এল যে শীতের বেলা
শীতের বেলা ফুরিয়ে এলে আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা উঁকি দেয়, সেই ক্ষণে মনে ভাসে রবিঠাকুরের কবিতার লাইন –
আসন আপন হাতে,
পেতে রেখো আঙিনাতে,
যে সাথী আসিবে রাতে,
তাহারই তরে…
অপরিণত বয়সে মনে প্রশ্ন জাগত, কোন সাথীর কথা তিনি বলেছিলেন, যিনি শীতের হিমেল রাতে আসবেন আমারই আঙিনায় আসন গ্রহণ করতে!
আজ মনে হয়, সে বুঝি বা আমার সঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা আমারই দ্বিতীয় সত্ত্বা।
কর্ম অন্তে, সন্ধ্যাবেলা ক্লান্ত গৃহস্থ, নিরালা অবসরে যেমন সারাদিনের লাভ লোকসানের হিসেব নিকেশ সেরে ফেলতে চায়, এ-ও বুঝি বা সেইরকমই। নিজের সঙ্গে নিজের একরকমের বোঝাপড়ার ইঙ্গিত। অস্তরবির ছবির সঙ্গে স্মৃতির দর্পণে ফুটে ওঠা সকালবেলার আমিকে মিলিয়ে দেখবার আয়োজন!
কী পেলাম, আর কতটুকু পাওয়া হল না, সেই হিসেবের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে দেখি, যতটুকু দিয়েছি, নিজেরই অজান্তে এই জীবনে পাওয়া হয়ে গেছে তার চেয়ে ঢের গুণ বেশি।
নিঝুম রাতে আজকাল অনবরত মনে ভেসে আসে ছেলেবেলার দিন, ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চার মতো ঘ্যানঘ্যানে, নাছোড়বান্দা! এখনকার কোনও কিছুতেই মন ওঠে না যেন।
এই যেমন, ইদানীং ঘরের ফুলদানিতে গুটিকতক চন্দ্রমল্লিকার শোভা মনের মধ্যে ভাসিয়ে আনে রাশি রাশি ফুলের অনির্বচনীয় সম্ভার। মনশ্চক্ষুতে ভেসে আসে বিশাল এক পুষ্পকানন, যেখানে সারি সারি গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, অ্যাস্টার, জিনিয়ার অতুলনীয় শোভা। আসলে সেটি হল আমার শৈশবে দেখা ফুলক্ষেতের ছবি। অভিজ্ঞ মালিদের সতর্ক পরিচর্যায় ফুলচাষ হত সেখানে।
তোড়ায় বাঁধা ফুলগুলি সে শোভা পাবে কোথায়!
আমার বাবার রেলওয়ের বদলির চাকরির সুবাদে সেবার আমরা গিয়ে পড়লাম বাংলা বিহারের সীমান্তবর্তী শহর কারমাটারে। হ্যাঁ, সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুণ্যপদধূলিধন্য কারমাটারই বটে।
সেই অনেক ছোট বয়সে স্থানমাহাত্ম্য বোঝবার বা উপলব্ধি করার বোধবুদ্ধিও হয়নি বিশেষ। শুধু দেখতাম, আমরা যেখানে থাকি, সেটি হল রুক্ষ লালচে ধরনের, ধুলোমাখা, ছোট্ট একটি নিরিবিলি শহর, যেখানে বাঙালি, বিহারী, সাঁওতালসহ ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষজনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আর পাঁচটা সাধারণ ছোট শহরের মতোই, সেখানেও ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে নানা ধরনের মানুষজনের বসবাস।
তার মধ্যে রেল কোম্পানির বাবু সাহেবরা একটু স্পেশাল খাতির পায়।
কেন? ছেলেবেলায় সে খবর কে রাখে! পরে বুঝেছি, মাড়বার বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী, এবং স্থানীয় বাঙালি দোকানদার শ্রেণীর মানুষজনদের মালপত্র, আমদানি-রপ্তানির কাজে রেলপথই তখন একমাত্র ভরসা। যদিও তার জন্য সংশ্লিষ্ট রেলকর্মচারীদের আলাদা করে খাতিরদারি করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। নির্দিষ্ট মাশুল গুণেই তাঁরা রেলকোম্পানির সার্ভিস পাবার অধিকারী। তবু বোধহয় সেইসব মানুষদের নিজস্ব সৌজন্যবোধই এর একমাত্র কারণ। হয়তো বা চাকরিসূত্রে বদলি হয়ে আসা সরকারি কর্মচারীদের অতিথির সম্মান দেওয়াটা নিজেদের কর্তব্য মনে করতেন তাঁরা।
এঁরা ছাড়াও ছিলেন বিহারের ভূমিপুত্রসহ সাঁওতাল গোষ্ঠীর মানুষজন।
সাঁওতালরা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে, নিজেদের মতো করেই বাঁচতেন। আলগা শহুরে খাতিরদারির পরোয়া তাঁরা করতেন না। তবে কিনা কাউকে মনে ধরলে, অকৃত্রিম এবং অকুণ্ঠ ভালোবাসা বিলোতেও মোটেই পিছপা হতেন না সহজসরল মানুষগুলি।
এছাড়াও বেশ কিছু স্থায়ী বাঙালি মানুষজনের বসবাস ছিল সেই শহরে। তাঁরা কে কবে কোথা থেকে এসে ওই জায়গায় বসবাস শুরু করেন, সে খবরে কারও মাথাব্যথা ছিল না! কে ভূমিপুত্র আর কে নয়, সেইসব চিন্তা ভাবনা না করে সবাই পাশাপাশি দিব্যি সুখেই দিন কাটাতেন।
আর এক শ্রেণীর মানুষজন ছিলেন অনেকটা শীতের পরিযায়ী পাখিদের মতো। তাঁরা মূলতঃ শহর কলকাতা থেকে আসতেন, বায়ুপরিবর্তনে।
সেকালে শীতের ছুটিতে স্বাস্থ্যকর জলবাতাসে হাওয়াবদলের একটি অভ্যাস, বিশেষ করে বাঙালি স্বভাবের অন্তর্গত ছিল। সেইসময়ে ক’টা মাস পথে ঘাটে অনেক অচেনা মুখের দেখা মিলত। সেজেগুজে রাস্তায় বেড়াতে বের হতেন তাঁরা। তাঁদের বাড়িতে কাজকর্ম করার জন্য লোকজনের প্রয়োজন পড়ত। এছাড়া হেথা হোথা যাওয়া আসা করতে, ঘোড়ায়টানা টাঙাগাড়ির দরকার। ফলে স্থানীয় গরীব মানুষরা সেইসময়ে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেতেন। ছোট শহরের নিস্তরঙ্গ জীবনে তখন নব জোয়ার আসত।
এবারে শুরুতেই যে ফুল চাষের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই কথায় আসি।
ছোট্ট শহরের জনবসতি ছাড়িয়ে একটু দূরে, দেখা পাওয়া যেত সেইসব ফুল ক্ষেতের। ছুটির দিনে বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে যেতেন ফুল দেখাতে। চোখের সামনে দেখতে পেতাম দিনে দিনে ছোট্ট চারাগাছগুলির ক্রমশ বড়ো হয়ে ওঠা, কুঁড়ি ধরা, অবশেষে সেই কুঁড়ির পরিপূর্ণ প্রস্ফুটন। মাইলের পর মাইল জুড়ে সেইসব ক্ষেতের সযত্নলালিত, তরতাজা ফুলের শোভা আজও চোখে লেগে আছে বলেই বোধহয় তোড়ায় বাঁধা, রিবনবাঁধা কেতাদুরস্ত পুষ্পস্তবকে মন ভরল না আর কোনও দিন। সেইসব ক্ষেতের ফুল নিয়মিত ট্রেনে করে চালান হয়ে আসত কলকাতার নিউমার্কেটের ফুলের দোকানে। আসলে তাঁরাই ছিলেন মহানগরীর চাহিদা মেটানো ফুলের জোগানদার।
এইখানেই বলে রাখা যাক, ছোট্ট চারাগাছগুলি সামান্য একটু বড়ো হলেই অভিজ্ঞ মালিরা ঠিক বুঝে ফেলতেন কোন গাছের কোন ফুল নিখুঁত ভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে। সামান্যতম ঘাটতির সম্ভাবনা আঁচ করতে পারলেই, সেইসব চারাগাছগুলি তুলে ফেলে দেওয়া হত।
কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক হলেও না বলে পারছি না, ওইসব উপড়ে ফেলা চারাগাছ সংগ্রহ করে এনে বাবা আমাদের বাড়ির টবে লাগিয়ে দিতেন। ফলে যথাসময়ে আমাদের বাড়ির পেল্লায় উঠোনখানা ফুলের শোভায় একেবারে আলো হয়ে থাকত। পুরো ব্যাপারটা আমাদের চোখের সামনে ঘটত বলেই বোধহয় ওই ছোট্ট বয়সে, টবের গাছগুলি হাতের নাগালে পাওয়া সত্ত্বেও ফুল ছেঁড়ার বাসনা হয়নি কোনওদিন। টব বাঁচিয়েই উঠোনে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে শিখে গিয়েছিলাম আমরা।
ফুলক্ষেতের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটার ওধারে ছিল অনেকটা জমির মাঝ-মধ্যিখানে, ছোট্ট, সাদা ধবধবে, ছিমছাম একখানা গির্জা। সেই গির্জার প্রশস্ত বাগানেও কত যে ফুলের মেলা। শীতসকালে রঙিন কাচের জানলার মধ্যে দিয়ে আসা গির্জার মেঝেয় রোদের রঙিন আলপনা, আর যিশুমূর্তির পাদদেশে অজস্র ফুলের সাজ – আজও মনের মাঝে আঁকা। শহুরে জীবনে ফুলদানির ফুলের অনুষঙ্গ যে কেবলই ঠেলে দেবে স্মৃতির রাঙামাটির শহরে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
সেই ছোট্ট শহরটিতে হাটবাজার বলতে তেমন বড়সড় কিছু ছিল না, তবে প্রতি বৃহস্পতিবার রেললাইনের ওপারে হাট বসত। ওইদিন দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে তরিতরকারি, মাছের পাশাপাশি অন্যান্য নানাবিধ পসরা নিয়ে ব্যাপারিরা হাটে আসতেন। আমার কাছে সেই হাটের একমাত্র আকর্ষণ ছিল সাঁওতালদের হাতে তৈরি করা লোহার ছোট ছোট খেলনা-বাটি।
ওইসব চমৎকার ছোট্ট ছোট্ট হাতা,খুন্তি, কড়াই-এর সম্ভারে আমার খেলাঘরটি সবসময় পরিপূর্ণ থাকত। শুধু অভাব ছিল একখানা উনুনের। তা সেই অভাবটি অবশ্য আগে টের পাইনি, যতদিন না কলকাতা থেকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা বড়পিসিমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন! সেই অভাবটি অবশ্য চটজলদি মিটিয়েও দিলেন তিনি।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাগান থেকে মাটি সংগ্রহ করে সারা দুপুর ধরে উনুন, শিলনোড়া, এমনকি একখানা রাঁধুনির অ্যাসিসটেন্ট বানিয়ে রোদে শুকোতে দিলেন। ভালো করে শুকিয়ে গেলে বাগানের এককোণে শুকনো পাতায় আগুন দিয়ে যাবতীয় মৃৎসম্ভার পুড়িয়ে পোক্ত করে আমার হাতে তুলে দিলেন তিনি। আজকের দিনের বহুবিধ দামী খেলনা-বাটির আসরে সেগুলি হয়তো বা দরিদ্র, কুণ্ঠিত গৃহবধূর মতো ঠেকবে। কিন্তু আমার কাছে সেই সম্পদ অমূল্য, তুলনারহিত।
জীবনভর তো কতো উচ্চমানের মড্যুলার কিচেনে রান্নাবান্না করা হল, তবু এখনও সেটি আমার মনে ‘সাত রাজার ধন এক মানিক’ হয়ে রয়ে গিয়েছে।
“দিবসে সে ধন হারায়েছি ,
…আমি পেয়েছি আঁধার রাতে”
সেই সময়ের মানুষজনরা বুঝি এইভাবেই আগলে রাখতেন শিশুদের, তাদের মনের মধ্যে বপন করে দিতেন সৃজনশীলতার বীজ। সেই শিক্ষার সম্পদ আজও বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে বেড়াই।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসস্থানটিও দেখা হয়েছিল বৈকি। আবছা হলেও মনে ছবি আসে, এক শীতের অপরাহ্ণে বাবা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সামনে বেশ বড়সড় খালি জমির মাঝমধ্যিখানে নির্জন ছোট্ট একখানি একতলা বাড়ি। সেই নিঝুম অপরাহ্ণে কেউ কোথ্থাও নেই। চোরকাঁটার মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা পথের ইশারা। বাড়ির পিছন দিয়ে সেটি কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে, হয়ত বা সাঁওতাল গ্রামে!
শীতের বেলা চট করে পড়ে আসছিল। আমরা দু-তিনধাপ উঁচু রোয়াকে গিয়ে উঠলাম। যতদূর মনে পড়ে লম্বা রোয়াকের দুপাশে দুটি উঁচু সিমেন্টের বেঞ্চি, সামনে বন্ধ কাঠের দরজা, পাশের বন্ধ কাচের সার্সির আড়াল থেকে আবছা আলোয় শূন্য ঘরের আভাস।
গোধূলির আলো ম্লান করে তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছিল। একটু পরেই শিশিরে স্নান করিয়ে আঁচলের আড়ালে ঢেকে নেবে সেই পুণ্যস্থান – ছেলেবেলার এইটুকু স্মৃতিই আজ আমার সম্বল।
বড় হয়ে শুনেছি, আদতে বাড়িটি নাকি কোনও এক মেমসাহেবের ছিল। বিদ্যাসাগর তাঁর কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন।
হঠাৎ মনে হল, আজকাল তো নেট দুনিয়ায় সব কিছুই হাতের মুঠোয়, একবার খুলে দেখাই যাক না, তার এখনকার চেহারাখানা!
ভাবামাত্রই স্মৃতির দুয়ারে সদাজাগ্রত প্রহরী পথ আগলে দাঁড়ায়। স্মৃতির মণিকোঠায় যা সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, সেটি অবিকৃতই থাক না, আমার ধ্যানের ধন হয়ে!
1 Comment