কেল্লাফতে

কেল্লাফতে

মেহরানগড় কেল্লা

“এর পরে আরও এক প্রস্তর সিঁড়ি চড়তে হবে নাকি?”
বড় বড় হাঁপ ছাড়ছিলাম আমি। পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও এই খাড়াই সিঁড়ি চড়া যে মুখের কথা নয়, সে যারা চড়েছে তারা জানে। গত পাঁচ দিন ধরে কেল্লা ফাতেহ করতে গিয়ে হাঁটু দু’টো প্রায় ক্ষয়ে যাওয়ার মতোই অবস্থা। মাঝে মাঝে একটু থেমে দম নিতে হচ্ছে।

অভি, মানে আমার বর ইশারায় বুঝিয়ে দিল আর‌ও অনেক সিঁড়ি চড়া বাকি।

এইরকম খাড়াই সিঁড়ি তৈরি করার কি কোনও মানে আছে? ওদের তো বোঝা উচিত ছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে পাহাড় কেটে যে বিশাল আকারের কেল্লা বানিয়েছিল, সেটা একসময় ভ্রমণপিপাসু মানুষদের জন্যে অন্যতম মূল আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হবে।

মহারাজ রাও যোধা কিংবা তাঁর পরিবারের মানুষেরা ডুলি, পালকি বা হাতির পিঠে চেপে ওঠা-নামা করতেন, রাজ-রাজাদের ব্যাপার আর কী! কিন্তু আমাদের মতো পর্যটকেরা সেটা পাবো কোত্থেকে? নিদেনপক্ষে সিঁড়ির উচ্চতা কিছুটা কম থাকলে শারীরিক ধকলটাও কিছুটা কম হত। যদিও‌ ওপরে ওঠার একটা একতরফা লিফট অবশ্য ছিল, যা ওপর পর্যন্ত নিয়ে ছেড়ে দেবে। তারপর পুরো কেল্লা দেখতে দেখতে সে-ই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হবে। কিন্তু সেই লিফটের সামনে ভিড় আর লম্বা লাইন পড়েছিল দেখে ওদিকটায় আর যাইনি আমরা।

এখানে এসে একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম যে কেল্লা থেকে শুরু করে সাধারণ রেস্তোরাঁ, দোকান কিংবা হোটেল, সব জায়গাতেই সিঁড়ির উচ্চতা আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে অনেকটাই বেশি। বলা বাহুল্য রাজপুত রাঠোর সম্প্রদায়ের মানুষজন ভেতো বাঙালিদের থেকে শারীরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। সিঁড়ি দেখলেই বোঝা যায় যে এসব অঞ্চলে বাতের রুগী নির্ঘাত কম।

কেল্লায় প্রবেশের মুখ

কেল্লায় ঢোকার মুখটা সরু, পাথরের রাস্তাটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। দুর্গের মোট ফটক সংখ্যা সাতটি। তার মধ্যে মূল ফটকটি হল ‘জয় পোল’। ১৮০৬ সালে জয়পুর এবং বিকানের-এর‌ সৈন্যবাহনীকে হারিয়ে মহারাজ মান সিং এই ফটকটি তৈরি করেন। তাই ওই নাম। আমরা ‘জয় পোল’ দিয়ে ঢুকে সামনের পাথুরে রাস্তাটায় পড়লাম। এক লহমায় চোখ জুড়িয়ে গেল। কী অসাধারণ আর্কিটেকচার। কেল্লার গায়ে লেগে থাকা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। সেই ওঠা শুরু। যত ওপরে উঠেছি দৃশ্য ততই মধুর হয়েছে। এক-একটা তলায় পৌঁছিয়ে যখন নীচের শহরের দিকে চোখ যাচ্ছিল নিজেকে যেন শঙ্খচিল মনে হচ্ছিল। একদিকে গোটা নীল শহরটার একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে পাচ্ছিলাম আর অন্যদিকে সুবিস্তৃত পাহাড়ের ঢাল দূরে আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে। কেল্লার পাথরের গায়ের ওপর খোদাই করা অসাধারণ কাজ মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে যখন পাথর কাটার কোনো যন্ত্র ছিল না তখন কয়েক হাজার শ্রমিক মিলে ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে পাথর কেটে এই বিশাল দুর্গ এবং দুর্গের দেওয়ালে নিখুঁত কারুকার্য রচনা করে গেছে। ওদের শরীরে নির্ঘাত ঈশ্বর বাস করতেন। এত সুন্দর নিখুঁত কাজ করা‌ কি মানুষের পক্ষে সম্ভব?

কেল্লার উঁচুতে

কেল্লার এক-একটা কক্ষ যেন এক-একটা চেম্বার অফ সিক্রেট। কতই না রহস্য লুকিয়ে রয়েছে কেল্লার দেওয়ালে। রাজা-রানিদের পোশাক-আশাক, ব্যবহৃত সামগ্রী (চিরুনি থেকে তলোয়ার পর্যন্ত), রান্নার বাসন, আসবাবপত্র, আরও কত কী কাচের বাক্সে বন্দি করে সাজিয়ে রাখা। অন্তত দশ-বারো রকমের পালকি দেখলাম, যেগুলোতে চড়ে রাজা-রানিরা দুর্গে যাতায়াত করতেন। প্রত্যেকের ওপরে ইংরেজি আর হিন্দি হরফে লেখা বিবরণ।

১২২ মিটার ওপরে পাহাড় কেটে বানানো যোধপুরের মেহারান গড় কেল্লা দেখতে একটা সকাল লেগে যায়। সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। ১২০ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মেহারান গড় কেল্লাটি রাজস্থান তথা ভারতবর্ষের

পালকি

অন্যতম সেরা কেল্লা। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ রাও যোধা মান্দৌর থেকে তাঁর রাজধানী এই পাথুরে-পাহাড়ে স্থানান্তর করেন। এই কেল্লার ভিত্তি স্থাপন হয় সেই বছরেই। তারপর অনেকবার কেল্লাটি মুঘল আর রাঠোরদের মধ্যে হাতবদল হয়।

আঠারোশো শতকে মহারাজা অজিত সিং মুঘলদের হারিয়ে কেল্লাটিতে নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং দুর্গের সংস্কার করেন। তিনি নতুন একটি প্রবেশদ্বারও তৈরি করেন, যার নাম দেন, ‘ফাতেহ পোল’।

শিশমহলটি রাজা অজিত সিংয়ের ব্যক্তিগত কক্ষ ছিল। ছোট ছোট কাচ আর আয়না বসিয়ে কক্ষটি এত সুন্দর সাজানো যে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিলাম। দেওয়ালে মহাভারত ও পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্র রাখা আছে।

এছাড়া আছে ঝাঁকি-মহল। এর বৈশিষ্ট হল জালি-জানলা। মহারাজা তাখত সিং রানি এবং রাজকন্যাদের জন্য এই কক্ষটি বানিয়েছিলেন। ছোট জালি-জানলা দিয়ে মহিলারা নীচের উঠোনের কাজকর্ম দেখতে পেতেন। কিন্তু রানি বা রাজকন্যাদের কিন্তু নীচ থেকে দেখা যেত না।

আরও নানা রকমের কক্ষ এবং গ্যালারি আছে এখানে। হাতি হাওদা (হাতির পিঠে বসার রুপোর তৈরি আসন), দৌলত খানা, পাগড়ি গ্যালারি (রাজপুতদের মাথায় জড়ানো কাপড় বা উষ্ণীব), পেইন্টিং গ্যালারি, টেক্সটাইল গ্যালারি, পালকি গ্যালারি, দোলনা গ্যালারি ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। এদের মধ্যে পালকির গ্যালারিটা আমার সবথেকে সুন্দর লেগেছিল। আমাদের সমগ্র রাজস্থান সফরের সেরা আকর্ষণ ছিল এই কেল্লা। আমরা যেদিন যোধপুর এসেছিলাম সেদিনই মেহরন গড় কেল্লাকে রাতের আকাশে, হোটেলের ছাদ থেকে দেখেছিলাম জ্বলজ্বল করতে। যোধপুরের মোটামুটি সব বাড়ির ছাদ থেকেই দেখা যায় এই সুবিশাল দুর্গটি।

কেল্লার মহল

কেল্লা দেখে বেরিয়েই আমাদের আদরের একমাত্র বিচ্চু কন্যাটি নানারকম বায়না শুরু করল। চিপস, আইসক্রিম, চকলেট – বাচ্চাদের দৌড় ওই পর্যন্তই। বুঝলাম ওর খিদে পেয়েছে। শারীরিক পরিশ্রম যা হয়েছে খিদে পাওয়া স্বাভাবিক। আমাদের পেটেও তখন বেসুরো বাজনা বাজছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার দাদাকে বললাম, ভালো নন-ভেজ রেস্তোরায় নিয়ে যেতে। ‘ইন্ডিক’ (Indique) নামটা আমরা আগের দিনই হোটেলের ম্যানেজারের মুখে শুনেছিলাম। ড্রাইভারও দেখলাম ওখানেই নিয়ে গেল আমাদের।

রাজস্থানি কারুকার্য করা লাল রঙের বিশাল গেট। গেটের ভেতর ঢুকতেই পেয়াদার মতো পোশাক পরা পাগড়িধারি একজন ভদ্রলোক আমাদের বেশ রাজকীয় কায়দায় সেলাম ঠুকল। ‘ইন্ডিক’ রেস্তরাঁটা কোনদিকে জানতে চাওয়ায় একটা লিফট দেখিয়ে বলল, “থার্ড ফ্লোর।” লিফটটা দেখলাম দু’দিকে খোলা যায়। যে দিকটা দিয়ে লিফটে উঠেছিলাম তার উলটোদিক থেকে বেরোতে হল।

আয়তনে বিশাল বড় না হলেও, সুন্দর গোছানো পরিপাটি রেস্টুরেন্ট। সামনের খোলা জানলা দিয়ে দেখা যায় বিশালাকার মেহারান গড় কেল্লা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আজও নিজের মর্যাদা রক্ষা করে চলেছে। একটা দিক খোলা ছাদের নীচে, আর অন্য দিকটা এসি ঘর। আমরা এসি’তেই গিয়ে বসলাম কারণ বেশ গরম লাগছিল।

পেটে অসম্ভব খিদে তখন। মেনু কার্ড পড়ার মতো ধৈর্য নেই কারোর। অভি বেশ রয়াল চালে ওয়েটারকে ডেকে শুধোল, “নন ভেজ মে কেয়া খানা আচ্ছা হোগা?”

লোকটি সাত-আট রকম খাবারের নাম আওড়ে গেল, আমরা তার মধ্যে থেকেই কয়েকটি বেছে অর্ডার করলাম। মাটন গলৌটি কাবাব, লাল মাস আর পরাঠা। ডেজার্ট এ ব্রাউনি উইথ ভ্যানিলা আইস ক্রিম। অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার কর্মচারীদের। আর স্বাদের ব্যাপারেও পাঁচে পাঁচ। এর আগে জয়পুরে রাজস্থানি খাবারের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছিল। কিন্তু এখানকার খাবারের স্বাদ অসাধারণ। হয়তো পরিবেশটা এতটাই মনোরম যে খাবারের স্বাদে তার প্রভাব পড়েছে। আমরা পেট পুরে খেয়ে আবার রাতে ডিনার করতে এসেছিলাম ওই একই জায়গায়। রাতে মাটন বিরিয়ানি, চিকেন রেশমি কাবাব, মাটন কষা আর মেথি রুটি খেয়েছিলাম। সঙ্গে পানীয়।

যোধপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে পাঁচ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই দুর্গ অন্যতম সেরা আকর্ষণ, সে তো আগেই বলেছি। শুনেছিলাম, মেহরন গড় কেল্লা থেকে নাকি দারুণ সূর্যাস্ত দেখা যায়। আমরা সকালের দিকে গেছিলাম বলে সূর্যাস্ত দেখা সম্ভব হয়নি। পরে যদি আবার কখনো বেলে পাথরের তৈরি এই সুবিশাল দুর্গে যাওয়ার সুযোগ পাই, নিশ্চয়ই সূর্যাস্ত দেখব।    

 

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Avijit Arinda , April 17, 2024 @ 4:12 pm

    Beautifully written. Felt like I was present in Meherangarh while reading it. Keep up the good writing.

  • Lopamudra dasgupta , April 23, 2024 @ 5:13 pm

    তোর লেখার পাল্কী চড়ে আর একবার ঘুরে এলাম ।স্মৃতি রোমন্থন হয়ে গেলো। বাকি ভ্রমণের লিপি কথন পাবার আশায় রইলাম বোন। বড় ভালো লিখেছিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *