবে, প্রকাশ করবে না।
পাঠক এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন; এ তো ভারী সমস্যা! আমি নিজেও জানি না আমার রোগটা আছে কিনা অথচ তা আমার অনাগত সন্তানের মৃত্যুর কারণ হতে পারে! এই বিষম সমস্যা এড়াবার উপায় কী? উপায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বাহক নির্বাচন ও জেনেটিক কাউন্সেলিং। একমাত্র এর মাধ্যমেই আপনি জানতে পারবেন আপনি রোগের বাহক কিনা আর হলে কিভাবে আপনি পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে পারেন। আপনার উর্ধ্বতন ও অধঃতন চোদ্দ পুরুষের দোহাই কুষ্ঠি মেলাতে জ্যোতিষীর কাছে না গিয়ে আগে বাহক বাছতে ডাক্তারের কাছে যান।