অঞ্চলছায়া

অঞ্চলছায়া

বেশ বুঝতে পারছি শিরোনামটি পড়া মাত্র‌ই পাঠকের কুঞ্চিত ভ্রুতে বিরক্তির গাঢ় রেখা। ভাবছেন হয়ত, প্রগতির চাকায় ভর দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা এই যুগেও শাড়ি নিয়ে সাতকাহন! জাস্ট অসহ্য!

আহা, অত অধৈর্য হলে কি চলে!

এই যুগেও শাড়ি আর শাড়ির আঁচল‌ নিয়ে আনাচে কানাচে কতো যে গপ্পো তৈরি হয়, আমরা  zআনতিও পারিনে। 

মাঝে মাঝে মনে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা যদি ইন-চার্জ হতেন, অনেক ‘গৃহযুদ্ধ’ না হলেও হতে পারত, হয়ত বা অনেক ক্ষোভ এবং অবিশ্বাস মুছিয়ে দিয়ে মমতামাখা “অঞ্চলছায়া‌ তারে রাখিত ঢাকি…!”

মূল গপ্পোটি পেশ করার আগে কিঞ্চিৎ মুখবন্ধ সহকারেই বরং মুখটা খুলি। আসলে পটভূমিকাটি ঠিকমতো বিছিয়ে না দিলে‌, গপ্পোটি তো ফোটে না!

সূর্যাস্তের পর কতশত রঙের প্রেক্ষাপটে, ধীর পায়ে সন্ধেটি নামে বলেই না সেটি এত মনোরম!

আমাদের পরিবারে চারজন সদস্য। এদের মধ্যে তিনজন, অর্থাৎ দুই কন্যে এবং তাদের পিতার পায়ের তলায় সর্ষে, আর আমার পায়ের নিচে শিকড় গাঁথা। হবেই তো, আমি যে বেকার! আর বাকি তিনজন‌ই কাজের লোক। আরে না না, তারা  লোকের বাড়ি বাসনকোসন মেজে বেড়ায় না। তারা তাদের তুখোড় বুদ্ধি এবং মেধার জোরে, দেশে বিদেশে কী যেন সব কঠিন কাজকর্ম করে বেড়ায়। আদার ব্যাপারি আমি ওসব বুঝিওনে, তাই বিশেষ মাথাও ঘামাই না। কেবল জানি, এক স্যুটকেশ ময়লা জামাকাপড় নামিয়ে রেখেই তারা আর এক স্যুটকেশ ভর্তি ধোপদুরস্ত পোশাক আশাক নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। আমার কাজ কেবল ময়লা, দলাপাকানো, দামি পারফিউম-ফেল-মারা ঘেমো গন্ধে বাসিত জামাকাপড়গুলো লন্ড্রিতে পাঠিয়ে পুনরায় ধোপদুরস্ত করে রাখা, যাতে তারা পরের ফ্লাইটটি নিশ্চিন্তে এবং নির্বিঘ্নে‌ পাকড়াতে পারে।

তাদের এই আনাগোনায় কনফিউজড্ ‌পাড়া প্রতিবেশী‌। মায় বিস্কুট‌-প্রত্যাশী পথের সারমেয়কুল‌ও ঠাহর পায় না, উহারা আউন্তি‌ না যাউন্তি‌।

লন্ড্রিখানার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও আমার প্রধান কাজটি হ’ল সংসারের চাকায় তেল দেওয়া, যাতে সেটি‌ বিনা বাধায় গড়গড়িয়ে চলতে পারে। ভদ্রভাষায় ইহাকেই কহে হোমমেকার। যতই গালভরা নাম থাক, আসলে তো চব্বিশ ঘন্টার কর্মচারী! সে যে কাঁহাতক ঘুমতাড়ানিয়া‌ আর দুখজাগানিয়া, ভুক্তভোগী মাত্রের‌ই সেকথা হাড়ে হাড়ে জানা। একাধারে বাজার সরকার, রাঁধুনি, মিস্ত্রি, নার্স এবং আরো অনেক কিছুর কম্বিনেশন, মাইনাস পদগৌরব! ওই যে কারা যেন সব বলে না, গৃহবধূরা হলেন গৃহলক্ষ্মী, ওই সব‌ই  ছেঁদো কথা। আসলে ইহা একটি বিতত বিতংস। সাধু ,থুড়ি‌ সাধ্বীরা সাবধান।

তবে হ্যাঁ ,স্বীকার করা কর্তব্য, আমিও কিন্তু‌ নিপীড়িত এবং পুরোপুরি  গৃহবন্দী ন‌ই। বরং এই যুগের স্বাধীন জেনানা।

শপিং-টপিং, বন্ধুবান্ধব, মাঝে মধ্যে সিনেমা, এ বাদে ন’মাসে-ছমাসে সপরিবারে বেড়াতেও যাওয়া হয়। এবং আমার পছন্দমতো জায়গাতেই, গাড়ি করে লংড্রাইভে। মাইলের পর মাইল সুন্দর অবারিত মাঠ, সবুজ ধানখেত, পথের পাশে গুমটি চায়ের দোকানে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে দুধে ফোটানো এলাচগন্ধী চা পান, টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙে, গাছের ডালে ডাকিছে‌ দোয়েল। না, কোয়েলরা‌ অবশ্য য‌খন তখন গায় না। তাতে কী , আমার পথ চলাতেই আনন্দ! দুচোখ ভরে কৃষ্ণচূড়া ,জারুল, বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া শৈশব দেখতে‌ দেখতে‌  মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীন ছুটে যাওয়াতে যে আরাম আর আনন্দ, আকাশপথে সেসব কোথায়! ওই যন্ত্রের পাখায় ভর ক’রে, বুক ঢিপঢিপানি-সহ মেঘমুলুকের আবছা যাত্রাপথ‌ আমার ঘোরতর নাপসন্দ্।

বাড়ির লোকেদের মতে একে নাকি বলে এয়ারোফোবিয়া। সে তারা যাই বলুক না কেন, খুব ঠেকায় না পড়লে আমি বাপু ওই পথে মোটেই পা বাড়াচ্ছি‌নে, সে কথা অনেকদিন আগেই দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে রেখেছি।

কিন্তু হায়, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়!

কে না জানে, যেখানে বাঘের ভয়, ঠিক সেইখানটিতেই টুক করে সন্ধেটি নামে এবং এই অমোঘ প্রবাদবাক্যটিকে মান্যতা দিয়ে আমার‌ বেড়ানোর আনন্দটিতেও  একখানা কেঁদো বাঘ এসে তার থাবাটি বাড়িয়েই দিল!

সেদিন দোলের সন্ধ্যায় পারিবারিক জমায়েতে হুল্লোড় পার্টি চলছে। হুজুগে বাঙালি তুমুল কলরব তুললে – 

“চলো ঘুরে আসি”

 “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো, চলো। কিন্তু কোথায়? দী-পু-দা (দীঘা‌,পুরী, দার্জিলিং) নয় কিন্তু!”

“আরে না না, সে আর বলতে! কিন্তু  যাবেটা কোথায়?”

ডেস্টিনেশন আননোন। তুমুল হট্টগোল, ঐক্যমত্যে আর আসাই যায় না, সকলের‌ই সব জায়গায় ঘোরা!

শান্তস্বভাব,দলের সবচেয়ে সিনিয়ার মানুষটি মৃদুকণ্ঠে প্রস্তাব দিলেন, “শিলং পাহাড়।”

প্রথমটায় পিনপতনের নীরবতা, তারপর ধীরে ধীরে একটি দুটি করে হাত উঠতে উঠতে অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল প্রস্তাবটি।

শিলং!! সে তো আমার কাছে  স্বপ্নরাজ্য! লীলা মজুমদারের হাত ধরে,সেই কবে থেকে আমি পাকদন্ডী পথ বেয়ে হেঁটেই চলেছি, অন্তবিহীন। মন তো আহ্লাদে আটখানা!

“বাট দেয়ার ইজ এ কিন্তু!”

গৌহাটি পর্যন্ত যাওয়া যে আকাশপথে!

মনকে বল্লেম, শান্ত হও!!  

ছেলেবেলায় মায়ের মুখে হাজারবার শোনা কবিতাটা দিনরাত মন্ত্রের মতো জপতে থাকি – 

“পাঁচজনে পারে যাহা তুমিও পারিবে তাহা,

পারো কিনা পারো, করো যতন আবার, একবারে না পারিলে…”

ওরে বাবারে, শতবারের দরকার নেই, একবার‌ই কাফি হ্যায়!

অলস‌ দ্বিপ্রহরের সুখনিদ্রাটি মাথায় উঠল। মনের মধ্যে আত্মবিশ্লেষণ চলতেই থাকে।

আচ্ছা আগেও তো ছেলেবেলায়, এমন কী বিয়ের পরেও কতবার উড়োজাহাজেই ভ্রমণ করা হয়েছে, ক‌ই, তখন তো কোন‌ওদিন…তাহলে কবে থেকে! কেনই বা! তাহলে কী, সেই যে হঠাৎ মায়ের অসুখের খবর পেয়ে, একবেলার মধ্যে‌ তড়িঘড়ি প্লেনে চড়ে বসলাম, অথচ… 

অশ্রুবারি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবার আগেই উঠে পড়ি, রান্নাঘরে চলে যাই বিকেলের চা তৈরী করতে। 

আমার বেদনা গভীর গোপনেই‌ থাকুক‌, আমার‌ পবিত্র সম্পদ হয়ে। 

তাহলে বুকঢিপঢিপানির কী হবে? ধুত্তোর! 

“আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ ভাবতে অনিবার…”

অচিরেই বল গড়াতে শুরু করে দিল। জীবনের গড্ডলিকা প্রবাহে আসে জোয়ার, সেই জোয়ারে আমিও একটু একটু করে ভাসতে শুরু করে দিয়েছি।

এমনিতে দলখানা বেশ বড়ই, তার মধ্যে আবার উপদল তৈরী হয়ে গেছে। বড় ননদকে টিমলিডার করে আমাদের মহিলাদল। বছর আষ্টেকের সর্বদা ললিপপমুখে শিশুটি তার মাকে ছেড়ে যায় কোথা, তাই পুংজাতীয় হয়েও সে এই দলেই এন্ট্রি নিয়েছে।

এছাড়া আছে তরুণ দল। আর বড় নন্দাইকে লিডার বানিয়ে প্রৌঢ়দল।

ভূকম্পনের এপিসেন্টারটি তো এইখানেই, তাই ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি সব এই বাড়ি থেকেই চলছে। আমরা অবশ্য ওইসব ঝঞ্ঝাটে নেই। রোজ সকালে ব্রেকফাস্টের পর ফোনেই আমাদের জরুরী দলীয় বৈঠক বসে। ক’খানা করে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ম্যাচিং শাল নেওয়া অবশ্যকর্তব্য, দুই এক জোড়া মোজা নিলে হয়, কর্তাদের জন্য উলেন টুপিও! বিরলকেশ মাথাগুলিতে যদি ঠান্ডা লেগে যায়, ভুগতে তো হবে এই আমাদেরকেই! সাবধানের মার নেই বাবা।

সেদিন‌ও ঠিক এইভাবেই আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ ছন্দপতন!

পাশের ঘর থেকে ল্যাপটপে নিবদ্ধদৃষ্টি কনিষ্ঠ কন্যেটির কণ্ঠস্বর ভেসে এল –

“সবাইকে মনে করিয়ে দাও, নিজের আই-ডি নিতে কেউ যেন না ভোলে।”

খোশগল্পে মগ্ন আমি থমকে গিয়ে বলি, “এ্যাঁ – ও, হ্যাঁ – হ্যাঁ।”

পাশের ঘর থেকে তার বাবার বাণী – 

“তোদের মাকে বল সে-ও যেন মনে করে নিজেরটা নিয়ে নেয়।”

“আরে‌ হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো এখুনি নিচ্ছি।”

“কোথায় ? স্যুটকেশে?”

অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি বলে ফেলেছি, “হ্যাঁ, এই তো, ইয়ে, মানে…।”

ব্যস, হাসির তোড়ে গগন ফাটে।

“দেখ, সাধে কী আর বলি…”

মেজাজ গরম হয়ে ওঠে, তীব্র তেজে বলে উঠি – 

“অত বলাবলির কী আছে? আই-ডি মানে যে আধার কার্ড, টিকিটের সঙ্গে দেখাতে হয়, সে আমার বিলক্ষণ জানা আছে। হাতের কাছেই রাখা হবে।”

“জানা থাকলেই ভালো, বলা তো যায় না, কখন কিসে আটকে দেয়, হয়ত দেখা গেল বাকি সবাইকে নিয়ে প্লেন হুউউস করে উড়ে গেল, আর তোদের মা – আরে তোরা বল না কিছু, তোদেরই তো মা!”

“আটকাবে মানে? কেন আটকাবে? আমি কি সোনা পাচার করছি, না কি চোরাচালানকারী!”

“আহা সে তো আমরা তোমায় চিনি, ওরা তো আর চেনে না!”

“ঠিক আছে ,আমারটা আমি বুঝে নেব, কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না।”

“বেশ, পরে যেন কেউ দোষ না দেয়।”

তখনকার মতো অল কোয়ায়েট অন দ্য‌ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, কেবল মাঝে মাঝে খুকখুকে শব্দ, হাসি না কাশি বোঝা দায়!

পরদিন সকাল হতেই বড়দিকে ধরি। কী জানি বাবা, নতুন কোনও‌ নিয়ম‌-টিয়ম চালু হল কিনা, বড়দি তো বছরে দুবার বিদেশ যায়, ছেলেদের কাছে। নিশ্চয়‌ই সব জানবে।

সব শুনে বড়দি বলে – 

“চুক্কর তো, ফাজিলের দল সব, ভালোমানুষ পেয়ে তোকে ভয় দেখাচ্ছে। আমার ভাইটিকে কি আজ থেকে চিনি! আর শোন, অতো ভয় পেলে চলবে? এই যে প্রতিবার বিদেশ যাবার সময় ছেলেরা বলে এটা নিও না সেটা নেওয়া বারণ – শুনি নাকি! আজ পর্যন্ত আমায় পেরেছে কেউ আটকাতে!” 

বিধাতা অবশ্য সেদিন একটু মুচকি হেসেছিলেন,আমরা কেউ টেরটিও পাইনি।   

ক্রমশ নির্দিষ্ট দিনটি চলে এল। এয়ারপোর্টেই দেখা হবে সকলের। সাতসকালেই সবাই রেডি।

আমিও জরির ঘন বুটিওয়ালা জম্পেশ একখানা মুগার শাড়ির ভাঁজ  ভেঙেছি। ব্যুটিকের শাড়ি, বৌদির উপহার।

হালকা প্রসাধন সেরে ঘড়ির চেনটা কব্জিতে আঁটতে,আঁটতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, অমনি সংসারে আমার একমাত্র সহমর্মী কমলাদি কোথা থেকে উদয় হয়ে কপালে একখানা দ‌ইয়ের ফোঁটা পরিয়ে দিয়েছে। থতমত খেয়ে সম্বিত ফিরতেই দেখি বাকিরা হেসে লুটোপুটি।

কমলাদি অবশ্য মোটেও ঘাবড়ানোর পাত্রী নয়। তেড়েফুঁড়ে উঠে বললে‌ – 

“অত হাসাহাসির কী আচে, দ‌ই খুব শুভ। এই যে আমার নাতনী ছেঁড়াবস্তি(শ্রাবস্তী) মাধ্যমিক দিল, পরীক্ষা দিতে যাবার আগে রোজ দ‌ইয়ের ফোঁটা দিয়ে দিতুম, কেমন টক্ করে পাশ তো করে গেল!”

“মা কি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে নাকি!”

“ওই হল। এই ক’দিন মাকে তো কম হেনস্তা হতে হচ্ছে না বাপু! সব‌ই আমার নজরে আসে।”

এই না বলে সুর করে একটি ছড়া আওড়াতে  শুরু করে‌ দিল – 

    ” আলাইপানি,ঝালাইপানি

       আমি একখান্ মন্তর জানি।

       পুব-পশ্চিম, উত্তরপাড়া

        দখিনদিকেও নিমঝাড়া,

         দিয়ে দিলাম,বুঝে নাও

        আপদ-বালাই তফাৎ যাও,

          ফুঃ ফুঃ,ফুঃ…”

তারপর আঁচলের খুঁটে বাঁধা পুজোর ফুল কপালে ঠেকিয়ে বললে – 

“নাও গো বেইরে পড়ো সবাই, ও বৌদি পেলেনখানা তো এদিক দে-ই যাবে, জানলা দে এট্টুসখানি হাত নেড়ে দিও, পেলেনের আওয়াজ পেলেই আমি লাল গামছা নিয়ে ছাদে ডাঁইরে থাকব।” 

কমলাদি চলে গেল। আমরাও র‌ওনা দিলাম। 

আশ্চর্য! মন্তরখানা শুনে এবারে কেউ তো হাসল না!

সময়ের অনেক আগেই এয়ারপোর্টে হাজির সবাই, আনন্দের ভাঁড়ারে একটুও যেন কম না পড়ে।

সব ফর্মালিটিস চুকিয়ে ফাঁকা চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসেছে‌ সবাই। ফ্লাইটের অনেক দেরি। কেউ বুঝি বা একটু চা-পানের ইচ্ছে‌ প্রকাশ‌ করেছিল, বড়দি এক ‌ধমকে থামিয়ে দিয়েছে।

“এয়ারপোর্টে‌ চা! বলি, পয়সা কি সস্তা‌ হয়েছে? চুপ করে বোসো সবাই, গলা ভেজানোর বন্দো‌বস্ত আমি করেই‌ এসেছি। সিকিউরিটি চেকিংটা সেরে ওপাশে চল, তখন সব হবে।”

“মানে?”

“সে আছে সারপ্রাইজ‌,” মুচকি হেসে কাঁধে ঝোলানো ঢাউস ব্যাগটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন বড়দি।‌

সিকিউরিটি চেকিং এর জন্য লাইন পড়তে শুরু করে দিয়েছে। বড়দি সবেতেই ফার্ষ্ট‌, লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। বাকিরাও ইতিউতি ঢুকে পড়ল, আমিও দেখাদেখি জায়গা ম্যানেজ করে নিলাম‌। কী যেন মন্ত্রটা, আলাইপানি, ঝালাইপানি – ধুত্তোর! লাইন এগোচ্ছে।

কাছাকাছি চলে এসেছি,  আচমকাই নজর গেল, বড়দি নির্বিঘ্নে বৈতরণী পেরিয়ে ওপাশে চলে গেছে ঠিকই কিন্তু সিকিউরিটির জালে ধরা পড়েছে।

বড়দির সেই রহস্যময় ঢা‌উস ব্যাগখানা এবং তার অভ্যন্তরস্থ ডজনদুয়েক ছোট ছোট ফ্রুট জ্যু‌‌সের টেট্রাপ্যাক সরিয়ে রাখা হয়েছে পাশের টেবিলে, ঐ যেখানে সারি দিয়ে‌ ‘জার্মান সোলজারসম’ জনা তিনেক হুমদোমুখো সেপাই বসে থাকে। মনে হল জিজ্ঞাসাবাদ‌ও‌ চলছে‌! তবে কিনা বড়দি‌ও কম লড়াকু নয়, দুর্বোধ্য হিন্দিতে সেই ছেলেবেলায় দেবসাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে পড়া  ‘কেটলি-পিসির’ মতো লড়ে যাচ্ছে‌। জয় মা!!

এদিকে আমার টার্ন এসে গেছে। এখন আর আমার একটুও  ভয় করছে না, আমার কাছে তো কিচ্ছুটি নেই। ধরবেটা কী! ফুরফুরে মেজাজে “নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়” জপতে জপতে সোজা গিয়ে ঐ কাঠের পিঁড়েতে, যিশুখৃষ্টে‌র ভঙ্গিমায় দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। সামনে অধিষ্ঠিত‌ অশোকবনের চেড়ি-সম দিদিমণিটি মেশিন বাগিয়ে এসে ক্যাজুয়ালি শাড়ির গায়ে ঠেকাতেই,

কেলোর কীর্তি। মেশিন তো তারস্বরে আর্তনাদ জুড়ে দিয়েছেন। চেড়ি দিদিমণি এবং আমি যুগপৎ হতভম্ব। খানিক সামলে নিয়ে দিদিমণি আবার এগিয়ে এলেন, একই রেজাল্ট। দুবার, তিনবার, চারবার, নো চেঞ্জ। ভদ্রলোকের সেই এক কথা।

এবার শুরু প্রশ্নোত্তরে পালা।

“কোমরে কোন‌ও কবজ, তাবিজ?”

 “না না।”

“রিসেন্টলি হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলেন?”

“না।”

“আগে পেটে কোন‌ও অপারেশন?”

“না।” 

“তাহলে?”

“তাহলে?”

দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুখে দুখী – উনি কিছু ধরতে পারছেন না বলে, আর আমি ছাড়া পাচ্ছি না বলে।

হঠাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেড়িদি আমাকে “ইধার‌ই রহো” বলে ঘর ছেড়ে গটগটিয়ে‌ বেরিয়ে গেলেন। ফেরেন আর না। কী ব্যাপার! মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে গেলেন নাকি!

এদিকে আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে, সত্যিই তো! ব্যাপারখানা কী! আমি তো জানি আমার কাছে  আপত্তিজনক কিছুই  নেই। এই তো দিব্যি সেজেগুজে নতুন শাড়িখানা‌ পাট ভেঙে পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম, এর মধ্যে বিমানবন্দরের মেশিন এত কান্নাকাটি করার কী খুঁঁজে পেল! 

ভাবতে ভাবতে আচমকাই মগজে আলোর উদ্ভাস। কুলকুল করে হাসির স্রোত ব‌ইতে শুরু করেছে।ঈশ্ কেন আগে মাথায় আসেনি…

ঠিক তখুনি একজন বড়দিমণিকে সঙ্গে নিয়ে চেড়িদি ফিরে এলেন।

আবার সেই এক‌ই প্রসিডিওর, কেউ কিচ্ছুই বোঝে না। প্রথমে ভেবেছিলাম চুপটি করেই থাকি, দেখাই যাক না কার দৌড় কদ্দুর! তারপর শুভবুদ্ধি মাথাচাড়া দিল। নাঃ, সময় অতি মূল্যবান বস্তু। অবশেষে আমাকেই ময়দানে নামতে হল।

পুরনো দিনের চলচ্চিত্রের নায়িকারা ঠিক যেমন ভঙ্গিতে আঁচলের খুঁটটি ধরে গান গাইতে গাইতে পাহাড় বেয়ে নেমে আসতেন, সেইভাবেই হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “এইবারে দেখ তো!”

হাওয়ায় ওড়া আঁচলে মেশিন ঠেকাতেই, আবার, আবার সেই কামান গর্জন। প্রথমে‌ হকচকিয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই ব্যাপারখানা বুঝে গেলেন তাঁরা।

একগাল হেসে বললেন, “কী আশ্চর্য, এ যে একেবারে খাঁটি জরি! এতে মেটাল আছে!”

“তাই তো মনে হয়। আচ্ছা, এবারে আর অসুবিধে নেই তো? আসি তাহলে?”

“শিয়োর, শিয়োর, ইয়ে, জাস্ট এ মিনিট, কোন দোকান থেকে  শাড়িটা কিনেছ একটু বলবে প্লিজ? না, মানে আমার মেয়ের জন্য একটা কিনতাম। বিয়ে করে কত দূরে যে চলে গেল মেয়েটা, কতদিন দেখি না, আসতেও পারে না আজকাল, বড্ড মনকেমন করে।”

অবাক হয়ে চেয়ে দেখি, কোথায় চেড়িদির সেই কঠিন কঠোর কর্তব্যপরায়ণ মুখ! তার বদলে এখন তার মুখশ্রীতে কেমন কোমল মাতৃত্বের মায়া।

বেরিয়ে এসে পুরো টিমের গার্ড অব অনার জুটল, মাইনাস টু। 

এয়ারপোর্টের সিলিং-এ বিচিত্রছাঁদের বাংলা স্বরবর্ণের অলঙ্করণে কনফিউজড মিঃ ললিপপ, আর দ্বিতীয়জন হলেন কন্যাদের পিতা। তিনি বোধহয় ভাবছিলেন, কোন‌ওকালেই তো তিনি তাঁর বাড়ির নাম “কিংকর্তব্যবিমূঢ়” রাখেননি, তাহলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কী করে! আসলে বুঝতে পারেননি, এটি হচ্ছে আমায় সারাক্ষণ অকারণে হেনস্তা করার ফল। ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতেই হয়, বিধির বিধান।

চেয়ারে আরাম করে বসে, বড়দির বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়া, এবং জোরালো স‌ওয়ালে পুনরুদ্ধারপ্রাপ্ত ফ্রুটজ্যুসে গলা ভিজিয়ে নেওয়া গেল। 

“ইধার‌ই বৈঠ করকে সবাই মিলে গলা ভিজানকে লিয়ে লায়া থা, ইয়ে হ্যায় তেষ্টার জল, ইসকো

আটকাতা! ঘর মে মা নেহি হ্যায়?” 

শুনেই তারা তড়িঘড়ি সব ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে! 

বড়দি অবশ্য তাদের‌ও অফার করেছিলেন, তারা নেয়নি।

পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে দিতে ফ্লাইটের  সময় হয়ে এল।

প্লেন ঠিকসময়েই টেক অফ করেছে। বড়কন্যে‌ পাশটিতে ঘনিয়ে এল – 

“আচ্ছা মা, ঐ ভদ্রমহিলা সত্যিই‌ তোমার কাছে শাড়ির দোকানের নাম জানতে চাইলেন! না মানে অন ডিউটি ছিলেন তো!”

“হ্যাঁ‌ রে, মজাটা কী জানিস, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে তিনি যে আবার মা হয়ে উঠেছিলেন, মায়ের বসবাস হৃদয়পুরে, কখন‌ও হারায় না।”

কথাক’টা বলে নিজেই চমকে গেলাম, আশ্চর্য! এতকাল নিজেই  ভুলে বসেছিলাম যে!

মেয়েরাও কি মাকে ভোলে! ঐ দূরদেশবাসিনী কন্যেটির‌ও কি মনখারাপ হয় না! 

“দূর বিদেশের কেতকীফুল, হয়ত এখন ফুটে আকুল…” 

আমরা দ্রুত এগিয়ে চলছিলাম গন্তব্যের দিকে।

বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি টাউনশিপ, কলকাতা ৯৪

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • সংহিতা কর , April 17, 2023 @ 1:32 pm

    খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *